এ পর্বটিতে যা জানতে পারবেন —
এ পর্বে ভৌগোলিক, নৃতাত্ত্বিক এবং ভাষাতাত্ত্বিক দিকে বঙ্গদেশ বা বাংলাভুমি, বাঙালি জাতিসত্তা এবং বাংলা ভাষার একটি প্রাথমিক পরিচিতি দেওয়া হবে। বাঙালি জাতিসত্তার আত্মপ্রকাশ, উৎসভূমি এবং বাংলা ভাষার ভূগোলের বিস্তার নিয়ে একটু আলোকপাত করা হবে।
বাঙালি বলতে ঠিক কাকে বোঝায়? বাঙালি কি শুধুই একটি রাষ্ট্রীয় বা প্রাদেশিক সীমারেখায় বসবাসকারি মানুষ? না এর বাইরের অধিবাসীরাও বাঙালি অভিধার অধিকারী? বাঙালি জাতিসত্তার সঙ্গে ভাষা ছাড়াও ঐতিহ্য, পরম্পরা, সংস্কৃতিও যে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত এদিকেও সামান্য আলোকপাত করা হবে।
ঐতিহাসিক বিবর্তন প্রক্রিয়ায় যে-বঙ্গদেশের সীমাবৃদ্ধি বা সংকোচন ঘটেছে, বঙ্গীয় সমভূমিতে বিভিন্ন রাষ্ট্রশক্তির উত্থান এবং পতনের মধ্য দিয়ে যে অখণ্ড দেশসত্তা প্রবহমান রয়েছে, হিমালয়ের পাদদেশ থেকে ভাগীরথীর উত্তর হয়ে পূর্বদিকে পার্বত্য অঞ্চল হয়ে বর্তমান বিহার ঝাড়খণ্ড নিয়ে বিস্তৃত ভৌগোলিক পরিসীমায় বাঙালি এবং বাংলা ভাষার বিস্তৃতির ধারাটি সূত্রাকারে আলোচিত হবে।
প্রাচীন কাব্য নিদর্শন চর্যাপদ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মঙ্গলকাব্যের যুগ পেরিয়ে প্রাগাধুনিক পর্বে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য; ইসলামীয় শাসনপর্বে এবং অতঃপর গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মাচারের আত্মপ্রকাশের কালে বাংলা ভাষার সৃজনধারার বিকাশ, লোকসাহিত্যের বিস্তার এবং এরপর রাজকীয় আদেশপত্র, তাম্রপত্র, প্রস্তরলিপি এবং সাহিত্যকৃতিতে বাংলা গদ্যের আত্মপ্রকাশের একটি রূপরেখা নিয়ে এ পর্বে অষ্টাদশ শতক থেকে পরবর্তীকালের গদ্য সাহিত্যের বিবর্তনের একটি রূপরেখাও তুলে ধরা হবে। বাংলা সাহিত্যের ঐতিহাসিক পরিক্রমায় প্রবন্ধ সাহিত্য এবং উপন্যাস ও ছোটগল্পকেও এ পরিসরে আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বাঙালি কারা?
সাধারণত একটা ধারণা প্রচলিত যে, যারা বাংলায় বাস করে তারাই বাঙালি, ঠিক যেমন যারা আসামে বাস করে এরা অসমিয়া, বিহারে বিহারি, পঞ্জাবে পাঞ্জাবি। কিন্তু প্রশ্ন উঠবে বাংলায় তো বিভিন্ন জনজাতি, বিভিন্ন প্রাদেশিক এবং বিদেশি মানুষও বাস করেন, ওদের কি বাঙালি বলা সঙ্গত?
সে সঙ্গে আরও একটি সমস্যা হল, বাংলাটা কোথায়? তদানীন্তন পূর্ববাংলা যা বর্তমানে স্বাধীন সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশে, না ভারতের পশ্চিমবঙ্গে না আর কোথাও? হাজার বছরের ঐতিহাসিক পরিক্রমায় যে বঙ্গভূমির বিবর্তন ঘটেছে নানা ভাবে, বিভিন্ন সময়ে এর সীমানা সম্প্রসারিত হয়েছে, সংকুচিত হয়েছে, নানা রাষ্ট্রশক্তির আত্মপ্রকাশ এ বঙ্গভূমিকে খণ্ডিত বিখণ্ডিত করেছে, ঔপনিবেশিক আমলে রাজ্য পুনর্গঠন কালে বঙ্গদেশ একাধিকবার খণ্ডিত হয়েছে, স্বাধীনতার মুহূর্তে আরও একবার খণ্ডিত হবার পর পরিবর্তনের প্রক্রিয়া রুদ্ধ হয়েছে স্বাধীনরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশে। কিন্তু বাঙালি যে ওই স্বাধীনরাষ্ট্রের বাইরে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক প্রদেশে আবহমানকাল থেকেই বসবাস করছে বাংলা-বিহার উড়িষ্যায় নবাবী আমলে, ক্লাইভ-কার্জনের আমলে, কিংবা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় আহোম রাজত্বকালে আর আসামের দক্ষিণে কাছাড় রাজ্যে- যেখানে একাধিক রাষ্ট্রশক্তি পর্যায়ক্রমে রাজত্ব করেছেন, একেবারে ইংরেজ অধিগ্রহণ (১৮৩২ খ্রিঃ) পর্যন্ত।
পরিবর্তনশীল বাংলার রাষ্ট্রসীমা এবং এর বহির্ভূত অঞ্চলেও বসবাসকারী মানুষকে বাঙালি বলা যাবে যদি তাদের মাতৃভাষা বাংলা হয় এবং এরা ঐতিহ্যগতভাবে, সামাজিক আচারআচরণ, সংস্কৃতিতে বঙ্গীয় পরম্পরাকে ধারণ করে রাখেন। ভিন্ন প্রদেশে বা ভিন্ন দেশেবাঙালি ও বাংলাভাষ ভিন্নতর প্রেক্ষিতে অন্য ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে কিংবা ব্যবহারিক জীবনে গ্রহণ করলেও বাঙালি জাতিসত্তা অক্ষুণ্ণই থাকবে। এমনকী স্বেচ্ছায় মাতৃভাষা বর্জন করে কিংবা নিজস্ব ভাষিক পরিচিতি পাল্টে দিলেও হাজার বছরের ঐতিহ্যের অভিঘাতকে সরানো সম্ভব হয় না, এটাও ঐতিহাসিক সত্য।
সে সঙ্গে রয়েছে নৃতাত্ত্বিক বিষয়। ভাষিক সত্তা পরিস্থিতির চাপে ঢাকা পড়লেও জিনগতভাবে (genetically), রক্তের গভীরে যে জাতিগত পরিচিতি- তাকে বিজাতীয় ভাষা, পোশাক পরিচ্ছদ, জীবনধারার অনুশীলনেও পরিবর্তন করা অসম্ভব। ধর্ম পরিবর্তন করা যায়, কিন্তু ভাষা অপরিবর্তনীয়।
অতএব, বাঙালি কারা এর উত্তরে বলব, যারা বাংলায় কথা বলেন বাংলায় স্বপ্ন দেখেন, বাংলায় জেগে থাকেন ―
বাঙালি ঐতিহ্য, পরম্পরা, সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ইত্যাদি নিজেদের প্রাত্যহিক জীবনচর্যায়, আচার আচরণ, জন্মমৃত্যু বিবাহ সংক্রান্ত প্রথায় যারা বহন করেন তারাই বাঙালি। এ বাঙালি বাস করতে পারেন স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশে, ভারতবর্ষের প্রদেশ পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, কর্ণাটক, বিহার, ঝাড়খণ্ড, মেঘালয়, মণিপুর কিংবা উত্তর ভারতের প্রদেশগুলোতে, আন্দামান দ্বীপে, এমনকী সাগরপারের দেশগুলোতে- আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকায়। ভাষায়, চিন্তা-চেতনায়, সামাজিকতায়, শিল্প-সংস্কৃতিতে, সঙ্গীতে, সাহিত্যে বাঙালিত্বের স্বাক্ষর যতদিন থাকবে ততদিন এরা বাঙালি।
ভারতবর্ষের প্রাদেশিক মানচিত্রের সীমা অতিক্রম করে বাংলা ভাষার ভূগোলের বিস্তার ঘটেছে আসামের ব্রহ্মহ্মপুত্র উপত্যকায়। আর বরাক উপত্যকা (তদানীন্তন কাছাড়) ভৌগোলিকভাবেই বঙ্গীয় সমভূমির স্বাভাবিক সম্প্রসারণ।
বাঙলার পূর্ব-সীমায় উত্তরে ব্রহ্মপুত্র নদ, মধ্যে গারো, খাসিয়া ও জৈন্তিয়া পাহাড়; দক্ষিণে লুসাই, চট্টগ্রাম ও আরাকান শৈলমালা। গারো-খাসিয়া-জৈন্তিয়া শৈলশ্রেণীর বিন্যাস দেখিলে স্পষ্টতই বুঝা যায়, বাঙলার সীমা ওই পার্বত্যদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত। গোয়ালপাড়া জেলার মতো শ্রীহট্ট এবং কাছাড় জেলার কিয়দংশের লোকও বাঙলা ভাষাভাষী, এবং সামাজিক স্মৃতিশাসন, আচার-ব্যবহার, রীতিনীতিও বাংলা-ভাষাভাষীর; জন এবং জাতও বাঙালীর এবং বাঙলার। তাছাড়া, বরাক ও সুরমা নদীর উপত্যকা তো মেঘনা-উপত্যকারই (মৈমনসিং-ত্রিপুরা-ঢাকা) উত্তরাংশ মাত্র। এই দুই উপত্যকার মধ্যে প্রাকৃতিক সীমা কিছু নাই বলিলেই চলে, এবং এই কারণেই প্রাচীন ও মধ্যযুগে পূর্ব বাঙলার এই কয়টি জেলার- বিশেষভাবে ত্রিপুরা ও পূর্ব মৈমনসিং জেলার-সংস্কার ও সংস্কৃতি এত সহজে শ্রীহট্ট কাছাড়ে বিস্তার লাভ করিতে পারিয়াছিল। এখনও শ্রীহট্ট-কাছাড়ের হিন্দু-মুসলমানের সমাজ ও সংস্কৃতি বাঙলার পূর্বতম জেলাগুলির সঙ্গে একসূত্রে গাঁথা। শুধু তাহাই নয়, লৌকিক ও অর্থনৈতিক বন্ধনও বাঙলার ওই জেলাগুলির সঙ্গে। সিলেট-সরকার আকবরের আমলে সুবা বাঙলার অন্তর্গত ছিল; ১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দে এই দুই জেলা ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত ছিল। শ্রীহট্টের দক্ষিণে ত্রিপুরা ও চট্টগ্রাম শৈলশ্রেণী এই জেলা হইতে শ্রীহট্টকে পৃথক করিয়াছে। ত্রিপুরার উত্তরে ও পূর্বে ত্রিপুরা-শৈলমালা পার্বত্য চট্টগ্রামকে ত্রিপুরা হইতে পৃথক করিয়াছে; দক্ষিণ ত্রিপুরার সঙ্গে নোয়াখালি এবং সমতল চট্টগ্রামের যোগাযোগ। যাহা হউক, ত্রিপুরা ও চট্টগ্রাম শৈলশ্রেণী বাঙলাদেশকে যে লুসাই জেলা এবং ব্রহ্মদেশ হইতে পৃথক করিয়াছে তাহা সুস্পষ্ট। এইসব কারণেই এই দুটি শৈলশ্রেণী বাঙলার পূর্ব-দক্ষিণ সীমা নির্দেশক। (বানান অপরিবর্তিত)
― নীহাররঞ্জন রায়, বাঙ্গালীর ইতিহাস (আদি পর্ব),
দে'জ পাবলিশিং, কলকাতা,
প্রথম প্রকাশ: ১৩৫৬, অষ্টম সংস্করণ: ১৪২০,পৃ: ৬৯।
তেমনি এ ভাষা-পৃথিবীর বিস্তার ঘটেছে বিহার, ঝাড়খণ্ডেও যেখানে মাধ্যমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বাংলা ভাষায় পঠন-পাঠনের সংস্থানও রয়েছে; এ ভাষার বিস্তার সী ঘটেছে বঙ্গোপসাগর অতিক্রম করে আন্দামানেও।
আসামের 'সরকারি ভাষা আইন ১৯৬০', এবং এর ১৯৬১-র সংশোধনী মতে বাংলা ভাষা বরাক উপত্যকায় (তদানীন্তন কাছাড়) স্বীকৃত ভাষা এবং শিক্ষার সূচনা থেকে মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে রয়েছে এ ভাষার সংস্থান, আকাশবাণীর গৌহাটি কেন্দ্রে সীমিতভাবে এবং শিলচর কেন্দ্রটির প্রচারের অন্যতম প্রধান মাধ্যমই হল বাংলা ভাষা (সে সঙ্গে অবশ্য ডিমাসা, মণিপুরি এবং চা জনজাতির ভাষায় অনুষ্ঠানেরও সংস্থান রয়েছে এবং অতি অবশ্যই রয়েছে হিন্দি); একই সঙ্গে স্থানীয় দূরদর্শন কেন্দ্র থেকে প্রচারিত অনুষ্ঠানেরই ভাষাও বাংলা।
এখানে এ কথাটির উল্লেখ থাকুক, তাসীন জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশে যদিও এককভাবে বাংলা ভাষারই অধিষ্ঠান, তবুও অপরাপর ভাষিক গোষ্ঠীর, বিশেষ করে মণিপুরি, চাকমা, হিন্দিভাষী এবং চা জনজাতির ভাসার প্রচলনও রয়েছে এই দেশে এসের নিজস্ব সাহিত্য, সঙ্গীত, নাটক, সিনেমার ধারাও রয়েছে। অব্যাহত গণমাধ্যমে সীমিত হলেও ওসের ভাষার অনুষ্ঠান প্রচারও হয়ে থাকে।নেপালি, কামতাপুরি, সাঁওতালি এবং আরও কিছু ক্ষুর জনগোষ্ঠী চা জনজাতির ভাবারও সংস্থান রয়েছে।
অর্থাৎ, বাংলার মূল ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে যেমন অপর ভাষার সংস্থান হতে পারে, তেমনি ভিন্নতর প্রাদেশিক ভূখণ্ডের অভ্যন্তরেও বাংলার অবস্থান স্বাভাবিক।
এ থেকে বোঝা গেল বাঙালি অভিধাটি কোন নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের বাসিন্দাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ হতে পারে না, এর বিস্তৃতি রাষ্ট্রনৈতিক সীমারেখা অতিক্রম করেই।
তবে বাঙালি জাতিসত্তার আত্মপ্রকাশ এবং বিকাশ অতি অবশ্যই বঙ্গদেশ বলে কথিত ভূমিতেই ঘটেছে এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য। বঙ্গদেশের রাষ্ট্রসীমার পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংকোচন ঘটেছে বিভিন্ন সময়ে। বঙ্গভূমিতে একাধিক রাষ্ট্রশক্তির উত্থান এবং পতন ঘটেছে, খণ্ডবিখণ্ড হয়েছে এ ভূমি, তবুও এরই মধ্যে অপরিবর্তিত ছিল এবং রয়েছে একটা অখণ্ড দেশসত্তা। এ দেশের ভাষা এক, চিন্তা এক, জীবনচর্চা এক এবং হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম, খ্রিস্টান হাড়াও নানান লৌকিক ধর্ম, গৌণধর্ম, মতবাদ এ ভূমির জনগোষ্ঠীর জীবনকে প্রভাবিত করেছে, একে অপরকে প্রভাবিত করেছে, সমন্বয়ী সমাজদর্শনের জন্ম দিয়েছে, বিশেষ করে সুফি প্রভাবিত ইসলাম এবং বৈষ্ণব প্রভাবিত বাউল জীবনাচার জন্ম দিয়েছে এক অবিভাজ্য মানবধর্মের।
বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের পাঠ নিতে হলে এ প্রাথমিক কথাগুলো মনে রাখা প্রয়োজন।
.... আনুমানিক তেরো শতকে সংকলিত বৃহদ্ধর্ম পুরাণে বাঙালীকে বর্ণভেদে ছত্রিশ জাতে ভাগ করা হয়েছে। কিন্তু এ বিভাজন নৃতাত্ত্বিক নয়- বৃত্তিসম্পৃক্ত, সমাজভিত্তিক। এছাড়া আধুনিক কালে রিজলি, রমাপ্রসাদ চন্দ, বিরজাশঙ্কর গুহ প্রমুখ অনেকেই বাঙালীর আঙ্গিক বিচার করেছেন এবং করছেন। মাথা-কপাল-নাক-ঠোঁট কিংবা চোখ-চুল-চামড়া এ পরীক্ষার অবলম্বন। কিন্তু প্রায় তিন হাজার বছরের সাংকর্য কারো কোনো লক্ষণই অবিকৃত রাখেনি। তাই সমস্যা রয়েই গেছে। মোটামুটিভাবে বলা চলে নেগ্রিটো আদি-অস্ট্রেলীয় (ভেড্ডিড) ও মঙ্গোলীয় নরগোষ্ঠীরই মিশ্রণ ঘটেছে বেশি। তাই শতকরা ষাট ভাগ অস্ট্রেলীয়, বিশ ভাগ মঙ্গোলীয়, পনেরো ভাগ নেগ্রিটো এবং পাঁচ ভাগ অন্য নানা নরগোষ্ঠীর রক্ত মিশেছে বলে অনুমান করা অসঙ্গত নয়। নিষাদ, কোল, ভীল, মুন্ডা, সাঁওতাল, শবর, পুলিন্দ, মালপাহাড়ী প্রভৃতি হচ্ছে অপেক্ষাকৃত স্বল্পসঙ্কর আদি-অস্ট্রেলীয় বা ভেড্ডি (Veddoid)। আর কিরাত, রাজবংশী, নাগা, কোচ, মেচ, মিজো, কুকী, চাকমা, আরাকানী প্রভৃতি হচ্ছে স্বল্প-সঙ্কর মঙ্গোলীয়। তাছাড়া কালপ্রবাহে কত কত গৌড়, মালব, চৌড় খশ, হুন, কুলিক, কর্ণাট, লাট, মনহলি-পট্রোলী, মদনপাল (দেব) দ্রাবিড়, মুরন্ডা, শক, কুশান, ইউচি, আরব, ইরানি, হাবসি, গ্রিক, তুর্কি, আফগান, মুঘল, পর্তুগীজ, ওলন্দাজ, ফরাসি ও ইংরেজ-রক্ত মিশ্রিত তো হয়েইছে। তবে তা পরিমাণে বেশি নয়। পুণ্ড্রা, রাঢ়া, বঙ্গা, সুদ্ধ নামের অস্ট্রীয় গোত্রগুলোই ছিল ভৌগোলিক বাঙলাদেশে প্রধান। অপ্রধানের মধ্যে কোল, শবর, পুলিন্দ, হাড়ি, ডোম, চণ্ডালেরা ছিল নির্জিত। (বানান অপরিবর্তিত)
― আহমদ শরীফ, 'বাঙলা বাঙালী ও বাঙালীত্ব,
২০১২, অনন্যা, ঢাকা, বাংলাদেশ পৃ. ২০।
বাঙালি কাদের বলব, এর উত্তর অবশ্য এখানেই শেষ হবে না, কিছু নৃতাত্ত্বিক বিষয়ও বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। বঙ্গভূমি, যার আদি সীমানা তদানীন্তন পূর্ববাংলা এবং গঙ্গাতীরবর্তী ভূমি অবধি বিস্তৃত, এ ভূমিতে তাল, ভিল, মুন্ডা, কোল ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে হাজার তিনেক বছর আগে একটি জাতিসত্তার আত্মপ্রকাশ ঘটে। মঙ্গোলীয় এবং দ্রাবিড় জাতির সংমিশ্রণে ওই জনগোষ্ঠীই খ্রিস্টীয় প্রথম সহস্রাব্দের পরবর্তীকালে বাঙালি (বঙ্গালি) জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ, চতুর্দশ থেকে একটি সুস্পষ্ট ভাষিক পরিচিতি লাভ করে।
এটা স্বীকৃত যে বাঙালিরা একটি মিশ্র জাতি। চেহারার দিকে তাই বাঙালির এত বৈচিত্র্য। একই পরিবারের সদস্যদের মধ্যেই চেহারা, রং, শারীরিক কাঠামোর পার্থক্য দেখা যায়। কারো রং ফর্সা আবার কারো কালো, কেউ উন্নতনাসা, কারো নাসিকা চ্যাপ্টা, কেউ দীর্ঘদেহী কেউ খর্বকায়। কিন্তু মঙ্গোলীয়, অস্ট্রিক পরিবারভুক্ত জনগোষ্ঠীর ব্যক্তিবিশেষের চেহারায় এত বৈচিত্র্য নেই, তফাত নেই। যত সহজে একজন মণিপুরি, ডিমাসা, মিজো কিংবা আহোমকে সনাক্ত করা যায় এত সহজে একজন বাঙালিকে (বিহারি, ওড়িয়া, মারাঠিকেও) আলাদাভাবে সনাক্ত করা যায় না সে যে সংকর জাতি, প্রকৃতির খেয়ালে কার উপর কখন কোন্ প্রত্ন-প্র-পিতামহের জিন (Gene) প্রভাব বিস্তার করবে কে জানে!
আপাতত বাঙালি ও বাংলা সম্বন্ধে এ প্রাথমিক ধারণাটাই যথেষ্ট। তবে বাঙালির ভাষায়ও ওই মিশ্র সংস্কৃতির প্রভাব বিদ্যমান, এটা মনে রাখা প্রয়োজন। বাংলা শব্দসম্ভারে 'দেশি' পর্যায়ের শব্দগুলো ওই আদি প্র-পিতামহদের সূত্রে প্রাপ্ত; এবং 'বিদেশি' বা 'ঋণ' শব্দসমূহও বিভিন্ন জনগোষ্ঠী, যাঁরা ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় 'এক দেহে হল লীন'- এদের সূত্রে প্রাপ্ত। তবে এটা স্বতন্ত্র আলোচনার বিষয়, যথাসময়ে আলোচিত হবে।