উপরে বর্ণিত প্রেক্ষাপটে ১৯৬০ সালের ১০ অক্টোবর বিধান সভায় উত্থাপিত রাজ্য ভাষা বিল। আসামের মুখ্যমন্ত্রী তখন কাছাড়ের বদরপুর থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি বিমলাপ্রসাদ চালিহা। ১০ তারিখ উত্থাপিত বিলটি ২৪ অক্টোবর রাত বারোটায় ৫৬-০ ভোটে এক তরফা গৃহীত হয়ে গেল। মুখ্যমন্ত্রী এবং আবদুল মতলিব মজুমদার ছাড়া কাছাড়ের বাঙালি অবাঙালি প্রতিনিধি দলমত নির্বিশেষে সবাই প্রতিবাদে সভাকক্ষ ত্যাগ করেন। একতরফা গৃহীত আইনটি হল Assam Official Language Act , 1960 (Assam Act no.XXXIII of 1960)। আইনটি গৃহীত হবার অব্যাবহিত পরেই শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, সচেতন রাজনৈতিক মহল এবং ছাত্র যুবসমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ২ ও ৩ জুলাই ১৯৬০ সালে শিলচর গান্ধীবাগে ‘নিখিল আসাম বাংলা ভাষা ও অনসমিয়া ভাষা সম্মেলন’। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন প্রখ্যাত সাংবাদিক চপলাকান্ত ভট্টাচার্য, এম,পি (পশ্চিমবঙ্গ)। ২ জুলাই ১৯৬০ শনিবার বিকেল ৩ টায় অভ্যর্থনা সমিতির পক্ষে বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় শ্রী চপলাকান্ত ভট্টাচার্যকে সভাপতির আসনে বৃত করেন। মঞ্চে আসন গ্রহণ করেন আসামের সরবরাহ মন্ত্রী ময়ীনুল হক চৌধুরী, খাসিয়া নেতা হুভার হুইনি নিউতা, এম পি, সুরেশ চন্দ্র দেব, এম পি এবং এম-এল-এ নন্দকিশোর সিং, বিশ্বনাথ উপাধ্যায় এবং হাইলাকান্দি, করিমগঞ্জের বিশিষ্ট নেতৃবর্গ। প্রথমে কয়েকটি লিখিত বার্তা পাঠ করে শোনানো হয়। সম্মেলনে উপস্থিত থাকতে না পারার জন্য দুঃখ প্রকাশ এবং সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে বার্তা প্রেরণ করেন আসামের নেতা মাদ্রাজের রাজ্যপাল, বিষ্ণুরাম মেধী, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল পদ্মজা নাইডু, সাহিত্যিক হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, রেজাউল করিম, মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা, অরুণচন্দ্র গুহ, প্রফুল্লচন্দ্র সেন, ড.ত্রিগুণা সেন, অতুল্য ঘোষ, অজয় মুখার্জি, ড৽আর আহমেদ, অনাথবন্ধু রায়, হরেশ্বর দাস, হেমচন্দ্র চক্রবর্তী প্রমুখ।
সম্মেলনে স্বাগত ভাষণে বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় বলেন যেহেতু এই প্রদেশের নাম আসাম, অনসমিয়া ভাষাভাষীগণ সেই কারণেই কাহারও কাহারও নিকট বহিরাগতরূপেই প্রতীয়মান হইতেছেন। এরা যেন এই রাজ্যের পক্ষে বোঝা স্বরূপ। শ্রীহট্ট ও পূর্ববঙ্গ হইতে লক্ষ লক্ষ হিন্দু দেশনায়কগণের প্রদত্ত প্রতিশড়ুতির উপর চনির্ভর করিয়া অসমিয়াভাষীদিগকে আত্মীয় জ্ঞান করিয়াই এই রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন। কিন্তু আজ ইহারা চরম উপেক্ষার পাত্র—অবাঞ্ছিত অতিথি।
…গায়ের জোরে একশ্রেণির লোক যে আজ অসমিয়া ভাষাকে আমাদের উপর চাপাইয়া দিতে চাহিতেছেন তাহারা ভুলিয়া যাইতেছেন যে, গায়ের জোর দেখানোর অর্থই হইতেছে তাঁহাদের দাবির পিছনে কোন যুক্তি নাই—এই কথা স্বীকার করিয়া লওয়া। অসমিয়া ভাষার প্রতি মমতা অপেক্ষা বাংলা ও অন্যান্য ভাষার প্রতি বিদ্বেষের কথাটাই বড়ো হইয়া উঠিতেছে।
বিশিষ্ট সাহিত্যিক, চিন্তাবিদ কাজি আব্দুল ওদুদ বলেন—
“ইংরাজের হাত হইতে স্বাধীনতা কাড়িয়া আনিবার জন্য আমরা এক উদ্দেশ্যে একযোগে কাজ করিয়াছিলাম, কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পর আমাদের সামনে সমস্যা ভিন্ন আকারে দেখা দিয়াছে। দেশের সামনে আজ সব চাইতে বড় সমস্যা দাঁড়াইয়াছে বৈচিত্র্যের মধ্যে একত্বকে কী করিয়া রক্ষা করা যায়। অসমিয়াগণ যখন অসমিয়া ভাষাকে রাজ্যভাষা করিতে চান তখন আপাতদৃষ্টিতে তাহাকে ন্যায়সংগত দাবি বলিয়াই মনে হয়। কিন্তু এই প্রশ্নের মীমাংসায় আসামের বিশেষ অবস্থার কথাও চিন্তা করিতে হইবে। আসাম বহু ভাষাভাষী রাজ্য। এখানে কোনো একটি ভাষাকে অপর সব ভাষার উপর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করিতে দেওয়া যায় না। কোনো একটি ভাষাকে সরকারি ভাষা করিয়া দিলেই কী তাহা বাস্তবিকপক্ষে বড় হইয়া যাইতে পারে? পৃথিবীতে অনেক রাজ্যে অনেক ভাষাকেই সরকারি ভাষা করা হইয়াছে- কিন্তু তাহাদের সবগুলিই ভাষা হিসেবে বড় নয়। কোনো ভাষাকে বড় করিতে হইলে মহৎ লোকের সৃষ্টি করিতে হয়। ডান্ডাবাজির দ্বারা সাহিত্যের উৎকর্ষসাধন হয় না। মহৎ সাহিত্যের সৃষ্টির জন্য মহৎ মানুষ সৃষ্টির প্রয়োজন। মনুষ্যত্বের বিকাশ ছাড়া সাহিত্য সৃষ্টি হয় না। সরকারি অর্থ সাহায্য লাভ করিয়াও কোনো সাহিত্য বড় হইতে পারে না। সরকারি অর্থের সাহায্যে অভিধান প্রস্তুত করা যাইতে পারে, অনুবাদ করা যাইতে পারে-কিন্তু সাহিত্য সৃষ্টি পৃথক জিনিস। বাঙ্গালী যাঁহারা আসামে আছেন- তাঁহাদের বিশেষ দায়িত্ব বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ সম্পদ অসমিয়াদের নিকট তুলিয়া ধরা আর অসমিয়া এবং আসামের অন্যান্য ভাষার মধ্যে শ্রেষ্ঠ বস্তু যাহা আছে তাহা বাংলা সাহিত্যের জন্য আহরণ করিয়া বাংলা ভাষাকে আরো সমৃদ্ধ করা। বাঙ্গালীরাও কর্তব্যবুদ্ধি প্রণোদিত হইয়া আসামের উন্নতির জন্য সচেষ্ট হইবেন। প্রেমের দ্বারা সকলের মন জয় করিতে হইবে।” (জনশক্তি, শিলচর ২৯ জুন ১৯৬০)
ভারত সীমান্তে চিন এবং পাকিস্তানের শত্রুতা এবং এ সঙ্গে নবসৃষ্ট আভ্যন্তরীন জটিলতা যে খুব সুবুদ্ধির পরিচায়ক নয় এ কথাটি মনে করিয়ে দিয়ে বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় এ ভুবনের কৃতী সন্তান বিপিনচন্দ্র পাল, ড. সুন্দরীমোহন দাস, মৌলবী আব্দুল করিম, কামিনীকুমার চন্দ, শচীন্দ্র সিংহ, ভুবনমোহন বিদ্যার্ণবের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করে স্বাধীনতা আন্দোলনে শ্রীহট্ট-কাছাড়ের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা, ১৯২১ সালে সুরমা উপত্যকার চা শ্রমিক আন্দোলনের কথা স্মরণ করেন। প্রকাশ্য অধিবেশনে ভাষণ দেন পশ্চিমবঙ্গের চিন্তাবিদ লেখক কাজি আব্দুল ওদুদ।
এদিন সন্ধ্যা সাতটায় শিলচর সাংস্কৃতিক ভবনে খাসিয়া জননেতা হুভার হুইনির সভাপতিত্বে আসামের পার্বত্য অঞ্চলের প্রতিনিধি সহ অন-অসমিয়া ভাষাভাষীদের সভায় অধ্যাপক শরৎচন্দ্র নাথ, আশুতোষ দত্ত ও ভাষণ দান করেন। বিশিষ্ট ডিমাসা আইনজীবী অনিলকুমার বর্মন একসময় যে ডিমাসা জাতি যে সমগ্র আসামে রাজত্ব করেন এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করেন অম্বিকাগিরি রায়চৌধুরী কোন অধিকারে কাছাড়কে আসাম থেকে বের করে দিতে চান? তিনি বলেন তাঁরাই বরং আসাম থেকে বের হয়ে যান। উত্তর কাছাড়ের লোক বাংলা বলে এবং বাংলায় শিক্ষালাভ করে এ কথা বলে তিনি রাজ্য ভাষা হিসেবে বাংলাকে হঠিয়ে দেবার বিরুদ্ধে মতামত দেন। কাবুই নাগা প্রতিনিধি সারা রাজ্যে অসমিয়া ভাষা চালু করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। খাসিয়া-জয়ন্তীয়া জেলা পরিষদের চিফ এক্সিকিউটিভ টি, কাজি বলেন, ‘আসাম উপত্যকার ষড়যন্ত্রের ফলেই শ্রীহট্ট পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এর ফলে খাসিয়া পাহাড়ে মানুষের দুর্গতি বেড়েছে। তিনি বলেন, একতরফা অসমিয়া ভাষা প্রবর্তনের বিরুদ্ধে পার্বত্য অঞ্চলের সকল জাতি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। রাজ্যভাষা আইনের বিরোধিতা করে বক্তব্য রাখেন পূর্ব ভারত উপজাতীয় ইউনিয়নের সহ সভাপতি এবং মিজো জেলা প্রতিনিধি থাঙ্গারিডেমা, কাছাড় পার্বত্য জাতি সমিতির সম্পাদক থেংটুয়ামা, কাছাড়ের মণিপুরি প্রতিনিধি শ্রী বি, সিং, জৈন্তা পাহাড়ের প্রতিনিধি শ্রী পর্শনা। রাত দশটায় জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান সমাপ্ত হয়।
অক্টোবর ভাষা বিল একতরফা গৃহীত হলে ৬ এবং ৭ নভেম্বর নিখিল আসাম বাংলা ভাষা সম্মেলনের উদ্যোগে হোজাইতে এক অভিবর্তন অনুষ্ঠিত হল। এতে আহ্বায়ক ছিলেন রমণীকান্ত বসু (ধুবড়ি), মোহিত মোহন দাস (করিমগঞ্জ), কালীকৃষ্ণ ব্যানার্জি, জ্ঞানেশচন্দ্র সেন (গৌহাটি), শান্তিরঞ্জন দাসগুপ্ত (হোজাই)। রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের পৌরোহিত্যে অভিবর্তনে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি এবং দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্থদের পুনর্বাসনের দাবি জানা হয়।
ইতিমধ্যে ৫ নভেম্বর ১৯৬০ করিমগঞ্জে অনুষ্ঠিত হয় জনসম্মেলন এই সম্মেলনে গঠিত হয় গণসংগ্রাম পরিষদ। মেঘালয়ের খাসি, গারো, উত্তর কাছাড়, কারবি আংলং এবং লুশাই হিলসের অন-অসমিয়া জনগোষ্ঠীও এ বিক্ষোভে সামিল হয়। কিন্তু এ সব কিছু উপেক্ষা করে ১৭ ডিসেম্বর বিধান সভায় পাস হওয়া ভাষা বিল রাজ্যপালের অনুমোদন লাভ করে। এরপর ২০ নভেম্বর কাছারের নরসিংপু্রে যোগী সম্মেলনীর ৩৬ তম অধিবেশনে ইতিহাসবিদ রাজমোহন নাথ বি, ই তত্ত্বভূষণের সভাপতিত্বে ‘রাজ্য ভাষা বিল সংশোধন করে বাংলা ভাষাকে অসমিয়া ভাষার সম-মর্যাদা দেওয়া না হলে আসামের বাংলা ভাষাভাষী এলাকাকে ‘বৃহত্তর আসাম হইতে বিচ্ছিন্ন করা অপরিহার্য’ হলে তজ্জন্য এই সভা’ সুষ্ঠু জনমত সংগঠন ক্রমে শান্তিপূর্ণ ও সংঘবদ্ধ সংগ্রাম পরিচালনার জন্য আহ্বান জানানো হয়। (প্রস্তাবক ও সমর্থক বৈদ্যনাথ নাথ এবং সুনীলবরণ নাথ।)
এরপর ১৯৬১ সালের ১৫ জানুয়ারি করিমগঞ্জ শহরে কংগ্রেস দলের আহ্বানে বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এক অভিবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। এতে পৌরহিত্য করেন নেতাজির একনিষ্ট সহকর্মী শীলভদ্র যাজি। অতঃপর ৫ ফেব্রুয়ারি করিমগঞ্জ টাউল ব্যাঙ্ক প্রাঙ্গনে হাইলাকান্দির আইনজীবী আব্দুর রহমানের পৌরোহিত্যে গণ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সিদ্ধান্ত হয় বৈষম্যমূলক রাজ্যভাষা আইন প্রত্যাহার না হলে রাজ্যের অন-অসমিয়া ও বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে স্বতন্ত্র প্রশাসনিক সংস্থা গড়ে তোলার দাবি নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। এই উদ্দেশ্যে কান্দ্রীয় ভাবে কাছাড় গণ সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে শিলচর, করিমগঞ্জ এবং হাইলাকান্দি এ তিন মহকুমা থেকে সদস্য নির্বাচন করা হয়।
৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১ তারিখে হাইলাকান্দিতে আরেকটি বিশেষ সভায় আব্দুর রহমানকে সভাপতি এবং নলিনীকান্ত দাসকে (করিমগঞ্জ) সাধারণ সম্পাদক, এবং বিধুভূষণ চৌধুরীকে কোষাধ্যক্ষ হিসেবে মনোনীত করে কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ গঠিতহয়।
মহকুমা স্তরে কাছাড়ের জন্য সভাপতি হিসেবে জিতেন্দ্র নাথ চৌধুরী ও সম্পাদক পরিতোষ পাল চৌধুরী, করিমগঞ্জের জন্য সভাপতি হিসেবে ব্যোমকেশ দাস ও সম্পাদক নৃপতিরঞ্জন চৌধুরী, হাইলাকান্দির জন্য সভাপতি কেশবচন্দ্র চক্রবর্তী ও সম্পাদক হরিদাস দেবকে মনোনীত করা হয়।
এই ভাবে গণসংগ্রাম পরিষদ ১৩৬৮ বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ (১৫ এপ্রিল, ১৯৬১) সংকল্প দিবস হিসেবে পালন করার পর পরবর্তী একমাসব্যাপী সভা সমিতি, শোভাযাত্রা, পদযাত্রার মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে আন্দোলনের বার্তা পৌঁছে দেবার কার্যসূচি রূপায়নে নেমে যায়। মহকুমা সমিতিগুলোকে আবার নিজ নিজ এলাকায় আঞ্চলিক সমিতি গঠন করে আন্দোলনকে আরও সুসংহত রূপ দেবার নির্দেশও দেওয়া হয়, এবং সারা কাছাড়ে গড়ে ওঠে অসংখ্য আঞ্চলিক শাখা।
প্রথম অবস্থায় যে সংগ্রামী চেতনা গড়ে উঠেছিল কামরূপ, গোয়ালপাড়া, হোজাই এলাকা নিয়ে, ক্রমে সেটা ঘনীভূত হল কাছাড় জেলার পরিধিতে। অপরদিকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় অসমিয়া রাজ্য ভাষার স্বপক্ষে ব্যাপক আন্দোলন এবং জনমত গঠনও শুরু হয়, শুরু হয় রাজনৈতিক তৎপরতা, সৃষ্টি হয় ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার পরিস্থিতি, সংঘটিত হল সন্ত্রাস, গৃহদাহ গণহত্যা। কাছাড়ে যেমন বাংলা ভাষার দাবিতে বঙ্গভাষী জনগণ পথে নামল, তেমনি অসমিয়া ভাষার দাবিতে অসমিয়া জনগণের সঙ্গে বঙ্গভাষী ছাড়াও অনসমিয়া জনগণও এগিয়ে গেল, একাধিক বাংলাভাষীর প্রাণও গেল এতে। ষাটের ভাষা আন্দোলনের অসমিয়া ইতিহাসকার দেবব্রত শর্মা ( এবং দয়াসাগর কলিতা) বলেছেন এই যে দুই উপত্যকায় ভাষার জন্য যাদের প্রাণ গেল, এদের জাতিগত পরিচয় দূরে সরিয়ে একত্রে ভাষাশহিদ বলাই তো সঙ্গত। এতে অসমিয়া রাজ্যভাষার সমর্থক বাঙালি যেমন আছেন তেমনি ভাষা কিংবা সাস্কৃতিক স্বাতত্র সম্বন্ধে নিতান্তই অজ্ঞ, এবং শান্তি সম্প্রীতি রক্ষায় নিবেদিত প্রাণ বাঙালি ও অসমিয়াও রয়েছেন। এদের একটি বিশদ তালিকা করার প্রয়াস পেয়েছেন দেবব্রত শর্মা এবং দয়াসাগর কলিতা যে তালিকায় শিলচরের একাদশ শহিদ যেমন আছেন, তেমনি ‘অসমিয়া ভাষার জন্য জীবন দেওয়া বাঙালি কমিউনিস্ট’ নগাওঁর শিশির নাগও আছেন। আছেন অসমিয়া শহিদ সাহিত্যিক সূর্য বরা, ছাত্র অনিল বরা, মজম্মিল হক এবং নাম না জানা আরও অনেক শহিদ। [সে সঙ্গে হাইলাকান্দির আলগাপুরে এককভাবে রাজ্যভাষা হিসেবে অসমিয়া ভাষার সমর্থনেপ্রকাশ্য দিবালোকে বাংলাভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে খাড়াকরা রাজনৈতিক মদৎপুষ্ট আইনভঙ্গকারি কতিপয়ভাড়াটে লুঠতরাজ, অগ্নিসংযোগেরত অবস্থায় পুলিশের গুলিতে নিহত নিরক্ষরমানুষ (এরা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় কোনও কোনও মহলে শহিদ বলেও চিহ্নিত)]।
ফিরে যাওয়া যাক আন্দোলন প্রসঙ্গে, —কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ ১৩৬৮ বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ, অর্থাট নববর্ষের দিনটিকে সংকল্প দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। স্থির হর ওই দিন থেকে একমাস ব্যাপী সভা, শোভাযাত্রা, পদযাত্রা ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণের মধ্যে আন্দোলনের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হবে। খ্রিস্টিয় ক্যালেন্ডারে সংকল্প দিবস ছিল ১৯৬১ সালের এপ্রিল মাসের ১৫ তারিখ। ২ মে তারিখ করিমগঞ্জে এক জনসভায় সিদ্ধান্ত হয় ১৯ মে পালিত হবে সর্বাত্মক ও পূর্ণ হরতাল। সরকারি প্রাশাসনিক ব্যাবস্থা অচল করে দেবার সমস্ত পন্থা গৃহীত হবে।
আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটীড় সভাপতি শরৎচন্দ্র সিংহ বিজ্ঞপ্তি জারি করে কংগ্রেস কর্মীদের সংগ্রাম থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেন। নিখিল ভারত কংগ্রস কমিটির সভাপতি সঞ্জীব রেড্ডিও অনুরূপ কড়া নির্দেশ জারি করেন দলীয় কর্মীদের প্রতি। প্রাথমিক ভাবে কিছু বিভ্রান্তি দেখা দিলেও এ নির্দেশ কংগ্রেস এবং অপর রাজনৈতিক দল সিপি আই –এর কর্মীদের আন্দোলনে সমর্থন দিতে কোন কুন্ঠা ছিল না। সংগ্রাম পরিষদের মুখ্য কার্যালয় ছিল করিমগঞ্জ, কিন্তু জেলা সদর শিলচরই হয়ে ওঠে সংগ্রামের মুখ্য কেন্দ্র। শিলচর মহকুমা সমিতির সদস্যদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিলে সমিতির সমস্ত কার্যভার এসে যায় সম্পাদক পরিতোষ পাল চৌধুরীর হাতে এবং কেন্দ্রীয় সমিতির তাঁকেই সর্বাধিনায়ক হিসেবে সংগ্রাম পরিচালনার দায়িত্ব দেন। তাঁর নেতৃত্ব উনিশে মে সারা কাছাড়ের সঙ্গে শিলচর মহকুমায়ও সর্বাত্মক বন্ধের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। দলে দলে স্বেচ্ছাসেবীরা নিজেদের নাম লিখিয়ে ধর্মঘটে যাবার প্রস্তুতি নিতে থাকলেন। স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রী ছাড়াও সার্বিক ভাবে যুব সমাজেও সংগ্রামী কার্যসূচিতে অংশগ্রহণে আগ্রহ দেখা গেল। বড়খলা, বিহাড়া, কাটিগড়া, বদরপুর, উধারবন্দ, লক্ষীপুর, জয়পুর, রাজাবাজার, সোনাই, ধলাই ছাড়াও মাছিমপুর, শ্রীকোণা, শালচাপরা, ভাঙ্গা, শ্রীগৌরী এবং করিমগঞ্জ শহর, এবং শহরতলি, সুপ্রাকান্দি, নিলামবাজার, কায়স্থগ্রাম হয়ে পাথারকান্দি, আর হাইলাকান্দি, লালা, কাটলিছড়া পেরিয়ে দুল্লভছড়া সর্বত্রই স্থানীয় নেতৃত্বে ছোট ছোট সমিতিসংগ্রামী কার্যসূচি গ্রহণ করছে। আসলে কয়েকদিন ধরে জেলা ভিত্তিক পদযাত্রা, পথসভা, এবং গ্রামেগঞ্জে জনসংযোগের ফলে ব্যপক জনসচেতনতাও জেগে উঠেছে। স্বাধীনতা আন্দোলনের পর এটাই ছিল দ্বিতীয় গণ আন্দোলন যার প্রভাব সারা কাছাড়ে সর্বস্তরের জনগণের কাছে ছড়িয়ে পড়েছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী দিনে উপত্যকা জুড়ে যে বস্ত্রসংকট, লবন সংকট, কেরোসিন সংকট, খাদ্য সংকট নিয়ে হাহাকার সৃষ্টি হয়েছিল এর সঙ্গে শরণার্থীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ, উদাসীনতা, ছাত্রদের সরকারি বৃত্তি প্রদানে সরকারি বিধিনিষেধ, ভূ- আবাসন, জমিবন্টন ইত্যাদি ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণ–সবকিছুরই বিরুদ্ধে জমে ওঠা ক্ষোভ একযোগে ভাষা আন্দোলনে প্রতিফলিত হয়েছিল, আন্দোলনটি হয়ে উঠেছিল সর্বাত্মক।
উনিশে মে ছিল সর্বাত্মক বন্ধের দিন। সকাল ছ’টার আগেই তারাপুর রেলস্টেশনে সত্যাগ্রহীরা রেললাইন অবরোধ করে বসেছিল। পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ ছিল এ ধর্ণা। কিন্তু দুপুর ২.৩৫ মিনিটে বিনা প্ররোচনায় পুলিশের গুলি চালনা এগারোটি তাজা প্রাণ ছিনিয়ে নিল।