এ পর্বটিতে যা জানতে পারবেন —
প্রতিটি ভাষারই একটি মান্যচলিত (Standard Colloqual) রূপ এবং এর একাধিক আঞ্চলিক রূপ থাকে। বাংলারও তেমনি রয়েছে অনেকগুলো অঞ্চলভিত্তিক, জেলা ভিত্তিক বৈচিত্র্য, যাকে ভাষাতত্ত্বে বলা হয় উপভাষা (dialect)। এ উপভাষার, সঙ্গে মূলস্রোত বা মান্যচলিত বাংলা ভাষার আন্তঃসম্পর্ক এবং সার্বিকভাবে বাংলা ভাষায় এর অবদান, বাংলা শব্দসম্ভারে, শব্দসৃজনে, শব্দসম্প্রসারণে, বাক্য প্রকরণে এবং বাংলা ভাষার সৃজন সম্ভাবনার বিস্তৃতিতে উপভাষাগুলোর ভূমিকা নিয়ে পাঠক্রমের এ পর্ব।
উপ-ভাষা শব্দটির মধ্যেই এর অর্থ নিহিত। একটি বিশেষ ভাষা, যাকে বলা যেতে পারে Main-stream language অর্থাৎ মূল-স্রোত ভাষা। একে কেন্দ্রে রেখে যে নিকটবর্তী কিংবা দূরবর্তী এলাকায় ‘একটি ভৌগোলিক’, কিংবা ‘একটি সাংস্কৃতিক’ ঐক্যভাবনার মধ্যে আবর্তিত হয়ে যে আঞ্চলিক ভাষাটি তৈরি হয় তা’ই উপভাষা, ইংরেজিতে যাকে বলে dialect। এখানে ‘একটি ভৌগোলিক’ শব্দটিও সংশয়ের সৃষ্টি করতে পারে। বিহার-ঝাড়খণ্ড থেকে গাঙ্গেয় সমভূমি, মেঘনা নদীর উত্তরাংশ, আর বরাক-ব্রহ্মহ্মপুত্র-উপত্যকা কিংবা, মেঘালয় যে ‘একটি-ভৌগোলিক অঞ্চল’ তা তো নয়, কিন্তু বাংলা ভাষার বিস্তৃতির সূত্রে এ অঞ্চলটি সামগ্রিকভাবে ‘একটি ভাষিক’ এবং ‘সাংস্কৃতিক অঞ্চল’ হিসেবে গড়ে উঠেছে তা তো সত্যি।
এখানে আরেকটি সংশয়ের অবকাশও রয়ে যেতে পারে এ বিবেচনায় আরও কটি কথা বলা প্রয়োজন। মূলস্রোত ভাষাকে কেন্দ্রে রেখে বা কেন্দ্র করে উপভাষার আবর্তিত হওয়া প্রসঙ্গ। আসলে উপভাষাগুলো তো নিজস্ব নিয়মেই তৈরি হয় নানা আঞ্চলিক বিভিন্নতা নিয়ে। এতে প্রাথমিক পর্বে বোধ হয় কেন্দ্রস্থিত মূলস্রোত-ভাষার প্রভাবের কোনও সম্ভাবনা থাকে না। কেন্দ্রীয় ভাবে কোনও ভাষার প্রভাব বিস্তারের প্রশ্নটি কালের বিচারে অর্বাচীনই। লিখন মাধ্যমের আত্মপ্রকাশ, রাজ-আনুকূল্য বা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়, ব্যবসায়িক কারণে, এবং লিখিত সাহিত্যের উদ্ভবের পরবর্তী স্তরেই ‘একটি ভাষার’ প্রাধান্যের ব্যাপারটি আসে, যাকে আমরা চিহ্নিত করতে পারি মূলস্রোত ভাষা বা কেন্দ্রীয় ভাষা হিসেবে। আজকাল শিষ্টভাষা শব্দটি অচল। কোনও ভাষাকে আজকের মানুষ অশিষ্ট বলতে রাজি নন, তা সে যতই অপরিণত, গ্রাম্য, ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে আবদ্ধ হোক না কেন। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায়ই ঔপনিবেশিক রাজধানী হিসেবে গড়ে ওঠা কলকাতা মহানগরী এবং এর পার্শ্ববর্তী পূর্ব হাওড়া, উত্তর চব্বিশ পরগণা এবং নদীয়ার কথ্যভাষা নিয়ে একটি মান্যচলিত, standard colloqual ভাষার আত্মপ্রকাশ ঘটে, যে-ভাষা একটা আদর্শ ভাষা হিসেবে তৎকালীন বঙ্গভূমির প্রায় সমস্ত অঞ্চলে মান্যতা লাভ করেছে লেখালেখির, শিক্ষা এবং প্রশাসনের ক্ষেত্রে একটি ফর্মাল (formal) ভাষা হিসেবে। অবশ্য ঘরে বাইরে, প্রাত্যহিক জীবনযাপনে এর স্বতন্ত্র আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য বজায় থাকে।
এ প্রক্রিয়াটি পৃথিবীর অন্যত্র তো বটেই, ভারতবর্ষের প্রদেশে প্রদেশে বিদ্যমান। আসামে নলবাড়ি, বড়পেটা, কামরূপ, লখিমপুর জেলার আঞ্চলিক টান অক্ষুণ্ণ রেখেই বৃহত্তর অসমিয়া জনগোষ্ঠী শিবসাগর জেলার কথ্যভাষার আদলে গড়ে ওঠা মান্য চলিত অসমিয়া ভাষাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিল্প-সাহিত্য-শিক্ষা-প্রশাসনে গ্রহণ করেছেন। উত্তর ভারতে হিন্দি ভাষার অনেক আঞ্চলিক রকমফের রয়েছে, রয়েছে আরবি-ফারসি শব্দে পূর্ণ উর্দু, আর সংস্কৃত তৎসম এবং তদ্ভব শব্দে তৈরি হিন্দুস্তানি। ইংরেজি বা ইউরোপীয় ভাষার প্রসঙ্গ আর ‘না’ই বা টানা হল।
উপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট হল, এক একটি ভাষার আবর্তনে একাধিক উপভাষার অবস্থিতি। এ উপ-ভাষার বাহকরা (Speakers) প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে ওই কেন্দ্রীয় বা মান্যচলিত ভাষাতে কাজ নির্বাহ করেন। এতে দুটো সম্ভাবনা প্রকট- এক, উপভাষাগুলো ক্রমে ক্রমে মূলস্রোত ভাষার চরিত্রলক্ষণ আত্মস্থ করে এই ভাষার সঙ্গে মিশে যাবে, আর দ্বিতীয়টি হল, উপ-ভাষার প্রভাবে মূলস্রোত ভাষায়ও কিছু চরিত্রগত পরিবর্তন সূচিত হবে। বাংলায় বিভিন্ন জেলার ঔপভাষিক গোষ্ঠীর একটি বিরাট অংশ তো মুদ্রিত বই, পত্র-পত্রিকা এবং বৈদ্যুতিন মাধ্যমের প্রভাবে কলকাতার কথ্যভাষাকে আত্মস্থ করতে চাইছেন আঞ্চলিক উচ্চারণ প্রবণতাকে দূর করে। আবার খোদ কলকাতায়ও অনেকে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক গান এমনকি সাজপোশাক, রান্নাবান্নাকে পর্যন্ত আত্মস্থ করে নিতে উৎসাহী। এর প্রভাব সিনেমা থিয়েটার, টিভি সিরেয়েলে তো বটেই, সৃজনশীল সাহিত্য সংগীত কবিতায়ও স্পষ্ট।
তবে উপরের আলোচনা থেকে এটা বোধহয় স্পষ্ট হয়েছে, ভাষাপৃথিবীতে উপভাষার একটা অস্তিত্ব রয়েছে। সেটা বাংলায় যেমন আছে, তেমনি হিন্দি, মারাঠি, ওড়িয়া, অসমিয়ায়ও আছে, আছে বিদেশি ভাষায়ও। আমাদের প্রতিবেশি জনজাতীয় ভাষা নিয়ে এরকম ডায়ালেকটিক্যাল স্টাডি কেউ করেছেন কিনা জানা যায়নি, তবে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা চা জনগোষ্ঠীর অর্থাৎ মুন্ডারি, ঝাড়খন্ডি, সাওতালিদের কথ্য ভাষায় বিভিন্নতা সাধারণ শ্রোতার কাছেও ধরা পড়ে।
আমরা এ প্রাথমিক আলোচনাটির সমাপ্তিতে উপভাষাকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করব। তবে আগে দেখে নিই Advance Learners’ Dictionary (7th Edition, 2005, P 420)-তে ডায়লেক্ট সম্পর্কে কী বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে ‘The form of language that is spoken in one area with grammar, words and pronunciation that may be different from other forms of the same language’। অর্থাৎ এলাকা অনুযায়ী একটি ভাষার গড়ে ওঠা Variety (বৈচিত্র্য) ই সে-ভাষার উপভাষা। এ উপভাষাগুলো শব্দগত, উচ্চারণগত এমনকি ব্যাকরণগত ভাবেও মূলভাষা থেকে ভিন্ন হতে পারে। ‘আসলে কোনও উপভাষা হল একটি ভাষার ভৌগোলিক রূপভেদ’ যেমন বলেছেন জ্যোতিভূষণ চাকী (বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, পৃ. ১৮)। কোনও জনগোষ্ঠীর লোকসংখ্যা যত বৃদ্ধি পাবে, জনবসতি যত-বিস্তৃত হবে ততই তাদের ভিন্ন উপভাষা তৈরি হবে, যেমন হয়েছে বাঙালির, বিহারির এবং অন্যান্য জনগোষ্ঠীর। সে অবশ্য স্বতন্ত্র আলোচনার বিষয়। আমরা আপাতত এখানেই থামব এ কথাটি স্মরণে রেখে যে, যেখানে ভাষা আছে সেখানে উপভাষাও আছে, সেটা খোদ কলকাতা বা লন্ডন নগরেই হোক বা হোক না কোনও শিল্পনগরী অথবা শিল্পাঞ্চল। উত্তর কলকাতা যদি এক ধরনের বাংলা বলে, তো দক্ষিণ কলকাতার ভাষা অন্যরকম, ইস্ট-লন্ডনার্সের কথ্যভঙ্গি ওয়েস্টানার্স থেকে আলাদা, দুর্গাপুর স্টিল কলোনির ভাষার থেকে নর্থ-ফ্রন্ট রেলওয়ে কলোনির বাঙালির ভাষায় বিস্তর তফাৎ। আর এ তফাৎই হল উপভাষা।
পরিশেষে এ প্রসঙ্গটিও ছুঁয়ে যাওয়া প্রয়োজন, আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানে Dialect - এর স্থলে Co-language এর ব্যবহার সুপারিশ করছে। এ সূত্রে বাংলায় আমরা উপভাষার স্থলে সহভাষা বা ভাষাবৈচিত্র্য শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করব কি না তা আগামী দিনের পণ্ডিতবর্গই স্থির করবেন।
A specific form of a given language, spoken in a certain locality of geographic area, showing sufficient difference from the standard or literary form of that language as to pronunciation, grammatical consideration and idimatic usage of words, to be considered a distinct entity, yet not a sufficiently distinct from other dialects of the language to be regarded as a different language.
বাংলা ভাষার পাঁচটি ভুবনের চারটি ছড়িয়ে আছে ভারতীয় উপমহাদেশে আর পঞ্চমভুবনটি ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকায় বাঙালিদের তৈরি। এ পাঁচটি ভুবনেরই এক একটা নিজস্ব চরিত্রলক্ষণ রয়েছে যা মূলভাষার সঙ্গে একটা ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ থাকলেও অপরাপর অঞ্চলের ভাষা থেকে নানাভাবে ভিন্ন। এই আঞ্চলিক বৈচিত্র্য, যাকে আমরা ঔপভাষিক বৈচিত্র্য বলি এ নিয়ে ভাষাবিজ্ঞানীরা গত কিঞ্চিদধিক একশো বছর ধরে নানা অনুসন্ধানমূলক কাজ করে আসছেন। সবাই যে এসব ক্ষেত্রে একমত তাও নয়, তবু এদের সবার আলোচনার নির্যাস নিয়ে আমরা বাংলার উপভাষার চরিত্রগত এবং অঞ্চলভিত্তিক ধারণা করে নিতে পারি।
ইংরেজ প্রশাসক-পণ্ডিত জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ার্সন (১৮৫১-১৯৪১) ১৮৯৮ সালে Linguistic Survey of India-এর দায়িত্ব প্রাপ্ত হন এবং ১৯২৮ পর্যন্ত ভারতীয় ভাষা নিয়ে সমীক্ষা করে ১৭৯টি ভাষার তথ্য সংগ্রহ করেন এবং দেশের পাঁচটি ভাষাপরিবারের মধ্যে ৫৪৪টি উপভাষাকে সনাক্ত করেন। ১১টি খণ্ডের ২০টি পর্বে, তাঁর এ প্রকল্পের ফলাফলটি প্রকাশ হয়। ১৯০৩ সালে প্রকাশিত পঞ্চম খণ্ডের প্রথম পর্বে (Volume V, Part I, 1903) তিনি বাংলার-উপভাষার পরিচয় তুলে ধরেন এবং এতে তিনি ৪০টির মতো উপভাষাকে চিহ্নিত করেন বাংলার উপভাষা হিসেবে। তিনি বাংলার উপভাষাকে নিম্নলিখিত ভাগে বিভক্ত করেন : -
তাঁর বিচারে মান্যচলিত ভাষাটিই ওই কেন্দ্রীয় উপভাষার পর্যায়ভুক্ত।
এর পরবর্তী পর্যায়ে যাঁরা বাংলা উপভাষা নিয়ে কাজ করেছেন এদের মধ্যে অন্যতম হলেন I.J.S Taraporewala (Elements of the Science of istics, Calcutta University, 1920), সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় (ODBL, 1926; ‘বাঙ্গালা ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা’, ১৯৬২)। এবং সুকুমার সেন (‘ভাষার ইতিবৃত্ত’ ১৯৬৫)। সুকুমার সেন বাংলা উপভাষাকে পাঁচটি গুচ্ছে ভাগ করেছেন : -
উপরে উল্লিখিত রাঢ়ী উপভাষার আওতায় আছে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, হুগলি, হাওড়া, উত্তর চব্বিশ পরগণা, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, নদিয়া, কলকাতা।
ঝাড়খণ্ডী উপভাষা মূলত বীরভূম ও পুরুলিয়ার অংশ, দক্ষিণ পশ্চিম বাঁকুড়া, সিংভূম, ওড়িষার ময়ূরভঞ্জ ও বর্তমান ঝাড়খণ্ডে প্রচলিত।
বরেন্দ্রীর আওতায় আছে মালদা, রাজশাহি, পাবনা, বগুড়া, দক্ষিণ দিনাজপুর।
কামরূপীর অন্তর্গত ভাষা অঞ্চল হল দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, রংপুর, কোচবিহার।
আর বঙ্গালি ভাষা-অঞ্চল হল ঢাকা, ফরিদপুর, খুলনা, ময়মনসিং, যশোর, বরিশাল, সিলেট, চট্টগ্রাম, নোয়াখালি, ত্রিপুরা, পূর্ব নদিয়া, কাছাড়।
প্রথানুগ ভাষাজরিপের এ রূপরেখা ছাড়াও বাংলা ভাষার উপভাষাকে আরো অন্য দৃষ্টিকোন থেকেও চিহ্নিত করা সম্ভব এবং অনেক ভাষাবিজ্ঞানীরা তাও করেছেন। গোপাল হালদার (A Comparative Grammar of East Bengali Dialects, 1986) এবং (Bengali and other relative Dialects of South Assam, 1995) সিলেটি উপভাষাকে একটি স্বতন্ত্র পরিসর দিয়েছেন। এরপর প্রথমে জগন্নাথ চক্রবর্তী প্রণয়ন করেছেন ‘বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক ভাষার অভিধান ও ভাষাতত্ত্ব (২০০৫), আর অতঃপর আবিদরাজা মজুমদার লিখলেন, ‘বরাক উপত্যকার কথ্য বাংলার অভিধান, (২০১১)। তাছাড়াও জন্মজিৎ রায় লিখেছেন গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ, ‘সিলেটি উপভাষা: ঐতিহাসিক ও ভাষাতাত্ত্বিক পরিপ্রেক্ষিত’ (১৯৯৬)। এসব নিয়ে বাঙ্গালি উপভাষাগুচ্ছের অন্যতম উপভাষা হিসেবে সিলেটির স্বীকৃতি যেমন মিলেছে তেমনি দেশবিভাগ পূর্ববর্তী সিলেট-কাছাড় নিয়ে আরেকটি বাংলা ভাষা-অঞ্চলের পরিচিতিও স্পষ্ট হয়েছে, যে-অঞ্চলটিকে সিলেট-কাছাড় বলাও যায়, আবার বরাক উপত্যকাও বলা যায় (যার মধ্যে কাছাড়-হাইলাকান্দি এবং করিমগঞ্জ রয়েছে) যার সঙ্গে অবশ্য সীমান্তের ওপারের ঔপভাষিক অঞ্চল সিলেটের নিবিড় সম্পর্কও বিদ্যামান।
কেবলমাত্র ভৌগোলিক অঞ্চলের নিরিখেই নয়, উপভাষাকে বৃত্তি বা সামাজিক শ্রেণীর উপর ভিত্তি করেও বিভাজিত করা হয় আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানে যেমন- অপরাধ জগতের ভাষা, মৎস্যজীবীদের ভাষা, শিল্পশ্রমিকদের, টুলোপণ্ডিত বা মাদ্রাসা-মৌলবিদের ভাষা, পুলিশি ভাষা, ড্রাইভারদের ভাষা ইত্যাদি। এ প্রত্যেকটি ভাষার নিজস্ব শব্দ, (সাংকেতিক বা গোপন), প্রকাশভঙ্গি, উচ্চারণভঙ্গি রয়েছে যা নিয়ে ভাষা-গবেষকরা অনেক কাজও করেছেন এর মধ্যে বাংলার পবিত্র সরকার অন্যতম (লোকভাষা লোক সংস্কৃতি, ২০০৩)।
এটা ইতিমধ্যে আলোচিত হয়েছে যে একটি সচল ‘জীবন্ত ভাষার’ এক বা একাধিক উপভাষা থাকবেই। Wakelin, Martyn Francis তাঁর Discovery of English Dialects (2008) গ্রন্থে লিখেছেন, উপভাষা হল ‘Subforms of language which are in general, mutually comprehensible’ (P-4)। এই Sub-forms গুলো সহ-উপভাষার কথকরা মোটামুটি বুঝতেও পারেন। যেমন সিলেটির মুখের ভাষা ঢাকা জেলার মানুষের বুঝতে খুব অসুবিধা হয় না, তেমনি বাঁকুড়া-বীরভূমের ভাষা নদিয়ার মানুষেরও বুঝতে অসুবিধা হয় না, কারণ দুটো উপভাষাই মূলস্রোত বাংলার সঙ্গে একসূত্রে গাঁথা। আসল কথা হল উপভাষাই মূলভাষাকে এর প্রাণরসের যোগান দেয়। এটা হল মূলভাষার feeder language । এর মাধ্যমেই মূল ভাষায় আসে নতুন শব্দসম্ভার, ঘটে শব্দের রূপান্তর, প্রকাশ-সম্ভাবনার সম্প্রসারণ। উপভাষার প্রবাদ প্রবচন, শব্দের বিশিষ্টার্থক প্রয়োগ, নিত্য নতুন ব্যঞ্জনা ক্রমে মূল ভাষার সঙ্গে মিলিত হয়ে ভাষাকে সমৃদ্ধ করে। এ হল উপনদীর মতোই যার কাজ মূল নদীর খাতকে জলের যোগান দিয়ে সমৃদ্ধ এবং সচল রাখা। যে-ভাষার কোনও উপভাষা নেই সে ভাষা হল মৃত, অথবা অবলুপ্তির দিকে অগ্রসরমান।
যে-ভাষাকে আমরা মূলস্রোত বা মান্যচলিত ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করি এ ভাষার প্রধান অবলম্বন অবশ্যই ছাপাখানা এবং ছাপা হয়ে বেরিয়ে আসা বই, পত্রপত্রিকা ইত্যাদি। সে সঙ্গে রয়েছে রেডিও, টিভি এবং সিনেমাও। এতে নানা ঔপভাষিক উপাদান মিশেই ভাষাকে একটা ফর্ম্যাল অর্থাৎ পোশাকি অবয়ব দেয়। এ ভাষাকে আবার একটা সময় শিষ্টভাষাও বলা হত। কিন্তু এ শব্দের প্রয়োগটা খুব যথাযথ নয়, কারণ চতুষ্পার্শে কথিত উপভাষাকে তাহলে এর বিপরীতে অ-শিষ্টভাষা বলার প্রবণতাটা যুক্তিগ্রাহ্যও নয়।
এ কথাটিও মনে রাখা প্রয়োজন বাংলা শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকৃতির অন্যতম সৃজনভূমি তো পূর্ব এবং পশ্চিমবঙ্গ সহ বঙ্গীয় সংস্কৃতির সম্প্রসারিত অঞ্চলগুলোই, যেসব অঞ্চলকে ঔপভাষিক অঞ্চল হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়। প্রতিট অঞ্চলেরই বাকরীতি, শব্দসম্ভার এবং ওই অঞ্চলের ভাষার রূপতত্ত্ব, ধ্বনিতত্ত্ব- সবকিছুই মূলস্রোত (mainstream) বাংলার সঙ্গে শব্দগত, ব্যাকরণগত একটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক স্থাপন করেছে। ভারতীয় উপমহাদেশের সিলেট-কাছাড় অঞ্চল কিংবা বরাক উপত্যকা বাংলার সৃজনশীলতায় কীর্তন, ভাসান, কথকতা, পাঁচালি, মারিফতি, আউল, বাউল, ফকিরি, মুর্শিদি, আই, ধামাইল, ভাটিয়ালি এবং অজস্র প্রবাদ-প্রবচন, ডিটান, পই এসবের সম্ভার হাজির করছে। ঔপভাষিক অঞ্চলই আসলে মূলস্রোত ভাষার চারণক্ষেত্র। অতএব ভাষাচর্চায় উপভাষাকে গুরুত্ব দেওয়া অতি প্রয়োজন। নাগরিক ধারার কবিতা, নাটক, গান, সিনেমাতে প্রাণসঞ্চার করতে হলে গ্রামবাংলা (গ্রামদেশ) এবং এতে প্রচলিত কথা, গান, সুর ধ্বনির প্রতিফলন ঘটানো প্রয়োজন। মান্যচলিত নাগরিক ভাষায় রচিত সৃজনকর্ম হয়ে থাকবে কৃত্রিম, শিকড়বিহীন টবের ফুল।
গত শতকের প্রথম পর্ব থেকেই বাংলা উপভাষা চর্চা এবং অভিধান প্রণয়ণের সূত্রপাত ঘটে। ১৯২৩ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল থেকে প্রকাশিত হয় অভিধান Vocabulary of Peculiar Bangali words। লিখেছেন এফ পি প্যারজিটার। গ্রিয়ার্সনের লিঙ্গুইস্টিক সার্ভের কথা তো উল্লেখ করতেই হবে, তবে ১৯৬৫ সালে পূর্ববঙ্গের (পাকিস্তান) বাংলা একাডেমী প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক অভিধান একটি মাইলফলকই। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রণীত এ গ্রন্থটির নাম ‘বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান।’ এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ড. অসিতকুমার বন্দোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হয়েছে ‘আঞ্চলিক বাংলাভাষার অভিধান।’ এই দুই আঞ্চলিক অভিধানে পূর্ববঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গের প্রধান ভাষা অঞ্চলগুলো স্থান পেলেও বাংলা ভাষার অন্যতম তৃতীয় ভূমি অর্থাৎ সিলেট-কাছাড় বা বরাক উপত্যকার অন্তর্ভুক্তি ঘটেনি। এ বিবেচনায়ই নিজস্ব প্রয়াসে দুজন ভাষা গবেষক দুখানা গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক অভিধান প্রণয়ন করেন। আগামীতে হয়তো বিহার-ঝাড়খন্ড, আন্দামান বা বাংলাভাষার বিদেশস্থিত অপরাপর ভূখণ্ডে এমনি আরও কিছু কাজ হবে এবং আঞ্চলিক বা উপভাষাচর্চা প্রাতিষ্ঠানিক অ্যাকাডেমিকসের পাঠক্রমেও অন্তর্ভুক্ত হবে।
এখন পর্যন্ত বাংলাভাষায় প্রকাশিত অভিধানগুলোতে মান্যচলিত ভাষার শব্দসম্ভারেরই প্রাধান্য। অবশ্য কিছু কথ্য, স্ল্যাং শব্দও স্থান পেয়েছে, কিন্তু বিভিন্ন ঔপভাষিক অঞ্চলের প্রাকৃত শব্দ এতে সংকলিত করার কোনও প্রয়াস কোথাও পরিলক্ষিত হয়নি। এ জন্যই বাঙালির জনসংখ্যা স্ফীত হলেও বাংলাভাষার অভিধানগুলোর পৃষ্ঠা সংখ্যা ১২৪৬, ১১৯৩, (বঙ্গীয় শব্দকোষ ২ খন্ড), ১০৯৩ (সংসদ, E to B), ১২৫৮ (AT Dev B to E), ৭৩০ (চলন্তিকা)-এর মধ্যেই সীমায়িত। অপরদিকে ইংরেজি অভিধানগুলো প্রকাশ হয় খণ্ডে খণ্ডে (পনেরো-কুড়ি খণ্ডেও)। এর কারণ ওই অভিধানগুলো all inclusive, বিশ্বময় ছড়ানো এ ভাষাপৃথিবী থেকে প্রাপ্ত naturalized শব্দগুলো এতে সংকলিত হয়েছে এবং প্রতিটি নতুন সংস্করণে নতুন শব্দ সংযোজিত হয়ে চলেছে। ১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দে যখন স্যামুয়েল জনসন ইংরেজি অভিধান প্রণয়ন করেন তখন ইংরেজি ভাষাটা ছিল ‘essentially the national property of British’ (Foreword by Heavy Widdowson, Advanced Learers’ Dictionary, 2005)। এর পর ক্রমে ভাষাটির বিস্তৃতি ঘটল বিশ্বের মহাদেশগুলোতে এবং এর ফলশ্রুতিতে 'ইংরেজি ভাষা বলতে এখন বোঝায় ‘an immensely diverse variety of different usages’। প্রাক্-ঔপনিবেশিক পর্বেই স্কটিশ, ওয়েলস, মিডল্যান্ড, কেল্টিক সূত্রে প্রাপ্ত শব্দের অন্তর্ভুক্তি শুরু হয়ে যায় ইংরেজি অভিধানে। সেই ট্র্যাডিশনের সম্প্রসারণ হিসেবেই আজ ইংরেজি ভাষা ঔপনিবেশিক দেশ ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে পরিব্যাপ্ত হয়েছে।
সম্প্রতি বাংলা উপভাষা, আঞ্চলিক ভাষায় রচিত সাহিত্য, বিশেষ করে সংগীত এবং লোকনাট্যের প্রতি যে-আগ্রহ এবং সচেতনতা দেখা যাচ্ছে- এতে বাংলাভাষার অগ্রগতির সম্ভাবনা স্পষ্ট এবং আগামীতে বাংলা জাতীয় অভিধানের স্ফীতি যেমন ঘটবে তেমনি বাংলা ভাষার সৃজনসম্ভাবনার নিত্য নতুন ক্ষেত্রও উন্মোচিত হবে- এটা অবশ্যই আশা করা যায়।
লোকে বলে সিলেটি ‘ভাষা’। আসলে এটা ‘উপভাষা’- ইংরেজিতে যাকে বলে ডায়লেক্ট। একটি মূল ভাষার অন্যতম উপাদানই হল উপভাষা, যাকে আঞ্চলিক ভাষাও বলা হয়। অনেকগুলো অঞ্চলের সমষ্টি যেমন একটি প্রদেশ, কিংবা দেশ, তেমনি অনেকগুলো আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষার সমষ্টিই হল একটি ভাষা, যাকে বলা হয় মান্যচলিত ভাষা। উপভাষা হল মূল ভাষার ‘ফিডার ল্যাঙ্গুয়েজ’ যেখান থেকে শব্দ, পরিভাষা, পদ এবং পদান্তর, নিত্য নতুন প্রকাশভঙ্গি, প্রবাদ-প্রবচন এসে মূল ভাষায় প্রাণরসের যোগান দেয়। উপভাষা বিহীন কোনও ভাষা একটি অবাস্তব ধারণা।
সিলেটি উপভাষা সম্বন্ধে আলোচনায় যাবার আগে কথাটি বলে নেওয়া ভাল, যাঁরা সিলেটি বলেন, অথচ শিষ্ট সমাজে এটা গোপন রাখতে চেষ্টা করেন। (পারেন কি?), এরা সম্ভবত ভাবেন, কিছু একটা অন্যায় করছেন। আসলে এরা বিষয়টিকে সেভাবে দেখেন না যে, ওদের মুখের কথ্য ভাষাটি মূল বাংলারই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। হয়তো জানেনই না যে, এক বা একাধিক কিংবা অসংখ্য উপভাষা-পরিবারের অস্তিত্বই একটি জীবন্তভাষার অন্যতম চরিত্রলক্ষণ। যে-ভাষার কোনও আঞ্চলিক রকমফের নেই, অর্থাৎ উপভাষা নেই, সে ভাষা তো মৃতভাষা। প্রাচীন সংস্কৃত ভাষারও বিভিন্ন আঞ্চলিক রকমফের ছিল। খ্রিস্টীয় প্রথম সহস্রাব্দে যখন এ চরিত্রলক্ষণটি বজায় ছিল, তখনকার সৃজনশীল সাহিত্যে উদাহরণ স্বরূপ ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকে রীতিমত উপভাষার প্রয়োগ আমরা দেখেছি। কিন্তু মধ্যযুগে এ ভাষা তার গতিশীলতা হারিয়েছে। কারণ, ইতিমধ্যে ভাষাটির কোনো আঞ্চলিক উপভাষার ধারা সৃষ্টি হয়নি। কোনও জীবন্ত মানুষের মুখের বুলিতে এ ভাষা চর্চিত হয়নি। তাই ভাষাটি তার সমস্ত ঐশ্বর্য, সৃজনসম্ভাবনা নিয়েও হয়ে পড়েছে গতিহীন, বাংলাভাষা যে একটি জীবন্তভাষা, এর পরিচয় ধারণ করছে ঢাকাই, চাঁটগাইয়া, নোয়াখালি, বরিশালি, কিংবা সিলেটি উপভাষাই। উপভাষার অবর্তমানে সংস্কৃত ভাষার মূলস্রোতের খাতটি শুকিয়ে গেছে। শুকনো গাঙ যেমন রেভিনিউ সেরেস্তার দাগ পাট্টার আশ্রয়ে জীবন্মৃত অবস্থায় টিকে থাকে (আসলে এটা অস্তিত্ববিহীনতাই) তেমনি উপভাষা-বিহীন একটি মৃতভাষারও শেষ আশ্রয় হয় পুথি কিংবা বইপত্র।
একটা গতিশীল, বৈচিত্র্যময়, সচল ভাষার প্রাণপাখিটি রয়েছে ওই ঔপভাষিক অঞ্চলের বুলিতে। নাগরিক মানুষের ছাপানো কেতাবের পৃষ্ঠা, মুদ্রাযন্ত্রে পিষ্ট খবরের কাগজ, ডিস্ক বা সিডি রেকর্ড, টিভির পর্দা, সেলুলয়েভের ফিতা, রেডিওর প্রোগ্রাম কিংবা ওয়েবসাইটে সেই জীবন্ত, সচল ভাষাটি নেই। তাকে এখানে খুঁজেও পাওয়া যাবে না সব সময়। সঙ্গে এ কথাটিও বলতে হয়, উপভাষার যে-বৈচিত্র্য, ভিন্নতা, তা'ই তথাকথিত মূলস্রোত ভাষার ঐশ্বর্য, তার শক্তির উৎস, দুর্বলতা নয়। এটা মান্যচলিত ভাষার বিকৃতি বা স্খলন নয়, মূল ভাষার স্বাভাবিক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
এখন অবশ্য সময় পাল্টেছে। বাঙালির শিল্পসংস্কৃতির রাজধানী কলকাতা কিংবা ঢাকায় নাগরিক শিল্পীরা বাংলার ঔপভাষিক কবিদের পদ গেয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করছেন। সিলেটের দেওয়ান হাসন রাজাকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক আগেই জগৎসভায় প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছেন। সিলেটি জননায়ক-চিন্তাবিদ বিপিনচন্দ্র পাল থেকে আরম্ভ করে হেমাঙ্গ বিশ্বাস, নির্মলেন্দু চৌধুরী হয়ে শাহ করিমের জয়জয়কার তো সর্বত্র। অবশ্য শুধু সিলেটিই নয়, আজকাল সাঁওতালি, দেহাতি গান, কবিতারও সমঝদারি বেড়েছে। আমাদের ভাষাপৃথিবীর এই যে বিস্তৃতির সূচনা -এটা আমাদের উপভাষাচর্চায় নতুন মাত্রা দেবে বইকি। মনে রাখা প্রয়োজন হিন্দি ভাষার আঞ্চলিক রকমফের রয়েছে, এগুলো হিন্দিভাষীরা কখনওই অবহেলা করেন নি, এবং আজকের দিনে এ ভাষার সমৃদ্ধির মূলে এটাও একটা প্রধান কারণ। দিল্লির পাঞ্জাবিঘেঁষা হিন্দি, দক্ষিণের মাদ্রাজি এবং অন্যান্য ভাষার মিশেলে দক্ষিণী-হিন্দি, মুম্বাইয়ের বস্তি অঞ্চলের হিন্দি, বাংলাঘেঁষা হিন্দি, অসমিয়াঘেঁষা হিন্দি, আসামের ডিমা হাসাওয়ে বিভিন্ন জনজাতিদের যোগাযোগের জন্য তৈরি হাফলং-হিন্দি আমাদের সামনে উজ্জ্বল উদাহরণ।
সিলেটি ভাষা নিয়ে আলোচনায় ওই ভাষা-অঞ্চল সম্বন্ধে একটা সাধারণ ধারণা নেওয়াও প্রয়োজন। এ ভাষা-অঞ্চলটি বর্তমান বাংলাদেশের অবিভক্ত সিলেট জেলা ছাড়াও আসামের করিমগঞ্জ এবং কাছাড়, হাইলাকান্দি জেলা অর্থাৎ বরাক উপত্যকা নিয়ে গঠিত। সে সঙ্গে অবশ্য ত্রিপুরা রাজ্যের ধর্মনগর, আসামের নওগা, হোজাই, লঙ্কা প্রভৃতি অঞ্চলেও সিলেটি উপভাষা কথিত হয়, তাই এ অঞ্চলও সিলেটি ভাষা-অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত বলা যায়। তবে কাছাড়ের সিলেটি উপভাষার সঙ্গে সিলেট জেলার ভাষার কিছু পার্থক্য রয়েছে। এ পার্থক্য মূলত উচ্চারণগত।
সিলেটি ভাষা নিয়ে সিলেটের মদনমোহন কলেজের প্রাক্তন উপাধ্যক্ষ প্রণবকুমার সিংহ, (“সিলেটের আঞ্চলিক ভাষা”, এই আঙ্গিনায়: সুবর্ণ জয়ন্তী স্মারকগ্রন্থ, মদনমোহন কলেজ, ১৯৪৩-১৯৯০), বরাক উপত্যকার জন্মজিৎ রায়, (“সিলেটি উপভাষা: ঐতিহাসিক ও ভাষাতাত্ত্বিক পরিপ্রেক্ষিত”, শ্রীহট্ট-কাছাড়ের প্রাচীন ইতিহাস ও সংস্কৃতির রূপরেখা, ১৯৯৬, শিলং) আবুল হোসেন মজুমদার সংক্ষিপ্ত পরিসরেই একটি গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ লিখেছেন (“বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক উপভাষার রূপরেখা”, স্মরণিকা, ১৭তম অধি, ১৪০৩, বউ বসাস, শিলচর)। একটি সম্পূর্ণ অভিধান বলা চলে কোষগ্রন্থই রচনা করেছেন জগন্নাথ চক্রবর্তী, আরেকটি লিখেছেন আবিদ রাজা মজুমদার যা সিলেটি উপভাষা চর্চার প্রতি বিশেষ আগ্রহ সৃষ্টি করেছে এবং বাংলা ভাষার প্রান্তদেশে অবস্থিত এ উপভাষাটিরও সে মূলস্রোত বাংলাভাষার সৃজনশীলতার বিকাশে বিশেষ অবদান যোগানোর ক্ষমতা রয়েছে এ বোধ সাধারণ্যেও প্রতিষ্ঠিত করেছে।
সিলেটি উপভাষা নিয়ে আলোচনা সমাপনান্তে কয়েকটি নমুনা দেওয়া হল, যার মধ্যে এ উপভাষার চরিত্রলক্ষণ ধরা পড়ে।
ব্যাকরণের পদ্ধতি অনুযায়ীই কয়েকটি উদাহরণ : -
এতো গেল ধ্বনি আর উচ্চারণের দিক। ঔপভাষিক অঞ্চলের মানুষের বুলিতে বিশেষণের ভাণ্ডার অফুরন্ত। সিলেটি বিশেষণের বিশেষত্ব হল আরবি-ফারসি শব্দের বাহুল্য :
বাংলা শব্দসম্ভারে আরবি-ফারসি শব্দঋণের অধিকাংশই সিলেটি এবং গ্রাম-কাছাড়ে আকছার ব্যবহৃত। যেমন : -
এখানে কথাটি বলে নেওয়া প্রয়োজন, যে-বাক্যগুলো এখানে দেওয়া হল তা একান্তই গ্রামবরাকে একসময় কথিত হত, বর্তমানে এর পরিবর্তন ঘটে গেছে। আর, সব সিলেটির (বরাক-সুরমা উপত্যকার) মুখে, নাগরিক বা আধা-নাগরিক মানুষের মুখে এ বাক্য পাওয়া যাবে না। কিছু কিছু প্রকাশ ভঙ্গি একান্তই গ্রাম কাছাড়ের কথ্য বুলি থেকে নেওয়া।
এবারে দেখা যাক ফারসি শব্দের মিছিল : -
ইংরেজি শব্দ সিলেটি তদ্ভব রূপে কী হয়েছে দেখা যাক : -
লজেন্স হয়েছে লেবেঞ্চুস,
গার্জিয়ান হয়েছে গার্জেন্ট।
তেমনি -
মিলিটারি - মেলেটরি,
ব্যারিস্টার - বালেস্টর,
ডিউটি - ডিবটি,
পকেট – পেকেট,
গ্যাসট্রিক - গেসটিং,
প্রেসার - পেসারিং,
পেনসন - পেনসিন।
কয়েকটি সিলেটি প্রবাদ প্রবচনের নমুনা : -