এ পর্বটিতে যা জানতে পারবেন —
প্রত্যেক ভাষারই একটি নিজস্ব ধ্বনিচরিত্র আছে। এ চরিত্রই ভাষাটিকে অন্য ভাষা থেকে আলাদা করে। বাংলায় একটি ধ্বনি শব্দের গোড়ায় বা শেষে বসবে কিনা তার নিয়ম যেমন আছে, তেমনি কোন্ ধ্বনির সঙ্গে কোন্ ধ্বনির সংযোগ হবে বা হবে না তারও নিয়ম আছে। ঙ, ড়, য় দিয়ে কোনও শব্দ শুরু হতে পারে না, দুটো মহাপ্রাণ ধ্বনির পাশাপাশি অবস্থান বা সংযুক্তি অসম্ভব- ইত্যাদি বাংলা ভাষার বিশেষ চরিত্রলক্ষণ।
বাংলা ভাষায় স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ মিলে ৫০টি বর্ণ দিয়ে ধরা হয়েছে ধ্বনিসমূহকে। প্রতিটি শব্দের ভেতর রয়েছে অনেকগুলো বর্ণ। যেমন ‘কলিকাতা’। এর ভেতর রয়েছে ক+অ+ল+ই+ক+আ+ত+আ = মোট আটটি বর্ণ। এমনি আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ধ্বনিবিজ্ঞানের আলোকে এ অধ্যায়ে আলোচিত হবে।
এ অধ্যায়ে মূলত জ্যোতিভূষণ চাকী এবং সুভাষ ভট্টাচার্যের দুটো গ্রন্থে উল্লিখিত বিশেষ বিশেষ পর্বের সাহায্যে বাংলা ভাষার ধ্বনির লক্ষণ এবং এর প্রয়োগ সম্পর্কে অবহিত করা হবে।
আমাদের কথা বলা কর্মটি সম্ভব হয় এ জন্যেই যে এ কর্মে আমাদের মুখ ও নাক দিয়ে হাওয়া বেরিয়ে আসে, যাকে আমরা বলি শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়া। ঠিক যেমন বাঁশের নলের একপ্রান্ত থেকে ফুঁ দিয়ে হাওয়া ঢুকিয়ে বাঁশটির শরীরের নির্দিষ্ট সাতটি ফুটোতে আঙুল সঞ্চালন করে শেষ প্রান্ত দিয়ে বের করিয়ে এক একটি বিশেষ সুর উৎপন্ন করা হয়- তেমনি ফুসফুস থেকে কণ্ঠ, স্বরপল্লব, আলজিব, অধিজিহ্বা, তালু, দন্ত, ওষ্ঠ এবং নাসিকা দিয়ে নির্গত হাওয়ার মাধ্যমেই সৃষ্টি হয় ধ্বনি, যা হল শব্দের এক একটি একক এবং এ থেকে সৃষ্টি হয় শব্দ যা দিয়ে আমরা গঠন করি বাক্য।
কথা বলার সময় আমাদের ভেতর থেকে (যা অবশ্য আমরা নিঃশ্বাসের মাধ্যমে ভেতরে নিয়ে জমা করি নিজেরাই) বেরিয়ে আসা হাওয়া নানা স্থানে বাধা পায়, আংশিক বাধা পেয়ে, পুরোপুরি বাধা পেয়ে নাক দিয়ে বেরিয়ে আসে, আবার কখনও বিনা বাধায় সরাসরি বেরিয়ে এসে একটি স্বর বা ধ্বনি ‘প্রডাকশন’ অর্থাৎ উৎপাদন করে। এ প্রক্রিয়ায় আমাদের মুখগহ্বরে কত কিছু ঘটে, (বুকের ভেতরে মাংসপেশিতেও) আমরা কি সব সময় সচেতন থাকি?
কথা বলার অন্যতম যন্ত্র জিহ্বা কখনও মুখের ভেতর ওপরে ওঠে, নিচে নামে, সামনে এগোয়, পিছিয়ে যায়, তালু স্পর্শ করে, দাঁত স্পর্শ করে, কখনও ঠোঁট দুটো একে অপরকে স্পর্শ করে, আবার ঠোঁটগুলো উন্মুক্ত হয়, বন্ধও হয়। আমাদের চোয়াল দুটোও ওঠানামা করে। এ সমস্ত প্রক্রিয়া থেকে উৎসারিত ধ্বনি বা ধ্বনি সমষ্টিকে ভাষাবিজ্ঞানীরা আলাদা আলাদা ভাবে শনাক্ত করে আলাদা আলাদা নামকরণ করেছেন। আমরা পেয়েছি স্বরধ্বনি, ব্যঞ্জনধ্বনি, স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ আরও কত কী।
‘ধ্বনি আর বর্ণ এক জিনিস নয়। ধ্বনি মুখে উচ্চারিত হয়, তা কানে শোনার জিনিস। তা চোখে দেখা যায় না। আর বর্ণ হল ধ্বনির লিখিত রূপ।’
তবে এ নিয়ে আরো এগোবার আগে একটা সাবধানবাণী। আমরা যেন সচেতন থাকি ‘ধ্বনি’ আর ‘বর্ণ’ এক নয়, আলাদা জিনিস। ধ্বনি সঠিকভাবে কী- তা বুঝতে ইংরেজির সাহায্য নিই- ধ্বনি হল Sound, যা উচ্চারিত হলে কানে শোনা যায়। আর, বর্ণ হল একটি Symbol বা চিহ্ন- প্রতীক, যা কাগজের উপর লেখা হলে আমরা পড়তে পারি চোখ দিয়ে। অ, আ, ই, ঈ এগুলো সবই বর্ণ- যখন লিখিতভাবে উপস্থাপিত হয়। তো এগুলোকে চরিত্র বিশ্লেষণে স্বরধ্বনি, ব্যঞ্জনধ্বনি এবং স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে ভাষাবিজ্ঞানে।
প্রশ্ন : স্বরধ্বনি কী ?
উত্তর : যে ধ্বনি কন্ঠ ও মুখবিবর থেকে কোনও বাধা না পেয়ে, স্বচ্ছন্দে বেরিয়ে আসে তা'ই স্বরধ্বনি। এ উৎসারণে তাকে অন্য কোন ধ্বনির সাহায্য নিতেও হয় না। বাংলায় স্বরধ্বনির সংখ্যা সাত।
এরা হল-ই, উ, এ, ও, অ্যা, অ, আ।
লক্ষণীয়, এখানে ক্রমটি একটু অন্যভাবে সাজানো, আর এখানে ৯ [লি] নেই। একটা সময় দীর্ঘ ঋ এবং দীর্ঘ ৯ [লী] ও ছিল, এখন নেই। (এখন কম্পিউটার সফ্টওয়ারেও এ অক্ষরটি নেই)।
আর ঈ, উ তো আসলে কোনও আলাদা ধ্বনি নয়-ই+ ইঈ, উ+উ=উ। তবে বর্ণ হিসেবে এদের অস্তিত্ব রয়েছে। তবে আমরা আপাতত আছি ধ্বনিতে।
আমরা জানি স্বরধ্বনি উচ্চারণে জিবের ভূমিকা প্রধান। এ জিবের ওঠা-নামার নিরিখে ধ্বনিগুলোর নামকরণ হয় নিম্নরূপ, (যেমনটি দেখিয়েছেন সুভাষ ভট্টাচার্য-)
এখানে ‘অ্যা’ দেখে সংশয় জাগতে পারে। এই ‘অ্যা’ কোনও বর্ণ নয় ধ্বনি, তার স্থান
আমাদের মুদ্রিত বইতে নেই, আছে মুখের উচ্চারণে। বেলা, খেলা, দেখাতে এই ‘অ্যা’ প্রকট। শুনুন রবীন্দ্রসংগীত, ‘আমার বেলা যে যায়’, কিংবা ‘খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি’, কিংবা ‘হেলা ফেলা সারাবেলা এ কি খেলা আপন মনে’। এখানে উল্লেখিত ‘বেলা’ আর ধ্বনিগত ‘ব্যালা’র পার্থক্য বুঝতে দুটো আধুনিক গানের পঙক্তি উদ্ধার করা প্রয়োজন- ‘বালুকা বেলায় কুড়াই ঝিনুক, ‘এই বালুকা বেলায় আমি লিখেছিনু।’ এই ‘বেলা’ নদীতীর হতে পারে, চরা জমি হতে পারে, তবে Time এর সমার্থক তো নয়।
ঠোঁটের উন্মুক্ততা (Openness) অনুযায়ী স্বরধ্বনির চারটি শ্রেণী : -
প্রশ্ন : ব্যঞ্জনধ্বনি কী ?
উত্তর : আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি, স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময় ধ্বনি কন্ঠ ও মুখবিবর থেকে বিনা বাধায়, স্বাচ্ছন্দে বেরিয়ে আসে। কিন্তু ব্যঞ্জনধ্বনির ক্ষেত্রে ব্যাপারটি এর বিপরীত। এখানে ফুসফুস থেকে বাতাসকে বেরিয়ে আসার সময় বেশ কিছু বাধা বিপত্তি অতিক্রম করেই আসতে হয়, তাই এ নির্গত ধ্বনির নাম ব্যঞ্জনধ্বনি।
প্রচলিত ধারণা, ব্যাঞ্জনধ্বনি স্বরধ্বনির সাহায্য ছাড়া উচ্চারিত হয় না, তবে এর ব্যতিক্রমও আছে, এ কথাটি আপাতত মনে রাখলেই যথেষ্ট।
বাংলা বর্ণমালায় পঁয়ত্রিশটি ব্যঞ্জনবর্ণ রয়েছে। কিন্তু ব্যঞ্জনধ্বনির সংখ্যা ত্রিশ। অর্থাৎ পাঁচটি ব্যঞ্জনবর্ণের ধ্বনিগত মান অন্য কোনও বর্ণের সমান।
বাংলা ব্যঞ্জন ধ্বনির উচ্চারণ নিম্নরূপ : -
ক খ গ ঘ ঙ উচ্চারণে জিবের মূল তালুর কোমল অংশ স্পর্শ করে। এগুলো কণ্ঠ্যবর্ণ। তবে ঙ উচ্চারণে বায়ু নাক দিয়ে বের হয়। এর নাম অনুনাসিক বর্ণ।
চ ছ জ ঝ ঞ উচ্চারণে জিব মাঝের অংশ দিয়ে তালুর সামনের বা কঠিন অংশ স্পর্শ করে। এর নাম তালব্য বর্ণ। যেহেতু জিব আর তালুর স্পর্শে বায়ুর ঘর্ষণ হয়, তাই একে বলে ঘৃষ্টবর্ণ (affriction)। আর ঞ হল অনুনাসিক বর্ণ, এখানে বায়ু নাক দিয়ে বের হয়।
ট ঠ ড ঢ ণ -এখানে জিবের ডগা উল্টে মূর্ধা আর তালুর কঠিন অংশ স্পর্শ করে। এর নাম মুমূর্ধন্য বর্ণও। এটাকে প্রতিবেষ্টিত ধ্বনিও (retroflex) বলে।
ড় এবং ঢ় -এখানে জিবের নীচের অংশ দিয়ে দন্তমূল তাড়ন করে উচ্চারিত হয়। এগুলোকে তাড়নজাত (flapped) ধ্বনিও বলে।
ত থ দ ধ ন -এ পাঁচটি বর্ণ উচ্চারণে দাঁত নীচু অংশে জিবের ডগা স্পর্শ করে।
প ফ ব ভ ম -এগুলোতেও দুটো ঠোঁটে একে অপরকে স্পর্শ করে। তাই এগুলোকে ওষ্ঠ্য (অর্থাৎ ঠোঁট) বর্ণ (labials) বলে।
এগুলো স্পর্শবর্ণ আর উষ্মবর্ণের মাঝখানে রয়েছে। তাই এদের নাম অন্তঃস্থ বর্ণ। শ ষ স হ- এরা হ’ল উষ্মবর্ণ (Spirant); এদের উচ্চারণে জিব, তালু, দাঁত যুক্ত হয় অথচ বায়ুকে রুদ্ধ করে না। প্রথম তিনটিকে আবার শিসধ্বনিও (Sibilant) বলে।
তাছাড়াও রয়েছে ঘোষবর্ণ, অঘোষ বর্ণ, মহাপ্রাণ বর্ণ, অল্পপ্রাণ বর্ণ।
⚫বিপ্রকর্ষ স্বরভক্তি (Anaptyxis) :
উচ্চারণের সুবিধার জন্য যুক্তাক্ষরের মধ্যে স্বরধ্বনি এসে যায়। যেমন : - রত্ন > রতন, যত্ন > যতন, গর্ব > গরব, স্নান > সিনান, ভ্রু > ভুরু, গ্রাম > গেরাম, শ্লোক > শোলোক।
⚫স্বরসঙ্গতি (Vowel Harmony) :
এখানে এক স্বরের প্রভাবে অন্যস্বরের পরিবর্তন ঘটে। যেমন : - বুড়া > বুড়ো, দেশি > দিশি, বিলাতি > বিলিতি, শুনা > শোনা, ছুটে > ছোটে।
⚫অপিনিহিতি (Epenthesis) :
শব্দের মধ্যে ই বা উ থাকলে পূর্ব থেকেই উচ্চারণ করে ফেলার প্রবণতা। যেমন : - আজি > আইজ, করিয়া > কইর্যা, দেখিয়া > দেইখ্যা।
⚫অভিশ্রুতি (Umlaut) :
অপিনিহিতি, ধ্বনিলোপ এবং স্বরসঙ্গতির ফলে যা দাঁড়ায় তা’ই অভিশ্রুতি। কন্যা শব্দটি অপিনিহিতির ফলে হয় কইন্যা, স্বরসঙ্গতির ফলে হয় কইনে, ই-ধ্বনি লুপ্ত হলে হয় কনে, তেমনি- রাখিয়া > রাইখা - রেখে; বসিয়া > বইসা - বসে।
সমীভবন (Assimilation) :
গল্প > গল্প, কর্ম > কৰ্ম্ম।
সংকোচন (Contraction) :
পরিষদ > পর্ষদ, অন্ধকার > আন্ধার।
ঘোষী ভবন (Voicing) :
ছোট (দা) > ছোড়দা, কতদূর > কদ্দুর।
অঘোষী ভবন (De-voicing) :
বীজ > বিচি, ছাদ > ছাত।
নাসিক্য ভবন (Nasalization) :
সন্ধ্যা > সাঁঝ, চন্দ্র > চাঁদ।
ধ্বনিবিপর্যয় (Metathesis) :
পিশাচ > পিচাশ, রিকশা > রিশকা।
কোনও ব্যক্তির কাণ্ডজ্ঞানহীনতা বোঝাতে অনেক সময় আমরা বলি, ‘লোকটার ণত্ব-যত্ন জ্ঞান নেই।’ এই ণত্ব আর যত্ব জ্ঞান যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা বিদ্যালয়-বহির্ভূত ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ থেকেও বোঝা যায়। আমাদের পণ্ডিতমশাইরা এ অজ্ঞতাটা ক্ষমা করতে পারতেন না। কোথায় ‘দন্ত্য-ন’ হবে আর কোথায় হবে ‘মূর্য্য-ন’, কোথায় ‘দন্ত্য-স’ আর কোথায় ‘মূর্ধন্য-স’ হবে এর একটা ধ্বনিতাত্ত্বিক, বিজ্ঞানসম্মত বিধি রয়েছে। ‘বিধি’ শব্দটি আবার সংশয়ের সৃষ্টি করতে পারে, তাই বলে রাখা ভালো, বিধি মেনে ণত্ব, যত্ব-র ধারণা উদ্ভব হয়নি, উচ্চারণের ধারা থেকেই এর উদ্ভব, ভাষা-বিজ্ঞানীরা তা লিপিবদ্ধ করে গেছেন মাত্র। তবে হ্যাঁ সংস্কৃত-পণ্ডিতরা নাকি অনুশাসন জারি করেছিলেন ‘ফাল্গুন’, ‘গগন’ আর ‘ফেন’ লিখতে যারা ‘ণ’ ব্যবহার করে তারা ‘বর্বর’, শ্লোকটি হল, ‘ফাল্গুনে গগনে ফেনে ণত্নমিচ্ছন্তি বর্বরাঃ।’
আসা যাক ‘ন’, আর ‘ণ’র স্থান নির্ণয়ে। তবে আগে মনে রাখতে হবে দন্ত্য-ন মানে যেখান উচ্চারণে জিহ্বা দাঁতের স্পর্শ পায়; মূর্ধন্য তে স্পর্শ হয় মূর্ধা অর্থাৎ তালুর পেছন দিক।
বাণিজ্য ভণিতা ভণে লাবণ্য শোণিত,
আপণ কঙ্কণ কোণ গণনা গণিত,
চাণক্য নিরূণ তৃণ।
বীণা কণা মণি পাণি বাণ পণ্য পণ
মাণিক্য নৈপুণ্য গণ্য ফণী পুণ্য গণ॥
ষ-ত্ব বিধি :
যে-সমস্ত নিয়মে দন্ত্য-স (স) এবং মূর্ধন্য স-হবে (ষ) তাই ষত্ববিধি।
নিয়ম : -
সন্ধি শব্দটি ইতিহাস বইতে বিস্তর পাওয়া যায়, তাছাড়া রাজনৈতিক পরিভাষায়ও শব্দটির ব্যাপক প্রচলন। আজকের পৃথিবীতে যুদ্ধের ঘটনা যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে সন্ধির খবরও। রাজনৈতিক জীবনে যেমন সন্ধি একটি বহুল প্রচলিত শব্দ, তেমনি ব্যাকরণ শাস্ত্রেও সন্ধির প্রচলন সমধিক। বিবদমান প্রতিবেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে যেমন সন্ধি হয় তেমনি সন্ধি বিচ্ছেদও হয় অহরহ, ঠিক যেমনটি ব্যাকরণ পাঠে আমরা পাই।
যা’ই হোক, আমরা শব্দটিকে বুঝবার চেষ্টা করি।
সন্ধি কী? পাশাপাশি দু’টি ধ্বনির মিলনের নামই সন্ধি। লক্ষ করুন দু'টি ‘ধ্বনি’র শব্দটিতে, দু’টি ‘বর্ণের’ নয়। সন্ধি আসলে বর্ণের সঙ্গে নয়, ধ্বনির সঙ্গে ধ্বনির মিলন। বিষয়টি ধ্বনিতত্ত্বের অন্তর্গত। ইউরোপীয় ভাষাতত্ত্ববিদ ব্লুমফিল্ড বলেছেন, ‘Literary, it means putting together’। অর্থাৎ একসঙ্গে ধারণ করা (সম্+ধি)।
এখানে একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন, বাংলার সন্ধি সংস্কৃত সন্ধির নিয়ম মেনে চলে না। অর্থাৎ সংস্কৃত সন্ধির নিয়ম বাংলা ভাষায় সব সময় প্রযোজ্য হতে পারে না, কারণ সংস্কৃত উচ্চারণ আর বাংলা উচ্চারণ আলাদা। তবে বাংলার শব্দসম্ভারে বিপুল তৎসম শব্দ রয়েছে, তাই এসব শব্দের সন্ধি সংস্কৃত মতে হয়, এমনকী তৎসম আর অ-তৎসম শব্দের সন্ধিতেও সংস্কৃত নিয়মও কার্যকরী হয়ে যায়, যেমন আইনানুসারে, দিল্লীশ্বর (নিমন্ত্রণপত্রে দেখা যায় ‘সেন্ট্রাল রোডোস্থিত’)।
আবার বন্ + অন্তর যদি সংস্কৃত নিয়মে সন্ধি হত তবে হত বনন্তর। এখানে সংস্কৃত নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে শব্দটি হল 'বনান্তর'। রবীন্দ্রসংগীতে আছে 'বাসন্তী, হে ভুবনমোহিনী, দিকপ্রান্তে, বন বনান্তে'। এখানে বনান্ত শব্দটির শুদ্ধিকরণ কি আমরা মেনে নেব? নজরুল ইসলামের সেই গান 'এল এই বনান্তে পাগল বসন্ত'- এতে বনান্ত শব্দটির কোনও বিকল্প হতে পারে কি?
এতটা কথা বলার একটাই উদ্দেশ্য সংস্কৃত নিয়মে সন্ধিতে ধ্বনির পরিবর্তন প্রতিফলিত হয় বর্ণে, অর্থাৎ বানানে। কিন্তু খাঁটি বাংলা সন্ধিতে ধ্বনির পরিবর্তন বানানে প্রতিফলিত হয় না। যেমন মীন অক্ষি মিলে লেখা হল মীনাক্ষি, কিন্তু মুখে বলা হচ্ছে মিনাক্সি। তবে আজকাল গণমাধ্যমের প্রভাবে বাঙালি মেয়েরা লীলাক্সি, মীনাক্সি হয়ে যাচ্ছে, টিভির অনুকরণে ছোটরা ঘরে বসে খেলছে ‘অন্তাকস্রী’।
সন্ধি ভাষার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ তা তো নিশ্চিতই, তাছাড়াও ভাষার মাধুর্য বাড়াতেও এর বিশেষ ভূমিকার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন জ্যোতিভূষণ চাকী মহাশয়। তিনি উদ্ধার করেছেন রবীন্দ্রসংগীতের দু’টি কলি, যেখানে ধ্বনিমাধুর্যে উদ্বেল দুটো সন্ধির নমুনা রয়েছে :
অয়ি ভুবনমনোমোহিনী
অয়ি নির্মল সূর্যকরোজ্জ্বল ধরণী।....
সন্ধি মূলত আমাদের বাক্সক্রিয়ায় একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। দ্রুত উচ্চারণে স্বাভাবিকভাবেই পর-পর উচ্চারিত ধ্বনির মধ্যে কিছু পরিবর্তন ঘটে। এ পরিবর্তন নানা ধরনের : -
সন্ধি কত প্রকার ও কী কী ——
সন্ধি তিন রকম : - স্বরসন্ধি, ব্যঞ্জনসন্ধি ও বিসর্গসন্ধি।
স্বরসন্ধি
স্বরবর্ণে স্বরবর্ণে সন্ধিই স্বরসন্ধি। অর্থাৎ পরস্পর সন্নিহিত দুইটি স্বরবর্ণ মিলে একটি স্বরবর্ণে পরিণত হলে হয় স্বরসন্ধি।
স্বরসন্ধির সূত্রগুলো নিম্নরূপ : -
ব্যঞ্জনসন্ধি
ব্যঞ্জনবর্ণের সঙ্গে ব্যঞ্জনবর্ণ বা স্বরবর্ণের মিলন হলে হয় ব্যঞ্জনসন্ধি। ব্যঞ্জনসন্ধিকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করা হয় : -
ব্যঞ্জনসন্ধির সূত্রগুলো নিম্নরূপ : -
(ক) ব্যঞ্জনে ব্যঞ্জনে সন্ধি
(খ) ব্যঞ্জনবর্ণে স্বরবর্ণে সন্ধি
(গ) ব্যঞ্জনবর্ণে ব্যঞ্জনবর্ণে সন্ধি
বিসর্গ সন্ধি
স্বরবর্ণ অথবা ব্যঞ্জনবর্ণের সঙ্গে বিসর্গের সন্ধি হলে বলে বিসর্গ সন্ধি। বিসর্গ দুই প্রকারের :- র-জাত এবং স্-জাত।
বিসর্গ সন্ধির সূত্রগুলো নিম্নরূপ : -