এ পর্বটিতে যা জানতে পারবেন —
এই পর্বটিতে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ এবং ব্যাকরণ পরম্পরার একটি প্রাথমিক ধারণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ব্যাকরণের কতকগুলি প্রাথমিক সমস্যার দিকেও আলোকপাত করা হবে। সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণের সঙ্গে বাংলা ব্যাকরণের সম্পর্কও আলোচিত হবে। এটা প্রয়োজনীয় এ জন্যেই যে আমাদের কয়েকজন বিশিষ্ট বৈয়াকরণ এবং ভাষাচিন্তকের অভিমত হচ্ছে, আমাদের স্কুলপাঠ্য যেসব বাংলা ব্যাকরণ রচিত হয়েছে এগুলো মূলত ‘সংস্কৃতঘেঁষা মুগ্ধবোধ প্রভাবিত, আর কিছু ইংরেজি ব্যাকরণ প্রভাবিত। কিছু উভয়ের মিশ্রণে জগাখিচুড়ি।’ (জ্যোতিভূষণ চাকী, বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, ভূমিকা) বাংলা ভাষার ব্যাকরণ যে পুরোপুরি বাংলা ব্যাকরণ হয়ে ওঠেনি এটা মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, এমনকী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও অভিমত। বাংলা ব্যাকরণ বলে যা দিয়ে আমাদের স্কুল কলেজের কাজটুকু চালিয়ে নেওয়া হয়, তা মূলত সংস্কৃত ব্যাকরণই। অথচ কালের বিবর্তনে বিভিন্ন ভাষিক উপাদান আত্মস্থ করে বাংলা ভাষা যে একটা নিজস্ব চরিত্রলক্ষণ নিয়েই আত্মপ্রকাশ করেছে এটা অস্বীকার করার জো নেই। জ্যোতিভূষণ চাকী মহাশয়ের একটি উদ্ধৃতি দিলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে-। তিনি বলেছেন-
‘পাণিনি থেকে বিদ্যাসাগর- সংস্কৃত ব্যাকরণের এই ধারাটি আড়াই হাজার বছরের, আর মনোএল থেকে সুনীতিকুমার বাংলা ব্যাকরণের এই ধারাটি আড়াইশো বছরের। প্রথম ধারাটির কাছে দ্বিতীয় ধারাটি ঋণী, তবু তা স্বতন্ত্র খাতে বয়ে চলতে চেয়েছে নিজের প্রাণশক্তিতে ।’
‘প্রকৃত বাংলা ব্যাকরণ একখানিও প্রকাশিত হয় নাই। সংস্কৃত ব্যাকরণের একটু ইতস্তত করিয়া তাহাকে বাংলা ব্যাকরণ নাম দেওয়া হয়।’
উনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্ব থেকে ভাষা, ভাষাতত্ত্ব ব্যাকরণ ইত্যাদি নিয়ে প্রবন্ধ লিখতে থাকেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, বসন্তরঞ্জন রায়, বিধুশেখর শাস্ত্রী এবং হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, বীরেশ্বর পাল, চারুচন্দ্র ঘোষ সুরেশচন্দ্র সমাজপতি, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত আর, সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণ, যোগীন্দ্রনাথ বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এদের অনেকে আবার ছিলেন প্রাচীনপন্থীও যাঁরা ‘সংস্কৃতের আধিপত্যে আস্থা রাখতেন’ (সুশান্ত কর, আকাদেমি পত্রিকা। ব. উ. ব. সা. স., ২০১৬)। তবে নব্য চিন্তাধারার অগ্রদূত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘শব্দতত্ত্ব’ (১৯১৫), ‘বাংলা ভাষা পরিচয়’ (১৯৩৮) এ দুটো গ্রন্থে তাঁর ভিন্নতর এ পরিচয়টি প্রতিষ্ঠা করেন যে, তিনি বাংলার অন্যতম ভাষা-বিজ্ঞানীও বটে। ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ODBL গ্রন্থের মুখবন্ধেও রবীন্দ্রনাথের এ পরিচয়টির কথা উল্লেখ করেন। আর সুকুমার সেন নির্দ্বিধায় বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথকে বাঙালি ভাষা বিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রথম বলিতেই হয়’। এ হেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুখ দিয়েই উচ্চারিত হয়, ‘প্রকৃত বাংলা ব্যাকরণ একখানাও লেখা হয় নাই’।
“বাঙ্গালা ভাষায় কিছু কম আড়াই শত বাঙ্গালা ব্যাকরণ লিখিত হইয়াছে। গত দশ বৎসরের মধ্যেই ইহাদের অধিকাংশ প্রাদুর্ভূত হইয়া বঙ্গীয় বালকগণের মস্তিষ্ক বিকৃত ও তাহাদের অভিভাবকগণের পয়সা অপহরণ করিতেছে। এতগুলো ব্যাকরণ বাহির হইয়াছে বলিয়া বাঙ্গালীর গৌরব করিবার কিছুই নাই; কারণ, সমস্ত বাঙ্গালা ব্যাকরণগুলিই দুই শ্রেণির লোক কর্তৃক দুই প্যাটেন্টে প্রস্তুত হইতেছে: একটি মুগ্ধবোধ প্যাটেন্ট- গ্রন্থকার পণ্ডিতগণ, আর একটি হাইলি-প্যাটেন্ট- গ্রন্থকার মাস্টারগণ।... বাঙ্গালাটা যে একটা স্বতন্ত্র ভাষা, উহা পালি, মাগধী, অর্ধমাগধী, সংস্কৃত, পার্সি ইংরেজি প্রভৃতি নানা ভাষার সংমিশ্রণে উৎপন্ন হইয়াছে যে কথা একবারও ভাবেন না।”
এ কথাগুলো মনে রেখেই বর্তমান পাঠক্রমে প্রথানুগ ব্যাকরণের ধারাবাহিকতায়ই বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব, শব্দতত্ত্ব, পদতত্ত্ব, বাক্যতত্ত্ব এখানে সহজবোধ্য ভাষায় উপস্থাপন করা হবে।
বাংলা ব্যাকরণ কী এর উত্তর সন্ধানে যাবার আগে একটু ধারণা করে নেওয়া প্রয়োজন, ‘ব্যাকরণ’ বলতে আমরা কী বুঝি, এবং ভাষার সঙ্গে ব্যাকরণের সম্পর্কটাই বা কী?
সাধারণভাবে এর উত্তরে বলা চলে, যে-অনুশীলন মানুষের মুখের এবং লেখার ভাষাকে বর্ণনা অর্থাৎ বিশ্লেষণ করে এবং ধ্বনি, শব্দ আর বাক্য সংগঠনের মধ্যে একটা নিয়মের অনুসন্ধান করে এবং এরপর সচেতনভাবে এর একটা বিধিবদ্ধ রূপ দেবার চেষ্টা তা'ই ব্যাকরণ।
‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ প্রণেতা হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ব্যাকরণ হল ‘ব্যাখ্যান’ স-বিস্তার বর্ণন’। (বঙ্গীয় শব্দকোষ, পৃ৽ ১৬৩৮) তিনি আরও সংযোজন করেছেন, ‘যাহা দ্বারা বা যাহাতে প্রকৃতিপ্রত্যয়ভেদে শব্দ ব্যুৎপাদিত হয়’ তাহাই ব্যাকরণ।
এটা অবশ্যই স্বীকৃত সত্য-ভাষা আগে, ব্যাকরণ পরে। ভাষা চলে তার নিজস্ব নিয়মে, ব্যাকরণ তাকে অনুসরণ করে, নিরীক্ষণ করে তার স্বরূপ, গতিপ্রকৃতি এবং এর মধ্যে একটা কার্যকারণ সূত্রের অনুসন্ধান চালিয়ে যায়। অর্থাৎ ব্যাকরণ ভাষার ‘নিজস্ব নিয়ম’টিকে বোঝার চেষ্টা করে। এ পর্যন্ত ব্যাকরণের একটি রূপ, তা হ’ল নির্মোহ দৃষ্টিতে ভাষার গতিপ্রকৃতি লক্ষ করে যাওয়া। কিন্তু সভ্যতা বিকাশের দ্বিতীয় পর্যায়ে এসে ব্যাকরণের ভূমিকারও ঘটেছে রূপান্তর। ব্যাকরণ আর নিছক পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব নিয়ে তৃপ্ত নয়, সে ভাষার উপর কর্তৃত্ব করতেও চায়, অর্থাৎ ব্যাকরণ এক পা এগিয়ে তার লব্ধ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নির্মিত একটি সুনির্দিষ্ট বিধি দ্বারা ভাষাপ্রবাহকে শৃঙ্খলিত করতেও চায়। এ প্রক্রিয়াটি নেহাৎ অর্বাচীন নয়, পাণিনি-পতঞ্জলির যুগ থেকে ঊনবিংশ শতকের বঙ্গদেশ হয়ে সাম্প্রতিককালেও এ ধারা প্রবহমান। দেশে দেশে, যুগে যুগে ভাষাপ্রবাহের এই স্বতঃস্ফূর্ত বিচরণ আর ব্যাকরণের শৃঙ্খল পরানোর প্রয়াস- এ নিয়েই ভাষার অগ্রগতি, অধোগতি এমনকি বিলুপ্তিও। বৈয়াকরণদের চোখ রাঙানির উত্তরে ভাষার নিজস্ব অভিমতটি রবীন্দ্রগানের একটি কলিতে নিহিত- ‘ আমারে বাঁধবি তোরা সেই বাঁধন কি তোদের আছে ’। অর্থাৎ অনুশাসনিক বা নির্দেশক (normative) ব্যাকরণ বলে একটি ব্যাকরণের ধারা রয়েছে যে ভাষাকে একটি নির্দিষ্ট প্রণালীতে চালাতে চায়। কিন্তু ভাষা এ অনুশাসন মানতে নারাজ, তার স্বপক্ষে রয়েছে নিরপেক্ষ ব্যাকরণ যাকে বলা হয় বর্ণনাত্মক ব্যাকরণ।
বাংলা ভাষায় (যে কোনও জীবন্ত ভাষায়ও) প্রতিনিয়তই আমরা এমন সব শব্দ, বানানরীতি, বাক্যগঠন, অর্থসম্প্রসারণ বা সঙ্কোচনের উদাহরণ পাই আমাদের মন সবসময় তা মানতে চায় না। সন্দেহ জাগে এতে ব্যাকরণের কি অনুমোদন আছে? যে-শব্দটি এখানে ব্যবহৃত হয়েছে তা কি অভিধান-স্বীকৃত? কারণ আমাদের মনে অনুশাসনিক ব্যাকরণের অভিঘাত ক্রিয়াশীল। অথচ চারটি দশক আগে যে শব্দ, বাক্য, বানান স্কুল কলেজের শিক্ষকদের নাসিকা কুঞ্চনের কারণ হত আজ তা অবলীলাক্রমে উত্তরপত্রে স্বীকৃতি পাচ্ছে। যে বিদেশি কিংবা প্রাদেশিক বা ঔপভাষিক শব্দপ্রয়োগকে ভাষার আভিজাত্য ক্ষুণ্ণ হওয়ার কারণ বলে বিবেচিত হ’ত, আজ তা ভাষার স্বতঃস্ফূর্তির লক্ষণ বলে প্রশংসিত। এ সময়ের অন্যতম বাংলা ব্যাকরণবিদ জ্যোতিভূষণ চাকী বলছেন- “ব্যাকরণের মতো নিরপেক্ষ তো কেউ নেই। তাকে শালিস মানলে সে বলবে, ‘ আমার হাঁ-ও নেই, না-ও নেই। তোমরা যা বলছ বা লিখছ আমি তার রহস্যটাকে ধরবার চেষ্টা করছি মাত্র।”
আমাদের অভীষ্ট হ’ল বাংলা ব্যাকরণ কী ? ইতিপূর্বেই আমরা একটা অমোঘ বাক্য স্মরণে এনেছি, ‘প্রকৃত বাংলা ব্যাকরণ একখানিও প্রকাশিত হয় নাই’। বাক্যটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। আসলে বাংলা ব্যাকরণ নামাঙ্কিত যে সমস্ত বই বাজারে রয়েছে, এগুলো হ’ল বাংলা ভাষা শেখার বই, এরকম অভিমত প্রকাশ করেন বাংলার মনীষী রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী। তাঁর মতে... ‘আমি ব্যাকরণ নামে যে বিজ্ঞান-শাস্ত্রের উল্লেখ করিতেছি, তাহার উদ্দেশ্য ভাষা শিখান নহে। উহার উদ্দেশ্য নিজে শেখা। ভাষার ভিতর কোথায় কী নিয়ম প্রচ্ছন্নভাবে রহিয়াছে, তাহাই আলোচনা দ্বারা আবিষ্কার করা। আগে সেই নিয়ম আবিষ্কার করতে হইবে...।’ [‘বাঙ্গালা ব্যাকরণ’, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রণীত (১৩৪২) গ্রন্থের ভূমিকায় উদ্ধৃত গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধের পরবর্তী অংশটুকু এখানে উদ্ধার করা যাক :
বাংলা ভাষার সেই ব্যাকরণ এখনও রচিত হয় নাই, কেননা বাঙ্গালা ভাষার মধ্যে কি নিয়ম আছে না আছে তাহার কেহই আলোচনা করেন নাই।... এখন যাহাকে বাঙ্গালা ব্যাকরণ বলা হয়, উহা বাঙ্গালা ব্যাকরণ নহে। বাঙ্গালা ভাষা সংস্কৃতের নিকট যে অংশ ঋণ স্বরূপ গ্রহণ করিয়াছে, সেই অংশের ব্যাকরণ। উহা সংস্কৃত ব্যাকরণ; বাঙ্গালা ব্যাকরণ নহে। বাঙ্গালার যে অংশ সংস্কৃত হইতে ধার করা নহে, যে অংশ খাঁটি বাঙ্গালা, সে অংশের ব্যাকরণ নাই। সেই অংশের ব্যাকরণ গড়িতে হইবে; খাঁটি বাংলার আলোচনা করিয়া তাহাকে খাড়া করিয়া তুলিতে হইবে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ধারণাটির মধ্যে একটা অস্বচ্ছতা বিদ্যমান। সে অর্থে প্রকৃত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ আজও অধরা রয়েছে। ভাষাবিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৩৪২ বঙ্গাব্দ (১৯৩৫) সালে ‘ভাষা ও ভাষা শিক্ষার্থীদের জন্য রচিত ব্যাকরণ বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘... শ্রীযুক্ত যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি মহাশয়ের ব্যাকরণ যে একটি খাঁটি বাঙ্গালা ব্যাকরণ তাহা সকলেরই স্বীকার করিতে হইবে। কিন্তু তাহা পূর্ণাঙ্গ নহে।’
এত কথার পরও প্রথম প্রশ্নটির উত্তরে যাওয়া হয়নি- বাংলা ব্যাকরণ কী? অবশ্য এরও সহজ উত্তরটি দিয়েছেন জ্যোতিভূষণ চাকী মহাশয়। তিনি বলেছেন-
‘যে-ব্যাকরণ বাংলাভাষার ধ্বনি, শব্দ, পদ ও বাক্য ইত্যাদির বিশ্লেষণ করে ভাষার স্বরূপটিকে তুলে ধরে তাকেই আমরা বাংলা ব্যাকরণ বলতে পারি।’ (বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, কলিকাতা- ১৯৯৬)
এখন সঙ্গত কারণেই অনুসন্ধিৎসা জাগবে, বাংলা ভাষাতত্ত্ব বা ভাষাবিজ্ঞানের চর্চা এবং বাংলা ব্যাকরণ ও অভিধান রচনার পরম্পরাটা কী?
বাংলা ভাষাচিন্তার প্রথম বইটি অবশ্য ১৭৪৩ খ্রিস্টাব্দ পর্তুগালের রাজধানী থেকে প্রকাশিত হয়। বইটি ছাপা হয়েছে রোমান হরফে। পর্তুগিজ পাদ্রি মনোত্রল দ্য আসসুম্পসাউ রচিত বইটির নাম, ‘ভোকাবুলারিও এম ইন্দিওমা বেনগল্লা’ । এরপর ১৭৭৮ সালে প্রকাশিত হয় নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেডের ইংরেজিতে লেখা বই, ‘A Grammar of the Bengal Language’। এর বছর দশেক পরে ১৭৮৮ সালে লন্ডনে প্রকাশিত হয় জনৈক অজ্ঞাত নামা সংকলকের ‘The Indian Vocabulary’। এরপর ১৭৯৩ সালে প্রকাশিত হয় ‘ইঙ্গরাজি ও বাঙ্গালী বোকাবুলারি’, প্রকাশক ‘আপনজন’। এ পর্যায়ে আরেকটি উল্লেখযোগ্য বই হল হেনরি পিটার ফরস্টারের ‘A Vocabularim In two parts English and Bengali and Vice Versa এ সবক’টি বইই বিদেশিদের লেখা। এদের ধারাবাহিকতায়ই আত্মপ্রকাশ করে উইলিয়ম কেরি এবং শ্রীরামপুরের আরও কয়েকজনের বাংলা ব্যাকরণ চর্চার ধারা। উইলিয়ম কেরির দীর্ঘ শিরোনামের বইটি দুইখণ্ডে প্রকাশিত হয় ১৮১৫ এবং ১৮২৫ সালে। বইটি নাম, ‘A Dictionary of the Bengali Language, in which the words are traced to their origin, and their various meanings given’। ১৮২৭ সালে প্রকাশিত হয় John Marshman-এর বই। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন ১৮৭২ সালে জন বিমসও একখানা বাংলা ব্যাকরণ লিখেছিলেন, এবং ১৮৯৮ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি নিবন্ধে এর কিছু ভ্রান্তির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণও করেন। (‘বীমসের বাংলা ব্যাকরণ’, শব্দতত্ত্ব, রচনাবলী ষষ্ঠখণ্ড, পৃ৽ ৬১৩) [বিস্তারিত দেখতে ‘আকাদেমি পত্রিকা’ খণ্ড ৬ সংখ্যা ৬, ভাষা আকাদেমি, বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনে প্রকাশিত সুশান্ত করের নিবন্ধ ‘বাংলা ভাষাবিদ্যা চর্চার আড়াই শতক]। রাজা রামমোহন রায় ১৮২৬ সালে ইংরেজিতেই ব্যাকরণ লিখেছিলেন। এরপর ১৮৩৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’, যে-বইটি বাঙালির লেখা প্রথম বাংলা ব্যাকরণ হিসেবে স্বীকৃত।
গৌড়ীয় ব্যাকরণের পর বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেছেন ব্রজকিশোর গুপ্ত, শ্যামাচরণ শর্মা, শ্যামাচরণ সরকার, লোহারাম শিরোরত্ন, রাজেন্দ্রলাল মিত্র এরা।
আমরা ইতিপূর্বেই হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রসঙ্গ আলোচনা করেছি, এরপর আধুনিক যুগে বাংলা ভাষাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। প্রথমজন ইংলন্ডে এবং দ্বিতীয়জন ফ্রান্সে ভাষাবিজ্ঞানে পাঠ নিয়ে বিশেষ ডিগ্রি লাভ করেছেন। সুনীতিকুমারের Origin and Development of the Bengali Language (সংক্ষেপে ODBL) প্রকাশিত হয় ১৯২৬ সালে। ডক্টর মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ভাষাতত্ত্ব বিষয়ক অনেক গ্রন্থ রচনা করেন, বাংলা আঞ্চলিক ভাষার অভিধানও তাঁর বিশেষ কীর্তি। তাঁর ‘বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ প্রকাশিত হয় ১৯৩৫ সালে। তাছাড়াও ১৯৩৯ সালে সুকুমার সেন লিখেন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ, ‘ভাষার ইতিবৃত্ত’।
বাংলা ভাষাবিজ্ঞান চর্চায় বাহান্নর ভাষা আন্দোলন-পরবর্তী পূর্ব-পাকিস্তান বিশেষ অবদান রাখে। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের School of Oriental And African Studies ,এ ভাষাতত্ত্ব গবেষণার পাঠ নিয়ে আসেন মুহম্মদ আব্দুল হাই। তাঁর A Study of Nasals and Nasalisation in Bengali বইটি ধ্বনিবিজ্ঞানে যে সব বাঙালি গবেষকদের উৎসাহী করেছিল, এদের অন্যতম হলেন মুনির চৌধুরী। তাছাড়াও ১৯৮৪তে হুমায়ুন আজাদ সম্পাদনা করেন বৃহদায়তন প্রবন্ধ সংকলন (প্রাচীন ও আধুনিক কালের), ‘বাংলা ভাষা’। সে সঙ্গে প্রকাশ করেন ‘বাক্যতত্ত্ব’ও। ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রফিকুল ইসলাম প্রকাশ করেন ‘ভাষাতত্ত্ব’।
এপারে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পরেশচন্দ্র মজুমদার, বিজনবিহারী ভট্টাচার্য, দ্বিজেন্দ্রনাথ বসু, নির্মল দাশ, মৃণাল নাথ, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশির দাশ, হায়দরাবাদের প্রবাল দাশগুপ্ত এবং পবিত্র সরকার এদের হাতে বাংলা ভাষাতত্ত্ব ও ব্যাকরণের আধুনিকত্বে উত্তরণ ঘটে।
ব্যাকরণ, ভাষাতত্ত্বে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে অভিধানচর্চা, এদিকেও বাংলা ভাষা এগিয়ে আছে। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের ‘বাংলা ভাষার অভিধান’ (১৩২৩), হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ (১৩৪০-৫৩), রাজশেখর বসুর ‘চলন্তিকা’ (১৯৩০), শৈলেন্দ্র বিশ্বাসের ‘সংসদ বাংলা অভিধান’ (১৯৫৫)- প্রভৃতি গ্রন্থের পরবর্তী পর্যায়ে ডক্টর মুহম্মদ শহিদুল্লাহ প্রণীত ‘পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’ (১৯৬৫), অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত ‘আঞ্চলিক বাংলা ভাষার অভিধান’ (কয়েক খণ্ডে), বাংলা ভাষাবিজ্ঞানে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। তাছাড়া ২০০৫ সালে আসামের হাফলং থেকে প্রকাশিত হয়েছে বৃহদায়তন গ্রন্থ, ‘বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক বাংলা ভাষার অভিধান ও ভাষাতত্ত্ব’ (১৪১২), লিখেছেন জগন্নাথ চক্রবর্তী। এরপর ২০১১ সালে শিলচর থেকে প্রকাশিত হয়েছে আবিদ রাজা মজুমদারের ‘বরাক উপত্যকার কথ্য বাংলার অভিধান’।
বাংলা ব্যাকরণ-পরম্পরার এ সংক্ষিপ্ত পরিচিতিটি মনে রাখলে আমরা অনুধাবন করতে পারব বাংলা ভাষাবিজ্ঞান কীভাবে সময়ের প্রয়োজনে নতুন বাঁক নিয়ে বর্তমান স্তরে এসে পৌঁছেছে।
মনে রাখুন :