নীড়  দূর-শিক্ষাকেন্দ্র  পাঠ্যপুস্তক  প্রথম পত্র - অধ্যায়: দুই
বাংলা ভাষা ডিপ্লোমা পাঠক্রম
rotateআপনার মুঠোফোনটিকে ল্যান্ডস্কেপে রাখুন
প্রথম ষান্মাসিক - প্রথম পত্র
ইতিহাসের আলোকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য
প্রথম পত্র   ❐   অধ্যায় - দুই
বাংলা ভাষা
 
২.০   উদ্দেশ্য   

এ পর্বটিতে যা জানতে পারবেন —

  1. ভারতীয় উপমহাদেশে বাংলাভাষার আত্মপ্রকাশের ইতিহাস
  2. বাংলাভাষার মৌলিক বৈশিষ্ট্যি
  3. বাংলাভাষার কুলুজি
  4. বাংলার আদিগ্রন্থের প্রাথমিক পরিচিতি
২.১   ভূমিকা

আমরা ইতিমধ্যে দেখেছি আজ ভারতীয় উপমহাদেশের যে ভূখণ্ডকে বাংলা বলে চিহ্নিত করা হয়, তা দুটো ভিন্ন রাষ্ট্রের অন্তর্গত ভূমি একটি স্বাধীন স্বতন্ত্র রাষ্ট্র, নাম বাংলাদেশ, অপরটি ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রদেশ, নাম পশ্চিমবঙ্গ। এর বাইরেও ত্রিপুরা, আসাম, বিহার, ঝাড়খণ্ড যেখানে বাঙালিরা স্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছে এবং যেখানে বাংলা ভাষা সরকারিভাবে স্বীকৃত। তাকে তো আর বঙ্গদেশ বা বাংলা বলা চলে না। তবে ওই অঞ্চলের বাংলাভাষীরা অতি অবশ্যই বাঙালি, পক্ষান্তরে তাদের মুখের ভাষা, মায়ের কোলে শেখা ভাষা অতি অবশ্যই বাংলা। বিহারে পূর্ণিয়া জেলার পূর্বাংশ, রাঁচি, হাজারিবাগ, সাঁওতাল পরগণা, সিংভূম ও মানভূম মধ্যযুগ থেকেই বাঙালি এবং বাংলা ভাষার অঞ্চল; দক্ষিণে বঙ্গসীমান্তবর্তী ওড়িশার জেলাগুলোতেও ছিল বাংলার ব্যবহার; আসামের কাছাড়, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি, ডিমা হাসাও, গোয়ালপাড়া ছাড়াও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার একাধিক জেলায় বাংলার বিস্তৃতি। ওই অঞ্চলে মান্য চলিত ভাষা ছাড়াও রয়েছে বাংলা ভাষার জীবন্ত রূপ কথ্য ভাষা অর্থাৎ আঞ্চলিক উপভাষা (Dialect)।

উপরে উল্লিখিত ভাষা-পৃথিবীতে যে ভাষাটি বাঙালিদের মুখে উচ্চারিত হয়, আঞ্চলিক রকমফের থাকলেও এই ভাষার মান্য চলিত রূপটির একটি নির্দিষ্ট ব্যাকরণগত কাঠামো রয়েছে, রয়েছে তার নিজস্ব শব্দসম্ভার, পদপ্রকরণ, বাক্য গঠনের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, ক্রিয়াপদ, কালের নিজস্বতা, সন্ধি, বিভক্তি, ক্রিয়ার কাল রূপ, লিঙ্গভেদের স্বাতন্ত্র্য; তাছাড়াও রয়েছে অর্থান্তর, শব্দের সম্প্রসারণ; আর রয়েছে প্রবাদ প্রবচন, উপমা ইত্যাদি। এ সমস্ত স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়েই হাজার বছরের বিবর্তন প্রক্রিয়ায় বাংলা ভাষাটি আজকের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। এ পথ পরিক্রমায় এ ভাষায় সংযোজিত হয়েছে নতুন শব্দ ; দেশীয় শব্দগুলোর প্রকাশ সম্ভাবনার ঘটেছে বিস্তার, লিখিত পুথি, শাস্ত্রগ্রন্থ, অনুশাসন, তাম্রপত্র ইত্যাদি সূত্রে লব্ধ সংস্কৃত শব্দসম্ভার এবং এর রূপান্তরিত তদ্ভব রূপ, ইসলামীয় সংস্কৃতির সংস্পর্শজাত আরবি, পার্শি শব্দ, ইউরোপীয় বণিক, সেনা এবং পরবর্তীতে শাসকদের সূত্রে ফরাসি, পর্তুগিজ এবং ইংরেজি শব্দের সংযোজন এ ভাষার গতিকে সচল করেছে; সে সঙ্গে দক্ষিণ ভারত, উত্তর ভারতের প্রাদেশিক শব্দসম্ভার ; প্রতিবেশী বিভিন্ন জনজাতির ভাষা থেকে আহরিত শব্দসম্ভার নিয়ে বাংলা ভাষা প্রকৃত অর্থেই একটি জীবন্ত ভাষা হয়ে উঠেছে।

পৃথিবীর অন্যান্য ভাষার মতো বাংলা ভাষারও নানা রূপ রয়েছে। লিখিত সাহিত্য প্রাক্-মুদ্রণ পর্বের হাতে লেখা পুথি এবং পরবতীকালে ছাপা বইয়ের মাধ্যমে যে ভাষিক রূপটি আত্মপ্রকাশ করেছে, তা হল 'সাধু ভাষা'। লিখনমাধ্যমে প্রচলিত এ ভাষার সঙ্গে মৌখিক বা কথ্য ভাষার একটা পার্থক্য রয়েছে, ব্যাকরণে এর নাম হয়েছে 'চলতি ভাষা'। বিশ শতকের মধ্য থেকে এ চলিত ভাষা সাধুভাষার সঙ্গে এক ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে বর্তমানে সাধু ভাষাকে নিতান্ত সংকুচিত করে রেখেছে। বাংলার জনপ্রিয় একটি দৈনিক পত্রিকার প্রথম সম্পাদকীয়তে সাত আট ইঞ্চি পরিসরে আর কিছু সরকারি কেজো দলিল-দস্তাবেজ, বিয়ের চিঠি, শ্রাদ্ধের চিঠি আর পঞ্জিকার পাতায় কোনও মতে সাধু ভাষাটি টিকে আছে। চলিত ভাষার জয়জয়কার সৃজনশীল সাহিত্য, মননশীল প্রবন্ধ নিবন্ধ ছাড়িয়ে কবিতা, সংগীতেও সূচিত হয়েছে; নাটক চলচ্চিত্র এবং রেডিও টিভিতে তো আছেই। চলিত ভাষায় আঞ্চলিক উপাদানের সংযোজন সাম্প্রতিক সৃজনশীল সাহিত্যকৃতিতে, গল্প উপন্যাস কবিতা এবং আধুনিক বাংলা গানেও একটা নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে।

বাঙালি জাতি যেমন একটি মিশ্র জাতি, তেমনি বাংলা ভাষাও বহু উপাদানে সৃষ্ট একটি ভাষা, যে ভাষার মূল কাঠামোতে সংস্কৃত ভাষার প্রভাব থাকলেও অপরাপর ভাষিক উপাদানেও সমৃদ্ধ এ ভাষা। পরবর্তী পর্যায়ে খুব সংক্ষেপে বাংলা ভাষার উদ্ভব এবং বিকাশের ধারা সম্পর্কে একটু আলোকপাত করে নেওয়া প্রয়োজন।

২.২   বাংলা ভাষার আত্মপ্রকাশ

আমরা জানি পৃথিবীতে প্রাপ্ত ভাষাগুলোকে তাদের গঠনগত মিল দেখে কতকগুলো ভাগে ভাগ করা হয়েছে যাকে ভাষা-পরিবার, ইংরেজিতে Language Family বলা হয়। ভাষাতাত্ত্বিকেরা পৃথিবীর জীবন্ত (living), মৃত (dead) এবং লুপ্ত (extinct) ভাষাকে চব্বিশ-পঁচিশটি পরিবারে বিভক্ত করেছেন। এ পরিবারগুলোর অন্যতম হল ইন্দো-ইউরোপীয়। বাংলা ভাষা এই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা-পরিবারের এক বংশধর।

আনুমানিক সাড়ে চার-পাঁচ হাজার বছর পূর্বে মধ্য ইউরোপের কোনও অঞ্চলে মানুষের মুখে একটি ভাষা ছিল যাকে প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয় (Proto Indo-European বা Old Indo- European) ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ওই ভাষাভাষী যাযাবর শ্রেণীর মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায় পৃথিবীর নানান অঞ্চলে। এবং ইউরোপ ও এশিয়ায় বিভিন্ন অঞ্চলে এ ভাষা থেকে ন'টি ভাষাগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। এরই অন্যতম ইন্দো-ইরানীয় বা আর্য ভাষাগোষ্ঠীর যারা আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বে ভারতে প্রবেশ করে এদের ভাষাকেই বলা হয় ভারতীয় আর্য-ভাষা (Indo-Arya Language) এবং ওই ভাষা থেকেই আধুনিক ভারতের বাংলা সহ অনেক আঞ্চলিক ভাষার উদ্ভব। এ বিবেচনায় বাংলাকে ভারতীয় আর্যভাষার এক সুদূর বংশধর বলা চলে।

২.৩   বাংলাভাষা সাহিত্যের আদিপর্ব: চর্যাপদ

৯০০ সাল থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দের অন্তর্বর্তীকালকেই বাংলা ভাষার প্রাচীন যুগ বলে চিহ্নিত করা যায়। এই সময়কালের শনাক্ত সাহিত্যকৃতিকে বাংলা ভাষার আদি রচনা বলেও ধরা যায়। পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহামহোপাধ্যায় নেপালের রাজকীয় গ্রন্থাগার থেকে যে প্রাচীন পুথি আবিষ্কার করেন (১৯০৭ খ্রি:) গীতিকবিতার আঙ্গিকে ৫০টি পদ সম্বলিত কবিতাগুলোকে নামকরণ করেন 'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়'। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত বইটির নাম হয় ‘হাজার বছরের পুরনো বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা’।

ছবি-২/১
ছবি-২/২

এই কবিতাগুলোর পদকর্তাদের মধ্যে লুইপাদ, কুক্কুরিপাদ, বিরুপাদ, গুণ্ডারিপাদ ছটিল্লাপাদ, ভুসুকুপাদ, কাহ্নপাদ, সরহপাদ সহ ২৪ জনের নাম সনাক্ত করাও সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে একটি পদ ‘আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী, ণিঅ ঘরিণী চণ্ডালে লেইলি’- এর মধ্যে ‘বঙ্গালী’ শব্দটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

এই চর্যাপদগুলোর ভাষাকে আখ্যা দেওয়া হয়েছে ‘সন্ধ্যাভাষা’। অর্থাৎ ভাষাটি কিছুটা অস্পষ্ট। আধুনিক বাংলার সঙ্গে এর পার্থক্য থাকলেও এ যে বাংলার আদিরূপ তা পদগুলোকে আজকের বাংলার সঙ্গে মিলিয়ে পড়লেই বোঝা যায়। উদাহরণ স্বরূপ কয়েকটি পদ এখানে তুলে ধরা যায় : -

চর্যা- ২৯:
(আদি) -ভাব না হোই অভাবন জাই
আইস মংবোহেঁ কো পতিআই।
(আধুনিক) -ভাব না হয়, অভাব না যায়
এমত বোঝানোয় কে করে প্রত্যয়।
চর্যা- ২৮:
(আদি) -উঁচা উঁচা পাবত তঁহি বসই সবরী বালী
মোরঙ্গি পীচ্ছ পরহিণ সবরী গীবত গুঞ্জরি মালী।
(আধুনিক) -উঁচু উঁচু পাহাড়। যেখানে শবরী বালিকা বাস করে।
(তার) পরনে ময়ূরপুচ্ছ, গলায় গুঞ্জার মালা।

ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় কৌতুক করে রবীন্দ্রনাথের দু’টি পঙক্তিকে যে চর্যার ভাষায় রূপান্তরিত করেছেন, এ থেকেও এ ভাষার সঙ্গে আধুনিক ভাষার আদিরূপের নৈকট্য যেন আরও স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়-

- ‘গান গাহিআ নাব বাহিআ কে আইশই পারহি;
   দেখিআ জৈহণ মণে (মণহি) হোই
   চিণহিআই ওহারহি।’
আজকের বাঙালি সামান্য আয়াসেই পঙক্তি দুটোকে শনাক্ত করতে পারেন-
- ‘গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে,
   দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।’
---সোনার তরী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
(দ্রষ্টব্য: বাঙ্গালা ভাষাতত্ত্বের গোড়ার কথা, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়: রূপা, কলকাতা, ১৯৯১, পৃ. ২)

ওই সময়সীমায় আবিষ্কৃত আরও একটি বিক্ষিপ্ত পদ এখানে উদ্ধার করা হল ‘দেশিল ব-আন সবজন মিঠা’ - এর বর্তমান রূপ, ‘দেশি ভাষা সবার প্রিয়’। হাজার বছর আগে বাঙালির আদি পুরুষের এ পঙক্তির প্রতিধ্বনি আধুনিক কালের বাংলার কবির গীতে  ‘মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি, বাংলা ভাষা’  ধ্বনিত হয়।

মূলত বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের মতবাদ, সাধনপদ্ধতিই এ চর্যাপদের উপজীব্য, তবু এতে তৎকালীন বঙ্গভূমির নিম্নবর্গের মানুষ, তাদের পরিপার্শ্ব, বৃত্তি, আচার আচরণ, জীবন যাপন ইত্যাদির একটা আভাস পাওয়া যায়। অন্ত্যজ শ্রেণীর নারী পুরুষ তাদের প্রেম, বেশভূষা, গৃহ, কৃষিকাজ, নৌচালনা, শিকারের প্রথা নিয়ে এ চর্যার ভুবনে অবস্থান করছে। বাংলাদেশের প্রখ্যাত কথাকার সেলিনা হোসেন এই চর্যাগীতির ভুবনের একটা জীবন্ত প্রতিবেদন খাড়া করেছেন তাঁর উপন্যাস ‘নীল ময়ূরের যৌবন’ বইতে।

অনুশীলনী
  1. বাঙালিরা ভারতবর্ষের কোন অঞ্চলে বাস করছে? সে সব অঞ্চলে বাংলাভাষার অবস্থিতি কি?
  2. বাংলাভাষার আঞ্চলিক রকমফেরের সঙ্গে মান্যচলিতের কোথায় মিল রয়েছ?
  3. বাংলাভাষার বয়স হাজার বছর এর সপক্ষে আপনার যুক্তি দিন।
  4. পৃথিবীর কত কোটি মানুষের মুখের ভাষা বাংলা?
  5. 'চর্যাপদ' পুথিটি কে, কবে, কোথায় আবিষ্কার করেন? এটা কাদের রচনা?

প্রথম পত্র
অধ্যায় - 
বাংলা ভাষা