এ পর্বটিতে যা জানতে পারবেন —
ছন্দবন্ধ বাক্যের একটা সুবিধা হল, তা সহজেই স্মৃতিতে ধারণ করা যায়, এবং স্মৃতি ও শ্রুতিবাহিত বাক্যটি যেমন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সহজেই বিচরণ করতে পারে, তেমনি সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মেও বিচরণ করতে পারে অনায়াসে। সেই কবে কবি পদ্যছন্দে শুনিয়েছিলেন ‘মহাভারতের কথা অমৃতসমান’ আর তা আজও আমাদের শ্রুতিতে অমলিন হয়ে রয়েছে ‘কাশীরাম দাস কহে শোনে পুণ্যবান’। বেদ, পুরাণ, উপনিষদ, পাঁচালি, কথকতা সবকিছুই কাব্যছন্দে রচিত। কবিতার ছন্দে রচিত চিকিৎসাবিদ্যার মতো নীরস তত্ত্বকথা আয়ত্ত করে যে বৈদ্য মানুষের সেবা করছেন তার উপাধি হল ‘কবি’রাজ।
মুদ্রণ মাধ্যমের উদ্ভবের হাজার বছর আগে, গাছের বল্কলে, শুষ্কপত্রে, তুলট কাগজে লেখালেখির বহু পূর্বে, শিলালিপি, প্রস্তর-লিপি, তাম্রলিপির উদ্ভবেরও পূর্বে মানুষের প্রকাশমাধ্যম ছিল কবিতাই। গদ্যের আবির্ভাব তো কালের বিচারে অর্বাচীন। বাংলা সাহিত্যে উনবিংশ শতাব্দী থেকেই ধারাবাহিকভাবে গদ্যের ইতিহাস রচিত হয়েছে। শ্রীরামপুর মিশন ও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পৃষ্ঠপোষকতায় বঙ্গদেশে মুদ্রণ জগতের সূচনা এবং এ প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় রামরাম বসুর 'রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র' (১৮০১) শীর্ষক গদ্যগ্রন্থের প্রকাশ একটি যুগান্তকারী ঘটনা। তবে এর পূর্ব থেকে যে গদ্যরীতির প্রচলন ঘটেছে তার ইতিহাস খুঁজে নেওয়াও সম্ভব। খ্রিস্টীয় চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতক কিংবা এরও আগে বাংলা গদ্যের প্রকাশ-সংকেত রয়েছে। আর, ষোড়শ শতক থেকে বাংলা গদ্যের নিদর্শন তো আমাদের আছেই। প্রাক্-পুরাতন বাংলা গদ্যের ইঙ্গিত রয়েছে প্রাচীনতম রচনা 'চর্যাপদ', 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন', এবং অতি অবশ্যই কৃত্তিবাসী রামায়ণ, চৈতন্যচরিতামৃত, কিংবা কাশীদাসী মহাভারতের মধ্যে প্রচ্ছন্ন হয়ে। (দ্রষ্টব্যঃ ভক্তিমাধব চট্টোপাধ্যায়, প্রাচীন বাংলা গদ্যের ইতিহাস, আদিপর্ব, পৃ. ৩০)
প্রাচীন কাব্য নিদর্শন চর্যাপদ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মঙ্গলকাব্যের যুগ পেরিয়ে প্রাগাধুনিক পর্বে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য; ইসলামীয় শাসনপর্বে এবং অতঃপর গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মাচারের আত্মপ্রকাশের কালে বাংলা ভাষার সৃজনধারার বিকাশ, লোকসাহিত্যের বিস্তার এবং এরপর রাজকীয় আদেশপত্র, তাম্রপত্র, প্রস্তরলিপি এবং সাহিত্যকৃতিতে বাংলা গদ্যের আত্মপ্রকাশের একটি রূপরেখা নিয়ে এ পর্বে অষ্টাদশ শতক থেকে পরবর্তীকালের গদ্য সাহিত্যের বিবর্তনের একটি রূপরেখাও তুলে ধরা হবে।
মধ্যযুগে, বিশেষ করে ষোড়শ শতাব্দী থেকে বঙ্গদেশ এবং সংলগ্ন কামরূপ-কাছাড়-ত্রিপুরা-মণিপুর-শ্রীহট্ট-কোচবিহারের তাম্রলিপি, প্রস্তরলিপি, মুদ্রা এবং রাজাজ্ঞা, পত্র ইত্যাদির মধ্যে রয়েছে বাংলা গদ্যের নিদর্শন। আহোম রাজ স্বর্গনারায়ণ ও কোচবিহারের নরনারায়ণের সমসাময়িক কাছাড়ের রাজা মেঘনারায়ণের মাইবং শিলালিপিতে ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের বাংলা গদ্যের নিদর্শনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন ভাষা গবেষকেরা। ১৪৯৮ শকাব্দ অর্থাৎ ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দের এ লিপিটির বয়ান নিম্নরূপ -
এ লিপির পরবর্তীকালে ত্রিপুরার একটি শিলালেখের বয়ান নিম্নরূপ-
১৭০৭ থেকে ১৭৯৪ খ্রি: পর্যন্ত সময়সীমায় একাধিক রাজা বা রাজ প্রতিনিধিদের পত্র, চুক্তিপত্র, আবেদন, মঞ্জুরীপত্র, নিয়োগপত্রের মধ্যেই বাংলা গদ্যের আত্মপ্রকাশের ধারাটি সনাক্ত করা সম্ভব। শ্রীহট্টের ফৌজদার মতিউল্লার গৌহাটির বড়ফুকনের নিকট লিখিত পত্র, কামরূপ রাজসভা থেকে শ্রীহট্টের ফৌজদারকে লেখা পত্র, মাইবঙের হেড়ম্বরাজ্য থেকে সমতল কাছাড়ের উজির নিযুক্তির আদেশনামা, আর ইংরেজ কোম্পানি বাহাদুর সমীপে দেশীয় রাজন্যবর্গের চিঠির গদ্যভাষা এক্ষেত্রে বিশেষ বিচার্য।
বঙ্গদেশের সীমার বাইরে বাংলা ভাষা-ভূগোলের বিস্তৃত অঞ্চল থেকে উদ্ধৃত এ গদ্য নিদর্শনে প্রাচীন গদ্যের ব্যবহারিক জীবনের উপযোগী হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটিতে তৎসম, তদ্ভব, দেশি শব্দের সঙ্গে আরবি, ফার্সি এবং ইংরেজি (বিদেশি) শব্দের অনুপ্রবেশের ধারাটিও স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে।
তাছাড়া, প্রাত্যহিক ব্যবহারিক জীবনে দলিলপত্র, জমিজমা সম্পত্তি বিষয়ক, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানাদি সম্পর্কিত এবং অন্তরঙ্গ ব্যক্তিগত চিঠিপত্রে ক্রমে বাংলা গদ্যের রূপ স্পষ্ট হতে থাকে, আত্মপ্রকাশ করে নিমন্ত্রণপত্রের সর্বজনগ্রাহ্য গদ্য বয়ান যা আজও বাঙালি জীবনে প্রায় অপরবর্তিত রূপে প্রবহমান।
ঔপনিবেশিক রাজত্ব প্রতিষ্ঠার সূচনা থেকেই সরকারি আফিস আদালতে বাংলা দলিল সম্পাদনের জোয়ার আসে, যেখানে প্রাক্-ঔপনিবেশিক আমলের আরবি-ফারসি ও সঙ্গে সংস্কৃত শব্দের মিশ্রণে গতবাঁধা একটা বয়ান জনপ্রিয়তা লাভ করে। ‘মিদংকার্যঞ্চ’, ‘শ্রীল শ্রীযুক্ত বাহাদুর... বরাবরেষু’ ইত্যাকার বাক্যবন্ধ থেকে ‘শ্রীচরণ কমলেষু’, ‘শ্রীচরণে শতসহস্র প্রণামান্তে নিবেদন এই যে’- এ ধরনের পাঠ সম্বলিত পত্রের বয়ান পর্যন্ত ব্যবহারিক গদ্যের ধারা অদ্যাবধি সচল।
আমরা ইতিমধ্যে বাংলা গদ্যে শ্রীরামপুর মিশনারি এবং ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ভূমিকার উল্লেখ করেছি। যুগের প্রয়োজনে যে লিখনকর্মের বিকাশ ঘটেছে অষ্টাদশ শতাব্দীর ওই বিশেষ লগ্নে, সে লিখনকর্মের প্রস্তুতিপর্বের সূচনা বঙ্গীয় সমাজ জীবনে ইতিপূর্বেই সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। উইলিয়াম কেরি সাহেবদের তত্ত্বাবধানে যে ছাপাখানা স্থাপিত হল এর ফাউন্ড্রির কারিগর হিসেবে পঞ্চানন কর্মকার এবং দপ্তরি, চিত্রকর, বাঁধাইকর্মী হিসেবে দেশীয় শ্রমিক-এরা পালন করলেন বিশেষ ভূমিকা। খ্রিস্টান মিশনারিদের রচিত বিশেষ চরিত্রলক্ষণ সম্বলিত বাংলা গদ্যগ্রন্থ, প্রচার পুস্তিকার পাশাপাশি বাংলা ভাষায় আরও বিচিত্র বিষয়ে গদ্যগ্রন্থ প্রকাশিত হতে শুরু হল। মুদ্রণযন্ত্রের বিকাশ এবং প্রচলন একদিকে যেমন পুথি-সাহিত্যের আধিপত্যকে বিনাশ করল তেমনি বিচিত্র ধরনের গদ্যগ্রন্থের বিস্তারের ক্ষেত্রকে করল প্রসারিত, এ প্রক্রিয়াটির পূর্ণতা ঘটল ‘বটতলা’ প্রকাশনার আত্মপ্রকাশে।
বাংলা গদ্যভাষাকে সাহিত্য পদবাচ্য করে তুলতে যে দুই মনীষীর অবদান বিশেষ ভাবে স্মরণীয় তাঁরা হলেন রাজা রামমোহন রায় এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে রামমোহন বিবিধ বিষয়ে প্রবন্ধ লেখা শুরু করেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সামাজিক সংস্কারমূলক গদ্যপুস্তিকা, বিধবা বিবাহের সপক্ষে বিতর্কমূলক পুস্তিকায় যেমন মননশীল গদ্যের ভিকে শক্ত করেন, তেমনি সংস্কৃত সাহিত্য, শেক্সপিয়ারের নাটকের গদ্য অনুবাদের মাধ্যমে বাংলা সৃজনশীল গদ্যকেও সমৃদ্ধ করতে থাকেন। - অবশ্য বিদ্যাসাগরের ভাষা একান্তই লিখিত, কেতাবি, আলঙ্কারিক। তবে ইংরেজি ভাষার অনুরূপ তিনি বিভিন্ন বিরতি চিহ্নের প্রয়োগে বাংলা গদ্যকে এগিয়ে নিয়ে যান।
‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার মাধ্যমে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা গদ্যকে সামাজিক, ঐতিহাসিক, দার্শনিক এবং আধ্যাত্মিক চিন্তার বাহন হিসেবে গড়ে তুললেন। ‘লোকরহস্য’ (১৮৭৪), ‘বিজ্ঞান রহস্য’ (১৮৭৫), ‘বিবিধ প্রবন্ধ’ (১৮৮৭-১৮৯২), ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ (১৮৭৫), ‘কৃষ্ণচরিত্র’ (১৮৮৬), ‘ধর্মতত্ত্ব’ (১৮৮৬) ‘সাম্য’ (১৮৭৯) ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলা গদ্যে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনেন তিনি। আর, সৃজনশীল সাহিত্যে অবদানের জন্য বঙ্কিমচন্দ্র ‘সাহিত্য সম্রাট’ শিরোপার যথার্থ অধিকারী। মননশীল গদ্যরীতিতে বিংশ শতাব্দীতে যে অগ্রগতি ঘটেছে এর সম্ভাবনার ক্ষেত্রগুলো বঙ্কিমচন্দ্রেরই সৃষ্টি।
বিংশ শতাব্দীর বাংলা গদ্যরীতি রবীন্দ্রনাথে এসে একটি বিশেষ মাত্রায় পৌঁছোয়। সাধু গদ্যরীতিতে লেখা শুরু করলেও প্রমথ চৌধুরীর ‘সবুজপত্র’ প্রকাশের পর কবিগুরু চলতি গদ্যেও প্রবন্ধ রচনা শুরু করেন এবং এ রীতিকে বিশিষ্টতা দান করেন। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্র সমসাময়িক স্বামী বিবেকানন্দের চলতি রীতিতে গদ্যের কথাও বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে।
রবীন্দ্র পরবর্তী কাল থেকে বুদ্ধদেব বসু, অন্নদাশঙ্কর রায়, বিনয় ঘোষ পর্যন্ত গদ্যের অগ্রগতি বাংলা মননশীল সাহিত্যের ইতিহাসে অতি অবশ্যই একটি গৌরবজনক অধ্যায় যার প্রভাব একবিংশ শতাব্দীতেও সক্রিয়।