এ পর্বটিতে যা জানতে পারবেন —
ধ্বনি থেকে বর্ণ, বর্ণ থেকে শব্দ, এবং শব্দের সঙ্গে শব্দ মিলে তৈরি হয় বাক্য। এই বাক্য দিয়েই আমাদের ভাব বিনিময়, আমাদের প্রশ্ন, কিংবা উত্তর, আদেশ কিংবা উক্তি, সমর্থন কিংবা প্রতিবাদ। বাক্যেই আমাদের ভালবাসা, ঘৃণা, সহমর্মিতা, উষ্মা প্রকাশ। এই বাক্য আবার গড়ে ওঠে একটা নির্দিষ্ট ধারায়, এর নিজস্ব ধারায় সৃষ্টি হয়ে যায় একটা প্রণালী। প্রত্যেকটি ভাষারই নিজস্ব একটা বাক্যগঠন রীতি তৈরি হয়ে যায়। একটি বাক্যে সব কটি শব্দ বাংলা হলেও দেখা যাবে গঠনগত দিক বিচার করলে বাক্যটি (Syntactically) বাংলা হয়ে ওঠেনি। যেমন এ বাক্য- ‘আসামে চিনিকল থাকা একটি স্থানের নাম লিখ’, কিংবা ‘সে তাহার বাবাকে মান দেয়’। এতে সবক’টি শব্দই বাংলা কিন্তু তৎসত্ত্বেও গঠনগতভাবে এ বাক্যদুটোই শুদ্ধ বাংলা নয়।
বাংলা বাক্যের সংগঠন সূত্র মূলত সংস্কৃত ব্যাকরণের ধারা মতেই নিরূপিত হয়েছে, এতে আবার ইংরেজি ব্যাকরণের অভিঘাতও এসে যোগ হয়েছে। এরই মধ্য দিয়ে একটি নিজস্ব চরিত্রলক্ষণ নিয়ে বাংলা ভাষার আত্মপ্রকাশ, যা পরিস্ফুট হয় আমাদের মুখের ভাষায়, অর্থাৎ বাক্যে।
পরবর্তী পর্বগুলোতে এ দিকগুলোই আলোচিত হবে।
বাক্য কী?
এ প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ নয়, অথচ মনে হয় সহজই তো বটে। কয়েকটি শব্দের সমষ্টি বলে একটি সংজ্ঞা খাড়া করলে, প্রশ্ন জাগবে ‘যেমন-খুশি কিছু শব্দ হলেই তা বাক্য হয়ে উঠবে?’ না, তা নয়। পাশাপাশি বিন্যস্ত কয়েকটি শব্দ (পদ) যদি একটি সম্পূর্ণ অর্থ বা মনোভাব প্রকাশ করতে পারে, তবেই তাকে বলা যাবে বাক্য।
এ বাক্য একটি মাত্র শব্দ (পদ) দিয়েই হতে পারে। যেমন: ‘এসেছে’, দু’টো দিয়ে, তিনটে, চারটে, পাঁচটা, ছ’টা দিয়েও হতে পারে। শুধু দেখতে হবে সম্পূর্ণ মনোভাব এতে প্রকাশ হয়েছে কি না।
এ সম্পূর্ণ মনোভাব প্রকাশ করার সঙ্গে আরও একটি জিনিস লক্ষণীয়। পদবিন্যাস যথাযথ হলেও, বাক্যটিতে অর্থসঙ্গতি আছে কি না, তা’ও বিবেচ্য। অন্ধকার রাতে পথ চিনে আসা হয়তো কোনো ক্রমে সম্ভব, কিন্তু ‘গভীর অন্ধকারে পথ দেখে বাড়ি পৌঁছলাম’ বললে শব্দগুলোর মধ্যে অর্থগত সম্পর্ক স্থাপিত হবে না। বাক্য হিসেবে এটা দাঁড়াবে না।
প্রথাগত ব্যাকরণে বলা হয় বাক্যের দু'টি উপাদান: উদ্দেশ্য এবং বিধেয়।
যাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলা হয় সে হল উদ্দেশ্য। যেমন, ‘প্রদীপ্ত কলেজে যাচ্ছে’- এখানে প্রদীপ্ত হ’ল উদ্দেশ্য, আর ‘কলেজে যাচ্ছে’ হল বিধেয়।
এই উদ্দেশ্য সাধারণত বাক্যের প্রথম অংশ অধিকার করে বসে, তবে এটা শেষেও আসতে পারে।
যে-রূপভেদের দ্বারা ক্রিয়া প্রধানত কা’কে অবলম্বন করে কাজ করছে তা বোঝা যায় তাকেই বলে বাচ্য। ইংরেজি বাচ্যকে বলে Voice । এর এক সংজ্ঞা এরকম, ‘Voice is the quality of a verb that indicates whether its subject acts (active voice) or is acted upon (Passive voice)’।
বাংলায় বাচ্য তিন প্রকারের : -
কর্তৃবাচ্য : যে ক্রিয়াদ্বারা কর্তা প্রধান রূপে বাচ্য হয় তা'ই কর্তৃবাচ্য (Active voice)। যেমন : - ‘আমি গান গাইছি’, ‘তুমি কথা বলছ’, ‘সে অঙ্ক কষছে’।
কর্মবাচ্য : যে ক্রিয়াদ্বারা কর্ম প্রধানরূপে বাচ্য হয়। তা'ই কর্মবাচ্য (Passive voice)। যেমন : - ‘কোথায় যাওয়া হচ্ছে’, ‘ওসব আমার দেখা আছে’, ‘বইটি পড়া হয়ে গেছে’।
ভাববাচ্য : যেখানে ক্রিয়ার অর্থই প্রধানরূপে প্রতীয়মান হয়, তা'ই ভাববাচ্য। এতে কর্তা বা কর্মের প্রাধান্য না বুঝিয়ে ক্রিয়ার প্রাধান্য বোঝায়। যেমন : - ‘আমার যাওয়া হচ্ছে’, ‘আমার রাত্রে ঘুম হয়নি’, ‘মহাশয়ের কী করা হয়?’
বাংলা ভাষায় এক শ্রেণীর বাচ্যকে অন্যশ্রেণীর বাচ্যে রূপান্তরিত করার প্রথা রয়েছে (এটা অবশ্য অন্যভাষায়ও আছে। ইংরেজিতে Voice change তো ব্যাকরণ অনুশীলনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়)। কর্তৃবাচ্যকে কর্মবাচ্যে, ভাববাচ্যকে কর্তৃবাচ্যে, কর্ম-কর্তৃবাচ্যকে কর্তৃবাচ্যে ইত্যাদি নানাভাবে রূপান্তরিত করা যায়।
এখানে কয়েকটি অনুশীলনী দেওয়া হল : -
কর্তৃবাচ্যকে কর্মবাচ্যে পরিবর্তন :
কর্তৃবাচ্যকে ভাববাচ্যে পরিবর্তন :
কর্মবাচ্যকে কর্তৃবাচ্যে পরিবর্তন :
ভাববাচ্যকে কর্তৃবাচ্যে পরিবর্তন :
কর্মকর্তৃবাচ্যকে কর্তৃবাচ্যে পরিবর্তন :
ইংরেজিতে দুটো শব্দ আছে ‘Phrase’ (শব্দগুচ্ছ) ‘আর’ Idiom (প্রবাদ)। বাংলায় প্রচলিত আছে ‘প্রবাদ’ ও ‘প্রবচন’। ‘আপ্তবাক্য’ শব্দটিও শোনা যায় যখন একটি বাক্য বহু ব্যবহারে প্রায় জীর্ণ হয়ে যায়। ইংরেজিতে একে বলে ‘Cliché’ (ক্লিশে)। আমরা যাকে বাগবিধি বা প্রবাদ-প্রবচন বলি, মোটামুটি ইংরেজি Idiom দিয়েই তা বোঝানো হয়। বর্তমান পাঠে আমরা বাগবিধিই বলব, তা সেটা শব্দগুচ্ছই হোক্ আর প্রবাদ-প্রবচন বা বিশিষ্টার্থক বাক্গুচ্ছই হোক্ না কেন।
বাঙালির মুখের ভাষায় এ বাগবিধির ছড়াছড়ি অজস্র। মান্য চলিত বাংলা ছাড়াও প্রতিটি আঞ্চলিক উপভাষায় এর উদাহরণ প্রচুর। আর সিলেট-কাছাড়, অর্থাৎ বরাক উপত্যকায় যুৎসই একটি বাক্যের প্রাণভ্রমরাই বুঝি এ বাগবিধি। মুখের ভাষা থেকে এ বাগবিধি লিখিত ভাষায়, মুদ্রণ মাধ্যমে এবং শ্রুতিমাধ্যমেও নিজস্ব স্থান করে নিয়েছে। সংবাদপত্রে অর্থনৈতিক দুর্নীতির খবরের শিরোনাম হয় ‘রক্ষকই ভক্ষক’ ‘ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়’, রাজনৈতিক নেতাদের দলবদলের শিরোনাম ‘আয়ারাম গয়ারাম’, দ্বিচারিতা বোঝাতে ‘কনের পিসি বরের মাসি’- এসবের জুড়ি নেই।
এই বাকরীতি উঠে এসেছে কখনও একেবারে প্রাত্যহিক, সাধারণ জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে, গ্রামীণ কথোপকথন থেকে, আবার কখনও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার থেকেও সংস্কৃত এবং বাংলা শব্দের মিশ্রণে। তবে সম্প্রতি হিন্দি বা আরবি-ফারসি শব্দের সঙ্গে বাংলা ক্রিয়াপদ জুড়ে যেমন বাকরীতি গড়ে উঠছে তেমনি ইংরেজি বা ইউরোপীয় শব্দের সঙ্গে বাংলা মিলেও সৃষ্টি হচ্ছে নতুন বাংলা ইডিয়ম। প্রথাগত বাংলা ব্যাকরণ থেকে বাংলা বাগবিধির তালিকা এবং উদাহরণগুলোর দিকে চোখ বুলালেই বোঝা যাবে বাংলা বাগন্ধারার সম্ভার যে কত বিচিত্র, কৌতূহল-উদ্দীপক এবং ব্যঞ্জনাময়।
ব্যাকরণের পরিভাষায় এ বাগধারায় রয়েছে বিশেষ্যপদের বিশিষ্ট প্রয়োগ যেমন ‘মাথা’ থেকে মাথা ধরা, মাথা খাওয়া, মাথা কেনা ইত্যাদি; বিশেষণ পদের বিশিষ্ট প্রয়োগ যেমন, কাঁচা থেকে ‘কাঁচা কাজ’, ‘কাঁচা ঘুম’, ‘কাঁচা পয়সা’, আর ক্রিয়াপদের বিশিষ্ট প্রয়োগ, যেমন- ‘ওঠা’ থেকে ‘বাজার উঠে যাওয়া’, ‘মিটিঙে বিষয়টি ওঠানো’, ‘হঠাৎ বলে ওঠা’, ইত্যাদি।
আমরা কয়েকটি লোকায়ত, কয়েকটি সংস্কৃতজাত, আর কয়েকটি বিদেশি সূত্রজাত উদাহরণ এখানে হাজির করব মাত্র :
কয়েকটি লোকায়ত বাগ্বিধি :
• আকথা কুকথা –এর অর্থ বাজে কথা |
• উল্টো চন্ডী –এর অর্থ বিরুদ্ধে চলা ব্যক্তি |
• একাদশে বৃহস্পতি –এর অর্থ সৌভাগ্যের কথা |
• কাঁটা দিয়ে কাঁটা –এর অর্থ শত্রু দিয়ে শত্রু দমন |
• কাকভূষন্ডী –এর অর্থ দীর্ঘজীবী |
• ঘর ভাঙানো –এর অর্থ বিবাদ লাগানো |
• কলুর বলদ –এর অর্থ অকর্মা |
• খাল কেটে কুমির আনা –এর অর্থ শত্রুকে পথ দেখানো |
• রথ দেখা কলা বেচা –এর অর্থ এক সঙ্গে দুই উদ্দেশ্য |
• শকুনি মামা –এর অর্থ কুচক্রী |
• সবে ধন নীলমণি –এর অর্থ একমাত্র সন্তান |
• হাড় জ্বালানো –এর অর্থ অত্যন্ত জ্বালাতন করা |
এবারে দেখা যাক কয়েকটি সংস্কৃত শব্দ দিয়ে তৈরি বাগ্বিধির নমুনা :
• অন্নচিন্তা চমৎকারা | • অধিকন্তু ন দোষায় | |
• অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী | • কিমাশ্চর্যম্ অতঃপরম্ | |
• প্রহারেণ ধনঞ্জয় | • বহারম্ভে লঘুক্রিয়া | |
• মধুরেণ সমাপয়েৎ | • মা ফলেবু কদাচন | |
• মৌনং সম্মতিলক্ষণম্ | • য পলায়তি স জীবত | |
• যেন তেন প্রকারেণ | • শঠে শাঠ্যাং সমাচরেৎ | |
• শতং বদ মা লিখ |
আমরা প্রতিদিনই মুখে এবং লিখিত ভাষায় ব্যবহার করি, তা'কি আর খেয়াল রাখি? অলমতি বিস্তারেণ। (অর্থ : "অধিক লেখার আর প্রয়োজন নেই" বা "বাহুল্যে প্রয়োজন নেই")
আরবি-ফারসির শব্দ মিলে, সঙ্গে বাংলাও নিয়ে রয়েছে অনেক বাগ্বিধি :
• আক্কেল সেলামি | • এলাহি কান্ড | |
• খয়ের খাঁ | • গদাই লশকরি | |
• বিসমিল্লায় গলদ | • মগের মুল্লুক | |
• নরক গুলজার |
এ ছাড়াও আমাদের প্রাত্যহিক কথাবার্তায় রয়েছে ইংরেজি, কিংবা ইংরেজি-বাংলা বা হিন্দি মিশে তৈরি হওয়া বাগবিধি। সঙ্গে আছে ইংরেজির সরাসরি বাংলা অনুবাদ করে (বঙ্গীকরণ) তৈরি নতুন বাগবিধি। যেমন : -
• চাকরি নট হওয়া | • শো কজ করা | |
• টেনশন নেওয়া | • অপারেশন | |
• মাল ডেলিভারি দেওয়া | • পারমিট নেওয়া | |
• স্ট্রাইক ডাকা | • মাত্রা দেওয়া | |
• বক্তব্য রাখা |
বাংলা গদ্য ভাষারীতির আত্মপ্রকাশ মোটামুটি অষ্টাদশ শতকেই। কিছু রাজকীয় আদেশপত্র, চিঠিপত্র, দলিল দস্তাবেজে প্রথম এ রীতির আত্মপ্রকাশ এবং এরপর তা আসে সৃজনশীল রচনাকর্মে – নিবন্ধ, প্রবন্ধ, গল্প, নাটকে। বাংলার মধ্যযুগে আঞ্চলিক ভাষার কাঠামোর উপর রাঢ়ী, বারেন্দ্র ও বঙ্গালি উপভাষার মিশ্রণে আত্মপ্রকাশ করল গদ্য ভাষা, যার নাম হল সাধু ভাষা। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজকে কেন্দ্র করে যে গদ্য ভাষাটি তৈরি হল তা'ই সাধু গদ্য সংস্কৃত ভাষার প্রভাবই ছিল সবচেয়ে বেশি। বলা বাহুল্য বাংলা ভাষার এ লেখ্য রূপটি কৃত্রিম, এবং মৌখিক ভাষার সঙ্গে তার ব্যবধানও বিস্তর। কথাগুলো মনে রাখা প্রয়োজন, বিদেশি মিশনারি-পন্ডিত উইলিয়াম কেরি, হ্যালহেড, ডানকান এবং দেশীয় পন্ডিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রাজা রামমোহন রায় আর পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাত ধরেই বাংলা সাধু গদ্যের উদ্ভব এবং বিকাশ।
“ বাঙ্গলা সাধুভাষা ধীরে ধীরে গড়িয়া উঠিয়াছে, ইহা এখনকার ‘পশ্চিমবঙ্গ’ ও ‘বাংলাদেশ’ নিবাসী দশকোটির উপর সমগ্র বঙ্গ-ভাষী জনগণের মাতৃভাষা, বিভিন্ন কথ্য ভাষা, বেশ জোরের সঙ্গে বিদ্যমান থাকিলেও সেগুলিকে এক সাধারণ ভাষার গন্ডীর মধ্যে সাধু ভাষার সূত্রে গাঁথিয়া রাখিয়াছে। এই যোগসূত্রকে ছিন্ন করিয়া দিলে, ভাষার রাজ্যে ঐক্যবোধ নষ্ট হইয়া যাইবে। বহুপূর্বে এই ভাবে ঢাকার বাঙ্গালা ও কলিকাতার বাঙ্গলাকে পৃথক করিয়া বাংলাভাষী জাতির মৌলিক ঐক্য ধ্বংস করিয়া দিবার চেষ্টা হইয়াছিল লর্ড কার্জনের আয়োজিত Partition of Bengal বা বঙ্গভঙ্গের দ্বারায়। ”
ক্রমে এ সাধু গদ্য রীতির মধ্যে তৎসম শব্দের পাশাপাশি তদ্ভব, দেশি, বিদেশি শব্দের স্থান লাভ, সংস্কৃত ক্রিয়াপদ, সর্বনামের স্থলে বাংলা ক্রিয়াপদ, সর্বনামের প্রয়োগ, নতুন বিরতি চিহ্নের ব্যবহার এবং কেতাবি ভাষার স্থলে মৌখিক ভাষার ব্যবহার বাংলা গদ্যকে ভিন্নপথে টেনে আনল, সৃষ্টি হল চলতি গদ্য। এ ইতিহাস অনুশীলন নয়, আমরা এ পর্বে সাধু ও চলতি গদ্যরীতির চরিত্রলক্ষণে আলোচনাকে সীমাবদ্ধ রাখব।
সাধু ভাষা :
ঊনবিংশ শতাব্দীতে সৃষ্ট বাংলা গদ্যের একটি পরিশীলিত (সাধু অর্থাৎ chaste) রূপই হ’ল সাধু ভাষা। এতে সংস্কৃত ভাষার প্রভাব বেশি। সংস্কৃত তৎসম এবং বাংলা তত্ত্বব শব্দের প্রয়োগ ছাড়াও ব্যাকরণগত আরও কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়েই এ ভাষার আত্মপ্রকাশ ঘটে। জ্যোতিভূষণ চাকীর মতে ‘সাধুভাষা নামটি সম্ভবত রামমোহনই দিয়েছিলেন। এই ভাষাকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর তিনিই স্থাপন করলেন। বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমের হাতে সে-ভাষা প্রাণ পেল।’
সাধু ভাষার গঠনগত রূপটি বুঝতে হলে চলতি ভাষার সঙ্গে এর পার্থক্যটি দেখতে হয়। তবে এ কাজে যাবার আগে বরং চলতি ভাষাটা কী, এদিকেই একটু দৃষ্টিপাত করে নেওয়া যাক্।
চলতি ভাষা বা চলিত ভাষা :
আধুনিক কালে বাংলা গদ্যে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহৃত মৌখিক ভাষাই প্রাধান্য লাভ করছে। অর্থাৎ গদ্যভাষা এসে গেছে আমাদের কথ্যভাষার কাছাকাছি। এতে সংস্কৃত ভাষার প্রভাব কম, তৎসম শব্দের প্রয়োগও কম, এবং সে সঙ্গে সমাপিকা ও অসমাপিকা ক্রিয়ার (শুনিতেছে, শুনিল), সর্বনাম (তাঁহারা) ও অনুসর্গের (ইহা) রূপ পূর্ণাঙ্গের পরিবর্তে হয়েছে সংক্ষিপ্ত। যেমন, শুনছে, শোনে, তাঁরা, এ ইত্যাদি।
তাছাড়াও কিছু অব্যয় ও ক্রিয়াবিশেষণের প্রয়োগেও ব্যতিক্রম রয়েছে। যেমন : -
সে সঙ্গে,
সাধু ভাষার কিছু উদাহরণ : -
চলিত ভাষার উদাহরণ : -
“বিগত শতকের ছয়ের দশকে, শুদ্ধ সাধু-ভাষায় মহাভারতের অনুবাদক কালীপ্রসন্ন সিংহ, কলকাতার বিশুদ্ধ অবিমিশ্র চলিত ভাষায় বাংলা সাহিত্যের একখানি Classic বা শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ লিখিলেন- ‘হুতোম পেঁচার নকশা’। সাধু-ভাষা ও চলিত-ভাষার মিলন, বা ঐক্য স্থাপিত করিতে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দান অপরিসীম। স্বামী বিবেকানন্দ ও চলিত-ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক। রবীন্দ্রনাথ ভাষা বিষয়ে ছিলেন সব্যসাচী। পরিণত বয়সে লেখা তাঁহার ‘জীবনস্মৃতি’ বিশুদ্ধ সাধু-ভাষায়, কিন্তু যৌবনের রচনা, ‘যুরোপ’ প্রবাসীর পত্র’ চলিত ভাষায় _ _ _”
বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, রাজেন্দ্র মিত্র এবং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন সাধু গদ্য ভাষাকে শ্রীমণ্ডিত করেন, এর প্রকাশ সম্ভাবনাকে আরও বিস্তৃত করেন, ঠিক ওই সময়ই প্যারীচাঁদ মিত্র এবং এর কিছু পরও কালীপ্রসন্ন সিংহ গদ্যভাষার জগতে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করলেন ‘আলালের ঘরের দুলাল’ এবং ‘হুতোম পেঁচার নকশা’ মৌলিক বাক্রীতি, দেশজ শব্দ, বিদেশি শব্দ, বাকভঙ্গির প্রয়োগ বাঙালি পাঠকদের যে চমকিত করেছে এ চমক আজও রয়ে গেছে। তবে ‘আলালী’ বা ‘হুতোমী’ ভাষা তৎকালীন বিদ্বজ্জনের অকুণ্ঠ সমর্থন যে লাভ করেছে তা বলা চলে না; বঙ্কিমচন্দ্র এ ভাষাকে প্রশংসা করলেও গ্রহণ করেননি।
চলতি ভাষার পক্ষে তাত্ত্বিক সমর্থন যুগিয়েছেন ১৮৭৭ সালে শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায় একটি ইংরেজি নিবন্ধে, Bengali, Spoken and Written এ। তাঁর অভিমত ছিল কৃত্রিম ভাষায় রচিত সাহিত্য প্রাণবন্ত হয় না। সাধুভাষা তো আসলে একটি কৃত্রিম, পরিশীলিত, শিষ্ট ভাষা, মানুষের মুখের ভাষা থেকে যার অবস্থান একটু দূরে। বিংশ শতকের প্রথম দিকেই প্রমথ চৌধুরীর ‘সবুজপত্র’ বাংলা ভাষায় এক বিরাট পরিবর্তনের সূচনা করে। এবং স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত এর প্রভাবে চলতি গদ্য লিখতে শুরু করেন। বিগত সত্তর আশি বছরে চলতি ভাষা সৃজনশীল সাহিত্য, প্রবন্ধ নিবন্ধের জগতে বিস্তর প্রভাব বিস্তার করেছে। সংবাদপত্র, লিটল ম্যাগাজিন, সাময়িক পত্রিকায়ও সাধুভাষার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে চলতি ভাষা। এখন পাঠ্যপুস্তক, স্কুল কলেজের উত্তরপত্র, শিক্ষকদের নোট এতেও চলতি ভাষার হয় জয়জয়কার।
আকাশবাণী এবং দূরদর্শনে তো চলতিভাষার প্রচলন একেবারে শুরু থেকেই। বর্তমানে বৈদ্যুতিন মাধ্যমের সমস্ত চ্যানেলে ওই চলতি ভাষা স্বাভাবিক ভাবেই সাধু ভাষার স্থান এখানে না থাকারই কথা। এ মুহূর্তে সাধুভাষা বাংলার অন্যতম মুদ্রণ মাধ্যম ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকার সম্পাদকীয় কলমের সংকীর্ণ পরিসরেই নিজের অবস্থানটুকু টিকিয়ে রেখেছে।