এ পর্বটিতে যা জানতে পারবেন —
সাহিত্য জগতে গল্প উপন্যাস, কাহিনির সমাদর সব দেশে, সব যুগেই বেশি, কিন্তু উপন্যাস এবং ছোটগল্পের এক একটি আঙ্গিক মাধ্যম বা literary genre হিসেবে আত্মপ্রকাশ কালের বিচার নেহাৎই সাম্প্রতিক। পদ্যছন্দে কাহিনি, পুরাণ মানুষকে আকৃষ্ট করেছে যুগে যুগে, অথচ গদ্যে কাহিনি অর্থাৎ কথাসাহিত্যের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হল অষ্টাদশ উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংরেজি ড্যানিয়েল ডিফো রচনা করলেন উপন্যাস ‘রবিনসন ক্রুশো’ (১৭১৯) এবং এর প্রায় শতবর্ষ পর বাংলায় রচিত হল ইউরোপীয় আঙ্গিকে উপন্যাস, লিখলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। উপন্যাস হল গদ্যে রচিত একটি বর্ণনামূলক উপস্থাপন (narrative) যেখানে বর্ণিত ঘটনা, মানুষজন, পরিবেশ, পরিপ্রেক্ষিত সমস্তই বাস্তবানুগত কিন্তু সমস্ত কিছুতেই মিশে থাকে কল্পনার রঙ , যার ফলে অতি পরিচিত ঘটনা, বিষয়বস্তুও পাঠকের কাছে অপরিচিত, রহস্যময়, প্রতিদিনের বাস্তবতাও অজানা বলে প্রতিভাত হয়। এ কাহিনির মধ্যে মানব জীবনের শৈল্পিক উপস্থাপন পাঠকদের এক গভীর গোপন সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। উপন্যাস বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি নয়, অথচ বাস্তবতা-বর্জিত উপন্যাস সম্ভবই নয়। তবে বর্তমান অধ্যায়ে উপন্যাসের আঙ্গিক বা গঠনগত দিক নিয়ে আলোচনার অবকাশ নেই। এখানে বাংলা উপন্যাসের আত্মপ্রকাশ ও বিবর্তনের ধারাই অভীষ্ট।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮ – ১৮৯৪) যখন কথাসাহিত্যের আঙিনায় পা দেন তখন বাংলা সাহিত্যে তাঁর সামনে আদর্শ স্থানীয় উপন্যাস প্রায় ছিলই না, প্যারীচাঁদ মিত্র (ছদ্মনামে টেকচাঁদ ঠাকুরের - ১৮১৪-১৮৮৩) ‘আলালের ঘরের দুলাল’ রচনাটির মধ্যে যদিও উপন্যাসের কিছু চরিত্রলক্ষণ ছিল। তবে পাদরি লঙ সাহেব এ বই (অনূদিত) পাঠ করেই সম্ভবত তাঁকে ‘ডিকেন্স অব বেঙ্গল’ বলে ভূষিত করেন। (বাঙালি চরিতাভিধান, ১ম খন্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা পৃ. ৪০০)। প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলাল’ ফর্মের দিকে যথার্থ উপন্যাস হয়তো বলা যাবে না, এটাকে প্রাক্-উপন্যাস বলাই সঙ্গত।
অতি উচ্চমানের তত্ত্বসমৃদ্ধ, প্রসাদগুণ সমন্বিত গদ্যকার বঙ্কিমচন্দ্রের কথাকার-সত্তা অতি অবশ্যই বিশেষ মর্যাদার। প্রথমে ইংরেজিতেই পরীক্ষামূলকভাবে উপন্যাস, ‘Rajmohan's Wife’ (১৮৬৪) লিখে তিনি বাংলায় রচনা করেন দুর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫), কপালকুন্ডলা (১৮৬৬), মৃণালিনী (১৮৬৯), এবং এ তিনখানি উপন্যাস বাংলা কথাসাহিত্যের জগৎটিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে দিল বাংলা তথা ভারতীয় সাহিত্যক্ষেত্রে। বিষবৃক্ষ (১৮৭৩), ইন্দিরা (১৮৭৩), চেন্দ্রশেখর (১৮৭৫), রজনী (১৮৭৭), কৃষ্ণকান্তের উইল (১৮৭৮), রাজসিংহ (১৮৮২), আনন্দমঠ (১৮৮৪), দেবী চৌধুরাণী (১৮৮৪) লিখ বাঙালিকে নতুন সাহিত্যের সন্ধান দিলেন বঙ্কিমচন্দ্র, এবং এ উপন্যাসগুলোর জনপ্রিয়তা শতাব্দী পেরিয়ে যাওয়ার পরও অমলিন।
বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে ইতিহাস-প্রেম-অতিপ্রাকৃত, আধিভৌতিক রোমান্স, সমাজ (রাজনীতি ‘আনন্দমঠ)’ বিষয় হিসেবে এসেছে, এবং ইংরেজি উপন্যাসের আঙ্গিক, নির্মিতির প্রভাব এতে নিঃসন্দেহে স্পষ্ট। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস এখনও জনপ্রিয়। একটা যুগের চিত্র ধারণ করেও তাঁর উপন্যাস সমসাময়িক। তাঁর সমসাময়িক ঔপন্যাসিকদের মধ্যে ‘বঙ্গবিজেতা’ (১৮৭৪), ‘মহারাষ্ট্র জীবনপ্রভাত’ খ্যাত রমেশচন্দ্র দত্ত (১৮৪৮-১৯০৯), ‘জাল প্রতাপচাঁদ’ (১৮৮৩), ‘রামেশ্বরের অদৃষ্ট’ (১৮৭৭) খ্যাত বঙ্কিমচন্দ্রের অগ্রজ সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৪-১৮৮৯), ‘কঙ্কাবতী’ (১৮৯২) খ্যাত ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় (১৮৪৭-১৯১৯) এরা উল্লেখযোগ্য।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) যখন ‘ভারতী’ পত্রিকায় ধারাবাহিক উপন্যাস ‘করুণা’ (১৮৭৭-৭৮) প্রকাশ করেন তখন তাঁর বয়স ষোলো-সতেরো বৎসর। ১৮৮৩-তে তিনি লিখলেন ‘বউঠাকুরানীর হাট’। এরপর ‘রাজর্ষি’ (১৮৮৭), ‘চোখের বালি’ (১৯০৩), ‘গোরা’ (১৯১০), ‘ঘরে বাইরে’ (১৯১৫), ‘চার অধ্যায়’ (১৯৩৫) লিখে কবিগুরু উপন্যাসের জগতে নির্দিষ্ট একটি স্থান করে নিলেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন বৃদ্ধ বয়সে, ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে কাব্যধর্মী ও রোমান্স-আশ্রিত উপন্যাস ‘শেষের কবিতা’ লিখে পাঠকদের বিস্ময়-বিমূঢ় করে দিলেন। জনপ্রিয়তার দিকে রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’ আজও পাঠকের প্রিয়। তবে ‘চোখের বালি’ (১৯০৩), ‘যোগাযোগ’ (১৯২৯), ‘চতুরঙ্গ’ (১৯১৫) আঙ্গিকগত দিকে সার্থক। তবে জাতির আত্ম আবিষ্কারের প্রশ্ন নিয়ে বাংলা উপন্যাসের জগতে 'গোরা' যে গভীর তাৎপর্যপূর্ণ পরিণতির দিকে গেছে, এটা অভূতপূর্ব।
রবীন্দ্রনাথ যখন মধ্যগগনে তখনই কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৭৬ – ১৯৩৮) উপন্যাস বাঙালি পাঠকদের কাছে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। সমসাময়িক বঙ্গীয় সমাজের সুখ দুঃখ হতাশা, গ্লানি, নিপীড়ন, কুপ্রথার বাস্তবিক পটভূমিকায় রচিত তাঁর উপন্যাস রয়েছ শিল্পীমনের সার্থক প্রতিফলন। বাস্তবতার উপর ভিত্ সত্ত্বেও সমসাময়িকতা বাস্তবতার উর্ধ্বে উদ্ভাসন তাঁর উপন্যাসে স্পষ্ট। শরৎচন্দ্র ইতিহাসে আশ্রয় নেননি, আশ্রয় নেননি কল্পনার স্বপ্নলোকে, তাঁর সৃষ্ট নরনারী আমাদের অতি পরিচিত, কিন্তু তৎসত্ত্বেও তাঁর রচনা নেহাৎ ডকুমেন্টেশন নয়, প্রকৃত সৃজনই হয়ে উঠেছে। নারীর প্রতি তাঁর ছিল পক্ষপাতিত্ব, তাই শরৎচন্দ্র অত্যাচারিতা, নিপীড়িতা, মাতৃস্বরূপা নারীচরিত্র চিত্রণে এদের পক্ষাবলম্বন করেছেন। তাঁর উপন্যাস নির্মম পুরুষ সমাজের বিরুদ্ধে, কুটিল সামাজিক প্রথার বিরুদ্ধে তীব্র আঘাত হেনেছে।
শরৎচন্দ্রের জীবনের একটি অধ্যায় কেটেছে প্রবাসে। বার্মায় বসবাসরত অবস্থায়ই তিনি লেখালেখি করেন এবং স্থায়ীভাবে দেশে ফিরে আসার পরও তাঁর জীবনধারায় সেই ভবঘুরে স্বভাবের পরিবর্তন হয়নি। সমাজের কুটিল জটিল গতি তিনি খুব কাছে থেকেই লক্ষ করেছেন, সামাজিক কর্মকাণ্ডেও তিনি পিছিয়ে থাকেননি, রাজনীতিতেও অংশগ্রহণ ছিল তাঁর। এসব মিলেই তাঁর সৃষ্টি। তাঁর ‘পথের দাবী’ একটা সময় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অনুপ্রেরণার স্থল ছিল, তাঁর আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘শ্রীকান্ত’ কিশোর-যুবক-শ্রৌঢ়-বৃদ্ধ সব বয়সের পাঠকদের কাছে জনপ্রিয়। কেবল বাংলাতেই নয়, হিন্দি সহ ভারতের অন্যভাষায় অনূদিত হয়ে তাঁর সৃষ্টির জনাদর সারা দেশেই।
বাংলা উপন্যাসের সৃজনশীল ধারাকে বঙ্কিম-রবীন্দ্র-শরৎচন্দ্রের পর যে তিন ব্যক্তি ধরে রেখেছেন সেই ‘তিন বন্দ্যোপাধ্যায়’ বলে চিহ্নিত এরা হলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০), তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১), এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬)। বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’ (১৩৩৫-১৩৩৬) গ্রন্থ হয়ে ছাপার (১৯২৯) আগেই বাঙালি পাঠকসমাজের প্রাণের ভেতর স্থান করে নিয়েছে, আর বিশ্ববিশ্রুত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় ১৯৫৫ সালে চিত্ররূপ দেওয়ার পর থেকে অদ্যাবধি ‘পথের পাঁচালী’র জনপ্রিয়তা বেড়েই চলেছে বিশ্ব্যব্যাপী। বিভূতিভূষণের প্রকৃতিচেতনা, গ্রামবাংলার জীবনধারা, সামাজিক বিবর্তন ধারা, হারানো দিন, হারানো শৈশবের চিত্রায়ণ এবং শিশু কিশোর জগৎকে সাহিত্যে সংস্থাপন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ‘দৃষ্টিপ্রদীপ’ (১৩৪২), ‘আরণ্যক’ (১৩৪৫), ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ (১৩৪৭), ‘দেবযান’ (১৩৫১), ‘ইছামতী’ (১৩৫৬) ছাড়াও তাঁর শিশু কিশোর উপন্যাস ‘চাঁদের পাহাড়’, ‘হীরামানিক জ্বলে’, ‘মরণের জয়ডঙ্কা বাজে’ বাঙালিদের চিত্ত জয় করেছে।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১) বাংলার যুগবিবর্তনের ধারাটি উপন্যাসে প্রতিফলিত করেছেন। পুরাতন, সামন্ততান্ত্রিক যুগের অবসানে নতুন যুগের সূচনায় গ্রামীণ জনপদের আধা-নগরায়নের দিকে এগিয়ে চলা যেমন তিনি ধরেছেন তেমনি রাঢ় বাংলার প্রান্তিক জনজীবন, সাপুড়ে, বাজিকর, সাঁওতাল, বৈষ্ণব-গোঁসাই, কবিয়াল, তান্ত্রিকদের নিয়ে এসেছেন উপন্যাস (এবং ছোটগল্পে)। রাইকমল (১৯৩৫), নীলকণ্ঠ (১৯৪৩), ধাত্রীদেবতা (১৯৩৯), কালিন্দী (১৯৪০) গণদেবতা (১৯৪২), পঞ্চগ্রাম (১৯৪৩), হাঁসুলি বাঁকের উপকথা (১৯৪৭) উপন্যাস বাঙালি-জীবনের এক অদেখা জগৎ মেলে ধরেছে।
আর তৃতীয় সেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯১০-১৯৫৬) পদ্মানদীর মাঝি (১৯৩৬), পুতুলনাচের ইতিকথা (১৯৩৬), দিবারাত্রির কাব্য (১৯৩৫) লিখে বাংলা উপন্যাসকে সমৃদ্ধ করেছেন।
বাংলা উপন্যাসের জগতে মহরম পর্ব, (১৮৮৫), উদ্ধার পর্ব (১৮৮৭), এবং এজিদ পর্ব (১৮৯১), এ তিনটি পর্ব নিয়ে একটি বৃহদায়তন উপন্যাস 'বিষাদ সিন্ধু' লিখে নিজের স্থান পাকাপোক্ত করেছেন বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন লেখক মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭ – ১৯১২)। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অনালোচিত এ নাট্যকার, কবি, প্রাবন্ধিক বাংলা কথাসাহিত্যে একটি নতুন মাত্রা সংযোজন করেন। কারবালার বিষাদময় ঘটনা নিয়ে উপন্যাস ছাড়াও তাঁর ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ (১৮৯০) উপন্যাসে নীলকরদের অত্যাচারের করুণ কাহিনিও বর্ণিত হয়েছে।
কমলকুমার মজুমদার (অন্তর্জলী যাত্রা, সুহাসিনীর পমেটম), অদ্বৈত মল্লবর্মন (তিতাস একট নদীর নাম), বুদ্ধদেব বসু (রাত ভর বৃষ্টি), সমরেশ বসু (প্রজাপতি, গঙ্গা), কাজি ইমদাদুল হক (আবদুল্লাহ), সৈয়দ মুজতবা আলী (শবনম, শহর ইয়ার), সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ (লালসালু, কাঁদো নদী কাঁদো), শওকত ওসমান (ক্রীতদাসের হাসি), আশাপূর্ণা দেবী (প্রথম প্রতিশ্রুতি, সুবর্ণলতা), মহাশ্বেতা দেবী (হাজার চুরাশির মা, অরণ্যের অধিকার), সতীনাথ ভাদুড়ি (ঢোড়াই চরিতমানস), প্রমথনাথ বিশী (কেরি সাহেবের মুন্সী), বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় (রাণুর প্রথম ভাগ), যাযাবর (দৃষ্টিপাত), অমিয়ভূষণ মজুমদার (রাজনগর), বিমল মিত্র (কড়ি দিয়ে কিনলাম), প্রেমাঙ্কুর আতর্থী (মহাস্থবির জাতক), বনফুল (মৃগয়া), আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (খোয়াবনামা), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (প্রথম আলো)- এ অসম্পূর্ণ তালিকায় বাংলা উপন্যাসের বহমান ধারার আভাস দেওয়া হল যা থেকে বাংলাদেশ সহ ভারতীয় উপমহাদেশের কথাসাহিত্যের সচল ধারাটি অনুধাবন করা সম্ভব হবে।
কথাসাহিত্যে ছোটগল্পের আত্মপ্রকাশ বিংশ শতাব্দীতে। দীর্ঘ পরিসরের কাহিনি অর্থাৎ উপন্যাস সাহিত্যজগতে স্বতন্ত্র Genre হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করার শতবর্ষ অতিক্রান্ত হবার অনেক পর হ্রস্ব-আকারের, সংক্ষিপ্ত পরিসরের এ আঙ্গিকটির উদ্ভব। সাধারণত ক্ষুদ্র অঙ্কুর থেকে সৃষ্টি হয় মহীরূহ, কিন্তু এখানে যাত্রাটি বিপরীত। ইউরোপে উনবিংশ শতাব্দীতে নগরায়নের বা শিল্পায়নের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তিত সমাজ কাঠামোয় দীর্ঘ পরিসরের কাহিনি, নভেল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং প্রত্যেক কথাকারই বিশাল কলেবরের উপন্যাস রচনা করেন, যা পত্রপত্রিকায় প্রথমে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হত এবং অতঃপর গ্রন্থাকারে মুদ্রিত হয়ে বাজারে এলে ক্রেতারা আবার নগদমূল্যে কিনে পাঠ করতেন। আমাদের দেশেও উনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্ব থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথম পর্ব পর্যন্ত তেমনি বৃহৎ কলেববের উপন্যাস জয়প্রিয়তা লাভ করে। কিন্তু ক্রমে মানুষের জীবনধারায় অবকাশ মুহূর্তের অবসান ঘটতে থাকে, ব্যস্ততম জীবনে দীর্ঘ রচনা পড়ার সময়, ধৈর্য দুটোতেই ঘাটতি পড়ে। অথচ মনের খোরাক তো মেটাতে হবে। তাই সৃষ্টি হল ছোটগল্প। এর প্রকাশস্থল হল সাময়িক পত্রপত্রিকা, বেতার অনুষ্ঠান ইত্যাদি। মানুষ মোটরে, রেলে, ট্রামে কর্মস্থলে যেতে আসতে এগুলো পড়ে নিতে পারছে, রেডিওর নব ঘুরিয়ে শুনে নিতে পারছে। আকাশবাণীর গল্পপাঠ, (আর BBC London এর Story of the Week এই সেদিনও জনপ্রিয় ছিল, আজও রয়েছে)।
এ গল্পগুলো আকারে ছোট, কিন্তু রচনার নৈপুণ্যে, প্রকাশশৈলীতে পাঠকমনে এর অভিঘাত অত্যন্ত গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী। আকারে, ইঙ্গিতে এ লেখকরা পাঠকদের মনকে এমনভাবে উদ্দীপ্ত করতে পারেন যে পাঠকরা নিজের অজান্তে নিজেরাই কখন হয়ে যান স্রষ্টতা বুঝতে পারেন না। গল্পপাঠ শেষ হলে শুরু হয়ে যায় নিজের সঙ্গে নিজের সংলাপ, পাঠক মনে শুরু হয় আরেক গল্পের নির্মান। ‘একটি-ঘটনা’ ‘একটি ব্যক্তি’র একটি অনালোকিত দিকে আলোক প্রক্ষেপণ ‘একটি কথা’ ‘একটি তত্ত্বের’ কোনও প্রকাশ নয়, একটু আভাস; কোনো সমাপ্তি নয়, ভিন্নতর সূচনার আভাস এ নিয়েই ছোটগল্প। এর সমাপ্তিকে বলা হয় Open-ending। এগুলোকে Anti-plot, বা Anti-hero গল্পও বলা হয়। অর্থাৎ কাহিনি বিহীনতাই কাহিনি, হিরো নয়, একেবারে অজ্ঞাত, অবহেলিত, ব্রাত্য চরিত্রই এ গল্পে মুখ্য। ইংরেজি Hero শব্দের স্থলে বলা হয় Protagonist।
বাংলা সাহিত্যে সার্থক ছোটগল্প এসেছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত দিয়েই। ১৮৯১ থেকে ১৯০৩ সালের মধ্যেই কবিগুরু তাঁর প্রধান গল্পগুলো লিখেছেন। অখণ্ড ‘গল্পগুচ্ছে’ তাঁর মোট ৯১টি ছোটগল্প সংকলিত হয়েছে। পোস্টমাস্টার, অতিথি, ছুটি, খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন, নষ্টনীড়, কাবুলিওয়ালা, স্ত্রীর পত্র, ক্ষুধিত পাষাণ, নিশীথে রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ছোটগল্প। বিশ্বসাহিত্যে যে গল্পকাররা সার্থক গল্প লিখে ছোটগল্পকে সাহিত্যজগতে প্রতিষ্ঠা করেন সেই রুশ আন্তন চেকভ (১৮৬০-১৯০৪), ফরাশি গাই দ্য মোপাশাঁ, (১৮৫০-১৮৯৩) রুশ নিকোলাই গোগল (১৮০৯-১৮৫২) রবীন্দ্রনাথের গল্পের স্থান এদের সৃষ্টির সমপর্যায়েই।
বাংলা সাহিত্যে সার্থক ছোটগল্প এসেছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত দিয়েই। ১৮৯১ থেকে ১৯০৩ সালের মধ্যেই কবিগুরু তাঁর প্রধান গল্পগুলো লিখেছেন। অখণ্ড ‘গল্পগুচ্ছে’ তাঁর মোট ৯১টি ছোটগল্প সংকলিত হয়েছে। পোস্টমাস্টার, অতিথি, ছুটি, খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন, নষ্টনীড়, কাবুলিওয়ালা, স্ত্রীর পত্র, ক্ষুধিত পাষাণ, নিশীথে রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ছোটগল্প। বিশ্বসাহিত্যে যে গল্পকাররা সার্থক গল্প লিখে ছোটগল্পকে সাহিত্যজগতে প্রতিষ্ঠা করেন সেই রুশ আন্তন চেকভ (১৮৬০-১৯০৪), ফরাশি গাই দ্য মোপাশাঁ, (১৮৫০-১৮৯৩) রুশ নিকোলাই গোগল (১৮০৯-১৮৫২) রবীন্দ্রনাথের গল্পের স্থান এদের সৃষ্টির সমপর্যায়েই।
ভারতবর্ষে রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও ভিন্ন ভাষাতেও ছোটগল্পকারের আত্মপ্রকাশ ঘটতে থাকে প্রায় একই সময়-সীমায়, এদের মধ্যে হিন্দি কথাকার মুন্সি প্রেমচন্দের (১৮৮০-১৯৩৬) নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তবে রবীন্দ্র সমসাময়িক কালে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় ভূত ও মানুষ (১৮৯৭), মুক্তামালা (১৯০১), মজার গল্প (১৯০৪), ডমরু চরিত (১৯২৩)-গল্পগ্রন্থ নিয়ে এ ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখেন। তাঁর গল্পের বৈশিষ্ট্য হল, এগুলো রবীন্দ্র প্রভাবের বাইরে। এ ক্ষেত্রে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, মনীশ ঘটক, জগদীশ গুপ্ত, গোকুল নাগ, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের নামও উল্লেখযোগ্য। অবশ্য বাংলার প্রায় সব বিশিষ্ট ঔপন্যাসিকই উল্লেখযোগ্য ছোটগল্প রচনা করেছেন এতে শরৎচন্দ্র থেকে বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আছেন। আছেন বনফুল, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, সুবোধ ঘোষ, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, আশাপূর্ণা দেবী, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, মনোজ বসু, মহাশ্বেতা দেবী , গল্পকারদের মিছিলে দুই বাংলাকে এক করলে যুক্ত করা যায় আরও অনেক নাম; এদের মধ্যে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, শওকত ওসমান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হকের নাম আসবে।
সাম্প্রতিক কালে আন্তর্জালে সীমান্তের এপারে ওপারে মুদ্রিত বইপত্রের আনাগোনার দৌলতে সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে বাংলাদেশের সাহিত্যকৃতির পরিচয় লাভ সহজ এবং সাহিত্যের ইতিহাস আলোচনায় বাংলা ভাষার ভুবনগুলোর অন্তর্ভুক্তি তো সময়েরই দাবি।
আলোচনার শেষে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে সমালোচক ভূদেব চৌধুরী ২০০০ সালে জানিয়েছিলেন ‘কেবল বাংলা ভাষাতেই যে বর্তমান কালে মোটামুটি হাজারের মতো গল্প বছরে প্রকাশিত হয়। (উদ্ধৃত অদ্রীশ বিশ্বাস, ‘বাংলা ছোটগল্প: ভারতীয়তার সন্ধান’, বিশ শতক: শেষ দশক: বঙ্গসংস্কৃতি, দেবব্রত চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত, কলিকাতা-২০০০, পৃ৯৪)। ইতিপূর্বে অবশ্য ১৯৫১ সালের ‘এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা’ জানিয়েছিল যে পূর্ববর্তী দশকে ইংরেজিতে এক লক্ষ ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছিল। বাংলা সাহিত্যে অনুরূপ জরিপ করলে অত্যাশ্চর্যজনক তথ্য বা পরিসংখ্যান বেরোবে সন্দেহ নেই।