নীড়  দূর-শিক্ষাকেন্দ্র  পাঠ্যপুস্তক  প্রথম পত্র - অধ্যায়: তিন
বাংলা ভাষা ডিপ্লোমা পাঠক্রম
rotateআপনার মুঠোফোনটিকে ল্যান্ডস্কেপে রাখুন
প্রথম ষান্মাসিক - প্রথম পত্র
ইতিহাসের আলোকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য
প্রথম পত্র   ❐   অধ্যায় -  তিন
বাংলা ভাষা প্রাক্‌-আধুনিক যুগে
 
৩.০   উদ্দেশ্য   

এ পর্বটিতে যা জানতে পারবেন —

  1. মধ্যযুগে বঙ্গদেশে বাংলাভাষার অগ্রগতির ধারা
  2. বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের যৌথ ও জীবনচর্যা থেকে উৎসারিত পাঁচালি, কথকতা ইত্যাদির উদ্ভব
  3. বাংলার বৈষ্ণব এবং শাক্তসাহিত্য
৩.১   ভূমিকা

একাদশ-দ্বাদশ শতকে চর্যার যুগের পরবর্তীকালে বাংলা ভাষা সাহিত্যে একটা শূন্যতার অধ্যায়ই বলা চলে। তবে এই সময় তুর্কি অভিযানে বিধ্বস্ত বঙ্গদেশে বাংলা ভাষা একটা নতুন অবয়ব ধারণ করতে শুরু করে। এ পর্বেই আত্মপ্রকাশ ঘটে অনুবাদ সাহিত্যের। রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত অনুবাদ বাংলা ভাষায় নতুন প্রাণ সঞ্চার করে। কৃত্তিবাসী 'রামায়ণ', কাশীরাম দাসের 'মহাভারত' আর মালাধর বসুর 'শ্রীকৃষ্ণবিজয়' বাংলা ভাষার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করে। সেই মধ্যযুগ থেকে আজও বাঙালির ঘরে চর্চিত হয় অমর পঙক্তি :

‘মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।’

অবশ্য কাশীরাম দাসের আগেই চতুর্দশ শতকের শেষ পর্বে কৃত্তিবাস ওঝার ‘রামায়ণ’ বঙ্গদেশে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।

চন্দ্রচূড়-জটাজালে আছিলা যেমতি
জাহ্নবী, ভারত-রস ঋষি দ্বৈপায়ন,
ঢালি সংস্কৃত-হ্রদে রাখিলা তেমতি;
তৃষ্ণায় আকুল বঙ্গ করিত রোদন।
কঠোরে গঙ্গায় পুজি ভগীরথ ব্রতী,
(সুধন্য তাপস ভবে, নর-কুল-ধন!)
সগর-বংশের যথা সাধিলা মুকতি,
পবিত্রিলা আনি মায়ে, এ তিন ভুবন;
সেই রূপে ভাষা-পথ খননি স্ববলে,
ভারত-রসের স্রোতঃ আনিয়াছ তুমি
জুড়াতে গৌড়ের তৃষা সে বিমল জলে!
নারিবে শোধিতে ধার কভু গৌড়ভূমি।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান
হে কাশি, কবীশদলে তুমি পুণ্যবান।।
-মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ‘কাশীরাম দাস’

ওই সময়ের (তুর্কি আমলে) সাহিত্যকৃতি প্রসঙ্গে এ কথাটিও স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে শাস্ত্র নির্দেশিত ‘রৌরব নরকভীতি’, সামাজিক নিন্দা উপেক্ষা করে বাঙালি ব্রাহ্মণ-কায়স্থরাই রামায়ণ-মহাভারত-ভাগবত অনুবাদে এগিয়ে এসেছিলেন। ঠিক তদ্রুপ কোরান-হাদিসের ভাবানুবাদের শাস্ত্রীয় নিষেধাজ্ঞাকে উপেক্ষার প্রয়াসও স্পষ্ট। স্মর্তব্য শাস্ত্রবাক্য, ‘অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য চরিতানি চ/ ভাষায় মানব শ্রুত্বা রৌরব নরকং ব্রজেৎ’। তদ্রুপ মুসলিম কবির স্বীকারোক্তিও স্মর্তব্য ‘মুসলমানী শাস্ত্রকথা বাঙ্গালা করিলুঁ/বহু পাপ হৈল মোর নিশ্চয় জানিলুঁ।’

আমরা ‘তুর্কি আমলেই পাচ্ছি লৌকিক কৃষ্ণকথা, লৌকিক দেবতার মাহাত্ম্যকথা, নাথগীতি, পালাগীতি প্রভৃতি। পনেরো-ষোলো শতকের দিকে তুর্কি প্রতিপোষণে পাচ্ছি সংস্কৃত সাহিত্য ও শাস্ত্রগ্রন্থের অনুবাদ। তুর্কির ধর্ম ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় ও সংঘাতমুহূর্তে দেখতে পাচ্ছি সনাতন ধর্মের সংস্কার ও রক্ষণ প্রয়াস- রঘুনন্দন-রঘুনাথ-রামনাথ প্রমুখের, ন্যায়-স্মৃতি ইত্যাদির চর্চায়।’   -আহমদ শরীফ, ‘বাঙলা বাঙালী ও বাঙালীত্ব’, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ৮৬-৮৭।

মধ্যযুগের সাহিত্যকৃতির মধ্যে মুসলিম কবির প্রণয়োপাখ্যান, শাস্ত্রগ্রন্থ, চরিতগ্রন্থ গাথা-গীতিকা, পির নারায়ণ, সত্য ও তার চেলা পির-দেবতাদের কাহিনী এও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিশিষ্ট স্থানলাভের অধিকারী। এই সময়সীমায় বাঙালি হিন্দুর প্রধান ধর্ম ছিল মূলত লোকধর্মই, এবং ষোলো-সতেরো শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত লৌকিক এবং লোকায়ত দেবদেবীই হিন্দুধর্মের প্রধান অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায়, যে প্রেক্ষিত থেকে উৎসারিত হয় বিপুল পরিমাণে পাঁচালি আর কথকতা। এ পটভূমিতেই ধর্মান্তরিত মুসলিম-বাঙালিদের মনোজগতে পূর্ব-পুরুষের বিশ্বাস-সংস্কারের সমন্বয়ে একটা লৌকিক ইসলামের আত্মপ্রকাশ জন্ম দিল কিছু সমন্বয়ী পাঁচালি, কথকতা এবং গীত ইত্যাদি। ধর্মীয় কঠোরতার আড়ালেই জলদেবতা, বনদেবতা, দরগায় ধর্না, মানত-সিন্নি-তাবিজ-কবচের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু-মুসলিমের যৌথ জীবনচর্যার একটা ধারার উদ্ভবও দেখা গেল বঙ্গভূমিতে যার স্বাক্ষর রয়েছে সত্যনারায়ণের পুথি পির-মাহাত্ম্য, বিভিন্ন উপ-দেবতার পাঁচালিতে- যা অবশ্য প্রথানুগ সাহিত্যের ইতিহাসে এখনও অন্তর্ভুক্তির অপেক্ষায়।

৩.২   মঙ্গলকাব্য এবং বৈষ্ণবসাহিত্য

প্রাক্-চৈতন্য যুগে রাধাকৃষ্ণ লীলা বিষয়ক পদ ভক্তিরসাশ্রিত পদাবলি নিয়ে বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব রচিত। বিদ্যাপতি এবং চণ্ডীদাসের ব্রজভাষায় অনুপম পদের আবেদনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আপ্লুত হয়ে রচনা করেন এ যুগের ব্রজবুলি, 'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী'। নানা পর্যায়ের এ পদাবলির আবেদন আজও সমান পূর্বরাগ, অনুরাগ, অভিসার, মাথুর, মিলন, প্রার্থনা প্রভৃতি ভাবুক মনে শিহরণ জাগায়। পদগুলোর ভাষা যেন অনেক দূরের, অথচ একেবারে কাছের -

বৈষ্ণব

প্রাক্-চৈতন্য পর্বের 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' পুথি (আবিষ্কার ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দ) বাংলা ভাষার দ্বিতীয় প্রাচীন নিদর্শন। বসন্তরঞ্জন রায় কর্তৃক এ পুথির প্রকাশ ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দ। এ কীর্তনের পদকর্তা বড়ু চণ্ডীদাস। এ পুথির ভাষা অনেকটাই স্বচ্ছ, চর্যার মতো সান্ধ্য তো নয়ই, ব্রজবুলির মতো কৃত্রিম আলঙ্করিকও নয়-

‘কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি কালিনী নই কূলে
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি এ গোঠ গোকুলে।
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি সে না কোন জনা
দাসী হআঁ তার পা এ নিশিবো আপনা
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি চিত্তের হরিষে
তার পাএ বড়ায়ি মোঁ কৈলো কোন দোষে।’

চৈতন্য-যুগে আসার আগে খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতক থেকে সৃষ্ট মঙ্গলকাব্যের দিকে আলোকপাত করা প্রয়োজন। গৃহস্থের মঙ্গল কামনায়, পৌরাণিক, শাস্ত্রীয় দেবদেবীকে লোকায়ত জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে এদের মাহাত্ম্য বর্ণন এবং এদের পূজা প্রচারের কাহিনিকে ঘিরেই মঙ্গলকাব্যের আবর্তন। মঙ্গলকাব্যের তিনটি ধারা- মনসাদেবীকে নিয়ে ‘মনসামঙ্গল’, চণ্ডীদেবীকে নিয়ে ‘চণ্ডীমঙ্গল’, ধর্মঠাকুরকে নিয়ে ‘ধর্মমঙ্গল’। ‘মনসামঙ্গল’ সম্ভবত বাংলায় সবচাইতে জনপ্রিয় কাব্য, যার উপস্থাপনমূলক (Performing) চরিত্র এর জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ। পাখোয়াজ, কর্তাল সঙ্গতে নৃত্য সহযোগে বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনী আশ্রিত এ কবিতা শ্রাবণ মাসে শ্রোতাদের সামনে দীর্ঘক্ষণ পরিবেশন করা হয়। দিশা, লাচাড়ি, পয়ার প্রবন্ধ নিয়ে এ পরিবেশনায় বাংলার বিভিন্ন ধারার সংগীতের সম্মিলন ঘটে। এটাকে ‘ভাসান গান’ বলেও আখ্যায়িত করা হয়। নারায়ণ দেব, দ্বিজবংশীদাস এ কাব্যের কবি। স্বর্গখণ্ড বা দেবখণ্ড, বণিকখণ্ড নিয়ে মূল কাহিনী এবং পার্শ্বকাহিনী (Main Plot ও Sub-Plot) সহ অসংখ্য উপ-কাহিনি (Episode/Anecdote) নিয়ে মনসামঙ্গলের রয়েছে একটি মহাকাব্যিক ব্যাপ্তি। ‘রূপসী বাংলা’র কবি জীবনানন্দ দাশের একটি পঙক্তিতে রয়েছে ভাসানের উজ্জ্বল উপস্থিতি –‘ভাসানের গান শুনে কতবার ভেসে গেলে ঘর আর খড়’, আর বরাক উপত্যকার কবি শক্তিপদ ব্রহ্মাচারীর পঙক্তি বড়ই মর্মস্পর্শী -

‘এখনও বুকের দ্বিজ বংশীদাস কহে
হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কালীদহে
ডহরের ঘোর লাগা গহনের টানে
সায়ের ঝিয়ারী যায় অনন্ত ভাসানে।’

এ পর্যায়ের আরেকটি কাব্যের নাম 'চণ্ডীমঙ্গল'। এর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি হলেন কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী; তবে এর আদি কবি হলেন মানিক দত্ত। দেবী চণ্ডী এখানে অরণ্যসম্পদ পালিকা।

তাছাড়াও ওই পর্বে রচিত হয়েছে ধর্মঠাকুরের মাহাত্ম্য অবলম্বনে 'ধর্মমঙ্গল'। পুরুষ দেবতার অধিষ্ঠান এখানে বিশেষ লক্ষণীয়। ময়ূরভট্ট, ঘনরাম চক্রবর্তী, রূপরাম চক্রবর্তীর 'ধর্মমঙ্গল' বিশেষ প্রসিদ্ধ।

মধ্যযুগের সাহিত্যের পরবর্তী পর্বে যাবার আগে আসা যাক চৈতন্য-যুগে। ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে নবদ্বীপ ধামে জন্ম নেওয়া জগন্নাথ মিশ্র এবং শচীদেবীর সন্তান চৈতন্যদেবের আদি ভদ্রাসন শ্রীহট্টের ঢাকাদক্ষিণ। অবশ্য মহাপ্রভুর জীবনের অর্ধেক কেটেছে নবদ্বীপে, বাকি অর্ধেক নীলাচলে। কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাস নিয়ে তিনি গৃহত্যাগী হন, মাধবেন্দ্রপুরীর শিষ্য ঈশ্বরপুরীর কাছে দীক্ষা নিয়ে তিনি প্রেমধর্ম প্রচারে ব্রতী হন। লুপ্ততীর্থ উদ্ধার, হরিনাম সংকীর্তনের ব্রত নিয়ে তিনি বিস্মৃতির আড়াল থেকে বৃন্দাবন ধামকে পরিচিতির আলোকে আনেন, দাক্ষিণাত্যে নিয়ে যান হরিনাম মাহাত্ম্য, কামরূপ রাজ্য ছাড়াও পিতৃপুরুষের ভূমি শ্রীহট্টেও তিনি পদার্পণ করে যান। চৈতন্যদেবের আবির্ভাব বাংলা এবং বাঙালি জীবনে এক বৈপ্লবিক অধ্যায়ের সূচনা করে।

নবদ্বীপে স্মৃতিশাস্ত্র, ন্যায়শাস্ত্র অধ্যয়ন করতে করতে নিমাই পন্ডিতের উত্তরণ ঘটে ভক্তিমার্গে। এ উত্তরণই বাঙালির জাতীয় জীবনে সূচনা করে নবযুগের। চৈতন্যের এ অভ্যুদয় বাঙালি জীবনে একটি রেনেসাঁ। তাঁকে কেন্দ্র করে নব্য বৈষ্ণবীয় আন্দোলন বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তরণ ঘটিয়েছে আধুনিকতায়; সামাজিক ভেদাভেদ ঘুচিয়ে মানুষকে করেছে এক; ব্রাহ্মণ্য ঐতিহ্যপ্রসূত ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুপমণ্ডুকতা, শাস্ত্রীয় অনুশাসন থেকে মানুষকে দিয়েছে মুক্তি। লোচনদাসের ‘চৈতন্যমঙ্গল’, বৃন্দাবনদাসের ‘চৈতন্যভাগবত’, কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’ প্রভৃতি জীবনীগ্রন্থ (কাব্য) বাংলা সাহিত্যে বিশেষ প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। বিচিত্র এবং অপর্যাপ্ত গৌরাঙ্গবিষয়ক পদ, পালাকীর্তন এবং সে সঙ্গে রাধাকৃষ্ণ লীলা বিষয়ক নতুন পদ নিয়ে ষোড়শ শতাব্দীর বৈষ্ণব সাহিত্য বাঙালি জীবনে যে তরঙ্গ সৃষ্টি করে এর অভিঘাত সপ্তদশ, অষ্টাদশ শতাব্দীতে পেরিয়ে একবিংশ শতাব্দীতে সক্রিয়। বৈষ্ণবীয় জীবনচর্যার অমোঘ প্রভাবে বাংলার লোকজীবনে পালাগান, লোকযাত্রা, লোকাচার-কেন্দ্রিক গীত, কথকতা, বাউল ভাটিয়ালিতেও রাধাকৃষ্ণ জীবন্ত হয়ে ওঠেন; শুধু হিন্দু নয়, শতশত মুসলিম পদকর্তাও বৈষ্ণব ভাবে ভাবিত হয়ে রচনা করেন পদ। এর মধ্যে লালন ফকির, হাসন রাজা থেকে সাম্প্রতিককালীন শাহ আব্দুল করিম পর্যন্ত রয়েছেন।

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে সুলতানী শাসনের অবদানও অনস্বীকার্য। মোগল সুবার অধীনে থাকাকালীন বঙ্গভূমিতে আরবি-ফার্সি ভাষার প্রভাব আসে নানা সূত্রে এবং এমনি করে সময়ের চাহিদা অনুযায়ী বাংলা ভাষার শব্দসম্ভারে ঘটেছে নতুন সংযোজন। ওই মুসলিম কবিদের রচিত প্রেমগাথা, লৌকিক গল্প, কেচ্ছা কাহিনি ছাড়াও আউল বাউল মারফতি, ফকিরি গীত। উল্লেখ করতে হয় সপ্তদশ শতাব্দীর আরাকান রাজসভার আনুকূল্যে রচিত সাহিত্যকৃতি, ‘সতী ময়না’, ‘পদ্মাবতী’ কাব্য প্রভৃতি।

এ পর্বে উল্লেখ থাকুক নাথসাহিত্যের কথাও। সিদ্ধাচার্যদের কাহিনি, মীননাথ, গোরক্ষবিজয় প্রভৃতি সাহিত্যকৃতি বাংলা সাহিত্যে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে।

৩.৩   বাংলা ভাষাসাহিত্যে প্রাক্-আধুনিক পর্ব

বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগের পরিসমাপ্তি ঘটে বাংলা তথা এ দেশে ঔপনিবেশিক রাজত্ব প্রতিষ্ঠা এবং দেশীয় রাজতন্ত্রের অবসানে প্রশাসন কেন্দ্র হিসেবে কলকাতা নগরীর আত্মপ্রকাশের সময়ে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধ এক্ষেত্রে একটি মাইলফলক। যুগসন্ধিক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ভাগে এসে প্রাগাধুনিকতার সমস্ত লক্ষণ পরিস্ফুট হতে থাকে বাঙালির সাহিত্যকৃতিতে যেখানে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, এবং সাংস্কৃতিক পালাবদলের প্রতিফলনও পরিলক্ষিত হয়।

মঙ্গলকাব্যের যুগ অবসান হলেও অষ্টাদশ শতাব্দীতে ওই ধারাতেই রচিত হয়। 'অন্নদামঙ্গল কাব্য'। রচয়িতা রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র (১৭১২-১৭৬০)। ভারতচন্দ্র এ কাব্যটি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর 'চণ্ডীমঙ্গলের' ধারাবাহিকতায় রচনা করলেও এর মধ্যে যুগসন্ধিক্ষণের অনেক লক্ষণ দেখা যায়। শিব এবং দাক্ষায়নী কাহিনি, বারাণসীতে পার্বতীর অন্নপূর্ণা হিসেবে আত্মপ্রকাশ, এরপর হরিহর ও ভবানন্দ মজুমদারের কাহিনির সঙ্গে দেবী দুর্গার লীলা মাহাত্মের সংযোগে কাব্যটির সমাপ্তি।

এরপর আত্মপ্রকাশ ঘটে অষ্টাদশ শতাব্দীর শাক্ত সাহিত্য। এ পর্বের প্রধান করি রামপ্রসাদ সেন (১৭২০-১৭৮১) এবং কমলাকান্ত ভট্টাচার্য (১৭৭২-১৮২১)। এ দুইজনেরই আবির্ভাব অষ্টাদশ শতকে। পন্ডিতদের অভিমত, শাক্তপদের উদ্ভব ঘটেছিল বাংলার এক দুর্যোগপূর্ণ রাত্রির ঘনান্ধকারে যুগসন্ধিক্ষণের অনিশ্চয়তা, অরাজকতায় এবং বৈষ্ণবীয় ভক্তি আন্দোলনের অবক্ষয়ে। নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে দ্রুত অপস্রিয়মান সামাজিক স্থিতাবস্থা এবং অনিশ্চিতি ও বিভ্রান্তির মুহূর্তে বরাভয়দাত্রী, অভয়াশক্তির সন্ধানেই এ মহাকালী মাতৃস্বরূপা দেবীর আবিষ্কার।

মাতৃ উপাসক, তন্ত্রসাধক রামপ্রসাদের পদগুলো ভাবের গভীরতায়, ভাষার স্বচ্ছতায়। এবং পদলালিত্যে বঙ্গদেশকে ভাসিয়ে দিয়েছে। রামপ্রসাদী সুর একেবারে বাংলার জনজীবনে মিশে গেছে। আধুনিক বাংলা গীতিকবিতার সমস্ত চরিত্রলক্ষণ নিয়েই রামপ্রসাদের গানের আত্মপ্রকাশ। কথিত যে বাংলার নবাব সিরাজদ্দৌল্লাও রামপ্রসাদের গানের রসাস্বাদন করেছিলেন কোনও এক বিশেষ মুহূর্তে।

রামপ্রসাদের পরবর্তী বাংলা শাক্তকবি হিসেবে আবির্ভাব হয় কমলাকান্তের (১৭৭২-১৮২১)। এ পদকর্তা অবশ্য অষ্টাদশ পেরিয়ে উনবিংশ শতাব্দীর প্রতিনিধিত্বও করেন। এই দুজনের সৃষ্ট পদাবলি সম্পর্কে অরুণকুমার বসুর একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য , তিনি বলেন ‘শাক্ত পদাবলীর দশভাগের একভাগ মাত্র মধ্যযুগীয়। বাকি নয় ভাগই আধুনিক’ । (নব সংস্করণ, শাক্ত পদাবলী, কলকাতা ২০০১, পৃ. ২) উনবিংশ শতকে বাঙালির আর্থসামাজিক জীবনে পরিবর্তন, নগরায়নের প্রভাব, নব্য বিত্তবান শ্রেণীর উদ্ভব এবং নাগরিক বিত্তবান, জমিদার পরিবারে আড়ম্বর সহযোগে শক্তি আরাধনা, দুর্গা, কালী পূজার জনপ্রিয়তায় পুজার অনুষঙ্গ হিসেবে শাক্তসংগীতের ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়। রামপ্রসাদ-কমলাকান্তের ধারাবাহিকতায়ই কবিওয়ালা, যাত্রাকার, নাট্যকার, এবং জমিদার সহ দেওয়ান-নায়েব শ্রেণীর অনেকেই শাক্তপদ রচনা করেন। কালী মির্জা, দেওয়ান নন্দকুমার রায়, মহারাজ নন্দকুমার, দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ, রাম বসু, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র, অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি, হরু ঠাকুর, শ্রীধর কথক, দাশরথি রায়, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, রসিক রায়, দেওয়ান রামদুলাল, মহারাজ মহাতাবচাঁদ, মির্জা হুসেন আলি প্রমুখ পদকর্তাদের সময়সীমা হল ১৭৫০ থেকে ১৮৫০ সাল অবধি। এরা অতি অবশ্যই প্রাগাধুনিক পর্বের পদকর্তা (মধ্যযুগীয় তো নয়ই)। এ তালিকায় গিরিশ ঘোষ, অমৃতলাল বসু, মনোমোহন বসু থেকে রজনীকান্ত সেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়ে নজরুল ইসলাম পর্যন্ত সংযোজন করে শাক্তপদের ধারাকে একেবারে আধুনিক স্তরে এনে স্থাপন করা যায়।

এ অধ্যায়টি অসম্পূর্ণ থাকবে যদি শাক্তপদের আলোচনায় আগমনী এবং বিজয়া পর্যায়ের পদ অনালোচিত থাকে। এ পর্যায়ের পদগুলোর উদ্ভবও রামপ্রসাদ ও কমলাকান্তর হাত ধরেই। শক্তি আরাধনার মধ্যে বাংলার শান্ত স্নিগ্ধ সমাজজীবন এবং নিসর্গের স্পর্শে দেবী দুর্গা বা কালী করালীবদনার মধ্যে পল্লিবাংলার মাতৃস্বরূপাকে সংস্থাপন, দেবীকে নিজের ঘরের মেয়ে হিসেবে পঞ্চঋতু সমাপনান্তে শরতের সপ্তমী তিথিতে তিনদিনের জন্য নিমন্ত্রণ করে আনা এবং দশমীতে বিদায়ের করুণ গাঁথা এনিয়ে আগমনী-বিজয়া। বাংলায় অসংখ্য আগমনী এবং বিজয়ার গানের জনপ্রিয়তা আজও, যার উৎসে রয়েছে সেই অষ্টাদশ শতকের শাক্ত পদাবলির ঐতিহ্য। এই করুণাঘন, মমতার রসে সিক্ত পদগুলোতে বাংলার ঘরোয়া চিত্র সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে, উৎসব উপলক্ষে গীত ও পদের সুরেলা উচ্চারণ যেন তিনটি দিনের জন্য মর্ত্যধামকে দেবতাদের পুণ্যভূমিতে রূপান্তরিত করে যেখান প্রত্যেক বাঙালি মা-বাবা যেন হিমালয়-মেনকা রূপে তাদের আদরের কন্যা-জামাতার মধ্যে কৈলাসবাসী হর-পার্বতীকে প্রত্যক্ষ করেই বরণ করেন নিজ গৃহে। বর্ষাশেষে শিউলীর গন্ধভরা আকাশে শুভ্রমেঘের ইতস্তত বিচরণ, পৃথিবীর গায়ে উৎসবের সাজ এমনি সময়ই মাতা মেনকার মনে কন্যার বিচ্ছেদজনিত কাতরতা মূর্ত হয় কমলাকান্তের পদে -

‘কব যাবে বলো গিররাজ গৌরীরে আনিতে
আকুল হয়েছে চিত উমারে দেখিতে’ -
রামপ্রসাদের পদে উচ্চারিত হয় বাঙালি মায়ের প্রাণের কথা -
‘এবার আমার উমা এলে আর উমায় পাঠাব না,
বলে বলুক লোকে মন্দ কারো কথা শুনব না।’ -
বিজয়া দশমীর বিচ্ছেদ কাতরতার প্রকাশ ঘটে মাইকেল মধুসূদন দত্ত-র অনুপম পদে -
‘যেও না রজনী আজি লয়ে তারাদলে।
গেলে তুমি দয়াময়ী এ পরাণ যাবে।’

সমাপ্তিতে, শাক্ত পদাবলিতে যে বৈষ্ণব-শাক্তমতের সমন্বয় ঘটেছে এদিকেও দৃষ্টি আকর্ষণের প্রয়োজন। বঙ্গীয় সমাজজীবনে বৈষ্ণবীয় জীবনচর্যার প্রভাব শাক্তভাবের প্রবল বন্যায় ভেসে যায়নি। রামপ্রসাদের পদে খড়্গধারিণী করালবদনা, মুণ্ডমালী দেবীর সঙ্গে বৃন্দাবনবিহারী কৃষ্ণের রূপকল্পের সংমিশ্রণ ঘটে -

‘নটবর বেশে বৃন্দাবনে, কালী হলি রাসবিহারী
পৃথক প্রণব নানা লীলা তব কে বুঝে এ কথা বিষম ভারী।
নিজতনু আধা গুণবতী রাধা, আপনি পুরুষ-আপনি নারী
ছিল বিবসন কটি এবে পীতধটি এলোচুল চূড়া বংশীধারী।’
তেমনি কমলাকান্তের পদে আরেকটি অপূর্ব চিত্রকল্প -
‘নব সজল জলধর কায়
শ্যামারূপ হেরিলে আঁখি জুড়ায়।
কপালে সিন্দুর কটিতে ঘুঙুর রতন নূপুর পায়
হাসিতে হাসিতে দানব দলিছে
রুধির লেগেছে গায় -।’
অনুশীলনী
পর্ব: ক :
  1. মধ্যযুগে পৌরাণিক সাহিত্য বাংলায় অনুবাদ করতে কী প্রধান সমস্যা ছিল?
  2. ইসলামীয় সাহিত্য বাংলায় অনুবাদ করতে গিয়ে মুসলিম কবি কী স্বীকারোক্তি করেছিলেন?
  3. পাঁচালি, কথকতা কোন প্রেক্ষিত থেকে উৎসারিত হয়?
  4. হিন্দু-মুসলিম যৌথ সাধনার সাক্ষ্য কোন সাহিত্যকৃতিতে পাওয়া যায়?
  5. তুর্কি শাসনকালে বাংলায় কী ধরনের সাহিত্য সৃজন হয়েছে?
পর্ব: খ :
  1. প্রাক্-চৈতন্য যুগে বাংলায় কী ধরনের সাহিত্য সৃষ্টি হয়? ওই যুগের দুজন কবির নাম করুন।
  2. ব্রজভাষায় রচিত পদাবলিগুলোকে কী কী পর্যায়ে বিভক্ত করা হয়েছে?
  3. ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন পুথি’ কে কবে আবিষ্কার করেন এবং এ পুথির কবি কে?
  4. ‘মঙ্গলকাব্য’ বলতে কী বোঝায়? এর তিনটি প্রধান ধারা কী?
  5. ‘মনসামঙ্গল’ কেন বাংলার সবচাইতে জনপ্রিয় কাব্য? এ কাব্যকে আর কী কী নামে অভিহিত করা হয়?
পর্ব: গ :
  1. শ্রীচৈতন্যদেব কবে জন্মগ্রহণ করেন? তাঁর আবির্ভাব বাঙালি জীবনে কী বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত করে? এ আবির্ভাবকে কেন বাঙালি জীবনে রেনেসাঁ বলা চলে?
  2. শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থের রচয়িতা কে? এ গ্রন্থের মুখ্য বিষয় কী?
  3. বৈষ্ণবীয় জীবনচর্যার প্রভাবে বাংলার জনজীবনে কী পরিবর্তন ঘটে?
  4. বৈষ্ণবীয় ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত হন কোন সম্প্রদায়ের মানুষ? এরা কি কেবলই হিন্দু?
  5. সুলতানী আমলে বাংলা ভাষায় কী নতুন প্রভাব আসে?
পর্ব: ঘ :
  1. শাক্ত সাহিত্যের উদ্ভব কবে হয়?
  2. দু'জন প্রধান শাক্ত পদকর্তার নাম করুন। তাঁদের রচিত পদাবলির প্রধান বৈশিষ্ট্য কী?
  3. দু'জন সাধক পদকর্তা ছাড়াও আর কারা শাক্তপদাবলি রচনা করেন?
  4. আগমনী ও বিজয়া পদ বলতে কী বোঝায়? এগুলোকে শাক্ত পদাবলি হিসেবে ধরা যাবে কি?
  5. বাংলার কোন নবাব শ্যামাসংগীতের গুণগ্রাহী ছিলেন?

প্রথম পত্র
অধ্যায় - 
প্রাক্‌-আধুনিক