এ পর্বটিতে যা জানতে পারবেন —
প্রাচীন এবং মধ্যযুগ পেরিয়ে অষ্টাদশ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্ব পর্যন্ত বাংলার প্রধান সৃজনশীল রচনাকৃতি ছিল মূলত গেয় (উপস্থাপনমূলক, Performing)- সেই চর্যার গীতই হোক, মঙ্গলগীতিকা বা ভাসান, বাউল কিংবা কীর্তন, শাক্তপদাবলিই হোক- সবকিছুর প্রধান অবলম্বন ছিল সুর। লিখিত মাধ্যমে নয়, উপস্থাপনের মাধ্যমেই এর প্রচার। গদ্যভাষা যদিও আত্মপ্রকাশ করেছে, তবু বাংলা সাহিত্যে তখনও ভাব প্রকাশের প্রধান বাহন ছিল গান। সুর-তাল বিহীন যে রচনার উদ্ভব ঘটেছিল তাও একধরনের উপস্থাপনমূলক সুর করে পাঠ করে ওই প্রচারিত কবিতা বা পাঁচালিও মূলত শ্রাব্য সাহিত্য।
অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যপর্ব থেকে উনিশ শতকের মধ্যপর্ব পর্যন্ত একশো বছর বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল সংকটাপন্ন। দেশে দ্বৈতশাসন- শাসনকার্যে দক্ষ নবাবের অভাব, পলাশীর যুদ্ধে স্বাধীনতার অবসান, কলকাতাকে কেন্দ্র করে নগরায়নের সূচনা এবং বাংলার আর্থ-সামাজিক জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন। প্রচলিত জীবনধারায় ভাঙনের প্রভাবে মধ্যযুগীয় সংস্কৃতি প্রায় নিঃশেষ। নতুন রাজধানী কলকাতাকে কেন্দ্র করে বিদেশী শাসক এবং বণিকের সঙ্গে সঙ্গে উদ্ভব হল নব্যবাবু সম্প্রদায়ের, দেওয়ান, গোমস্তা, মুৎসুদ্দি, মোসাহেব এবং নগরবাসী জমিদার শ্রেণী (absentee landlord)। যাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বিকৃত রুচি, স্কুল বিনোদনের উপকরণ হিসেবে সৃষ্টি হল লঘু, আদিরসাত্মক খেউড়, হাফ আখড়াই গান, আত্মপ্রকাশ ঘটল কবিয়াল শ্রেণীর, যারা চাপান, 'উতোর'-এর মাধ্যমে বারোয়াড়ি আসরে নব্য ধনিক শ্রেণী এবং তাদের অনুগামীদের মনোরঞ্জনে আত্মনিয়োগ করলেন। এদের হাতে যেমন নিম্নমানের খেউড়, তর্জা ইত্যাদি সৃষ্টি হল , তেমনি এদের হাতে কিছু উন্নতমানের বৈঠকী, মাতৃসংগীত, রাগভিত্তিক টপ্পা, আগমনী, বিজয়ার গানেরও উদ্ভব হল এটাও স্বীকার করে নেওয়া প্রয়োজন।
বিখ্যাত কবি গায়কদের মধ্যে ভোলা ময়রা, রাম বসু, হরুঠাকুর, অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি ছাড়া দাশরথি রায়, রূপচাঁদ পক্ষীও ছিলেন। এদের কবিগানের সঙ্গে বাণিজ্যিক বিষয়টি থাকাতেও এদের প্রতি সমাজে এক ধরনের অবজ্ঞার ভাব ছিল, অথচ অদীক্ষিত শ্রোতার মনোরঞ্জনের দিকটি বাদ দিলে এদের কাব্য প্রতিভা, বেদপুরাণ, শাস্ত্রে এদের ব্যুৎপত্তি, তাৎক্ষণিক সৃজনক্ষমতা এবং সর্বোপরি সুর, তালে বিশেষ দক্ষতা কোনও অংশেই অবহেলার নয়। এটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন উনবিংশ শতাব্দীর কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯), যিনি ইংরেজি সাহিত্য সম্রাট সেমুয়েল জনসনের 'লাইভস অব পোয়েটস' এর অনুরূপ, 'কবিজীবনী' গ্রন্থটি (ভবতোষ দত্ত সম্পাদিত, কলিকাতা ১৯৫৮, দ্রষ্টব্য) সংকলন করেন। পরিবর্তিত সামাজিক প্রেক্ষিতে বাঙালির এই অবহেলিত কাব্য উত্তরাধিকার রক্ষার জন্য তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। তাঁর নিজের ভাষায় 'দুঃখের কথা লিখিত হইলে চক্ষের জলে বক্ষস্থল প্লাবিত হয় ... পায়ে ধরিয়াছি, হাতে ধরিয়াছি, কত বিনয় করিয়াছি, স্বয়ং গিয়াছি, লোক পাঠাইয়াছি, পত্র লিখিয়াছি... জলে ভাসিয়াছি, আহার নিদ্রার সুখে বর্জিত হইয়াছি, প্রাণের প্রত্যাশা ছাড়িয়াছি...।’ বাংলা কবিতার পর্ব থেকে পর্বান্তরের বির্বতনের অন্বেষণ প্রাগাধুনিক স্তরের ওই ইতিহাস অন্বেষার প্রয়াসটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এ পর্বের সাহিত্যকৃতির আলোচনায় উনিশ শতকের শেষার্ধে প্রকাশিত অনেকগুলো গীত-সংকলন গ্রন্থের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। এ গ্রন্থগুলো হল, গোপালচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'প্রাচীন কবি সংগ্রহ' (১৮৭৭), নবকান্ত চট্টোপাধ্যায়, 'ভারতীয় সঙ্গীতমুক্তাবলী' (১৮৮৮), নরেন্দ্রনাথ দত্ত ও বৈষ্ণবচরণ বসাক সংকলিত, 'বিশ্বসঙ্গীত', এবং 'সঙ্গীত কল্পতরু' (১৮৯৬), দুর্গাদাস লাহিড়ীর 'বাঙ্গালীর গান' (১৩১২)।
উনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ঈশ্বর গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯) বাংলা কবিতার জগতে ব্যাপক প্রভাবশালী ছিলেন। তাঁর সম্পাদিত 'সংবাদ প্রভাকর' পত্রিকার গুরুত্ব অপরিসীম। ঈশ্বর, নীতি, প্রেম, প্রকৃতি, স্বদেশপ্রেম এবং সর্বোপরি সমসাময়িক ঘটনাবলীই তাঁর কবিতার প্রধান উপজীব্য। সমসাময়িক সমাজ জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে তাঁর সরেস এবং ব্যঙ্গাত্মক কবিতার জনপ্রিয়তা এখনও হ্রাস পায়নি। নগরজীবনের দুর্বিষহ কষ্ট দেখে রচিত তাঁর 'রেতে মশা, দিনে মাছি, এই নিয়ে, কলকেতায় আছি' পঙক্তিটি আজও সংবাদপত্রের শিরোনামে ব্যবহৃত হয়। আর 'ধন্য রে বোতলবাসী ধন্য লাল জল / ধন্য ধন্য বিলাতের সভ্যতা সকল', 'যত ছুঁড়িগুলো তুড়ি মেরে কেতাব হাতে নিচ্ছে যবে/তখন এ. বি শিখে বিবি সেজে বিলিতী বোল ক'বেই কবে' - এসব তখনকার জনপ্রিয় কবিতার পঙক্তি। এ হেন কবি অবশ্য বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ আন্দোলনের তীব্র সমালোচনা করেছেন তাঁর কবিতায়। অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংরেজি স্যাটায়ার কবিতার (Satirical poetry) প্রতিরূপ পাওয়া যায় উনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি কবির রচনায়।
ওই পর্বের উল্লেখযোগ্য আরেক কবি মদনমোহন তর্কালঙ্কার (১৮১৭-১৮৫৮), পুরনো ধারার কিছু কবিতা লিখেছিলেন, তা অবশ্য কালের বিচারে খুব স্থায়িত্ব লাভ করেনি, কিন্তু তাঁর সংকলিত 'শিশুশিক্ষা' (১ম-২য় ভাগ, ১৮৪৯, ৩য় ভাগ ১৮৫০), তাঁকে অমর করে রেখেছে। তাঁর উজ্জ্বল পঙক্তি আজও মানুষের স্মৃতিতে অক্ষয়, 'পাখি সব করে রব, রাতি পোহাইল / কাননে কসুমকলি সকলি ফুটিল ।’
উনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্ব থেকেই বাংলা কাব্যে আধুনিক যুগের সূচনা। রঙ্গলাল এর বন্দ্যোপাধ্যায়, (১৮২৭-১৮৮৭) মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩), হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, (১৮৩৮-১৯০৩), নবীনচন্দ্র সেন (১৮৪৭-১৯০৯) পর্যন্ত একটি ধারা লে সমাপনান্তে বিহারীলাল চক্রবর্তী (১৮৩৫-১৮৯৪), অক্ষয়কুমার বড়াল (১৮৬০-১৯১৯), তার মানকুমারী বসু (১৮৬৩-১৯৪৩), কামিনী রায় (১৮৬৪-১৯৩৩) প্রভৃতি কবিদের হাতে বাংলা এটি গীতিকাব্যের অধ্যায় শুরু হয়, যে ধারাটি বিংশ শতাব্দীতে নানা ভাবে পল্লবিত হতে থাকে।
ইংরেজি ভাষা-সাহিত্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত কবি রঙ্গলাল ইতিহাস আশ্রিত আখ্যানকাব্যের অনুকল্পে দেশপ্রেমের ভাবনায় জারিত আখ্যান কাব্য 'পদ্মিনী উপাখ্যান' (১৮৫৮) লিখে বাংলা কবিতায় বিশেষ স্থান অর্জন করেন। কাব্যের ঐতিহাসিক বাস্তবতা এক স্বীকার্য, কাব্যকৃতি কতটা অভিনব এ বিচারে না গিয়ে কবিতাটিতে দেশপ্রেমের যে বার্তা ধ্বনিত হয়েছে এটা আজও প্রাসঙ্গিক। ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামে যে বার্তাটি বিশেষ অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল তা এ 'পদ্মিনী উপাখ্যানে'রই দু'টি পঙক্তি-
তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য (১৮৬০), ব্রজাঙ্গনা কাব্য (১৮৬১), মেঘনাদবধ কাব্য (১৮৬১), বীরাঙ্গনা (১৮৬২) এবং চতুর্দশপদী কবিতাবলী (১৮৬৬) নিয়ে বাংলা কাব্যকাননে মাইকেল মধুসুদন দত্ত-র প্রবেশ একটি যুগান্তকারী ঘটনা। মহাকাব্যের ঐতিহ্যকে বাংলা কাব্যজগতে প্রতিষ্ঠা করা, অমিত্রাক্ষর ছন্দকে সার্থকভাবে প্রয়োগ করা, ইউরোপীয় সারা আঙ্গিককে বাংলার মাটিতে রোপন করা, ইতালীয় Epistlic আঙ্গিকের কবিতাকে বাংলায় সার্থকভাবে সংস্থাপন করা- মাইকেল মধুসুদনের অমর কীর্তি। আঙ্গিকের অভিনবত্বে, ভাষার চমৎকারিত্বে, শব্দ সৃজনের পারদর্শিতায় মাইকেল বাংলা ভাষায় অবিস্মরণীয় স্রষ্টা। এ কথা বলা যেতে পারে মধুসুদন বাংলা কবিতায় আধুনিকতার সূত্রপাতও করেছেন সার্থকভাবে।
বাংলা কাব্যজগতে যখন মহাকাব্যের কথা, অমিত্রাক্ষর ছন্দের জয়জয়কার, high seriousness, তখনই রোমান্টিকতা, গীতিপ্রবণতার ধারার আত্মপ্রকাশ ঘটতে থাকে যা বিহারীলাল চক্রবর্তীতে (১৮৩৫-১৮৯৪) এসে একটি বিশেষ মাত্রা লাভ করে। বিহারীলাল তাঁর গীতিধর্মিতা, নিসর্গপ্রেম, সৌন্দর্য চেতনায় পরবর্তী কবিদের বিশেষভাবে প্রভাবিত করেন। তাঁর অনুরাগীর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও অন্যতম। বিহারীলালের জীবিতাবস্থায়ই রবীন্দ্রনাথের 'সন্ধ্যাসঙ্গীত' (১৮৮২), 'প্রভাত সঙ্গীত' (১৮৮৩), 'ছবি ও গান' (১৮৮৪), এবং 'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী' (১৮৮৪), 'মানসী (১৮৯০), 'সোনার তরী' (১৮৯৪) প্রকাশিত হয়ে গেছে, রবীন্দ্রনাথের সংগীত প্রতিভার স্ফুরণ হয়ে গেছে। এর পরবর্তী চারটি দশক বাংলা কবিতার জগতে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি একটি স্বতন্ত্র ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। 'কথা' (১৯০০), 'কাহিনী (১৯০০), 'ক্ষণিকা' (১৯০০), 'নৈবেদ্য' (১৯০১), 'শিশু' (১৯০৬), 'উৎসর্গ' (১৯১৪), 'খেয়া (১৯১০) 'স্মরণ' (১৯০২-০৩) কাব্যগ্রন্থগুলো বাংলা ভাষা এবং বাঙালি মননকে গড়ে তুলেছে নতুন আঙ্গিকে। ইতিমধ্যে 'বঙ্গভঙ্গ' বিরোধী-আন্দোলনে কবির অংশ গ্রহণে উপলক্ষ হয়ে দেখা দিয়েছে তাঁর অপূর্ব সব স্বদেশ সংগীত সৃজনের যেখানে 'বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু বাংলার ফল' নানা ভাবে, নানা বিভঙ্গে মূর্ত হয়েছে। কবির স্বদেশ চেতনা পরিব্যাপ্ত হয়েছে সারা দেশে, দেশমাতৃকার আহ্বানে 'আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে' একলা চলার বার্তা প্রাদেশিক সীমানা অতিক্রম করে পৌঁছেছে সমগ্র ভারতে। জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী যে কঁটি গান আজীবন তাঁর জীবনের সঙ্গী করে নিয়েছিলেন এই গানটি তার অন্যতম। তাঁর জীবিতাবস্থায় প্রকাশিত 'সঞ্চয়িতা' (১৩৩৮, ১৩৪০, ১৩৪৪, বঙ্গাব্দে) কাব্য সংকলনে ৩৫২টি কবিতা, এবং সঙ্গে আরো ৮২টি সংযোজন, ৩২টি গানের বিপুল সম্ভার বাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। সে সঙ্গে অবশ্য আরও একটি সংকলন 'চয়নিকা' (১৯২০) ও রয়েছে। এ সুত্রে প্রকাশনা সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে যাওয়াতে সাধারণ পাঠকদের কাছে এ তথ্যটি অজ্ঞাত রয়ে গেছে যে, কবি সারাজীবনে মোট ৫২টি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছেন। সে সঙ্গে অবশ্য ২২৩২টি গান নিয়ে 'গীতবিতান' (১৯৩১) এবং ১৫৭টি কবিতা নিয়ে 'গীতাঞ্জলি' (১৯১০) এবং ১০৩টি ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে 'Gitanjali: Song Offerings' (১৯১২) উপহার দিয়ে গেছেন। দীর্ঘ জীবনে কবিতার বিষয়বস্তু, প্রকাশভঙ্গি, কাব্যভাষার বিবর্তন ঘটেছে নানা ভাবে। মধ্যযুগীয় বৈষ্ণব পদাবলি, উনিশ শতকীয় কাব্যধারা তো বটেই, প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃত সাহিত্যের অভিঘাত যেমন তাঁর সৃজনশীলতায় বিশেষ অবদান যুগিয়েছে তেমনি আধুনিক ইউরোপীয় কাব্যভাষা এবং থিম, টেকনিকও আত্মস্থ করে কবিগুরুর অবস্থান আধুনিকতার একেবারে শীর্ষে। তাঁর সৃজনবিশ্বে প্রাচীন, মধ্যযুগ, সাম্প্রতিকতা এক হয়ে আগামীর দিকে যে যাত্রা শুরু করেছিল বাংলা কাব্যজগতে সে যাত্রা আজও প্রবহমান। রবীন্দ্রনাথে এসে বাংলা কবিতার উত্তরণ ঘটল আধুনিকতায়। তিনিই বাংলায় প্রথম আধুনিক।
১৯১২ খ্রিস্টাব্দে ইংলন্ড থেকে Gitanjali: Song Offerings বইটি প্রকাশিত হবার পর পাশ্চাত্যে রবীন্দ্রনাথের কবিকৃতি প্রসিদ্ধি লাভ করে এবং এ সূত্রে বিশ্ববাসীর নজর আকৃষ্ট হয় বাংলা তথা ভারতীয় সাহিত্যজগতের প্রতি, যার পূর্ণতা ঘটে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে সুইডিশ অ্যাকাডেমি কর্তৃক কবিকে নোবেল পুরস্কার প্রদানে। ইংরেজ (জন্মসূত্রে আইরিশ) কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস্ লিখিত 'Gitanjali Song Offerings'-এর ভূমিকাটি কবিগুরুকে পাশ্চাত্য জগতে সুপ্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছে।
আমি অনুবাদের এই পাণ্ডুলিপিটি বেশ কিছুদিন বয়ে বেড়িয়েছি। এগুলো রেলগাড়িতে, যাত্রীবাহী বাসে, রেস্তোরাঁয় সর্বত্র বসে পড়েছি। অনেক সময় খোলা পৃষ্ঠা বন্ধ করে রাখতে হতো, কারণ পাশের অপরিচিত কোনও মানুষ নইলে হয়তো বুঝে ফেলবেন যে এই লেখা আমাকে কতখানি আপ্লুত করেছে। আমার ভারতীয় বন্ধুরা আমাকে বলেছেন যে মূল বাংলায় ওগুলো গীতিকবিতা, তাতে ছন্দের সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনা, অনুবাদে আসে না এমন সব কমনীয় বর্ণালী অভিব্যক্তি, স্বর ও মাত্রার নতুনতম প্রয়োগ ইত্যাদির বিপুল সমাহার লভ্য। এগুলোর চিন্তাসমৃদ্ধি এমন একটা জগতে পৌঁছে দেয় যার স্বপ্ন আমি আজীবন দেখেছি। মহান উচ্চতম এক সংস্কৃতির ফসল এই লেখাগুলোকে আবার মৃত্তিকাতে স্বতোৎসারিত তৃণগুল্মের মতো স্বাভাবিক বলে মনে হয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বহমান এই ঐতিহ্যে ধর্ম আর কাব্য একীভূত হয়ে গেছে, তাতে সঞ্চিত হয়েছে জ্ঞানলব্ধ অথবা সহজিয়া রূপক আর আবেগময় অভিব্যক্তির সম্ভার। আবার জ্ঞানীগুণীদের চিন্তার এইসব প্রকাশ ফিরে গেছে লোকায়ত সমাজে অগণিত মানুষের কাছে। বাংলার সভ্যতার প্রবাহ যদি অবিচ্ছিন্ন থাকে – যদি সেই গণমানস আমাদের মতো ভেঙে চৌচির হয়ে একের সঙ্গে অপরের অন্তহীন বিচ্ছিন্নতার শিকার না হয়, সব কিছু যদি নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকে, তবে ভবিষ্যৎবাণী করা যায় যে কয়েক প্রজন্ম পর এই কবিতার সুক্ষ্মতম নিদর্শনগুলোও পথের ভিক্ষুকদের মধ্যে পরিব্যাপ্ত হবে।
... প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রাজপথের পথিক আর নদীপথের মাঝিদের কণ্ঠে এগুলো গীত হবে। প্রেমিকরা যখন একে অন্যের জন্য প্রতীক্ষায় থাকবে, এইগুলো গুনগুন করতে করতে আবিষ্কার করবে যে ঈশ্বরপ্রদত্ত ওই ভালবাসার গান এমন এক যাদুসাগর যেখানে স্নান করে নিজের তিক্ত অনুভূতিকে নবীকৃত যৌবনে রূপান্তরিত করা যায়। ...
যে পথিকের রাঙা বেশ ধুলার ধূসরতাকে ঢেকে রাখে, যে বালিকা রাজার দুলালের মালা থেকে খসে পড়া ফুলের পাপড়ি বিছানায় খুঁজে বেড়ায়, যে দাসী বা বধূ একলা ঘরে প্রভুর আগমনের প্রতীক্ষায় থাকে, এগুলো সবই হচ্ছে ঈশ্বরের পায়ে হৃদয় সমর্পণের রূপক।
ফুল আর স্রোতস্বিনী, শঙ্খধ্বনি, ভারতীয় বর্ষার প্রবল বর্ষণ গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহ - এ সবই ঈশ্বরের সঙ্গে মানব হৃদয়ের বিরহ-মিলনের যে নিত্য বিনিময় চলে, তার রূপভেদ আর পর্যায়ভেদের প্রতিবিম্ব। আর চীনা চিত্রকলার রহস্যময় অর্থসমন্বিত মানব প্রতিকৃতির মতো যে মানুষটি নদীবক্ষে তরীপরে বাঁশি বাজাচ্ছেন, তিনি হচ্ছেন ঈশ্বর স্বয়ং। একটি পূর্ণ জনগোষ্ঠী, সম্পূর্ণ একটি সভ্যতা, যার সঙ্গে আমাদের অপরিচয়ের ব্যাপ্তি পরিমাপের অতীত, দেখা যাচ্ছে ঐ ধরনের ভাবধারায় আবিষ্ট ছিল। আমরা এগুলো দ্বারা যে অভিভূত হচ্ছি তার কারণ এই নয় যে এগুলো আমাদের কাছে চমকপ্রদ বলে মনে হয়েছে, আসলে এগুলোতে আমাদের নিজ প্রতিবিম্ব আমরা আবিষ্কার করছি, আমরা যেন রোসেটির উইলো বৃক্ষের বনের মধ্য দিয়ে পথ পরিক্রমা করছি, অথবা সম্ভবত আমাদের সাহিত্যে প্রথমবারের মতো স্বপ্নের মধ্যে নিজ কন্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি। (নির্বাচিত অংশ)
এখানে এ কথাটি মনে রাখা প্রয়োজন ইংরেজিতে অনূদিত গীতাঞ্জলি (Song Offerings)-এ মূল বাংলা গীতাঞ্জলি থেকে ৫৩টি কবিতা নেওয়া হয়েছে। ইংরেজি বইটির ১০৩টি অনুবাদের ১৫টি নেওয়া হয়েছে কবির 'নৈবেদ্য' (১৯০১) থেকে, ১৬টি 'গীতিমাল্য' (১৯১৫) থেকে, ১১টি 'খেয়া' থেকে ৩টি 'শিশু' (১৯০৬) থেকে। তাছাড়াও 'কল্পনা' (১৯০০), স্মরণ (১৯০২-০৩), 'চৈতালী' (১৮৯৬) 'উৎসর্গ' (১৯১৪) কাব্যগ্রন্থ থেকে ১টি করে, এবং 'অচলায়তন' (১৯১২) নাটক থেকে ১টি করে।
কবিকে ইংলন্ডের বিদ্বৎসমাজে পরিচয় করিয়ে দিতে কবিবন্ধু উইলিয়াম রোদেনস্টাইন, (১৮৭২-১৯৪৫) কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস (১৮৬৫-১৯৩৯)-এর নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তাছাড়াও এজরা পাউন্ড (১৮৮৫-১৯৭২) সেই সময় রবীন্দ্রনাথের কবিতার প্রতি বিশেষ আগ্রহী হন।
মধ্যযুগীয় কাব্যভাষা 'ব্রজবুলি' থেকে সাধু ক্রিয়াপদ, সর্বনাম যুক্ত কাব্যভাষা থেকে একেবারে চলতি বাংলায়, এমনকি ছন্দবিহীন গদ্য কবিতার বিচিত্র সম্ভার দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বাংলা কবিতার জগৎটি গড়ে দিয়েছেন। আধ্যাত্মিক চেতনা সমৃদ্ধ কবিতা থেকে কাহিনিভিত্তিক দীর্ঘ কবিতা, কাব্যনাট্য, রোমান্টিক লিরিক, প্রেম, প্রকৃতি, ছড়া, সনেট নিয়ে সমৃদ্ধ তাঁর কবিতাসম্ভারে ছন্দ, অলঙ্কার নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষার স্বাক্ষর রয়েছে। আর, রবীন্দ্রনাথের সংগীতসম্ভার ছাড়াও রয়েছে অসংখ্য ছড়া, ছোট কবিতা, লিমেরিকস যা পত্রপত্রিকা, গ্রন্থ ছাড়াও এখানে ওখানে কোনও বইয়ের উৎসর্গপত্রে, কিংবা কোনও অনুরাগীর খাতায় তিনি লিখে দিয়েছেন এর মধ্যে সত্যজিৎ রায়ের অটোগ্রাফ বইতে 'দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া', সিলেটের এক অনুরাগীর খাতায় 'মমতাবিহীন কালস্রোতে বাঙালার রাষ্ট্রসীমা হোতে নির্বাসিতা তুমি'... কবিতা দুটি উল্লেখযোগ্য।
রবীন্দ্রনাথ যে-সময় কবিতা, গান লিখছিলেন সে সময় বাংলায় ছিলেন আরও তিন কবি, যাঁরা কবিতা এবং গানে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করে তোলেন। এদের মধ্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় সৃজনশীলতার (১৮৬৩-১৯১৩) রচনা করেছেন কালজয়ী দেশাত্মবোধক কবিতা ও গান। তাঁর 'ধন্য ধান্য পুষ্প ভরা' গানটি সর্বকালীন জনপ্রিয়।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় 'সোনার কাঠি'র স্পর্শে বাংলা গানে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলা গানে মেলোডি আর হার্মোনি এনে দ্বিজেন্দ্রলাল সৃষ্টি করেছেন এক নতুন ইতিহাস। এ সঙ্গে রয়েছেন 'বলো, বলো, বলো সবে, শতবীণা বেণু রবে' খ্যাত কবি-গীতিকার অতুলপ্রসাদ সেন (১৮৭১-১৯৩৪)। আর ছিলেন রজনীকান্ত সেন (১৮৬৫-১৯১০), যাঁর 'তুমি নির্মল করো মঙ্গল করে, মলিন মর্ম মুছায়ে' গানটি বাঙালিদের চিরকালীন প্রার্থনা সংগীতই হয়ে আছে। রবীন্দ্রনাথ সহ এ 'চারজন গীতিকার তাঁদের যৌথ সাধনায় অথচ আলাদা বন্দিশে নিয়ে এসেছিলেন বাংলা গানের মুক্তির চাবিকাঠি। এ দেশের গানহীনতার কলঙ্ক বা বিষয়গত বদ্ধতা ভেঙে এঁরা পূজা-প্রেম-স্বদেশ-নিসর্গের বৈচিত্র্যে ভরে দিলেন গানের ভুবন...। গানের ভেতর দিয়ে এঁরা জাগাতে চেয়েছিলেন বাঙালির সুপ্ত মনন ও নন্দনের বোধ। (সুধীর চক্রবর্তী, বাংলা গানের আলোকপর্ব, কলকাতা, ২০০১, পৃ. ২০)
উপরিউল্লিখিত চারজনের বৃত্তের বাইরে রয়েছেন আরেকজন কবি, কাজি নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)। স্বদেশমন্ত্রে দীক্ষিত, সৈনিক হিসেবে যুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ , রাজনীতি, সাহিত্য, সংগীত এবং সমাজ-সচেতনায় মগ্ন এক যুগস্রষ্টা, বিদ্রোহী। বাংলা কাব্যজগতে তাঁর প্রবেশ আক্ষরিক অর্থেই 'বিদ্রোহী'র। ১৩২৮ বঙ্গাব্দে (১৯২১) প্রকাশিত তাঁর উদাত্ত উচ্চারণ বাঙালিকে হঠাৎ সচকিত করে দিল -'বলো বীর, বলো উন্নত মম শির’। তাঁর প্রকাশিত পত্রিকা 'ধুমকেতু' (১৯২২) রাজদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত হল, তাঁকে কারাবরণ করতে হল কবিতার জন্য। ১৯২৪ সালে রাজনৈতিক আন্দোলনে তাঁর জড়িয়ে পড়া এবং বাঁধভাঙা কবিতার উৎসারণ নতুন মাত্রা লাভ করল ১৯২৬ থেকে যখন তাঁর ভেতর অফুরন্ত গানের উৎস খুলে গেল। ১৯৩৩ সালে তাঁর নিজেরই স্বীকারোক্তি, 'কাব্যলোকের গুলিস্তান থেকে সঙ্গীতলোকের রাগিনী দ্বীপে আমার দ্বীপান্তর হয়ে গেছে' (ভূমিকা, রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম)।
১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'অগ্নিবীণা।' এর পর প্রকাশিত হয় 'দোলনচাঁপা', 'ছায়ানট', 'সর্বহারা', 'সাম্যবাদী' 'বিষের বাঁশী' 'ফণিমনসা', ‘সিন্ধু হিন্দোল', 'চিত্তনামা', 'ঝিঙেফুল', 'বুলবুল', 'জিঞ্জীর', 'চক্রবাক্', 'সন্ধ্যা', 'চোখের চাতক', 'চন্দ্রবিন্দু'। তাছাড়াও রয়েছে তাঁর কাব্যানুবাদ, কিশোর কাব্য, এবং সংগীত গ্রন্থ। সে সঙ্গে তো প্রবন্ধ, বক্তৃতা, নাটক, গল্প এবং উপন্যাস তো আছেই।
১৯২৪ সাল থেকে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লব, অসহযোগ, খিলাফৎ আন্দোলনের অনুপ্রেরণায় নজরুলের কাব্য এবং সে সঙ্গে সংগীতধারার উৎসারণ। 'শিকলপরা ছল', 'কারার ওই লৌহকপাট ভেঙে ফেল কর রে লোপাট', 'দুর্গম গিরি কান্তার মরু', আর 'জাগো অনশনবন্দী ওঠো রে যত' - বিদ্রোহাত্মক, দেশাত্মবোধক, সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী গানগুলো আজও বাঙালি জীবনে সচল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নজরুল ইসলামের প্রতিভার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তাঁর 'বসন্ত' নাটকটি উৎসর্গ করেন কাজি নজরুল ইসলামের প্রতি। কারাবাসে অনশনব্রত থাকার সময় নজরুলকে কবিগুরুর টেলিগ্রামের মধ্যেও এ মনোভাব প্রকট হয়েছে: 'Give up hunger strike, our literature claims you'। বাংলা সাহিত্যে নজরুলের অবস্থান কী, তা এতে প্রমাণিত। মাত্র কুড়ি বছরের সাহিত্যকৃতিতে নজরুল যে ভাষিক বৈচিত্র্যে, বিশেষ করে আরবি-ফারসি শব্দের শৈল্পিক প্রয়োগে, দেশজ, লোকজ থেকে মধ্যপ্রাচ্যের সাহিত্য সম্ভারের কাব্যিক সংশ্লেষ, চিত্রকল্প, সুর, ছন্দ, দৃশ্য, মেজাজের প্রতিস্থাপনে যে অভিনবত্ব দেখিয়েছেন এটা অভূতপূর্ব।
বাংলা গানের দিগন্তকে তিনি প্রসারিত করেছেন সুদূর পশ্চিম সীমান্ত অবধি এবং তা অতিক্রম করে পৌঁছে গেছেন সাগরপারের দেশে। বাংলা গানে যেমন 'শ্যামলবরণ বাংলা মায়ের' রূপ তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন, তেমনি এ গানে কাওয়ালির তীব্রতা, খেজুরবনের ঝঙ্কার, মরুভূমির ব্যাকুলতা, মরু মুসাফিরের তৃষ্ণার্ত অভিব্যক্তিকেও মূর্ত করে তুলেছেন। কিঞ্চিদধিক দুহাজার গানের স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, 'আমার কাব্যের কোনোকালে আনাদর হতেও পারে, কিন্তু বাংলাদেশের লোককে আমার গান গাইতেই হবে' (কিশোরীমোহন সাঁতরাকে লেখা পত্র, ৭ মার্চ, ১৯৩৪)। তেমনি পাঁচ সহস্রাধিক গানের স্রষ্টা নজরুল ইসলামও বলেছিলেন: 'সাহিত্যে দান আমার কতটুকু তা আমার জানা নেই, তবে এইটুকু মনে আছে, সংগীতে আমি কিছু দিতে পেরেছি। সংগীতে যা দিয়েছি সে সম্বন্ধে আজ কোনো আলোচনা না হলেও ভবিষ্যতে যখন আলোচনা হবে তখন আমার কথা সবাই মনে করবেন - এ বিশ্বাস আমার আছে।'(জনসাহিত্য সংসদের ভাষণ, ১৯৩৮)।
নজরুলের সংগীত প্রসঙ্গে আরও বলতে হয়, তিনি যেমন শাস্ত্রীয় সংগীত অবলম্বনে অনুপম সব গান রচনা করেছেন, তেমনি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সাপুড়িয়া, সাঁওতালি, ছাত পেটানো শ্রমিকদের গানকেও বাংলার সংগীত সভায় প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন।
বাঙালি জাতিসত্তাকে গড়ে তুলতে এ যে কী অবদান তা আগামীর ইতিহাসই বলবে। যে সংগীতস্রষ্টা নজরুল ইসলাম 'জাতের নামে বজ্জাতির' বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছেন, 'হিন্দু না ওরা মুসলিম' ভাবনায় ভাবিতদের উদ্দেশে বলছেন 'কাণ্ডারী! বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার'। আর, 'মোরা একই বৃস্তে দু'টি কুসুম হিন্দু-মুসলমান' গেয়ে ঐক্যভাবনা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। তিনি যে সমন্বয়ী ভাবধারাকে সৃজনশীলতার সঙ্গে মিশিয়ে অভূতপূর্ব সৃষ্টির নিদর্শন রেখেছেন। এদিকে আলোকপাত করা প্রয়োজন। গভীরভাবে ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী কাজি নজরুল ইসলাম সৃষ্টি করেছেন বৈষ্ণবীয় ভাবাদর্শে সিক্ত পদাবলি; আবার একই সঙ্গে সৃষ্টি করেছেন গভীর আধ্যাত্মিক শ্যামাসংগীত, আগমনী, বিজয়া, এবং ধ্রুপদী আঙ্গিকে সৃষ্ট কীর্তন, রাধাকৃষ্ণলীলা বিষয়ক চেতনা সমৃদ্ধ শাক্তপদাবলি , শিববন্দনা। তিনি যে এযুগের বিদ্যাপতি-চণ্ডীদাস, আবার একই সঙ্গে রামপ্রসাদ-কমলাকান্তও। আর তাঁর রচিত ইসলামি গীত তো বাংলা গানের ধারায় একেবারে নতুন পথ সৃষ্টি করেছে।
নজরুল ইসলামের কবিতায় বাঁধভাঙা 'আবেগের উচ্ছ্বাস' 'প্রচণ্ড গতিবেগ'কে 'ক্ষণিকের উত্তেজনা' আবিষ্কার করে এ সৃষ্টিকে উপেক্ষা করলে বাংলা ভাষা তথা বাঙালি জাতি পিছিয়ে যাবে, অথচ এ প্রয়াস বাংলা সাহিত্যের কিছু গবেষক করেছেন এটাও সত্য।
কাব্য রচনার সূচনায় যে প্রেক্ষিতে যে কবি ঘোষণা করেন-'মহাবিদ্রোহী রণক্লান্ত। আমি সেই দিন হব শান্ত', সেই প্রেক্ষিত তো আজও বিদ্যমান, আজও আকাশে বাতাসে 'উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল' শোনা যায়, 'অত্যাচারীর খঙ্গ কৃপাণ ভীম রণভূমে' আজও সচল; জাতের নামে যে বজ্জাতির বিরুদ্ধে তাঁর জেহাদ- এর অবসানও যেখানে হয়নি সেখানে নজরুল ইসলামের 'একদা-জনবল্লভ কবিতাগুলির এখন আর ততটা জনপ্রিয়তা নেই' (অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত, কলকাতা, ১৯৬৬, পৃ. ৪৭২-৭৩)-এ ধরনের উক্তিও প্রাসঙ্গিকতা হারায়। বাংলা তথা বাঙালির অন্যতম সৃজনশীল এ কবির জীবন কেটেছে নিদারুণ দুঃখকষ্টে, প্রিয়জন বিচ্ছেদে, সমাজ, সংস্কার, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। জীবনের একটি অতি দীর্ঘ পর্ব তাঁর কেটেছে জীবস্মৃত অবস্থায়। অথচ বাঙালি জাতির আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে উঠে দাঁড়ানোর প্রয়াসে, বিভেদের প্রাচীর ভেঙে একসাথে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে নজরুল ইসলামের কবিতা ও গান যে হয়ে উঠেছিল সংগ্রামী হাতিয়ার, এটা (সাময়িক বিস্মৃতির পর অবশ্য) বাঙালি জাতি ক্রমে ক্রমে অনুভব করেছে। আজ তিনি শুধু বাঙালিদের মধ্যেই একজন সমাদৃত কবি নন, অসমিয়া সহ বিভিন্ন ভাষিক গোষ্ঠীর কাছেও সমাদৃত কবি একজন আস্থার স্থল। আর, স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র বাংলাদেশের তিনি 'জাতীয় কবি'।
রবীন্দ্রনাথের জীবিতাবস্থায়ই বাংলা কবিতার কালান্তরের চিহ্নগুলো স্পষ্ট হতে থাকে। তাঁর কবিতা ও গানে এ রূপান্তরের লক্ষণও দেখা যায়। তাঁর 'পুনশ্চ', 'শেষ লেখা' ছাড়াও আরো কিছু কবিতায় নতুন দিনের কাব্যভাষা, নতুন আঙ্গিক, প্রকাশভঙ্গি এবং চিন্তার প্রতিফলন দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ তো আধুনিকতার অগ্রদূতও। পাশ্চাত্য নব্য কাব্য আন্দোলনের সঙ্গে তিনি সুপরিচিত, এলিঅট সহ তৎকালীন আধুনিক কবিদের রচনার সঙ্গে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন। নতুন যুগের কবিদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কও গড়ে ওঠে।
জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, সমর সেন, অজিত দত্ত, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত- এদের কবিতার সঙ্গেও রবীন্দ্রনাথের প্রাথমিক পরিচয় হয়। রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলা কাব্যের ওই যুগটি 'কল্লোল' (১৯২৩), 'কালিকলম' (১৯২৬), 'প্রগতি' (১৯২৭), এবং 'কবিতা' (১৯৩৫), পত্রিকাকে কেন্দ্র করে আত্মপ্রকাশ করে। এ সময়ের কবিদের দৃষ্টি প্রসারিত হল সাম্প্রতিক বিশ্ব কবিতা-আন্দোলনের দিকে। ইউরোপীয় কাব্যাদর্শ, বিশ্বযুদ্ধ-অন্তর্বর্তীকালীন সমাজ-মানসিকতা, দর্শন, বোধ, নতুন প্রকাশ-মাধ্যমের অভিঘাত এদের মধ্যেও ক্রিয়াশীল ছিল এবং এদের হাতে বাংলা কবিতা নতুন ভাষায় কথা বলতে শুরু করল। এ কবিতার বিরুদ্ধে দুর্বোধ্যতার অভিযোগও ওঠে; অভিযোগ ওঠে অশ্লীলতারও। রক্ষণশীল পাঠক, সমালোচক এত সহজে নতুন দিনের কবিতাকে গ্রহণ করতে সক্ষমও ছিলেন না সঙ্গত কারণেই।
'প্রগতি' আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্র বিরোধিতার কথা বললেও রবীন্দ্র-প্রভাব মুক্ত হতে পারেননি। তবে নতুন কবিতাধারা প্রবর্তনে তাঁর ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। 'মর্মবাণী' (১৯২৫), 'বন্দীর বন্দনা' (১৯৩০), পৃথিবীর প্রতি' (১৯৩৩), 'কঙ্কাবতী', 'দময়ন্তী' (১৯৪৩) ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ নব্য কবি সমাজকে প্রভাবিত করল। তাঁর সম্পাদিত 'কবিতা' পত্রিকায় গদ্য পদ্যে নতুন সাহিত্য আন্দোলন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এ পত্রিকায়তেই জীবনানন্দ দাশের (১৮৯৯-১৯৫৪) কবিতাগুলো প্রকাশিত হয়, প্রকাশিত হয় জীবনানন্দের প্রবন্ধ, 'কবিতার কথা' (১৩৪৫ বঙ্গাব্দ, বৈশাখ), অশোক মিত্রের জীবনানন্দ বিষয়ক প্রবন্ধ 'আমাদের কবি' (কবিতা, সংকলন-৩, কলকাতা, ১৯৮৯), নিরুপম চট্টোপাধ্যায়ের 'রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ' (কবিতা সংলন) ইত্যাদি। কিন্তু তৎসত্ত্বেও বাংলায় জনসন-সদৃশ কবি-প্রাবন্ধিক বুদ্ধদেব বসু সম্ভবত রবীন্দ্র পরবর্তী অন্যতম কবি হিসেবে জীবনানন্দকে বুঝে উঠতে পারেননি।
কবি নিজের সংগোপনে লেখা যে কবিতাগুলো প্রায় লোকচক্ষুর আড়ালে রেখেছিলেন, মৃত্যুর পর যেগুলো সংকলিত হয় 'রূপসী বাংলা' শিরোনামে (১৯৫৭)। এই কাব্যের কবিতাগুলি সব সনেট। তবে ইতিমধ্যে তাঁর 'ঝরা পালক' (১৯২৭), 'ধূসর পাণ্ডুলিপি' (১৯৩৬), 'বনলতা সেন' (১৯৪২), 'মহাপৃথিবী' (১৯৪৪), 'সাতটি তারার তিমির' (১৯৪৮) প্রকাশিত হয়ে যায়। ষোলো বছর বয়সে পাঠানো একটি কবিতা পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যাকে লিখেছিলেন, 'তোমার কবিত্ব শক্তি আছে, তাতে সন্দেহ মাত্র নেই। কিন্তু ভাষা নিয়ে এত জবরদস্তি কর কেন বুঝতে পারিনে' - সেই জীবনানন্দ দাশই পরবর্তীকালে বাংলা ভাষার 'শুদ্ধতম কবি' হিসেবে আখ্যায়িত হন।
'রূপসী বাংলার' যে শান্ত, মৃদু , কন্ঠস্বর, তা'ই যে সময়ের প্রয়োজনে যুদ্ধের দামামা হয়ে উঠতে পারে একাত্তরের বাংলায় তা'ই প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ববাসী।
এ পর্বে 'ঊর্বশী ও আর্টেমিস (১৯৩২), 'চোরাবালি' (১৯৩৮), 'পূর্বলেখ' (১৯৪০), 'নাম রেখেছি কোমল গান্ধার' (১৯৫০), 'স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ' (১৯৭১) খ্যাত বিষ্ণু দে, 'খসড়া' (১৯৩৮), 'এক মুঠো (১৯৩৯), 'মাটির দেওয়াল' (১৯৪২) খ্যাত অমিয় চক্রবর্তী- এছাড়াও প্রেমেন্দ্র মিত্র, মনীশ ঘটক, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য, দিনেশ দাস, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শামসুর রহমান (ঢাকা), জসিমউদ্দিন (ঢাকা), বিনয় মজুমদার - এদের হাতে বাংলা কবিতার সচল ধারাটি সাম্প্রতিকতার দিকে সততই এগিয়ে গেছে যে-ধারাটি বর্তমানে নানাভাবে পল্লবিত হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমারেখার বাইরেও আরেকটি বাংলা ভাষা-অঞ্চলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে অবিভক্ত ভারতের সিলেট এবং কাছাড় ও সংলগ্ন অঞ্চল অর্থাৎ ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা, ত্রিপুরা, মেঘালয় (উত্তরপূর্বাঞ্চল) নিয়ে যা সাংস্কৃতিক এবং ভাষিক সূত্রে আবহমান কালের বাংলা ও বাঙালির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কে আবদ্ধ। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্ব থেকে এ ভুবনের সাহিত্য এবং কাব্যচর্চার উন্মেষ ঘটে যা বিংশ শতাব্দীতে নানাভাবে পল্লবিত হয়ে ওঠে। দেশবিভাগের ফলে রাজনৈতিক মানচিত্রে বাংলা ভাষা-সাহিত্যের বেন্দ্র হল কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গ, এই অঞ্চলটিকে বলা হয় বাংলা সাহিত্যের প্রথম ভুবন। স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের ফলে বাংলা সাহিত্যের ওই ভূখণ্ড হয়ে গেল দ্বিতীয় ভুবন। আর ভৌগলিকভাবে বাংলা ভাষা-সাহিত্যের মূল দুটি ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন আমাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা সাহিত্য পরিচিতি পেল বাংলা সাহিত্যের তৃতীয় ভুবন হিসাবে। রবীন্দ্রকথিত 'বাংলার রাষ্ট্রসীমা হতে নির্বাসিতা' এ সুন্দরী শ্রীভূমির কাব্যকৃতির একটি সংক্ষিপ্ত এবং প্রাথমিক আলোচনা এখানে আবশ্যক।
ঔপনিবেশিক স্বার্থে বাংলা প্রেসিডেন্সি থেকে ১৮৭৪ সালে বিচ্ছিন্ন করে আসামের সঙ্গে সংযুক্ত করে দিলেও বঙ্গীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে এ ভূমির বিচ্ছেদ ঘটেনি। বাংলা ভাষিক এবং সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষার দায়বোধ এ অঞ্চলে তীব্র হয়ে ওঠে। এদিকে আত্মপ্রকাশ ঘটে প্যারীচরণ দাসের সম্পাদনায় 'শ্রীহট্ট প্রকাশ' (১৮৭৫), বিপিনচন্দ্র পালের 'পরিদর্শক' (১৮৮০), ভুবনমোহন বিদ্যার্ণবের 'শ্রীহট্ট দেশবার্তা' (১৯০৯), রমণীমোহন দাস ও অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধির 'কমলা', যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্যের 'শ্রীহট্ট সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা' (১৯২৬), মুহম্মদ নূরুল হকের 'আল-ইসলাহ' (১৯৩২) এসব পত্রপত্রিকাকে কেন্দ্র করে এ ভুবনে সাহিত্যচর্চা এগিয়ে যেতে থাকে। অবশ্য এ ভুবনে অসংখ্য লোককবি, আউল, বাউল, সুফি, বৈষ্ণব গীতিকার, পদ্মপুরাণের কবি ইতিমধ্যে একটি শক্তিশালী কবিতার ঐতিহ্য সৃষ্টি করেই রেখেছিলেন। আধুনিক পর্বে কবিদের মধ্যে শরৎচন্দ্র চৌধুরীর (১৮৫২-১৯২৬) নাম করতেই হয় যাঁর ১১টি সর্গে বিন্যস্ত 'দেবীযুদ্ধ' (১৯০০) কাব্য যদিও একটি পৌরাণিক কাহিনীর উপর ভিত্তি করে রচিত, তবুও এর মধ্যে নিহিত ছিল ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের আহ্বান। ওই পর্বের আরেকটি উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকৃতি হল কবি রামকুমার নন্দী মজুমদারের 'বীরাঙ্গনা পত্রোত্তর কাব্য' (১৮৭২) যেখানে মাইকেল মধুসূদনের বীরাঙ্গনাদের প্রতি তাঁদের বীর স্বামীদের অমিত্রাক্ষর ছন্দে, একেবারে মাইকেলি ঢঙে একগুচ্ছ পত্র সংকলিত হয়। (দ্রষ্টব্য: অমলেন্দ ভট্টাচার্য, জহরকান্তি সেন সম্পাদিত 'বীরাঙ্গনা পত্রোত্তর কাব্য' ১৪০২, শিলচর)।
বিংশ শতাব্দীতে সিলেট বা সুরমা উপত্যকার কবিদের কবিতা প্রকাশিত হতে শুরু করে 'ভারতবর্ষ', 'প্রবাসী', 'ভারতী'র মতো সাহিত্য পত্রিকায়ও। রবীন্দ্রঅনুষঙ্গধন্য কবি হাসনরাজার পুত্র একলিমুর রাজা, সাম্যবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করি আব্দুল গফফার দত্তচৌধুরী যে নতুন কাব্য আন্দোলনের সূচনা করেন, রবীন্দ্রসম্পর্কধন্য কবি অশোকবিজয় রাহা (১৯১০-১৯৮৫)- এঁকে পরিণত আধুনিকতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যান। 'ডিহাং নদীর বাঁকে', 'রুদ্র বসন্ত', 'ভানুমতীর মাঠ, 'জলডম্বরু পাহাড়', 'রক্তসন্ধা' 'পৌষচূড়া', 'উড়ো চিঠির ঝাঁক – প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ খ্যাত অশোকবিজয় ছাড়া উল্লেখ করতে হয় 'দিগন্ত', 'উত্তর বসন্ত', 'ইশারা', 'এষা', 'নির্জন প্রহর', 'পঞ্চমুখ', 'অন্তরঙ্গ', 'নিরুক্ত' খ্যাত কবি মৃণালকান্তি দাশ, (১৯১৫-১৯৮০), পরবর্তীকালে যিনি সন্ন্যাসী হয়ে পরমানন্দ সরস্বতী নামে পরিচিত হন, অবশ্য কবিতা থেকে বিদায় নেননি।
খণ্ডিত সুরমা উপত্যকার কাছাড়, পরবর্তীতে যা বরাক উপত্যকা হিসেবে পরিচিত, এ ভুবনের কবিতা আন্দোলনে যাঁরা বিশেষ ভূমিকা নেন। এদের মধ্যে নগেন্দ্রচন্দ্র শ্যাম (১৮৯১-১৯৬৪), রসময় দাস (১৯০৪-১৯৭২), রামেন্দ্র দেশমুখ্য (১৯১৫-১৯৮৬), করুণারঞ্জন ভট্টাচার্য (১৯২৯-২০০৯), সুধীর সেন (১৯১৬-১৯৯০), দেবেন্দ্রকুমার পালচৌধুরী (১৯০৭-২০০৩), শক্তিপদ ব্রহ্মচারী (১৯৩৭-২০০৫), অনুরূপা বিশ্বাস (১৯৩২-২০১১), করুণাসিন্ধু দে (১৯৪২-২০০৫), বিমল চৌধুরী (১৯৩৮-২০১১), রুচিরা শ্যাম (১৯৪৫-২০১৫)-এদের নাম উল্লেখযোগ্য। এখানে তৃতীয় ভুবনের অন্তর্গত ত্রিপুরার বিখ্যাত কবি অনঙ্গমোহিনী দেবী (১৮৬৪-১৯১৮), রণেন্দ্রনাথ দেব (১৯২৬-২০০৫), বিজনকৃষ্ণ চৌধুরী (১৯৩০-১৯৯২), সলিলকৃষ্ণ দেববর্মন (১৯১২-১৯৮৭) এবং ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার হেমাঙ্গ বিশ্বাস (১৯১২-১৯৭৮), অমলেন্দু গুহ (১৯২৪-২০১৫), বীরেন্দ্রনাথ রক্ষিত (১৯৩৪-২০০৬) এবং উধ্বেন্দু দাশ (১৯৪২-২০১৬)-এর নাম স্মরণীয়।
বাংলা ভাষার তৃতীয় ভুবনের অনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি মিলেছে কলকাতা থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং বিজিৎকুমার ভট্টাচার্য সম্পাদিত কাছাড়ের নির্বাচিত কবিতা সংকলন, 'এই আলো হাওয়া রৌদ্রে' প্রকাশের সঙ্গে (১৯৬৯)। এরপর বরাক উপত্যকা বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন কর্তৃক প্রকাশিত হয় 'ঈশানের পুঞ্জমেঘ: বরাক উপত্যকার নির্বাচিত কবিদের কবিতা সংকলন সপ্তদশ-বিংশ শতাব্দী', শিলচর, (১৯৯২)।। প্রায় দু'শো পৃষ্ঠার এ গ্রন্থটি সম্পাদনা করেন শক্তিপদ ব্রহ্মচারী এবং বিশ্বতোষ চৌধুরী। এ দুই প্রকাশনা ছাড়াও এ অঞ্চলের অসংখ্য সংকলন বাংলা ভাষার অন্যভুবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে বাংলা কাব্য আন্দোলনে নিজস্ব ভূমিকা পালন করে আসছে।