নিবন্ধ 
বঙ্গভবনের হয়ে ওঠার ইতিবৃত্ত
বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য
(সংগৃহীত: বঙ্গভবন উদ্বোধন স্মরণিকা : ২৭ কার্তিক ১৪২১ বঙ্গাব্দ)
slider 01

বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের স্থায়ী ঠিকানা ছিল না। জন্মলগ্ন ১৯৭৭ থেকে দীর্ঘদিন সম্মেলনের ঠিকানা থাকত প্রযত্নে সাধারণ সম্পাদকের ব্যক্তিগত আবাসস্থল। লেখক, শিল্পী, কবি এবং সংস্কৃতমনস্ক বাক্তিরা দীর্ঘদিন শিলচরের নরসিং হাইস্কুল, পাবলিক স্কুল, ডি.এন.এন.কে স্কুল বা গান্ধী শান্তি প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি স্থানে অস্থায়ীভাবে কার্যালয় করে কাজকর্ম করেছেন, সম্মেলনের অনেক অধিবেশন সুসম্পন্ন করেছেন।  সম্মেলনের স্থায়ী কার্যালয় নির্মাণে একটুকরো জায়গার

জন্য ব্যক্তিবর্গরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৯৪ সালে সম্মেলনের তদানীন্তন সভাপতি নৃপতিরঞ্জন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক বিজিৎ চৌধুরীর উদ্যোগে চাঁদমারিতে দূরদর্শন কেন্দ্রের নিকট মূল সড়কে ৪ (চার) কাঠার উপর একখণ্ড জমি মুখ্যমন্ত্রী হিতেশ্বর শইকিয়ার বদান্যতায় সম্মেলন লাভ করে। কিন্তু নানা কারণে ওই জমিতে দীর্ঘসূত্রিতায় স্থায়ী কার্যালয় নির্মাণ করা সম্ভব পর হয়ে ওঠেনি।

slider 01

বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের স্থায়ী ঠিকানা ছিল না। জন্মলগ্ন ১৯৭৭ থেকে দীর্ঘদিন সম্মেলনের ঠিকানা থাকত প্রযত্নে সাধারণ সম্পাদকের ব্যক্তিগত আবাসস্থল। লেখক, শিল্পী, কবি এবং সংস্কৃতমনস্ক বাক্তিরা দীর্ঘদিন শিলচরের নরসিং হাইস্কুল, পাবলিক স্কুল, ডি.এন.এন.কে স্কুল বা গান্ধী শান্তি প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি স্থানে অস্থায়ীভাবে কার্যালয় করে কাজকর্ম করেছেন, সম্মেলনের অনেক অধিবেশন সুসম্পন্ন করেছেন। সম্মেলনের স্থায়ী কার্যালয় নির্মাণে একটুকরো জায়গার জন্য ব্যক্তিবর্গরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৯৪ সালে সম্মেলনের তদানীন্তন সভাপতি নৃপতিরঞ্জন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক বিজিৎ চৌধুরীর উদ্যোগে চাঁদমারিতে দূরদর্শন কেন্দ্রের নিকট মূল সড়কে ৪ (চার) কাঠার উপর একখণ্ড জমি মুখ্যমন্ত্রী হিতেশ্বর শইকিয়ার বদান্যতায় সম্মেলন লাভ করে। কিন্তু নানা কারণে ওই জমিতে দীর্ঘসূত্রিতায় স্থায়ী কার্যালয় নির্মাণ করা সম্ভব পর হয়ে ওঠেনি।

বর্তমানে ওই জমিতে ২০১২ সালে মাননীয় সাংসদ কবীন্দ্র পুরকায়স্থের সাংসদ উন্নয়ন তহবিলের আড়াই লক্ষ টাকার চার সীমানার দেওয়াল নির্মাণ সহ গেট দিয়ে সম্মেলনের কেন্দ্রীয় সমিতির জায়গাটি সুরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু সাংস্কৃতিক সংস্থা 'কৃষ্টি বিবেকের' পাশের জমিটি আজও ওই অব্যবহৃত অবস্থায় রয়েছে। যাতায়াতের সুবিধা ও সহজে যোগাযোগের কেন্দ্র হিসাবে কাছাড় জেলা সমিতির নিজস্ব একখণ্ড জমির সন্ধান চলতে থাকে। ২০০৩ সালে শিলচর অধিবেশনের সময় কর্মঠ ও নিষ্ঠাবান সরকারি আধিকারিক দীনেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাস উৎসাহ নিয়ে সক্রিয়ভাবে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁরই উদ্যোগে শিলচর কোর্ট প্রাঙ্গণের উত্তরদিকে পুরসভার জমির পাশে ফরেস্ট অফিসের পূর্বদিকে সরকারি খাস জমির সন্ধান পাওয়া যায়। আসলে প্রাক্তন জেলা অতিরিক্ত উপাযুক্ত দীনেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাস এক সময় জেলার সেটেলমেন্ট অফিসারও ছিলেন। তাই তাঁর কাছে জায়গা জমির ব্যাপার-স্যাপার খুব সহজবোধ্য ছিল। তাঁরই ঐকান্তিক চেষ্টায় এবং আসামের মন্ত্রী গৌতম রায়ের উদ্যোগে প্রথম দফার বরাক উপত্যকা বঙ্গসাহিত্য সংস্কৃতি সম্মেলন সরকারি পরিত্যক্ত ডোবাখানায় পাঁচ কাঠার জমির বন্দোবস্ত পায়। একই সঙ্গে শিলচর ব্রিজ ক্লাবকে মাননীয় মন্ত্রী আড়াই কাঠা জমি বন্দোবস্ত দেন। এখানে উল্লেখ্য যে মন্ত্রী গৌতম রায় ওই সময় আসামের ভূমি ও রাজস্বমন্ত্রীর দায়িত্বেও ছিলেন। এর আগে জমির আবেদন নিয়ে তৈমুর রাজা চৌধুরী, সৌরীন্দ্র কুমার ভট্টাচার্য, অনন্ত দেব, প্রদীপ আচার্য, বিনোদ দেবনাথ, দীনেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাস, শ্যামলেন্দু চক্রবর্তী ও বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সন্তোষ মোহন দেবের তারাপুর বাড়িতে দেখা করেন। সকালে সাক্ষাতের জন্য সময় চাওয়ার সময় বিস্তারিতভাবে কেন্দ্রীয় সদস্য বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য সন্তোষমোহন দেবকে জানিয়েছিলেন। কথামত কাজ হয়। শ্রী দেব বঙ্গসাহিত্যকে একখণ্ড জমি বরাদ্দের ব্যাপারে তদানীন্তন জেলা উপাযুক্তের ল্যান্ড এডভাইসরি কমিটিতে সুপারিশ পাঠান। তখন জেলাশাসক ছিলেন প্রদীপ কুমার দাস।

বরাক উপত্যকা বঙ্গসাহিত্য সংস্কৃতি সম্মেলনকে পাঁচ কাঠা জমি সরকারি তরফে বরাদ্দের পর প্রচার মাধ্যমে গৌহাটি থেকে সংবাদ প্রচারিত হয় ১ (এক) বিঘা জমি সম্মেলনকে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে। আসলে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় পাঁচ কাঠায় এক বিঘা হয়। স্বাভাবিকভাবেই গৌহাটির সব সংবাদদাতাই এক বিঘা জমি দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করেন। এর পরপরই আমরা সদলবলে মন্ত্রী গৌতম রায়ের মেহেরপুর বাড়িতে ধন্যবাদ জানানোর জন্য দেখা করতে যাই। প্রসঙ্গক্রমে এক বিঘা জমির কথাটাও আলোচনায় আসে। সঙ্গে সঙ্গে তদানীন্তন জেলা সভাপতি দীনেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাস ও প্রদীপ আচার্য সহ আমরা মন্ত্রীকে অতিরিক্ত পাঁচ কাঠা জমি বরাদ্দের অনুরোধ জানালে মন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে তা গ্রহণ করেন এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে অতিরিক্ত চার কাঠা অর্থাৎ সর্বমোট নয় কাঠার জমির মালিকানা বরাক উপত্যকা বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের কাছাড় জেলা সমিতির কাছে আসাম সরকারের পক্ষ থেকে সমঝে দেওয়া হয়।

জমি অধিগ্রহণের পর বিড়ম্বনার শেষ ছিল না। একে তো ডোবাখানায় ঘর কীভাবে হবে তা নিয়েই আমরা দুশ্চিন্তায় ছিলাম, অন্যদিকে পুরসভার রাস্তার সম্মুখ থেকে কোর্ট প্রাঙ্গণ যাওয়ার সেই পুরানো রাস্তার পরিধি ছিল তিন ফুট। আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় অনন্ত দেব মহাশয় বরাবরই জেলা সমিতির নিজস্ব ভবনের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। তাঁরই আন্তরিকতায় চতুর্দশ শিলচর সম্মেলনে বেশ কিছু টাকা (১ লক্ষ ২৪ হাজার সুদ সহ) কোষাধ্যক্ষ হিসেবে তাঁর কাছে গচ্ছিত ছিল। তিনি সম্মেলনের সঞ্চিত টাকা ফিক্সড্ ডিপোজিট করে রেখেছিলেন। এর পরেও সপ্তদশ অধিবেশনের কিছু টাকা (৫১ হাজার) সম্মেলনের অভ্যর্থনা সমিতির সাধারণ সম্পাদক সুজিত কুমার ভট্টাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ শ্যামলেন্দু চক্রবর্তীর কাছে ছিল। আমাদের নিজস্ব গৃহ নির্মাণ করার জন্য মূলধন বলতে ওই টাকাই তখন সম্বল।

এরপর সম্মেলনের কর্মকর্তারা মাননীয় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সন্তোষমোহন দেব থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা এবং মাননীয় মন্ত্রী গৌতম রায় থেকে ৬ লক্ষ টাকা আর্থিক সহায়তার আশ্বাস পাওয়ার পরই বঙ্গভবনের শিলন্যাসের দিন স্থির করা হয়-৭ ডিসেম্বর ২০০৫ খ্রিঃ (২১ অগ্রহায়ণ ১৪১২ বাংলা)। ওই দিন কাছাড় জেলা সমিতির কার্যালয় ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন কেন্দ্রীয় ভারীশিল্পমন্ত্রী সন্তোষমোহন দেব ও প্রধান অতিথি হিসাবে ছিলেন ভূমি, রাজস্ব ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী গৌতম রায়। ওই শিলান্যাস অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিধায়ক বিমলাংশু রায়, পৌর সভানেত্রী শ্রীমতী বীথিকা দেব, জেলা সমিতির সম্পাদক প্রদীপ আচার্য। সভায় সভাপতিত্ব করেন জেলা সমিতির সভাপতি দীনেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাস। অনুষ্ঠান পরিচালনায় বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য। শিলান্যাসের আগে বঙ্গভবনের অ্যাপ্রোচ রোড ৩ ফুট থেকে ১২ ফুট এক সকালে ধুম ধাড়াক্কাভাবে হয়ে গেল। সম্মেলনের কর্মকর্তা তৈমুর রাজা চৌধুরী জেলা উপাযুক্ত সুনন্দা সেনগুপ্তকে অনুরোধ করে জেলা সহকারি ভূমি অভিবাসন আধিকারিক নির্মল দেবনাথকে দিয়ে পাশের জেলা উপাযুক্তের চতুর্থ শ্রেণির কোয়ার্টারের জমি কিছুটা ছেড়ে রাস্তা চলাচলে সুবিধা করে দেন। বর্তমানে ওইখানে একটি সরকারি অফিসও তৈরি হয়েছে, এতে পূর্বসূরিদের দূরদর্শিতার ছাপ স্পষ্ট।

বঙ্গভবন নির্মাণে প্রথম পর্বে যারা আর্থিকভাবে সাহায্য করেছেন তাদের তালিকা দেওয়া হল-

  1. সন্তোষমোহন দেব, সাংসদ ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী : ৫,০০,০০০/-
  2. গৌতম রায়, মাননীয় মন্ত্রী, আসাম : ৬,০০,০০০/-
  3. সুস্মিতা দেব, সভানেত্রী আঁশিয়া : ৫,০১, ০০০/-
  4. কুতুব আহমেদ মজুমদার, বিধায়ক, সোনাই : ২৫,০০০/-
  5. তৈমুর রাজা চৌধুরী : ৫০০/-
  6. হেমলতা ইন্ড্রাস্ট্রিজ, শিলচর : ২০০০/-

ইতিমধ্যে জেলা সমিতির উদ্যোগে ‘কাছাড় জেলা ভবন নির্মাণ কমিটি’ নামে একটি উপসমিতি গঠন করা হয়। দীনেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাস পদাধিকারে সভাপতি এবং প্রদীপ আচার্য সম্পাদক মনোনীত করা হয়। উপসমিতিতে সদস্যরা ছিলেন অনন্ত দেব, মৃণালকান্তি দত্ত বিশ্বাস, তৈমুর রাজা চৌধুরী, সমীর কুমার দাস, শান্তনু দাস, সুজিত কুমার ভট্টাচার্য, সৌরীন্দ্রকুমার ভট্টাচার্য ও বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য। পরবর্তীতে আরো চারজন সদস্য অর্ন্তভুক্ত হন। এরা হলেন সমীর দাস, শ্যামলকান্তি দেব, বিনোদ দেবনাথ ও প্রণব কুমার দাস । বঙ্গভবনের শিলান্যাসের পর-পরই শান্তনু দাসকে দায়িত্ব দিয়ে বঙ্গভবনের নির্মাণের কাজ শুরু করা হল। কিন্তু ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক কাজকর্মে শ্রীদাস ব্যস্ত থাকার দরুণ পরবর্তীতে প্রদীপ আচার্য ও বিশ্বনাথ ভট্টাচার্যকে আহ্বায়ক করে নির্মাণ উপসমিতিকে বঙ্গভবনের কাজকর্মের জন্য দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।

বিভিন্ন সময়ে সময়ে বঙ্গভবনের কাজে শিলচর পলিটেকনিকের প্রাক্তন অধ্যাপক প্রণব কুমার দাস সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিঙের কাজে সহায়তা করেছেন। এছাড়া এনআইটির অধ্যাপক অসীম দে, শিলচর উন্নয়ন সংস্থার রাহুল দাশগুপ্ত পরামর্শ দেন। ইলেকট্রিক্যাল কাজে রন্টু বাঙ্গি, চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট শিবব্রত দত্ত সহায়তায় ছিলেন। অসীম দে মূল কাজের প্ল্যান এস্টিমেট ও ভূমি পরীক্ষার দায়িত্বও পালন করেন। বরাক উপত্যকা বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের প্রবীণ সদস্য অনন্ত দেব, প্রসূনকান্তি দেব এবং অনুরূপা বিশ্বাসের প্রেরণা নির্মাণ সমিতির কাজে উৎসাহিত করেছে। শিলচর উন্নয়ন সংস্থার তদানীন্তন চেয়ারম্যান পার্থরঞ্জন চক্রবর্তী বঙ্গভবনের কাজে অফিস ফিজের টাকা ছাড় দিয়েছিলেন এবং পৌরসভার সভানেত্রী বীথিকা দেব বিভিন্নভাবে পৌরসভার পক্ষে সহযোগিতা করেছেন।

প্রায় ১৮ লক্ষ ৫০ হাজার টাকার প্রায় ১২০০ বর্গফুটের প্রথম দফায় বঙ্গভবনের কাজের পর ৩ আগস্ট ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে ১৮ শ্রাবণ ১৪১৫ বাংলা মাননীয় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সন্তোষমোহন দেব বঙ্গভবনের দ্বারোদ্ঘাটন করেন। ওইদিন আসামের মাননীয় মন্ত্রী গৌতম রায়, প্রধান অতিথি, আঁশিয়ার সভানেত্রী সুস্মিতা দেব প্রমুখ বিশিষ্টজনেরা উপস্থিত ছিলেন। এই হল 'বঙ্গভবন' নির্মাণের প্রথম পর্ব। সম্প্রসারিত বঙ্গভবন তৈরি করার সময় সবারই ইচ্ছা ছিল প্রথম নির্মিত ঘরগুলো যেন রক্ষা করা হয় এবং যে অনুযায়ী নবনির্মিত ভবনের সঙ্গে ওই সাবেক অংশটিও সুকৌশলে জুড়ে দেওয়া হয়েছে, কারণ প্রথম পর্যায়ের ওই ভবনের সঙ্গে আমাদের অনেকের স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে।


বঙ্গভবন- আমার কথা
দীনেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাস
(সংগৃহীত: বঙ্গভবন উদ্বোধন স্মরণিকা : ২৭ কার্তিক ১৪২১ বঙ্গাব্দ)
slider 01

বরাক উপত্যকা বঙ্গসাহিত্য ও সম্মেলনের শিলচরে প্রতিষ্ঠিত 'বঙ্গভবন' সম্পর্কে নৈর্ব্যক্তিকভাবে কিছু বলা বা লেখা একান্ত প্রয়োজন। তবুও কিছু ব্যক্তিগত কথা এসে পড়ে। তাই ব্যক্তিগত কথা দিয়েই শুরু করছি।

সরকারি চাকরিতে কর্মরত থাকা অবস্থাতেই বঙ্গসাহিত্য ও সম্মেলনের প্রতি একটা আকর্ষণ ও দুর্বলতা আমার মনের মধ্যে ছিল। করিমগঞ্জ ও শিলচরে অনুষ্ঠিত একাধিক বার্ষিক/দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে দর্শক ও শ্রোতা হিসাবে উপস্থিত থেকেছি। সম্মেলনের একজন সাধারণ সদস্য হিসাবে ২০০৩ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে নরসিং উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত সমিতির দ্বিবার্ষিক সাধারণ সভায় উপস্থিত ছিলাম। খুবই অপ্রত্যাশিতভাবে সেই সভাতেই আমাকে কাছাড় জেলা সমিতির সভাপতি পদে নির্বাচিত করা হয়।

সেই বছরের মার্চ মাসে করিমগঞ্জে অনুষ্ঠিত দ্বিবার্ষিক অধিবেশনের অব্যবহিত পরে মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে জেলা সমিতির প্রথম কার্যকরী সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং ভবন নির্মাণের জমির জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারি আধিকারিকবর্গের নিকট আবেদন জানানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেই সভাতে জেলা সমিতির নামে পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কে একটি অ্যাকাউন্ট খোলারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তার কয়েক দিন পূর্বে অর্থাৎ মে মাসের ৫ তারিখে জেলা সমিতির সভাপতি হিসাবে স্থায়ী কার্যালয় নির্মাণের জন্য একখানা আবেদন জেলা সভাপতি হিসাবে কাছাড় জেলার উপায়ুক্তের নিকট দেওয়া হয়েছিল। একই সঙ্গে শিলচরের বাইরের সচল ও সম্ভাব্য ১৮টি আঞ্চলিক সমিতির জন্য সরকারি জমি বণ্টনের অনুরোধ জানিয়ে কাছাড় জেলা ভূ-বাসন আধিকারিকের নিকট আবেদন জানানো হয়। জেলা ভূ-বাসন আধিকারিক লিখিতভাবে তাঁর অধীনস্থ আধিকারিকদের প্রস্তাব দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। কিন্তু বিশেষভাবে তদ্বির নিতে অক্ষমতার জন্য এই প্রচেষ্টা সাফল্য লাভ করেনি।

শিলচর শহরে সরকারি জমি পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী হওয়ায় ২০০৩ সনের ১৯ অক্টোবর জেলা সমিতির বর্ধিত সভায় মূল প্রস্তাব সংশোধন ক্রমে তেরোজন সদস্য বিশিষ্ট একটি নির্মাণ সমিতি গঠিত হয়। সদস্যরা ছিলেন- দীনেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাস, অনন্ত দেব, সুজিত কুমার ভট্টাচার্য, মৃণালকান্তি দত্ত বিশ্বাস, সমীর কুমার দাস, প্রদীপ আচার্য, শান্তনু দাস, বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য, তৈমুর রাজা চৌধুরী, সৌরীন্দ্রকুমার ভট্টাচার্য, শ্যামলকান্তি দেব, বিনোদবিহারী দেবনাথ ও প্রণব কুমার দাস।

তখন পর্যন্ত জেলা সমিতির হাতে কোনও অর্থ ছিল না। অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে উল্লেখ করতে হয় সম্মেলনের বরিষ্ঠ সদস্য অনন্ত দেব মহাশয় যিনি সম্মেলনের একাদশ অধিবেশনের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন তিনি জেলা সমিতির সম্পাদক প্রদীপ আচার্যকে ডেকে তাঁর হাতে গচ্ছিত অর্থ ভবন নির্মাণের জন্য দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং সেই বৎসরের ১৩ ডিসেম্বর জেলা কমিটির বর্ধিত জরুরি সভায় এক লক্ষ টাকার সেভিংস সার্টিফিকেট এবং নগদ তিন হাজার কুড়ি টাকা হস্তান্তর করেন।

একটি বিষয় উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে স্থায়ী ভবন নির্মাণের জন্য ভাবনাচিন্তা শুরু হওয়া থেকেই কার্যকরী সমিতির সদস্য ও সাধারণ সদস্যদের মধ্যে ভবন নির্মাণের বিষয়ে লক্ষণীয় উৎসাহ পরিলক্ষিত হয়। তদুপরি এই সময়কালে জেলা সমিতির বিভিন্ন কার্যসূচি যথারীতি উদ্দীপনার সঙ্গে পালন করা হয়। এই সব কাজে সম্পাদক প্রদীপ আচার্যের দৌড়ঝাঁপ এবং ঘন ঘন বৈঠক ডেকে আলোচনা ও পরামর্শ নেওয়ার প্রয়াস আমার কাছে আজ অসাধারণ বলে মনে হয়। লক্ষণীয় যে নতুন কার্যকরী সমিতি গঠনের এক বৎসরের মধ্যে ভবন নির্মাণের জন্য অর্থ হাতে আসে এবং ভবন নির্মাণ উপসমিতিও গঠিত হয়।

এবার আসি ভবন নির্মাণের জন্য জমি সংগ্রহের বিষয়ে। কাছাড় জেলার উপায়ুক্তের নিকট ২০০৩ এর মে মাসে আবেদন জানানোর পর ভূবাসন আধিকারিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় এবং বর্তমানে যে স্থানে বঙ্গভবন অবস্থিত তারই একটা অংশ বন্দোবস্ত দেওয়ার জন্য ভূ-বাসন আধিকারিক উপায়ুক্তের নিকট প্রস্তাব দেন। সেই প্রস্তাব যাতে পরবর্তী মহকুমাভিত্তিক জমি বণ্টন উপদেষ্টা কমিটিতে উত্থাপিত এবং অনুমোদিত হয় সেজন্য উপদেষ্টা কমিটির প্রায় সকল সদস্যের কাছে ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ রাখা হয়। এত তোড়জোর করার প্রধান কারণ হল প্রস্তাবিত ভূমিটি বণ্টনযোগ্য সাধারণ খাস জমি ছিল না, সেটা ছিল জেলা আদালতের সংরক্ষিত জমি এবং সেই মুহূর্তে শিলচর এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের নামে নির্দিষ্ট। অবশেষে ২০০৪ সনের ২২ জানুয়ারি ভূমি বণ্টন উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক বসে এবং ৮ নং প্রস্তাবে ৫ কাঠা জমি বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের নামে বণ্টনের অনুমোদন দেওয়া হয়। সেই বৎসরের ২৫ মার্চ তারিখে প্রস্তাবটি উপায়ুক্ত আসাম সরকারের নিকট প্রেরণ করেন। কিন্তু প্রস্তাবে একটি ভুল ছিল যা আমাদের পক্ষে গ্রহণযোগ্য ছিল না। প্রস্তাব ছিল ভূমি 'বন্দোবস্তের'-যার জন্য জমির মূল্যের প্রিমিয়াম দিতে হত। তাই উপায়ুক্তের সঙ্গে দেখা করে ভূমি বন্দোবস্তের প্রস্তাবের স্থলে ভূমি বণ্টনের সংশোধিত নতুন প্রস্তাব পাঠানো হয়। এখানে একটি ঘটনার উল্লেখ না করে পারছি না। জেলা সভাপতি হিসাবে আমি ও সম্পাদক হিসাবে প্রদীপ আচার্য সমিতির টাকা পয়সার হিসাবপত্র যথাযথভাবে রাখার তাগিদ অনুভব করি, তাই কলেজ রোডের কালিদাস চৌধুরীর বাড়িতে যাই এই বিষয়ে তাঁর উপদেশ নেওয়ার জন্য। কয়েক মিনিট কথাবার্তার পরই তিনি বলেন রাজ্যের মন্ত্রী গৌতম রায় মহাশয়ের সঙ্গে ব্যক্তিগত কাজের জন্য তিনি দেখা করতে যাবেন। তখনই আমি ও প্রদীপ মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ নেওয়ার জন্য কালিদাস চৌধুরীর সঙ্গে সার্কিট হাউসে চলে যাই। কালিদাস চৌধুরী তাঁর ব্যক্তিগত কথা বলার পর আমি মন্ত্রীকে বঙ্গসাহিত্যের জমির যে প্রস্তাব সচিবালয়ে গেছে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলি। মন্ত্রী গৌতম রায় মহাশয় উৎসাহ দেখিয়ে বলেন তিনি দিসপুর থেকে জমি বণ্টনের সরকারি অনুমোদন পাঠিয়ে দেবেন এবং তাঁর সঙ্গে আসা সুজন দত্তের নিকট সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র দেওয়ার জন্য বলেন। মন্ত্রী শ্রীরায় আরও উৎসাহিত হয়ে বলেন যে ঘর নির্মাণের জন্য তিনি ব্যক্তিগতভাবে পাঁচ লক্ষ টাকা দেবেন। মন্ত্রীর এই ঘোষণা আমাদের কাছে মেঘ না চাইতেই জল পাওয়ার মতো মনে হয়েছিল।

আজ দশ বৎসর পর মন্ত্রী গৌতম রায়ের সঙ্গে সেদিনের সাক্ষাৎকার এক সুদুরপ্রসারী ঘটনা বলে মনে হয়। কারণ সেদিনের সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়েই বঙ্গভবন নির্মাণের কাজে মন্ত্রী গৌতম রায় জড়িয়ে পড়েন। তাঁর সাহায্য ছাড়াও বঙ্গভবন অবশ্যই হত কিন্তু সেদিনের পর বঙ্গভবনের প্রথম অংশের নির্মাণ এবং বর্তমান ভবনের সম্প্রসারিত অংশের যে বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে তা হয়তো আমাদের পক্ষে স্বপ্নই থেকে যেতো।

ফিরে আসি ভবন নির্মাণর জন্য জমি বণ্টনের কথায়। ২০০৪ সনের অক্টোবর মাসে মৃদুল মজুমদার ভূমি বণ্টনের জমির বণ্টন পত্র সম্পাদকের হাতে তুলে দেন। জেলা সমিতির পক্ষ থেকে ডিসি কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হলে ২ সেপ্টেম্বর এক চিঠিযোগে উপায়ুক্ত শ্রীমতী সুনন্দা সেনগুপ্ত কাছাড় জেলার ভূ-বাসন আধিকারিককে জমির দখল সমঝে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। সেই অনুসারে সেপ্টেম্বর মাসের ২৯ তারিখে প্রদত্ত পাঁচ কাঠা জমির সীমানা সহ দখল সমঝে দিয়ে জমি হস্তান্তরের প্রমাণপত্র দেওয়া হয়।

জমি পাওয়ার পরও আমাদের উৎসাহ শেষ হয়নি। তারপর ৩০/১১/২০০৪-এ উপায়ুক্তকে ধন্যবাদ জানিয়ে একখানা চিঠি দেওয়া হয় এবং সেই চিঠিতে সম্মেলনের প্রয়োজনীয় অডিটোরিয়াম, আর্কাইভ, লাইব্রেরি, কনফারেন্স হল, প্রকাশনা কেন্দ্র, অতিথি ভবন, আর্ট গ্যালারি ইত্যাদি গড়ে তোলার জন্য প্রাপ্ত জমি সংলগ্ন আরও পাঁচ কাঠা জমির জন্য আবেদন জানানো হয়। আমাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে উপায়ুক্ত ভুবাসন আধিকারিকের নিকট প্রতিবেদন চেয়ে পাঠান এবং মহকুমা ভূমি বণ্টন কমিটির অনুমোদন নিয়ে যথারীতি সম্মেলনের নামে এর সুপারিশ করে রাজ্য সরকারের নিকট পাঠান। অতিরিক্ত ভূমি অনুমোদন ২০০৫ সনের ডিসেম্বর মাসে উপায়ুক্তের নিকট আসে এবং উপাযুক্তের নির্দেশ মত ২০ ডিসেম্বর ভুবাসন আধিকারিকের পক্ষে সরকার অনুমোদিত চার কাঠা জমির দখল প্রমাণপত্র সহ আমাদের সমঝে দেওয়া হয়। এখানেও একটি কথা অবশ্যই উল্লেখ করা প্রয়োজন যে দ্বিতীয় কিস্তির চার কাঠা জমি সরকার কর্তৃক বণ্টনের সময় গৌতম রায় রাজস্ববিভাগের মন্ত্রীত্বের দায়িত্বে ছিলেন। নতুন নিয়ম অনুসারে শহরাঞ্চলে জমি আবণ্টনে মন্ত্রীসভার অনুমোদন বাধ্যতামূলক ছিল। এবারও আমাদের জমি পাবার জন্য দিসপুর সচিবালয়ে যেতে হয়নি।

আবার ভবন নির্মাণের অর্থের কথায় ফিরে আসি। যেহেতু সম্মেলনের নিজস্ব কোনও জমি ছিল না তাই ভবন নির্মাণের তহবিলের প্রশ্ন এতদিন উঠেনি। যদিও তখন জেলা সমিতির সদস্য সংখ্যা পাঁচশতের কাছাকাছি ছিল, দ্বিবার্ষিক সদস্য চাঁদা মাত্র কুড়ি টাকা ছিল বলে সঞ্চয়েরও কোনও সুযোগ ছিল না। ১৯৯১ এবং ১৯৯৪ সালে শিলচরে যথাক্রমে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের একাদশ ও চতুর্দশ অধিবেশনের উদ্ধৃত্ত এক লক্ষ ছেষট্টি হাজার টাকার উপর নির্ভর করে আমরা অগ্রসর হই। ইতিমধ্যে আসামের আবগারি মন্ত্রী গৌতম রায় ছয় লক্ষ, কেন্দ্রীয় ভারীশিল্প মন্ত্রী সন্তোষমোহন দেব পাঁচ লক্ষ, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আঁশিয়ার পক্ষে শ্রীমতী সুস্মিতা দেব পাঁচ লক্ষ, সোনাই বিধানসভার তৎকালীন বিধায়ক কুতুব আহমেদ মজুমদারের নিকট থেকে পঁচিশ হাজার টাকা অর্থাৎ মোট যোলো লক্ষ পঁচিশ হাজার টাকা আমাদের হাতে আসে। উপরোক্ত অর্থ একদিনে আসেনি। প্রায় এক বৎসর সময়কালের মধ্যে এসেছিল।

সম্মেলনের কার্যকরী সমিতির ৩০/১০/২০০৫ তারিখের সিদ্ধান্ত অনুসারে ২০০৫ সনের ৭ ডিসেম্বর তারিখে শিলান্যাসের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জেলা সমিতির সদস্য এবং বিশিষ্টজনদের শিলান্যাস অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। শিলান্যাস করেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সন্তোষমোহন দেব ও আসামের রাজস্ব ও আবগারি মন্ত্রী গৌতম রায় ও আরও বিশিষ্টজনেরা। শিলান্যাস অনুষ্ঠানে মন্ত্রী শ্রীরায় বলেন যে সদরঘাট সেতু পেরিয়ে শহরে প্রবেশ করেই চোখে পড়বে বাঙালিদের এই স্মারক ভবন। তাই এটি হওয়া চাই সবদিক থেকে দর্শনীয়।

ভবন নির্মাণের নকশা ও এস্টিমেট তৈরি করেন এনআইটির অধ্যাপক অসীম দে। মোট ৬ টি পিলার সম্মিলিত প্রায় ১১০০ বর্গফুট আয়তনের ভবনের কাজ শুরু হয়। প্রাপ্ত জমিতে ব্রিটিশ আমলের শতাধিক বৎসরের পুরানো পুকুর থাকাতে পাম্প লাগিয়ে জল নিষ্কাশন ও বহু ট্রাক মাটি ফেলে কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। পুকুরের পাড় সংলগ্ন সম্মিলিত জমি ভরাট করে বাঁশ ও টিনের চাল দিয়ে একটি অস্থায়ী গৃহ কাজের সুবিধার জন্য তৈরি করা হয়। পরবর্তীতে ছোটোখাটো বৈঠকও এই গৃহে অনুষ্ঠিত হয়। নির্মাণ সমিতির পক্ষে নির্মাণের কাজ পরিচালনার জন্য শান্তনু দাসকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি নিজ কর্ম ব্যস্ততার মধ্যেও ভবন নির্মাণের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। নির্মাণ কাজ চলাকালীন সদস্যদের অনেকেই প্রত্যেকদিনই উপস্থিত হতেন। প্রায় ছয় সাত মাসের মধ্যে পাইলিং করে পিলার বসানোর ও টাইবিমের কাজ সম্পন্ন হয়। এতবড় কাজের দায়িত্বে ভয়েরও কারণ থাকে তাই কাজ চলাকালীন শহরের বিশিষ্টজনকে সুযোগমত এনে কাজ দেখানো হয়েছে। তাঁদের প্রশ্নের উত্তরে আমরা বলতাম এটা Social Audit। বিশিষ্টজনের মধ্যে দীপক ভট্টাচার্য, বাদল দে, ভক্তিমাধব চট্টোপাধ্যায় ও পরিমল শুরুবৈদ্যের নাম মনে আছে। ভবন নির্মাণের কাছ অগ্রসর হওয়ার পর দেখা গেল নির্মাণ কাজ সারাক্ষণ তদারকির প্রয়োজন আছে। যেহেতু সমিতি নিজেদের দায়িত্বেই কাজ চালিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। জেলা সমিতির সিদ্ধান্তমতে তাই কাজের দায়িত্ব সমিতির সম্পাদক প্রদীপ আচার্যকে দেওয়া হয়। কিছুদিন পর সমিতির পুরনো সদস্য বিশ্বনাথ ভট্টাচার্যকে নির্মাণ উপসমিতির কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কাজ চলাকালীন এনআইটির অধ্যাপক অসীম দে প্রয়োজনীয় উপদেশ প্রদান করেছেন। কিছুদিন পর আমার সহপাঠী ইঞ্জিনিয়ার শিলচর পলিটেকনিকের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক প্রণব কুমার দাসকে অনুরোধ করাতে তিনি নিয়মিত দেখাশোনার দায়িত্ব নেন। ভবন নির্মাণ সম্পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত অসীম দে ও প্রণব কুমার দাস তাঁদের মূল্যবান সময় এই কাজে ব্যয় করেন। একটি কথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে এই কাজের জন্য তাঁরা কোনও পারিশ্রমিক গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। ভবন নির্মাণের সংগৃহীত অর্থ থেকে এক টাকাও নির্মাণ কাজের বাইরে অন্যভাবে খরচ করা হয়নি এবং কোনও সদস্যই দায়িত্ব পালনের জন্য কোনও পারিশ্রমিক নেননি।

জমি প্রাপ্তি ও ভবন নির্মাণের কাজ শেষ করার মধ্যে সংশ্লিষ্ট সবাইকে কত দৌড়ঝাঁপ ও পরিশ্রম করতে হয়েছে তা ভাবলে নিজেরই অবিশ্বাস হয়। ভবন নির্মাণের কাজ চলাকালীন মন্ত্রী গৌতম রায় সুযোগ মত নির্মাণস্থলে আসতেন এবং কাজের অগ্রগতি দেখে পরামর্শাদি দিতেন। হঠাৎ একদিন মন্ত্রীর নজরে আসে বঙ্গভবনের জন্য প্রদত্ত ভূমির উত্তরদিকে P. W.D. রাস্তা সংলগ্ন ঘরগুলি। প্রশ্নের উত্তরে যখন বলা হল যে ঘরগুলো উপায়ুক্তের কার্যালয়ে কর্মরত কর্মচারীদের, তখনই তিনি বললেন যে এই ঘরগুলোকে স্থানান্তরিত করতে হবে। তারপর যখনই তিনি বঙ্গভবনে এসেছেন তখনই কাছাড়ের উপায়ুক্ত গৌতম গাঙ্গুলি মহাশয়কে ডেকে এনে ঘরগুলো সরানোর ব্যাপারে পরামর্শ দিতেন। এরপর শুরু হয় আমাদের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে উপায়ুক্তকে চিঠি মারফত ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ এবং উপায়ুক্তেরর পক্ষ থেকে সরকারের সঙ্গে চিঠি আদান-প্রদান। অবশেষে সরকারের টাউন এন্ড কান্ট্রি প্লানিং বিভাগের পক্ষ থেকে প্রথম কিস্তির চার লক্ষ টাকা মঞ্জুর হয় এবং ওই বিভাগেরই তত্ত্বাবধানে অফিস পাড়ার ডাকবাংলোর পেছনে ঘরগুলো নতুনভাবে তৈরি করে দেওয়া হয়।

এতসব কর্মকাণ্ডের মধ্যে আরও যেসব কাজের কথা মনে পড়ে তা মোটামুটি নিম্নরূপ:-
ভবন নির্মাণের অনুমতির জন্য নকশাদি দিয়ে শিলচর উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যানের নিকট আবেদন দাখিল। শিলচর পৌরসভার চেয়ারম্যানের নিকট বঙ্গভবনের হোল্ডিং নম্বর দেওয়ার আবেদন ও পৌরসভা কর্তৃক আদায়কৃত ট্যাক্স মকুব করা এবং বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য পৌরসভার No objection সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন করা। প্রায় একই সাথে জনস্বাস্থ্য কারিগরি বিভাগ থেকে পানীয়জল সংযোগের জন্য পৌরসভার নিকট আবেদন জানানো হয়। কিছুদিনের মধ্যেই বিদ্যুৎ ও নলবাহিত জলসংযোগের কাজ সম্পন্ন হয়। নতুন ভবনের অভ্যন্তরীণ বৈদ্যুতিকীকরণের কাজ আমাদের সমিতির প্রবীণ সদস্য রন্টু বাগচীর তত্ত্বাবধানে অতি সুন্দরভাবে যথাসময়ে সম্পন্ন হয়। মন্ত্রী গৌতম রায় মহাশয়ের পরামর্শে বঙ্গভবন সম্প্রসারণের জন্য Untide Fund থেকে অর্থ বরাদ্দের জন্য আমাদের হাতে প্রস্তুত থাকা এক কোটি তেত্রিশ লক্ষ চুয়ান্ন হাজার টাকার একটি Plan estimate উপায়ুক্তের নিকট দাখিল করা হয়। Plan estimateটি তৈরি করেন পলিটেকনিকের অধ্যাপক প্রণব কুমার দাসের ছাত্র সুরজিত নন্দী। পরবর্তীতে বঙ্গ সাহিত্যের পক্ষ থেকে আসামের অতিরিক্ত মুখ্য সচিবকে (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগ) পত্রযোগে অর্থ বরাদ্দের জন্য চিঠি দেওয়া হয়।

এবার আসি ভবনের নামকরণ নিয়ে। কার্যকরী সমিতির ২০০৮ সনের ৬ জুলাই তারিখের সভায় এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। কেউ প্রস্তাব করেন 'শহীদ স্মৃতি ভবন' আবার কেউ প্রস্তাব করেন ভাষা আন্দোলনের স্মরণে নাম রাখা হউক 'উনিশে'। সম্পাদক প্রস্তাব করেন 'বঙ্গভবন' যা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।

প্রাপ্ত জমিতে গভীর পুকুর থাকায় সেটা ভরাট করা সমিতির এক চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। শিলচর পৌরসভার সঙ্গে আলোচনাক্রমে পৌরসভা কর্তৃক খনন করা বিভিন্ন নর্দমার মাটি বেশ কিছুদিন ধরে ফেলা হল। বর্তমান শিলচর আঞ্চলিক সমিতির সহ সভাপতি পরিতোষ দে ও তৎকালীন জেলা সম্পাদক প্রদীপ আচার্য অনেক রাত পর্যন্ত উপস্থিত থেকে মাটি ফেলার কাজে তদারকি করেন।

ভবন নির্মাণের কাজে আর যেসব সংস্থা ও ব্যক্তির নিকট থেকে সমিতি সাহায্য পেয়েছে তাদের নাম উল্লেখ না করলে অসম্পূর্ণ থেকে যায়। উপায়ুক্তের রাজস্ববিভাগ, ভূবাসন আধিকারিকের কার্যালয় শিলচর পৌরসভা, শিলচর ডেভেলপমেন্ট অথরিটি এবং পার্থরঞ্জন চক্রবর্তী, বীথিকা দেব, সুজন দত্ত, অসীম দে, মৃদুল মজুমদার, রাহুল দাশগুপ্ত, প্রণব কুমার দাস, সুরজিত নন্দী এবং আরও অনেকে। ভবন নির্মাণ চলাকালীন সময়ে পূর্বাপর যথারীতি শিলচর নরসিং হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল ও ডিএনএনকে বালিকা বিদ্যালয়ের গৃহ আমাদের প্রস্তুতিপর্বের সভা ও অনুষ্ঠানাদির অনুমতি দেওয়ার জন্য সম্মেলনের কাছাড় জেলা সমিতি স্কুল কর্তৃপক্ষের নিকট কৃতজ্ঞ। অবশেষে কার্যকরী সমিতির ২৭/৭/০৮ তারিখে সভায় উদ্বোধনের দিন সাব্যস্ত হয় পরের মাসের ৩ তারিখ রবিবার। নতুন ভবনের পূর্বদিকে যে খালি জায়গা ছিল সেখানে এবং তারও পূর্বদিকে ছোট রাস্তা এবং পৌরসভার পাশে যে মিষ্টির দোকান সেই অংশে মঞ্চ এবং প্যান্ডেল বানানোর সিদ্ধান্ত হয়। এই কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় চক্কেশ্বরী ভাণ্ডারের মালিক জয় বরদিয়াকে। সেই সভায় নতুন ভবনের উদ্বোধক, প্রধান অতিথি, বঙ্গভবন সম্পর্কীয় প্রতিবেদন পাঠ, অনুষ্ঠানের সভাপতি, অনুষ্ঠানের ঘোষক এবং সভাশেষে ধন্যবাদ জ্ঞাপন কে করবেন এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কাছাড় জেলার সকল আঞ্চলিকের সদস্যদের এবং করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দির জেলা সমিতিকে উপস্থিত থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানানো স্থির হয়। অনুষ্ঠানে সবাইকে জলযোগে আপ্যায়ন করারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

কার্যকরী সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে এক সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সভায় সভাপতি দীনেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাস, সম্পাদক প্রদীপ আচার্য, কেন্দ্রীয় সমিতির সহসভাপতি সুজিত ভট্টাচার্য প্রাক্তন কেন্দ্রীয় সম্পাদক বিনোদ বিহারী দেবনাথ সহ শ্যামলকান্তি দেব, তৈমুর রাজা চৌধুরী, শান্তনু দাস, বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য, অনিল পাল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সাংবাদিক সম্মেলনে কর্মকর্তারা আশা প্রকাশ করেন এই নতুন ভবন বরাক উপত্যকার বিভিন্ন ভাষা গোষ্ঠীর শিল্প সাহিত্য তথা সংস্কৃতির বিকাশে এক নতুন দিশা দেবে। উপস্থিত সাংবাদিকগণকে কর্মকর্তারা আরও জানান যে এই ভবনটি পরবর্তীকালে সম্প্রসারিত করে তৈরি করা হবে ও তাতে থাকবে সংগ্রহশালা, লাইব্রেরি, প্রেক্ষাগৃহ, আর্ট গ্যালারি ইত্যাদি। ইতিমধ্যে প্রায় দেড় কোটি টাকার প্রস্তাব রাজ্য সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছে বলে জানানো হয়।

উদ্বোধনের আগের দিনই বঙ্গভবন প্রাঙ্গণ সুন্দর সাজে সেজে ওঠে এবং সব সদস্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। পরের দিন অর্থাৎ ৩রা আগস্ট ২০০৮ সন (১৮ শ্রাবণ ১৪১৫ বঙ্গাব্দ) রবিবার বেলা ১০টায় অব্যবহিত পর থেকেই সম্মানিত অতিথিগণ এসে উপস্থিত হতে থাকেন। আনন্দমুখর পরিবেশের মধ্যে ফিতা কেটে নতুন ভবনের দ্বারোদ্ঘাটন করেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সন্তোষমোহন দেব এবং ভবনের ভিতরেই সুন্দরভাবে স্থাপন করা প্রদীপ প্রজ্বলন করেন আসামের মন্ত্রী গৌতম রায়। নতুন ভবনটি সকল অভ্যাগতের প্রশংসা অর্জন করতে সমর্থ হয়। এর পরই সভার কাজ শুরুর ঘোষণা করেন ঘোষক সব্যসাচী পুরকায়স্থ। একে একে অভ্যাগতদের সমাদর সহকারে মঞ্চে নিয়ে আসা হয়। মঞ্চে আসন অলংকৃত করেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সন্তোষমোহন দেব, রাজ্যের মন্ত্রী গৌতম রায়, করিমগঞ্জের সাংসদ ললিতমোহন শুক্লবৈদ্য, প্রাক্তন সাংসদ কমলেন্দু ভট্টাচার্য, উপায়ুক্তের প্রতিনিধি অতিরিক্ত উপায়ুক্ত এইচ. এন. লস্কর, পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান (বর্তমানে প্রয়াত) সুদীপ দত্ত, আঁশিয়ার চেয়ারপার্সন শ্রীমতী সুস্মিতা দেব ও জেলাশাসক গৌতম গাঙ্গুলী জায়া সঞ্চিতা গাঙ্গুলী, কাছাড় জেলার পুলিশ সুপার ভায়োলেট বরুয়া, কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সম্পাদক যথাক্রমে প্রয়াত শ্যামলেন্দু চক্রবর্তী ও তরুণ দাস, সম্মেলনের জ্যেষ্ঠ সদস্য অনন্ত দেব, জেলা সমিতির প্রাক্তন সভাপতি সুজিত ভট্টাচার্য, জেলা সমিতির তৎকালীন সভাপতি ও সম্পাদক যথাক্রমে দীনেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাস ও প্রদীপ আচার্য। সভায় সভাপতিত্ব করেন দীনেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাস। একে একে মঞ্চে উপবিষ্ট সকল সম্মানিত অভ্যাগতদের উত্তরীয় ও ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ করা হয়। এরপর উদ্বোধনী সঙ্গীত সৌরীন্দ্র কুমার ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে পরিবেশন করেন কাছাড় জেলা সমিতির শিল্পীবৃন্দ। যতদূর মনে পড়ে শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন সৌরীন্দ্র কুমার ভট্টাচার্য, লুৎফা আরা চৌধুরী, বাপী রায়, তাপসী বণিক, সত্যরঞ্জন রায়, গৌরব বণিক, শুভদীপ আচার্য, গৌরী শুক্লবৈদ্য, মনোজিত দত্ত ও সঞ্জয় দেব।

সভার শুরুতে সম্পাদক আচার্য স্বাগত ভাষণ দেন। তারপর উদ্বোধক সন্তোষমোহন দেব তাঁর ভাষণে বলেন কোনও ভাষা কারো উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যায় না। এই অঞ্চলের মানুষ তা প্রমাণ করেছেন। বরাক ও ব্রহ্মপুত্রের মধ্যে সমন্বয়ের সোপান গড়ে তোলারও তিনি আহ্বান জানান। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি গৌতম রায় বলেন এই ভবন আরও আগেই হওয়া উচিত ছিল। এটা না করে দেওয়ার জন্য জনপ্রতিনিধিদের গাফিলতিকে তিনি দায়ী করে দোষ নিজের ঘাড়েও টেনে নেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন শিলচরের এই বঙ্গভবন ভবিষ্যতে বাঙালিদের গর্বের কারণ হবে। বঙ্গভবনের নির্মাণ সংক্রান্ত কাজ উচ্চমানের হয়েছে বলে মন্তব্য করেন। সাংসদ ললিতমোহন শুক্লবৈদ্য বলেন মন্ত্রী গৌতম রায় স্বপ্নদর্শী। সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। প্রাসঙ্গিক বক্তব্য রাখেন শ্যামলেন্দু চক্রবর্তী, তরুণ দাস, ভায়োলেট বরুয়া, সুদীপ দত্ত, হোসেন আহমেদ লস্কর। অনুষ্ঠানের সভাপতি দীনেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাস বরাক উপত্যকায় যে চোরাগুপ্তাভাবে ভাষিক আগ্রাসন চলছে সে সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করে দেন। সভাপতির ভাষণের পর ধন্যবাদসূচক বক্তব্য রাখেন তৈমুর রাজা চৌধুরী।

উদ্বোধন অনুষ্ঠানের মধ্যেই বঙ্গভবন গড়ে তোলার কাজ থেমে থাকেনি। গৃহস্থ বাড়ির মতো উঠান ও সীমানাজুড়ে বাঁশের ফেন্সিং দেওয়া, নথিপত্র সংরক্ষণের জন্য প্রয়াত দেবেন্দ্রশংকর দত্ত ও প্রয়াত অনিল ওরফে কার্তিক বিশ্বাস মহাশয়ের পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে দান হিসাবে আলমারি গ্রহণ, শিলচর শহরের প্রায় প্রতিটি ব্যাঙ্কে চেয়ার, টেবিল, আলমারি ইত্যাদি সামগ্রী সাহায্য হিসাবে পাওয়ার আবেদন, এমনকি Goodrick Tea Company যাদের কাছাড় জেলায় চা বাগান আছে তাদের কলকাতার কার্যালয়ের সাথে বঙ্গভবনে লাইব্রেরি গড়ে তোলার জন্য সাহায্যপ্রার্থী হয়ে চেষ্টা করা হয়েছে। তারপর বঙ্গভবনের সম্মুখভাগের নয় কাঠা খাস জমি পাওয়ার জন্য আবেদন এবং সেই আবেদন ২০০৯ সনের ১২ নভেম্বর তারিখে মহকুমা ভূমি বণ্টন কমিটির অনুমোদনসহ জেলা উপায়ুক্তের পক্ষ থেকে সরকারের নিকট প্রস্তাব পাঠানোর ব্যাপারে অনবরত চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

বঙ্গভবনের প্রথম পর্যায়ের কাজের বিবরণ শেষ হল। পরবর্তী পর্ব হল আরেক ইতিহাস। সে ইতিহাস তো এ ক্ষুদ্র পরিসরে ধরা সম্ভব নয়। এ কাজটুকু সম্মেলনের অন্য সহযোগীর হাতেই থাকুক এবং এ স্মারক পত্রিকায়ই তা লিপিবদ্ধ হবে বলে আমার বিশ্বাস।


বঙ্গভবন আদিপর্ব
প্রদীপ আচার্য
(সংগৃহীত: বঙ্গভবন উদ্বোধন স্মরণিকা : ২৭ কার্তিক ১৪২১ বঙ্গাব্দ)

১৯৯৯ সালে নরসিং উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বরাক উপত্যকা বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের দ্বিবার্ষিক সাধারণ সভায় আমাকে শিলচর আঞ্চলিক সমিতির সম্পাদক হিসাবে মনোনীত করা হয়। যদিও নয়ের দশকের শুরু থেকেই শিলচর আঞ্চলিক সমিতির কার্যকরী সদস্য হিসাবে কাজ করে গেছি। আমার প্রিয় স্যার প্রসূনবাবু (প্রসুনকান্তি .

slider 01
দেব) প্রায় প্রতিদিনই আমার আর্ট স্টুডিওতে আসতেন এবং বঙ্গসাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতেন। এই আলোচনায় একদিকে যেমন সম্মেলনের বিভিন্ন অনুষ্ঠান সম্পর্কিত প্রসঙ্গ আসত তেমনি আসত সম্মেলনের একটি স্থায়ী ঠিকানার প্রশ্নটিও। একদিন স্যার বললেন করিমগঞ্জে ও করিমগঞ্জ জেলা সমিতির জন্য সরকার থেকে নিজস্ব কার্যালয়ের ভবনের জন্য ...

ভূমি বরাদ্দ করা হয়েছে কিন্তু কাছাড় জেলা সমিতির স্থায়ী কোনও ঠিকানা আজও হল না। তবে দীনেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাস এবং সন্তোষ কুমার গুপ্ত এ দু′জন ব্যক্তিকে এবার সম্মেলনের সদস্য করেছি যারা করিমগঞ্জ বঙ্গসাহিত্য বিভিন্ন অনুষ্ঠান তথা অধিবেশনেও বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছেন। আবার দীনেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাস মহাশয় করিমগঞ্জ জেলা সমিতির জমি পাওয়ার ব্যাপারেও সহায়তা করেছেন। এসব কথা বলে স্যার বললেন, ‘তুমি কিন্তু সব সময় ওদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করবে’। আমিও যথারীতি এ নির্দেশ পালন করার চেষ্টা করে গেছি। ২০০১ সালে সম্মেলনের শিলচর আঞ্চলিক কার্যকরী সমিতি গঠনের সময় দীনেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাস মহাশয়কে কোন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়ে আসার চেষ্টা করেও সফল হইনি। ইতিমধ্যেই দীনেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাস মহাশয়ের সঙ্গে আমাদের হৃদ্যতা বাড়তে লাগল। এরই মধ্যে এসে গেল আবার নতুন কার্যকরী সমিতি গঠন পর্ব। ০১-০২-০৩ (১৮ই মাঘ ১৪০৯ বঙ্গাব্দ) তারিখে শিলচর নরসিং উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিবার্ষিক সাধারণ সভা। এই সভায় বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের কাছাড় জেলা সমিতির সভাপতি হিসাবে দীনেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাসকে মনোনীত করা হল এবং সম্পাদক হিসাবে আমাকে। প্রভাস সেন মজুমদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভা কদিন পরই শিলচরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের বিংশতিতম অধিবেশন শেষ হলে কাছাড় জেলার নবনির্বাচিত সমিতি ২১ ফেব্রুয়ারি ২০০৩ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা উদ্‌যাপনের মাধ্যমে নব-নির্বাচিত কাছাড় জেলা সমিতির প্রথম অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয় স্থানীয় গান্ধী শান্তি প্রতিষ্ঠানে। অনুষ্ঠান শেষ করে বাড়ি ফেরার পর রাত প্রায় ১১টা নাগাদ বিশ্বাসদা (দীনেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাস সম্বোধনে আমার ঈষৎ কুষ্ঠা আঁচ করে এই সমাধানটা তিনিই বাতলে দিয়েছিলেন। ফোন করে অনুষ্ঠানের ত্রুটি বিচ্যুতি নিয়ে আলোচনা করে জিজ্ঞেস করলেন ‘আচ্ছা বলতো বঙ্গসাহিত্যের অনুষ্ঠানে লোক কম হয় কেন?’ আমার তাৎক্ষণিক জবাব, ‘আমাদের বসার কোন নির্দিষ্ট জায়গা নেই তাই আমরা কোন অনুষ্ঠানকে সেভাবে organise করতে পারি না, হয়ত এজন্যই লোক কম হয়।’ শুনে তিনি বললেন, ‘কাল দিনের বেলা তুমি ফ্রি আছ কি? কেন?’ জিজ্ঞেস করলে বিশ্বাসদা বললেন, ‘না, তাহলে তোমাকে নিয়ে একটু ল্যান্ড সেটেলমেন্ট অফিসে যেতাম।’ শুনে বললাম, ‘আমি ফ্রি থাকি আর নাই বা থাকি, যাব।’ তিনি বললেন ‘তাহলে সকাল এগারোটায় আমার বাড়ি চলে আসবে।’ যথারীতি সকালে হাজির হলে তিনিও আমার বাইকে চেপে বসলেন। সেটেলমেন্ট অফিসে আমরা ঢুকলাম। একে একে করণিক থেকে আধিকারিক অনেকের সাথে পরিচয় করে দিলেন। লক্ষ্য করলাম বিশ্বাসদা সম্পর্কে অফিসের সবার গভীর শ্রদ্ধাবোধ। যা'ই হোক বিশ্বাসদা কাছাড় জেলা সমিতির কার্যালয়ের জন্য প্রয়োজনীয় খাস জমির ব্যাপারে খোঁজ খবর নিলেন আর সেদিন থেকেই শুরু হয়ে গেল আমাদের অন্য এক মিশন। এরপর ২৭ মে ২০০৩ কাছাড় জেলা কার্যকরী সমিতির প্রথম বৈঠকে জেলা সমিতির স্থায়ী কার্যালয় ভবন না থাকায় যে অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় তা নিবারণকল্পে কাছাড় জেলা সমিতির নিজস্ব জায়গা তথা ভবনের জন্য জেলা সমিতির পথ থেকে সংশ্লিষ্ট সরকারি আধিকারিক বর্গের কাছে আবেদন জানানোর জন্য এক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। যদিও ইতিমধ্যেই অর্থাৎ ৫ মে ২০০৩ আমরা উপায়ুক্ত প্রদীপ দাস মহাশয়ের কাছে আমাদের আবেদন দাখিল করে নিয়েছিলাম। যাতে পরবর্তী ল্যান্ড এডভাইসরি কমিটিতে আলোচ্য সূচিতে এটা স্থান পায়। ইতিমধ্যেই এক অনুষ্ঠানে অনন্ত দেব মহাশয়ের সঙ্গে দেখা হলে তিনি আমাকে তাঁর বাড়িতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন এবং বললেন অনেক কথা আছে সম্ভব হলে জেলা সভাপতিকেও নিয়ে যাওয়ার জন্য বললেন। একদিন সময় করে সভাপতিকে নিয়ে অনন্ত দেব মহাশয়ের বাড়িতে হাজির হলাম। তিনি আনন্দিত হলেন। প্রস্তাবিত জমির ব্যাপারে অনেক কথা হল। তিনি বলেন, ‘একাদশ অধিবেশনের উদ্বৃত্ত টাকা ব্যাঙ্কে রাখা আছে এটা আমি এই জেলা সমিতির কাছে হস্তান্তর করতে চাই যাতে প্রস্তাবিত কার্যালয় ভবনের কাজে এটা লাগতে পারে।’ আমি একটু অবাকই হয়ে ছিলাম কারণ অনেকদিন থেকেই এই উদ্বৃত্ত টাকা হস্তান্তরের জন্য সম্মেলন কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করে আসছিলেন কিন্তু তিনি রাজি হননি।

slider 01

১৯৯৯ সালে নরসিং উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বরাক উপত্যকা বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের দ্বিবার্ষিক সাধারণ সভায় আমাকে শিলচর আঞ্চলিক সমিতির সম্পাদক হিসাবে মনোনীত করা হয়। যদিও নয়ের দশকের শুরু থেকেই শিলচর আঞ্চলিক সমিতির কার্যকরী সদস্য হিসাবে কাজ করে গেছি। আমার প্রিয় স্যার প্রসূনবাবু (প্রসুনকান্তি দেব) প্রায় প্রতিদিনই আমার আর্ট স্টুডিওতে আসতেন এবং বঙ্গসাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতেন। এই আলোচনায় একদিকে যেমন সম্মেলনের বিভিন্ন অনুষ্ঠান সম্পর্কিত প্রসঙ্গ আসত তেমনি আসত সম্মেলনের একটি স্থায়ী ঠিকানার প্রশ্নটিও। একদিন স্যার বললেন করিমগঞ্জে ও করিমগঞ্জ জেলা সমিতির জন্য সরকার থেকে নিজস্ব কার্যালয়ের ভবনের জন্য ভূমি বরাদ্দ করা হয়েছে কিন্তু কাছাড় জেলা সমিতির স্থায়ী কোনও ঠিকানা আজও হল না। তবে দীনেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাস এবং সন্তোষ কুমার গুপ্ত এ দু′জন ব্যক্তিকে এবার সম্মেলনের সদস্য করেছি যারা করিমগঞ্জ বঙ্গসাহিত্য বিভিন্ন অনুষ্ঠান তথা অধিবেশনেও বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছেন। আবার দীনেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাস মহাশয় করিমগঞ্জ জেলা সমিতির জমি পাওয়ার ব্যাপারেও সহায়তা করেছেন। এসব কথা বলে স্যার বললেন, ‘তুমি কিন্তু সব সময় ওদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করবে’। আমিও যথারীতি এ নির্দেশ পালন করার চেষ্টা করে গেছি। ২০০১ সালে সম্মেলনের শিলচর আঞ্চলিক কার্যকরী সমিতি গঠনের সময় দীনেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাস মহাশয়কে কোন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়ে আসার চেষ্টা করেও সফল হইনি। ইতিমধ্যেই দীনেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাস মহাশয়ের সঙ্গে আমাদের হৃদ্যতা বাড়তে লাগল। এরই মধ্যে এসে গেল আবার নতুন কার্যকরী সমিতি গঠন পর্ব। ০১-০২-০৩ (১৮ই মাঘ ১৪০৯ বঙ্গাব্দ) তারিখে শিলচর নরসিং উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিবার্ষিক সাধারণ সভা। এই সভায় বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের কাছাড় জেলা সমিতির সভাপতি হিসাবে দীনেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাসকে মনোনীত করা হল এবং সম্পাদক হিসাবে আমাকে। প্রভাস সেন মজুমদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভা কদিন পরই শিলচরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের বিংশতিতম অধিবেশন শেষ হলে কাছাড় জেলার নবনির্বাচিত সমিতি ২১ ফেব্রুয়ারি ২০০৩ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা উদ্‌যাপনের মাধ্যমে নব-নির্বাচিত কাছাড় জেলা সমিতির প্রথম অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয় স্থানীয় গান্ধী শান্তি প্রতিষ্ঠানে। অনুষ্ঠান শেষ করে বাড়ি ফেরার পর রাত প্রায় ১১টা নাগাদ বিশ্বাসদা (দীনেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাস সম্বোধনে আমার ঈষৎ কুষ্ঠা আঁচ করে এই সমাধানটা তিনিই বাতলে দিয়েছিলেন। ফোন করে অনুষ্ঠানের ত্রুটি বিচ্যুতি নিয়ে আলোচনা করে জিজ্ঞেস করলেন ‘আচ্ছা বলতো বঙ্গসাহিত্যের অনুষ্ঠানে লোক কম হয় কেন?’ আমার তাৎক্ষণিক জবাব, ‘আমাদের বসার কোন নির্দিষ্ট জায়গা নেই তাই আমরা কোন অনুষ্ঠানকে সেভাবে organise করতে পারি না, হয়ত এজন্যই লোক কম হয়।’ শুনে তিনি বললেন, ‘কাল দিনের বেলা তুমি ফ্রি আছ কি? কেন?’ জিজ্ঞেস করলে বিশ্বাসদা বললেন, ‘না, তাহলে তোমাকে নিয়ে একটু ল্যান্ড সেটেলমেন্ট অফিসে যেতাম।’ শুনে বললাম, ‘আমি ফ্রি থাকি আর নাই বা থাকি, যাব।’ তিনি বললেন ‘তাহলে সকাল এগারোটায় আমার বাড়ি চলে আসবে।’ যথারীতি সকালে হাজির হলে তিনিও আমার বাইকে চেপে বসলেন। সেটেলমেন্ট অফিসে আমরা ঢুকলাম। একে একে করণিক থেকে আধিকারিক অনেকের সাথে পরিচয় করে দিলেন। লক্ষ্য করলাম বিশ্বাসদা সম্পর্কে অফিসের সবার গভীর শ্রদ্ধাবোধ। যা'ই হোক বিশ্বাসদা কাছাড় জেলা সমিতির কার্যালয়ের জন্য প্রয়োজনীয় খাস জমির ব্যাপারে খোঁজ খবর নিলেন আর সেদিন থেকেই শুরু হয়ে গেল আমাদের অন্য এক মিশন। এরপর ২৭ মে ২০০৩ কাছাড় জেলা কার্যকরী সমিতির প্রথম বৈঠকে জেলা সমিতির স্থায়ী কার্যালয় ভবন না থাকায় যে অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় তা নিবারণকল্পে কাছাড় জেলা সমিতির নিজস্ব জায়গা তথা ভবনের জন্য জেলা সমিতির পথ থেকে সংশ্লিষ্ট সরকারি আধিকারিক বর্গের কাছে আবেদন জানানোর জন্য এক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। যদিও ইতিমধ্যেই অর্থাৎ ৫ মে ২০০৩ আমরা উপায়ুক্ত প্রদীপ দাস মহাশয়ের কাছে আমাদের আবেদন দাখিল করে নিয়েছিলাম। যাতে পরবর্তী ল্যান্ড এডভাইসরি কমিটিতে আলোচ্য সূচিতে এটা স্থান পায়। ইতিমধ্যেই এক অনুষ্ঠানে অনন্ত দেব মহাশয়ের সঙ্গে দেখা হলে তিনি আমাকে তাঁর বাড়িতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন এবং বললেন অনেক কথা আছে সম্ভব হলে জেলা সভাপতিকেও নিয়ে যাওয়ার জন্য বললেন। একদিন সময় করে সভাপতিকে নিয়ে অনন্ত দেব মহাশয়ের বাড়িতে হাজির হলাম। তিনি আনন্দিত হলেন। প্রস্তাবিত জমির ব্যাপারে অনেক কথা হল। তিনি বলেন, ‘একাদশ অধিবেশনের উদ্বৃত্ত টাকা ব্যাঙ্কে রাখা আছে এটা আমি এই জেলা সমিতির কাছে হস্তান্তর করতে চাই যাতে প্রস্তাবিত কার্যালয় ভবনের কাজে এটা লাগতে পারে।’ আমি একটু অবাকই হয়ে ছিলাম কারণ অনেকদিন থেকেই এই উদ্বৃত্ত টাকা হস্তান্তরের জন্য সম্মেলন কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করে আসছিলেন কিন্তু তিনি রাজি হননি।

১ কার্তিক ১৪১০ বঙ্গাব্দ (১৯ অক্টোবর ২০০৩) নরসিং উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বরাক উপত্যকা বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন, কাছাড় জেলা সমিতির এক বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়।

এই সভায় বরাক উপত্যকা বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন 'কাছাড় জেলা ভবন নির্মাণ কমিটি' নামে একটি উপসমিতি গঠন করা হয়। অনধিক নয় জনের এই সমিতিতে প্রয়োজনে আরও বিশিষ্ট সদস্যদের অন্তর্ভুক্তি করার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। সমিতিটির সদস্যবৃন্দ-

  1. সভাপতি- দীনেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাস
  2. সম্পাদক- প্রদীপ আচার্য
  3. সদস্য- সুজিৎ কুমার ভট্টাচার্য
  4. সদস্য- অনন্ত দেব
  5. সদস্য- মৃণাল কান্তি দত্তবিশ্বাস
  6. সদস্য- সমীর কুমার দাস
  7. সদস্য- তৈমুর রাজা চৌধুরী
  8. সদস্য- শান্তনু দাস
  9. সদস্য- বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য

পরবর্তী কিছুদিনের মধ্যেই অবশ্য কাছাড় জেলা সমিতির প্রাক্তন সভাপতি সৌরীন্দ্র কুমার ভট্টাচার্যকে নির্মাণ কমিটির সদস্য করা হয়।

২৬ অগ্রহায়ণ ১৪১০ বঙ্গাব্দ (১৩ ডিসেম্বর ২০০৩) বিকেল চারটায় কাছাড় জেলা কার্যকরী সমিতির এক বর্ধিত জরুরি সভা আহ্বান করা হয়।

১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে শিলচরে অনুষ্ঠিত বরাক উপত্যকা বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের একাদশ অধিবেশনের উদ্বৃত্ত অর্থ তৎকালীন কোষাধ্যক্ষ (একাদশ অধিবেশনের অভ্যর্থনা সমিতির) অনন্ত দেব জেলা সভাপতি দীনেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাস এবং সম্পাদক প্রদীপ আচার্যের হাতে তুলে দেন। এতে ১ লক্ষ টাকার সেভিংস সার্টিফিকেট এবং নগদ ৩,৮২০ (তিন হাজার আটশত কুড়ি) টাকা। সভা একাদশ অধিবেশনের অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি সরোজ কুমার দাস এবং সম্পাদক বিজিৎ চৌধুরীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।

ইতিমধ্যেই ল্যান্ড এডভাইসরি কমিটিতে যাতে জমি সংক্রান্ত আমাদের আবেদন মঞ্জুর হয় তার জন্য ল্যান্ড এডভাইসরি কমিটির সদস্যদের সঙ্গে দেখা করে কেন আমাদের একখণ্ড জমির প্রয়োজন তা তাদের বুঝিয়ে বলার সিদ্ধান্ত হয়। এই লক্ষ্যে প্রথমেই আমরা মাননীয় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সন্তোষমোহন দেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। নির্মাণ কমিটির সদস্য বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য এই সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে দেন। সন্তোষমোহন দেবের পরামর্শক্রমে তৎক্ষণাৎই সৌরীন্দ্রকুমার ভট্টাচার্য জেলা উপায়ুক্তের প্রতি একখানা পত্র লেখেন এবং শ্রীদেব পত্রটিতে সাক্ষর করে জেলা উপায়ুক্তের কাছে প্রেরণ করেন। সন্তোষমোহন দেব আশ্বাস দেন। এ ব্যাপারে তিনি প্রয়োজনীয় সহায়তা করবেন। ল্যান্ড এডভাইসরি কমিটির সভায় সম্মেলনের জমির সেই আবেদন মঞ্জুর হয়ে যায়। এরপর তা আসাম সরকারের স্বীকৃতির জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দিসপুর সচিবালয়ে পাঠানো হয়। সেখান থেকে এটা যাতে সরকারি অনুমোদন লাভ করে এর চেষ্টা অব্যাহত থাকে। সম্মেলনের প্রাক্তন সভাপতি ড. সুবীর করের ভাই সচিবালয়ের বিশিষ্ট কর্মী। তাঁর সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়। এভাবেই চলতে থাকে আমাদের অপেক্ষা। আর এরই মধ্যে আসামের মাননীয় মন্ত্রী গৌতম রায় ভূমি ও রাজস্ব বিভাগের দায়িত্ব লাভ করেন। বঙ্গসাহিত্যের অন্যতম শুভাকাঙ্ক্ষী কালীদাস চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে আমরা সভাপতি ও সম্পাদক শিলচর আবর্তভবনে মন্ত্রী গৌতম রায়ের সঙ্গে দেখা করে জমির ব্যাপারে আবেদন জানাই। আমাদের কাছ থেকে সব শুনে তিনি বললেন, 'জমির ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকুন জমির ব্যবস্থা তো হবেই। আর আমি সেখানে আপনাদের বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনের কার্যালয় বানানোর জন্য পাঁচ লক্ষ টাকা দেব।' যদিও তখন পর্যন্ত আমরা আর্থিক সাহায্যের ব্যাপারে কোন আবেদন রাখিনি। খুবই উৎসাহিত হয়ে আমরা বাড়ি ফিরলাম। এরপর শুধুই অপেক্ষা ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের এক দুপুরে মন্ত্রী গৌতম রায়ের স্থানীয় প্রতিনিধি মৃদুল মজুমদারের একটি ফোন পেলাম, হ্যালো বলায় অন্য প্রান্ত থেকে বললেন 'আচার্যি এই মাত্র ডেপুটি কমিশনারে অফিসে একটি ফেক্স এসেছে যে বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনকে আসাম সরকার থেকে এক টুকরো জায়গা দেওয়া হয়েছে। এটা কি তোমাদের বঙ্গসাহিত্য সম্মেলন? জায়গার পরিমাণ ১ বিঘা।' প্রথম কথাটায় লাফিয়ে উঠলাম কিন্তু দ্বিতীয় লাইন শুনে কিছুটা দমে গেলাম, তবুও আশায় বুক বেঁধে বললাম, 'হ্যাঁ এটা আমাদেরই'। দমে যাওয়ার কারণটা ছিল আমরা আবেদনই করেছি দশ কাঠা জায়গার জন্য সেখানে এক বিঘা অর্থাৎ বিশ কাঠা কী করে হবে? পরে বুঝলাম ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার মাপকাঠি আর এই অঞ্চলের জমির মাপকাঠি তো আলাদা হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার পাঁচ কাঠায় এক বিঘা যা আমাদের বরাক উপত্যকায় বিশ কাঠা। যাই হোক তাৎক্ষণিক বিহ্বলতা কাটিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমি কোথায় আসব এক্ষুনি এটা দেখতে চাই।’ মজুমদার বললেন, ‘আমি এখন কংগ্রেস অফিসে আছি’। সঙ্গে সঙ্গে হাতের কাজ রেখে বাইক স্টার্ট দিলাম দু-তিন মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। কাগজটা হাতে নিয়েই লাফিয়ে উঠলাম- হ্যাঁ এ তো আমাদেরই। মজুমদার এবং মন্ত্রী গৌতম রায়কে ধন্যবাদ জানিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ছুটলাম সভাপতির বাড়িতে। ফ্যাক্স দেখে তিনিও ভীষণ আনন্দিত। আমরা একটু অবাক হলাম জায়গা দেওয়া হয়েছে পাঁচ কাঠা যদিও ল্যান্ড এডভাইসরি কমিটিতে দশ কাঠা জায়গাই অনুমোদন লাভ করেছিল। যাই হোক প্রথমে ভবন নির্মাণ কমিটির সদস্যদের এবং পরে যতটা সম্ভব বাকি সদস্য এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের সুখবরটা জানালাম। এরপর আমরা জেলা উপায়ুক্ত শ্রীমতী সুনন্দা সেনগুপ্ত মহাশয়ার সঙ্গে দেখা করে সরকারি প্রদত্ত জমি হস্তান্তরের জন্য অনুরোধ জানাই। সঙ্গে সঙ্গে অ্যাসিস্ট্যান্ট সেটেলমেন্ট অফিসার সদর সার্কেল, শিলচর-এর সঙ্গে ও সাক্ষাৎ করে হস্তান্তরের দিন ধার্য করা হয়। ২৯ নভেম্বর ২০০৪ অকারণে কিছুটা বিলম্ব ঘটল। নির্দিষ্ট দিনে আমরা অর্থাৎ নির্মাণ কমিটির সদস্য এবং জেলা কার্যকরী সমিতির সদস্যরা সদরঘাটের অরুণ কুমার চন্দ রোডের নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছুলাম। ইতিপূর্বেই আমরা সভাপতি সম্পাদক সরকারি বিভাগীয় কর্মকর্তাদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে এসেছি। কিন্তু অন্তহীন প্রতীক্ষা। তখন আমাদের সদস্য তৈমুর রাজা চৌধুরীকে ব্যাপারটা জানালাম। তিনি জেলা উপায়ুক্তের সাথে যোগাযোগ করে সরকারি আধিকারিককে সঙ্গে নিয়ে এসে উপস্থিত হলেন। জমির সামনের রাস্তা অত্যন্ত সংকীর্ণ ছিল মাত্র চার ফুট, আমরা নিজেদের জন্য তো বটেই সেই সঙ্গে আমাদের পেছনের সারিতে প্রতিষ্ঠান আছে তাদের সুবিধার কথাও মাথায় রেখে নিজেদের জায়গা ছেড়ে শুরুতেই রাস্তার সাথে আরও দশ ফুট জুড়ে দিই। জায়গাটা ছিল একটা ডোবা কচুরিপানা এবং আগাছায় পূর্ণ। ফিতে ধরার জন্য সরকারি কর্মী কেউ যেতে পারছে না পেছনের (পশ্চিম) দিকে। আমি অবশ্য আগে থেকেই সেটা আঁচ করে আমার দীর্ঘদিনের কর্মচারী, জলের সঙ্গে যার মিতালি, সেই মনীন্দ্র দাস সাধু নামে যে অধিক পরিচিত তাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছিলাম। পরবর্তী সময়ে যে দীর্ঘদিন এই ভবন রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত ছিল। সভাপতি বিশ্বাসদা অনেক দিন থেকেই নিজ খরচায় অনেকগুলো আর সি সি পিলার বানিয়ে রেখেছিলেন। যাই হোক সাধু সেই কচুরিপানার উপর লিকলিকে একটা দুটো বাঁশ ফেলে পৌঁছে গেল ফিতে নিয়ে প্রায় একশো ফুট পশ্চিমে। জায়গা নির্দিষ্ট হল পেছনের বাকি অংশের জন্য আমাদের এবং ডিস্ট্রিক ব্রিজ অ্যাসোসিয়েশন, শিলচর-এর মাঝখানে দশ ফুট কোরিডর রাখা হল। দক্ষিণ দিকে ফিতে ধরতে গিয়ে আমরা দেখি বড়সড় কি যেন একটা নড়ছে। কচুরিপানা, আগাছা সরিয়ে দেখি একটা গরু তখনও জীবন্ত কবে এই ডোবায় পড়েছিল কে জানে। শুধু নাকটা উঁচিয়ে রেখে হৃদ্‌ স্পন্দনটাকে ধরে রেখেছে। সঙ্গে সঙ্গে আমরা কজন চেষ্টা করলাম এটাকে উঠানোর। কিন্তু পারলাম না। পরে পৌরসভা থেকে শ্রমিকদের ডেকে নিয়ে এসে বহু কষ্টে এটাকে ওঠানো হল। আশপাশের বাড়ি থেকে বস্তা জোগাড় করে প্রাণীটার শীত নিবারণের চেষ্টা করা হল।

দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষার অবসানে সবাই আনন্দিত কাছাড় জেলা সমিতির এক টুকরো জায়গা হয়েছে কিন্তু আমরা সভাপতি, সম্পাদক কিছুটা হতোদ্যম, কেননা মনে মনে যে প্লেন ছিল তা পাঁচ কাঠা জমিতে কিছুতেই মিলাতে পারছিলাম না। আমার এই বিমর্ষ ভাব দেখে অনন্ত দেব মহাশয় বললেন পাঁচ কাঠা তো অনেক জায়গা। তুমি আমার বাড়ি যাবে। চার কাঠা জায়গাতে কতকিছু করা যায় আমি তোমাকে দেখাব। একে একে সবাই চলে গেলেন। বাঁশের বেড়া দেওয়ার কাজ চলছে। হঠাৎ সভাপতি আমাকে বললেন 'প্রদীপ চল'। আমি বললাম ‘কোথায়?’ বললেন, ‘আগে বাইক স্টার্ট কর তারপর বলছি।’ তিনি চেপে বসলেন যেতে যেতে বললেন, ‘বাকি পাঁচ কাঠা আমাদের আদায় করতে হবে না?’ এ কথা বলে বললেন, ‘ডি সির অফিসে চল।’ আমি অভিভূত হলাম।

দুপুর গড়িয়ে গেছে আগেই কিন্তু তিনি এই টেবিল ওই টেবিলে ছোটাছুটি করতে লাগলেন। অনেক ফাইল ঘাঁটাঘাঁটির পর তিনি বললেন, 'দেখো কাণ্ড। ল্যান্ড এডভাইসরি কমিটিতে দশ কাঠার অনুমোদন থাকলেও এখান থেকে দিসপুরে আসাম সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছে শুধু পাঁচ কাঠা। যাই হোক এবার দেখো আমি কী করে বাকি জায়গা আদায় করি।' তারপর আরও অনেক দৌড়ঝাঁপ করে সন্ধ্যাবেলা আমরা বাড়ি ফিরলাম। পরবর্তী দুদিনে আমাদের জমির তিনদিকের সীমানার বেড়া দেওয়ার কাজ সমাধা হল। পশ্চিম প্রান্তে জলের গভীরতা বেশি থাকায় সেদিকে সম্ভব হল না। কাছাড় জেলা ভবন নির্মাণ কমিটির এক সভা ৫ ডিসেম্বর ২০০৪ সন্ধ্যা ৬ টায়। কমিটির অন্যতম সদস্য অনন্ত দেব মহাশয়ের বাড়িতে সৌরীন্দ্রকুমার ভট্টাচার্যের পৌরোহিত্যে অনুষ্ঠিত এই সভায় কাছাড় জেলা প্রস্তাবিত ভবনের জায়গা পাওয়ার ব্যাপারে সভাপতি দীনেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাস এবং সম্পাদক প্রদীপ আচার্যের নিরলস প্রচেষ্টার জন্য আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা হয়। সেই সঙ্গে এই জায়গা পাওয়ার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সন্তোষমোহন দেব এবং আসামের মন্ত্রী গৌতম রায়কে চিঠি দিয়ে ধন্যবাদ জানানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সেই সঙ্গে করিমগঞ্জে অনুষ্ঠিতব্য ২১তম অধিবেশনের আগেই কাছাড় জেলা ভবনের শিলান্যাস করার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। বঙ্গসাহিত্যের প্রস্তাবিত কার্যালয় ভবনের শিলান্যাস করার জন্য ক্রমশ চাপ বাড়তে লাগল। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০০৫ স্থানীয় দীননাথ নবকিশোর উচ্চতর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ উদ্‌যাপনের অনুষ্ঠান চলছে। অনন্ত দেব আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘সবাই অরগেনাইজার হয় না, তাই বলেও লাভ নেই, তোমার কাছে প্রত্যাশা অনেক শিলান্যাস যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করে ফেল।’

কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমার এবং বিশ্বাসদা দুজনেরই এ ব্যাপারে সহমত ছিল যে একবার যদি এই পাঁচ কাঠার উপর কাজ শুরু হয়ে যায় তাহলে হয়ত পরবর্তী পাঁচ কাঠার তাগিদটা হ্রাস পাবে এবং শেষ পর্যন্ত ঐ পাঁচ কাঠা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে এবং এতে আমাদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য কোনোটাই সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হবে না। অপেক্ষায় ছিলাম আমরা উপযুক্ত সময়ের এবং অবশেষে আমরা যখন বুঝতে পারলাম যে আমাদের উদ্দেশ্য প্রায় সফল হতে যাচ্ছে তখনই শিলান্যাসের তারিখ নিয়ে ভাবতে বসলাম যদিও ইতিমধ্যে আরও একটা বছর প্রায় কেটে গেছে।

৩০-১০-০৫ নরসিং উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কাছাড় জেলা সমিতির এক বর্ধিত কার্যকরী সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে আগামী শীতের মরশুমের শুরুতেই যাতে কাছাড় জেলার প্রস্তাবিত ভবনের শিলান্যাস করা যায় তা সুনিশ্চিত করতে ৭ ডিসেম্বর ২০০৫ দিনটিকে ধার্য করা হয়। এবং দলমত নির্বিশেষে সবাইকে এই শিলান্যাস অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হবে বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ৭ ডিসেম্বর ২০০৫ বুধবার বেলা ১২ টায় বরাক উপত্যকা বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের কাছাড় জেলা সমিতির ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হবে। ঐ দিন ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন কেন্দ্রীয় ভারী শিল্প ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ও জলসম্পদ দফতরের মন্ত্রী সন্তোষমোহন দেব। অনুষ্ঠানে মুখ্য অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকবেন আসামের ভূমি রাজস্ব সমাজকল্যাণ মন্ত্রী গৌতম রায়।

সম্মানিত অতিথি হিসাবে আসামের জনস্বাস্থ্য কারিগরি ও আইনমন্ত্রী দীনেশ প্রসাদ গোয়ালা, সমবায় ও পর্যটন মন্ত্রী মিসবাহুল ইসলাম লস্কর, রাজ্যসভা সাংসদ কর্ণেন্দু ভট্টাচার্য, বিধায়ক বিমলাংশু রায়, শিলচর পৌরসভার সভানেত্রী শ্রীমতী বীথিকা দেব এবং জেলা উপায়ুক্ত শ্রীমতী সুনন্দা সেনগুপ্তকে মঞ্চে সম্মানিত অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ করা হবে। কাছাড় জেলা সমিতির সভাপতি দীনেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাসের পৌরোহিত্যে অনুষ্ঠিতব্য এই সভায় উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করবেন সম্পাদক প্রদীপ আচার্য, সভা সঞ্চালনায় থাকবেন বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য। এছাড়াও শিলান্যাসের প্রস্তুতি অস্থায়ী মঞ্চ ও মিলনায়তন এবং আনুষঙ্গিক ব্যবস্থাদির জন্য ভবন নির্মাণ সমিতির সদস্য শান্তনু দাসকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তহবিল সংগ্রহের জন্য চতুদর্শ অধিবেশনের উদ্বৃত্ত টাকা যা তৎকালীন অধিবেশন সম্পাদক সুজিৎ কুমার ভট্টাচার্যের তত্ত্বাবধানে ব্যাঙ্কে গচ্ছিত আছে, তা কাছাড় জেলা সমিতিকে হস্তান্তরের জন্য সুজিৎ কুমার ভট্টাচার্য মহাশয়কে অনুরোধ জানানো হয়।

১৮-১১-০৫ সন্ধ্যা ৬ টায় এবং ২-১২-০৫ সন্ধ্যা ৬-৩০ মিনিটে স্থানীয় রাধামাধব বালিকা বিদ্যালয়ে কাছাড় জেলা ভবন নির্মাণ কমিটির দু′টো সভা অনুষ্ঠিত হয়। দু′টো সভাতেই মূলত শিলান্যাস অনুষ্ঠানের অগ্রগতি সম্পর্কে পর্যালোচনা করা হয়। এরপর আসে বহু আকাঙ্ক্ষিত সেই দিন। ৭ ডিসেম্বর ২০০৫ ভবনের শিলান্যাসের অনুষ্ঠানে সন্তোষমোহন দেব তাঁর বক্তব্যে প্রস্তাবিত এই ভবনকে সবরকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। গৌতম রায় মঞ্চে ঘোষণা করেন, ‘আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই আমি প্রস্তাবিত ভবনের জন্য পাঁচলক্ষ টাকা আর্থিক সাহায্য দেব এবং সেইসঙ্গে আসাম সরকার থেকে বাকি জমিটুকুর ব্যবস্থাও করে দেব।’  শিলচরের বিধায়ক বিমলাংশু রায় বললেন, ‘আমি নিতান্তই বিরোধী দলের বিধায়ক। তবুও সেতুবন্ধে কাঠবিড়ালীর ভূমিকা পালন করে যাব।’ জেলা উপায়ুক্ত সুনন্দা সেনগুপ্তের প্রতিনিধি হিসাবে, অতিরিক্ত জেলা উপায়ুক্ত বহ্নিশিখা দত্ত জেলা প্রশাসন থেকে সবরকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। শিলান্যাস অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে প্রবীণ সদস্য/সদস্যা অনেকেই স্মৃতি মেদুরতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন।

৯ ডিসেম্বর ২০০৫ মন্ত্রী গৌতম রায়ের প্রতিনিধি মৃদুল মজুমদার আমাকে দূরভাষে কুশলাদি জিজ্ঞেস করে বললেন ‘মন্ত্রী মহোদয় শিলান্যাস অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি মাফিক পাঁচ লক্ষ টাকা দিয়ে পাঠিয়েছেন আপনি বাড়ি আছেন তো আমি টাকাগুলো নিয়ে আসছি।’ আমি তাৎক্ষণিকভাবে বাকরুদ্ধ হলাম তারপর বিহ্বলতা কাটিয়ে বললাম আমাকে এক ঘণ্টা সময় দিন এমন একটা শুভ মুহূর্তের সাক্ষী হওয়ার জন্য আমি বিশেষ করে ভবন নির্মাণ সমিতির সদস্যদের আমন্ত্রণ জানাতে চাই। দূরভাষে প্রথমেই এই শুভ সংবাদটা জেলা সভাপতিকে জানালাম এরপর একে একে অনন্ত দেব, মৃণালকান্তি দত্তবিশ্বাস, সৌরীন্দ্রকুমার ভট্টাচার্য, শান্তনু দাস, তৈমুর রাজা চৌধুরী, বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য, সমীর কুমার দাস আদি সবাইকে দূরভাষ মারফৎ সুসংবাদটা দেওয়া হল। এরপর শ্রী মজুমদার আমার জয়গুরু লেন, বিলপারের বাড়িতে এসে কাছাড় জেলা ভবন নির্মাণ সমিতির অন্যান্য সদস্যবৃন্দের উপস্থিতিতে সভাপতি দীনেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাসের হাতে মন্ত্রী গৌতম রায়ের পাঠানো নগদ পাঁচ লক্ষ টাকা তুলে দেন। শিলান্যাস অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সন্তোষ মোহন দেব যে আর্থিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তারই সূত্র ধরে বরাক বঙ্গের এক প্রতিনিধি দল শ্রী দেবের বাড়িতে গিয়ে আর্থিক সাহায্যের জন্য আবেদন জানানো হয়। প্রতিনিধি দলে ছিলেন সৌরীন্দ্রকুমার ভট্টাচার্য, শ্যামলেন্দু চক্রবর্তী, তৈমুর রাজা চৌধুরী, বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য, দীনেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাস, বিনোদ বিহারী দেবনাথ, প্রসূন কান্তি দেব এবং আমি। প্রস্তাবিত ভবনের আনুমানিক ব্যয়ের রাশি শুনে তিনি পাঁচ লক্ষ করে দু দফায় দশ লক্ষ টাকা অনুদানের প্রতিশ্রুতি দেন। দুদিন পর আমি ও সভাপতি দীনেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাস কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বাড়িতে উপস্থিত হলে মন্ত্রী প্রতিনিধি বাদল দে নগদ পাঁচ লক্ষ টাকা আমাদের হাতে তুলে দেন। ১৩ আগস্ট ২০০৫ মন্ত্রীর আহ্বানে কাছাড়ের উপায়ুক্ত গৌতম গাঙ্গুলি জেলা সমিতির অস্থায়ী কার্যালয়ে উপস্থিত হলে নির্মীয়মান ভবনের সামনের দিকে সরকারি আবাসনগুলোকে অন্যত্র সরিয়ে উক্ত ভূখণ্ড সম্মেলনকে দেওয়ার জন্য বিহিত ব্যবস্থা গ্রহণ করার নির্দেশ দেন।

সেপ্টেম্বর, ২০০৭ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আঁশিয়ার সভানেত্রী সুস্মিতা দেব, সম্পাদক শান্তনু চৌধুরী এবং সদস্য বিকাশ দেব সম্মেলনের অস্থায়ী কার্যালয়ে এসে ভবন নির্মাণের জন্য তাঁদের সংস্থার পক্ষ থেকে পাঁচ লক্ষ টাকার চেক দীনেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাসের হাতে তুলে দেন।

৭ এপ্রিল ২০০৮ সৌরীন্দ্রকুমার ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে আমরা বিধায়ক কুতুব আহমেদ মজুমদারের বাদ্রিপারের বাসভবনে উপস্থিত হলে ভবন নির্মাণের জন্য তাঁর প্রতিশ্রুত পঞ্চাশ হাজার টাকা অনুদানের প্রথম অংশ হিসাবে পঁচিশ হাজার টাকা তুলে দেন জেলা সমিতির প্রতিনিধি দলের হাতে।

বঙ্গভবনের প্রথম দফার নির্মাণকার্য প্রায় শেষের দিকে এগোচ্ছিল কিন্তু তখনও আরো কিছু টাকার প্রয়োজন এদিকে তহবিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। এই অবস্থায় আবার মন্ত্রী গৌতম রায়ের কাছে আর্থিক সাহায্যের আবেদন জানানো হলে ১২ মে ২০০৮ পরিদর্শনে এসে আরও একলক্ষ টাকা দান করেন। ৯ জুন ২০০৮ দীনেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাসের পৌরোহিত্যে অনুষ্ঠিত ভবন নির্মাণ কমিটির সভায় জেলা সমিতির নির্মিয়মান ভবনের প্রথম পর্যায়ের কাজের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।

৩ আগস্ট, ২০০৮ বহুকাঙ্ক্ষিত সেই দিনে মাননীয় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সন্তোষ মোহন দেব এবং আসামের মাননীয় মন্ত্রী গৌতম রায় কর্তৃক বঙ্গভবনের দ্বারোদ্ঘাটন এবং প্রদীপ প্রজ্বলনের মাধ্যমে বরাক উপত্যকা বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।

বঙ্গভবনের প্রথম পর্ব শেষ হল, কিন্তু ভবনকে পরিপূর্ণ রূপ দেওয়ার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। বাস্তুকার প্রণব কুমার দাস এবং প্রদীপ আচার্য মিলে ফ্রন্ট এলিভেশন সহ এক কোটি তেত্রিশ লক্ষ টাকার এক প্রকল্প তৈরি করলেন এতে মন্ত্রী গৌতম রায় অনুমোদন জানালে তা মন্ত্রী মহোদয় মারফৎ আর্থিক সহায়তার জন্য আসামের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ সমীপে প্রেরণ করা হল।

কবি করুণারঞ্জন ভট্টাচার্য, অনুরূপা বিশ্বাস, ছবি গুপ্তা আরও অনেকেই এমন একটা দিন চাক্ষুষ করতে পেরে আনন্দ প্রকাশ করেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রায় সবাই সিমেন্ট-বালি-পাথরের মিশেল ভিত্তি প্রস্তরের স্তম্ভে ঢালেন। এর পরবর্তী সবই ইতিহাস। প্রথম পর্যায়ের ওই উদ্বোধনীর মধ্যেই যেন লুকিয়ে ছিল আগামীর স্বপ্ন। আপাতত অলোচনাকে আর বিস্তৃত করার অবকাশ নেই। তাই এখানেই ইতি টানতে হবে। তবে পরিশেষে বলতে চাই এই প্রকল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সম্মেলনের প্রাক্তন জেলা সভাপতি প্রসুনকান্তি দেব, অনুরূপা বিশ্বাস এবং অনন্ত দেবের অনুপ্রেরণায় এবং বিশেষ করে সৌরিন্দ্র কুমার ভট্টাচার্য, তৈমুর রাজা চৌধুরী, সুজিৎ কুমার ভট্টাচার্য, সমীর কুমার দাস, শান্তনু দাস, বিনোদ বিহারী দেবনাথ, অমলেন্দু ভট্টাচার্য, সন্তোষ কুমার গুপ্ত, শ্যামল কান্তি দেব, বিভাসরঞ্জন চৌধুরী, সুজন দত্ত, মৃদুল মজুমদার, অনিল পাল, সঞ্জীব দেবলস্কর, দীপক সেনগুপ্ত, বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য এদের কাছ থেকে যে স্বতঃস্ফূর্ত সাহায্য পেয়েছি তা না বললে অকৃতজ্ঞতা হবে। আর জেলা সমিতির সভাপতি দীনেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাস-মহাশয়ের কর্মতৎপরতা ভাষায় প্রকাশ করার সাধ্য আমার নেই।


স্বপ্ন যখন সত্যি হয়...
তৈমুর রাজা চৌধুরী
(সংগৃহীত: বঙ্গভবন উদ্বোধন স্মরণিকা : ২৭ কার্তিক ১৪২১ বঙ্গাব্দ)

হাঁটছিলাম। প্রতিদিনের রুটিনমাফিক সান্ধ্য ভ্রমণ। সন্ধ্যার আলো জ্বলে উঠেছে চারপাশে। সদরঘাট বিবেকানন্দ মূর্তি পেরিয়ে ডানদিকে মোড় নিতেই চোখ আটকে গেল। আলোয় ঝলমল করছে কয়েকটি অক্ষর-‘বঙ্গভবন’।

লাল, হলুদ, সবুজ, নীলচে আভায় সদ্য আলোকস্নাত এক সুউচ্চ, সুদৃশ্য ইমারত অন্ধকার আকাশের বুক চিরে বেরিয়ে গিয়ে বাখান করছে কীসের গৌরব গাঁথা! থমকে দাঁড়ালাম। বিস্ময়মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। এটাই আমাদের স্বপ্নসৌধ। এর স্রষ্টা আমরা! এখনও ভাবতে যেন দুঃসাহসিক রোমাঞ্চ অনুভূত হচ্ছে। কিন্তু অকল্পনীয় কল্পনারই তো মূর্ত রূপ চোখের সামনে আলোর সঙ্গে মায়াবী খেলায় মত্ত। কয়েক যুগের সঞ্চিত স্বপ্ন, পুঞ্জিত অভিমানের মূর্তমান প্রতিবিম্বের সামনেই তো দাঁড়িয়ে আমি। এতো শুধু ইমারত নয়, বরাকের বাঙালির শিল্প সংস্কৃতির একটা স্থায়ী সাকিন, এ অঞ্চলের বহু ভাষাভাষী, বর্ণগোষ্ঠীর সমন্বয়ের সাজানো মঞ্চ। মনে পড়ছিল এই সেদিনের সে এঁদো পুকুর, তার মধ্যে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন। একের পর এক ইটের গাঁথুনি বিশাল ইমারতের রূপ নিয়েছে। এর নির্মাণকাজে এতটাই জড়িয়েছিলাম যে তা খেয়াল করার অবকাশই যেন ঘটেনি। ভাবতেই এখন মনে পুলক লাগছে।

হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ে গেল কত কথা। বঙ্গভবনের গোড়ার কথাগুলোও স্মৃতিপটে ভেসে উঠতে লাগল। ছিলাম বরাক উপত্যকা বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের একজন সাধারণ সদস্য, প্রতিষ্ঠাতা সদস্যও বটে। পরে বিভিন্ন পদেও দায়িত্ব নির্বাহ করেছি। মনের কোণে সব সময়ই একটা পুরনো ব্যথা চাগাড় দিয়ে খানিকটা বিব্রত করত। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে নিয়ে ভারতবর্ষের একটা মিনি সংস্করণ এই বরাক উপত্যকা-এখানে বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীরই নিজস্ব সংস্কৃতিচর্চার নিজস্ব পরিসরে নিজস্ব স্থায়ী ঠিকানা রয়েছে অথচ বরাকের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির এ ক্ষেত্রে নিজের বলে কিছুই নেই। ভাবতাম এ অঞ্চলের বাঙালিরও একটা স্থায়ী ঠিকানা যদি হত, সেখানে শিল্প সংস্কৃতির চর্চা, প্রচার-প্রসার, ঐতিহ্যকে ধরে রাখার মানসিকতা সম্পন্ন মানুষ একজোট হয়ে কাজ করবেন। যে ঠিকানা বাঙালির উদ্যোগে হয়েও আখেরে বরাকের বহুভাষিক শিল্প, সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্র হয়ে উঠবে; যে ঠিকানা সংকীর্ণতার গণ্ডি পেরিয়ে এ অঞ্চলের সর্বজাতি, সর্বভাষাগোষ্ঠীর সংস্কৃতির রক্ষক, পৃষ্ঠপোষক এবং পথ প্রদর্শকের ভূমিকা নেবে। আমার মতো সমমনোভাবাপন্ন অনেক মানুষই ছিলেন। অবশেষে স্বপ্নের জাল বুনোনের প্রথম গ্রন্থিটা বাঁধা হল।

১৯৯১ সাল। শিলচরে বরাক উপত্যকা বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের একাদশ অধিবেশনের আয়োজন হল। অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি হলেন সরোজকুমার দাস, অধ্যাপক বিজিৎ চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক, আমি নিজে ছিলাম সহকারী সাধারণ সম্পাদক এবং কোষাধ্যক্ষ ছিলেন অনন্ত দেব। অধ্যাপক বিজিৎ চৌধুরীর সহধর্মিণী অনিমা চৌধুরী তখন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। স্বাভাবিক কারণেই বিমর্ষ বিজিৎদা সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে অব্যাহতি চাইলেন। আমিই তাঁকে বললাম, ওই পদে আপনার থাকার একটা আলাদা গুরুত্ব আছে, আপনি থাকুন। আপনার হয়ে পরোক্ষে আমি সব দিক সামলানোর দায়িত্ব নেব। অগত্যা তিনি রাজি হলেন। একাদশ অধিবেশন বেশ সাড়া জাগিয়েই সমাপ্তির পথে এগোেল। একাদশ অধিবেশন বিশেষ একটা কারণে বঙ্গসাহিত্যের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ওই অনুষ্ঠান শেষে আমরা প্রথমবার একটা ভাল পরিমাণ অর্থ উদ্বৃত্ত হিসেবে আমাদের কোষাগারে দেখতে পেলাম। উচ্ছ্বসিত অনন্তদা তখন আমাদের অনেককে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ালেন। বিজিৎ চৌধুরী, শান্তনু দাস, বর্তমানে বিজেপি নেতা অজিত ভট্টাচার্য সহ সম্মেলনের সক্রিয় পদাধিকারীরা অনন্তদার বাড়িতে হাজির হলাম। অনেক হইচই হল। তখন অনন্তদাই প্রথম প্রস্তাবটা রাখলেন-যাযাবর জীবন তো অনেক বছর কাটাল বঙ্গসাহিত্য; চল এবার চেষ্টা করা যাক না একটা স্থায়ী ঠিকানা তৈরি করা যায় কিনা। সবাই একবাক্যে সায় জানালাম। কিন্তু জায়গা পাব কোথায়? আরও কয়েক বছর কেটে গেল। ইতিমধ্যে সম্মেলনের চতুর্দশ অধিবেশনেও আরও কিছু উদ্বৃত্ত অর্থের মুখ আমরা দেখলাম। সুজিৎকুমার ভট্টাচার্য তখন সাধারণ সম্পাদক।

এদিকে, তখন সন্তোষমোহন দেব কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, জাতীয় পরিচিতি নিয়ে দাপটের সঙ্গে মন্ত্রিত্ব সামলাচ্ছেন। রাজ্য সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী গৌতম রায়। আমরা এবার তাঁদের দ্বারস্থ হলাম। মূলত তাঁদের বদান্যতায় আমরা সদরঘাট বাসস্ট্যান্ডের পাশে সামান্য জমিও পেলাম। সেখানে ২০০৫ সালের ৭ ডিসেম্বর ঘর নির্মাণের জন্য ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হল। ছোট্ট একটা পাকা ঘরও নির্মিত হল। বরাক উপত্যকা বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের কাছাড় জেলা সমিতির প্রথম নিজস্ব মাথা গোঁজার ঠাঁই হল। এই জায়গা পেতে প্রশাসনিক সাহায্য কোনওদিন ভোলার নয়। ২০০৮ সালের ৩ আগস্ট সম্মেলনের নবনির্মিত কার্যালয়ের উদ্বোধন করলেন মন্ত্রী সন্তোষমোহন দেব এবং মন্ত্রী গৌতম রায় মিলেই। জেলা সভাপতি দীনেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাস, সম্পাদক প্রদীপ আচার্য এবং সক্রিয় সদস্য শান্তনু দাস এতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। দীনেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাস সহ অন্যান্যদের নিষ্ঠা এবং দায়বদ্ধতার জন্যই তা সম্ভব হয়েছে। অবশ্য ছোট্ট ভবনটির নির্মাণের প্রাথমিক কাজটা হয়েছিল সম্মেলনের কোষাগারের জমানো অর্থ থেকেই। কারণ প্রথমবারের উদ্বৃত্ত অর্থ এতদিনে সুদেমূলে বেড়ে হয়েছে প্রায় এক লক্ষ পনেরো হাজার টাকা এবং তার সঙ্গে যোগ হল চতুর্দশ অধিবেশনে উদ্বৃত্ত ৫০ হাজার টাকা। তারপর এ কাজে এগিয়ে আসেন সন্তোষমোহন দেব, গৌতম রায় এবং শ্রীমতী সুস্মিতা দেব। এক্ষেত্রে গৌতমবাবু ৬ লক্ষ, সন্তোষবাবু ৫ লক্ষ এবং সুস্মিতা দেব (বর্তমান সাংসদ) তাঁর আঁশিয়া সংগঠন থেকে ৫ লক্ষ টাকার সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসেন। এদিকে, সেই সময়ের বিধায়ক কুতুব আহমদ মজুমদারও ২৫ হাজার টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। এই ছোট্ট ভবনটির নির্মাণের ক্ষেত্রে কারিগরি পরামর্শদানে বিরাট সাহায্য করেছিলেন ইঞ্জিনিয়ার পি কে দাস।

আমাদের খুশি আর বাঁধ মানছিল না। বিরাট তৃপ্তি ছেয়েছিল মনে। কিন্তু সেই তৃপ্তির ভিতে আবার এক অতৃপ্তির জন্ম হল। আমরা ভাবতে লাগলাম যদি আমাদের একটা ভবন হত যেখানে থাকবে অত্যাধুনিক প্রেক্ষাগৃহ, আর্ট গ্যালারি, ভাষা শহিদের স্মৃতি রক্ষা তথা ভাষা আন্দোলনের দলিল সংরক্ষণের জন্য কক্ষ, বরাকের শিল্প, সংস্কৃতি, ইতিহাসসমৃদ্ধ মিউজিয়াম ইত্যাদি ইত্যাদি। তাহলে কী ভাল হত। বরাক উপত্যকায় একটা সংস্কৃতিচর্চার প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠত সেটা। সেই থেকে আমরা স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম একটা পূর্ণাঙ্গ বঙ্গভবনের। কিন্তু তার জন্য চাই একটা বিশাল পরিসর। এত বড় জায়গা কীভাবে ম্যানেজ হবে, এটা একটা বিরাট ভাবনা ছিল।

এই ভাবনার সূত্রে মনে হল ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখাই যাক না প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্বরা কীভাবে গড়ে তুলেছিলেন সারস্বত সাধনার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। প্রথমেই মনে পড়ল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এর কথা। তথ্য ঘেঁটে দেখলাম, ১৩০১ বঙ্গাব্দের ১৭ বৈশাখ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ। ছয় বছর পর সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিষৎ-এর নিজস্ব ভবন নির্মাণের প্রয়োজন অনুভূত হয়। পরিষৎ-এর জমি কেনার সামর্থ ছিল না। তাই চারুচন্দ্র ঘোষ, রজনীকান্ত গুপ্ত, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, সুরেশচন্দ্র সমাজপতি, নগেন্দ্রনাথ বসু এই পাঁচজন কাশীমবাজারের মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর সঙ্গে দেখা করে পরিষৎ-এর নিজস্ব ভবন নির্মাণের জন্য জমি প্রার্থনা করেন। ১৯০১ খ্রিঃ ২০ আগস্ট মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী পরিষৎ-এর ভবন নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় জমিদান করেন। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রেও সমস্যা দেখা দিল। নক্শা অনুযায়ী দ্বিতল ভবন নির্মাণের অর্থ নেই। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে এলেন লালগোলা নিবাসী রাজা যোগেন্দ্রনারায়ণ রায়বাহাদুর। দ্বিতল নির্মাণের সম্পূর্ণ ব্যয় ১০, ০৫৮ টাকা এককভাবে দান করলেন যোগেন্দ্রনারায়ণ। একতলায় গ্রন্থাগারের বইপত্র যাতে নষ্ট না হয় এজন্য নিজ খরচে নিম্নতল মর্মর মণ্ডিত করে দেন মুর্শিদাবাদের রায় শ্রীনাথ পাল। এই তিন মহৎ পুরুষের দানে নির্মিত বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ ভবনের উদ্বোধন হয় ১৩১৫ বঙ্গাব্দের ১৯ অগ্রহায়ণ। একশো ছয় বছর পর নির্মিত প্রান্তীয় অঞ্চলের এই ভবন কি সেই উচ্চতায় পৌঁছবে? উত্তর প্রজন্মের কাছে প্রত্যাশা রাখছি। আমি তৃপ্ত। কারণ দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন আজ বাস্তব হয়েছে। আসামের মহৎপ্রাণ ব্যক্তিরা আমাদের আবেদনে সাড়া দিয়েছেন বলেই এই ভবন নির্মিত হয়েছে। তাঁদের অবদান অবিস্মরণীয়, তাঁদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করছি। এই আনন্দ প্রকাশ করতে গিয়ে আমি স্মরণ করছি আমাদের চিরকালীন আশ্রয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কয়েকটি কথা। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ ভবনের প্রতিষ্ঠা উৎসবের অভিভাষণে তিনি বলেছিলেন—  “আমাদের এই সাহিত্য পরিষৎ এতদিন গর্ভবাসে ছিল । সে অল্পে অল্পে রসে-রক্তে পরিপুষ্ট হইয়া উঠিতেছিল। তাহার সুহৃদগণ তাহাকে নানা আঘাত অপঘাত হইতে সযত্নে বাঁচাইয়া আসিয়াছেন । তাহার দশমাস কাটিয়ে গিয়াছে- আজ সে ভূমিষ্ঠ হইয়াছে”।

কবি বলিয়াছেন,  “শরীরমাদ্যং খলু ধর্মসাধনম্। ধর্ম্মসাধনের গোড়াতেই শরীরের প্রয়োজন হয়। সাহিত্য পরিষদের সেই আদ্য প্রয়োজন আজ সম্পূর্ণ হইয়াছে, এখন হইতে তাহার ধর্মসাধনা সবলে সিদ্ধির পথে অগ্রসর হইবে এইরূপ আশা করা যাইতেছে”।

আমাদেরও আশা, বরাক উপত্যকা বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন আজ থেকে অনেক বেশি গতিশীল হবে। পূর্বসূরিদের কল্পনা বাস্তব রূপ লাভ করবে।

আমাদের ভাবনার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মুশকিল আসান করে দিলেন মন্ত্রী গৌতম রায়। তিনি আমাদের পুরনো ভবন সংলগ্ন বিশাল সরকারি জমি পাইয়ে দেবার ব্যবস্থা করলেন। এমনকী ওই জায়গার সামনের দিকে কিছু সরকারি কোয়ার্টার ছিল তাঁর উদ্যোগেই সেগুলো অন্যত্র স্থানান্তরিত হল। সম্পত্তি তো হল কিন্তু এই এতবড় জমি বেদখল হবার ভয়, নিরাপত্তার উদ্বেগ একটা রয়ে গেল। শুনে বর্তমান বঙ্গভবনের পুরো সীমানা দেওয়াল করিয়ে দিলেন মন্ত্রী গৌতম রায়। আমরা অনেকটা নিশ্চিন্ত হলাম।

২০১১ সালের ১৬ জানুয়ারি বরাক উপত্যকা বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের কাছাড় জেলা সমিতির সভাপতি হলাম আমি এবং সম্পাদকের দায়িত্ব পেলেন দীপক সেনগুপ্ত। যদিও দু-বছর সহ-সভাপতি পদে ছিলাম, সভাপতি পদে এই প্রথম। আমরা পূর্ণাঙ্গ বঙ্গভবনের স্বপ্ন নিয়ে গুটি গুটি পায়ে এগোতে শুরু করলাম। জানতাম কাজটা কঠিন। এরমধ্যে এসে গেল বিধানসভা নির্বাচন। ২০১১-র রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে জিতলেন শিলচর থেকে শ্রীমতী সুস্মিতা দেব এবং কাটলিছড়া থেকে গৌতম রায়। দু‘জনেই আমাদের সম্মেলনের সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের আমরা ওই বছরের ২৬ জুন বঙ্গভবনে আমন্ত্রণ করলাম। স্মারক হিসেবে দুটো বেগবান ঘোড়া তাঁদের হাতে তুলে দিলাম। স্মারকটি খুবই অর্থবহ ছিল দু‘জনের পক্ষে। সংস্থার পক্ষ থেকে তাঁদের উদ্দেশ্য করে বললাম ‘আপনারা বেগবান অশ্বের মতো আসামের রাজনৈতিক তেপান্তরে ছুটছেন। সব বাধা বিপত্তি গুঁড়িয়ে আপনারা এগিয়ে যান। আশা রাখি, বরাক উপত্যকার সাংস্কৃতিক উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ পূর্ণাঙ্গ বঙ্গভবনের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রেও আপনাদের সদর্থক ভূমিকা থাকবে।’

ইতিমধ্যে আবেগিক সূত্রে বরাকবঙ্গের সঙ্গে অটুট বন্ধনে বাঁধা পড়লেন মন্ত্রী গৌতম রায়। তিনি অত্যন্ত আবেগের সঙ্গেই সেদিন প্রতিশ্রুতি দিলেন সবার সাহায্য সহযোগিতায় পূর্ণাঙ্গ বঙ্গভবনের স্বপ্ন তিনি সফল করবেন। কারণ এ স্বপ্ন তাঁর নিজেরও স্বপ্ন। ব্যাস, আর কাল বিলম্ব নয়। মন্ত্রীর নিরন্তর তাগাদার প্রেক্ষিতে ২০১১-র ১৫ আগস্টই শিলান্যাস হয়ে গেল পূর্ণাঙ্গ বঙ্গভবনের। কাজ শুরু হল ওই বছরেরই ২ ডিসেম্বর। এদিকে, ২০১৩ সালের ২০ জানুয়ারি আমি এবং দীপক সেনগুপ্ত পুনর্বার নির্বাচিত হই সভাপতি ও সম্পাদক হিসেবে। ভবন নির্মাণের কাজ চলতে থাকল। এরপর যা হল সেটা একটা ইতিহাস। বরাক উপত্যকার সাংস্কৃতিক উন্নয়নের এক উজ্জ্বল গাঁথা রচিত হল। মাত্র আড়াই বছরের মধ্যেই সম্প্রসারিত বঙ্গভবন সগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়াল চোখ ধাঁধানো রূপ নিয়ে। পর্যাপ্ত অর্থ ভাণ্ডার নিয়েও অন্য কোনও জায়গায় এত বৃহৎ প্রকল্প এত দ্রুততায় ক‘টা সম্পূর্ণ হয়েছে, আমার জানা নেই। জানি না, কীভাবে যে এসব হল। লক্ষ্য করলাম, স্বপ্ন দেখছিলাম আমরা, কিন্তু আমাদের স্বপ্ন যে কখন এ অঞ্চলের অগুনতি মানুষের স্বপ্ন হয়ে উঠল টেরই পেলাম না। সংস্কৃতিজীবী, বুদ্ধিজীবী বাছবিচার নেই যে যেমন পারলেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এলেন। সদস্যরা চাঁদা দিলেন, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে কত মানুষ যে সাধ্যমতো অর্থ সাহায্য করলেন তাঁদের নাম বলে শেষ করা যাবে না। তবে অর্থ জোগানের মূল উৎস ছিলেন মন্ত্রী গৌতম রায়-ই। এই প্রকল্পে কোনও রাজনীতি নয়, আগপাছ না ভেবেই তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন। পাশাপাশি, কিছু নামোল্লেখ না করলেই চলে না যাঁদের সম্মেলনের সঙ্গে যোগ থাকার কথাই ছিল না। তাঁদের মধ্যে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে রাজ্যসভার সাংসদ শ্রীমতী নাজনিন ফারুকি দিলেন ৫০ লক্ষ টাকা, সাংসদ পঙ্কজ বরা ৭০ লক্ষ টাকা, মন্ত্রী রকিবুল হোসেন দিলেন ৫ লক্ষ টাকা। বরাকের চা-শিল্প মহল থেকে এসেছে ৩৪.৪৩ লক্ষ টাকা, শিলচরের তদানীন্তন সাংসদ কবীন্দ্র পুরকায়স্থ প্রথম দফায় ৫ লক্ষ টাকা দিলেন এবং দ্বিতীয় দফায় ১৮০ কেভির জেনারেটর সেট কেনার জন্য দিয়েছেন আরও ১৩ লক্ষ টাকা। শিলচর ফুড গ্রেইন্স মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন দিয়েছে ২ লক্ষ, মন্ত্রী অজিত সিং দিয়েছেন ১ লক্ষ টাকা। এছাড়া আসাম সরকারের সাংস্কৃতিক পরিক্রমা দফতর থেকে পেয়েছি ১ কোটি টাকা। অবশেষে প্রায় ৬.৫ কোটি টাকা ব্যয়ে মাথা তুলে দাঁড়াল আমাদের স্বপ্নের সম্প্রসারিত বঙ্গভবন। কয়েকজন সদস্যের অল্পকিছু দান ও কবীন্দ্রবাবুর মঞ্জুর করা অর্থ ছাড়া বাকি সমস্ত দান এবং অবশিষ্টাংশ অর্থের ব্যবস্থাপনার মূল ভূমিকায় ছিলেন মন্ত্রী গৌতম রায়। অর্থ সাহায্য ছাড়াও বঙ্গভবনের রূপায়ণে প্রাণপাত শ্রম করেছেন অনেকেই। সব কাজ ভুলে বঙ্গভবনের কাজের তদারকিতে নামলেন নির্মাণ উপ-সমিতির কার্যকরী সভাপতি সুজন দত্ত, প্রকৌশলী আশিস কুমার গুপ্ত ও চন্দন শর্মা। অত্যন্ত কর্মঠ এবং বিচক্ষণ রাজমিস্ত্রি রঞ্জিৎ দাস বঙ্গভবনে দিনরাত যাপন করে সুক্ষভাবে কাজ করেছেন।

একটা পুকুর ভরাট করে তৈরি করা এই ভবন নির্মাণে পাইলিঙের কাজে নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করেন গৌতম কন্সট্রাকশনের বিনোদ সিঙ্গি। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন হাইলাকান্দির বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব বাদল পাল। প্রাথমিক স্তরে প্রকল্পের কারিগরি দিক দেখাশোনা করেছেন মহীতোষ (আশু) পাল, বিশ্বদীপ চক্রবর্তী, অরূপ রায়, অসীম দে-র মতো মানুষ। নান্দনিক বিষয় নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন, পরামর্শ দিয়েছেন শিল্পী সুজিৎ পাল, নির্মলকান্তি রায়, গণেশ নন্দী, সমিত রায়রা। ভবনের অভ্যন্তরীণ সজ্জার কাজটা দেখাশোনা করেছেন দীপঙ্কর দেব। নানাভাবে সাহায্য করেছেন মৃদুল মজুমদারও। আরও কত মানুষ যে কত ভাবে অবদান রেখেছেন বলে শেষ করা যাবে না। বিনা শুল্কে এবং স্বল্প সময়ে ভবন নির্মাণের অনুমতি প্রদান করে সহযোগিতার জন্য শিলচর পৌরসভাকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। তাঁদের প্রত্যেককে ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা জানাবার কোনও উপযুক্ত ভাষা আমার সঞ্চয়ে নেই।

অগুনতি মানুষের আবেগ, কায়িক, মানসিক, আন্তরিক শ্রমের পুঞ্জীভূত রূপ আমার সামনে অপার সৌন্দর্য ও অহঙ্কারের অভিব্যক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে। কী নেই এতে! ৬০০ আসন ক্ষমতাসম্পন্ন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রেক্ষাগৃহ। অত্যাধুনিক সাউন্ড, আলো, মঞ্চ ও কারিগরি বৈশিষ্ট্য নিয়ে সুসজ্জিত। আছে ১০০ আসনের সুদৃশ্য মিনি কনফারেন্স হল। আছে প্রমাণ সাইজের আর্ট গ্যালারি, মিউজিয়াম, সুরম্য অতিথিকক্ষ। বরাকের ভাষা সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিতে থাকবে একটা কক্ষ যেখানে ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস, ভাষা সেনানীদের টুকরো টুকরো স্মৃতি, নথিপত্র সব সংরক্ষণ করা হবে। এনিয়ে গবেষণা করতে আগ্রহীরা যাতে এখান থেকে মূল্যবান তথ্য পেতে পারেন তার জন্য যত্নশীল থাকবে সম্মেলন। ভবনের সামনে প্রাঙ্গণে থাকবে শহিদ মিনার। ভবনের দেয়ালগাত্রে ভাষা আন্দোলন সম্পর্কিত বিশাল ফাইবার ম্যুরাল থাকছে। পাশাপাশি বরাকের ভূ-প্রকৃতি, ঐতিহাসিক সৌধ, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও পরম্পরাও ম্যুরালে স্থান পাবে। ভবনের সামনে থাকছে শিল্প, সংস্কৃতি ও সমাজ সংস্কারে বিশ্ববরেণ্য বাঙালি মনীষীদের প্রতিকৃতি এবং ভবনের ভিতরের দেয়ালে থাকবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বরাককে পথ দেখানো স্থানীয় কৃতবিদ্যদের প্রতিকৃতি। সব মিলিয়ে বহুত্বের একটা নিরেট রূপ আমাদের সম্প্রসারিত বঙ্গভবন। আজ পিছন ফিরে চেয়ে ভাবি কীভাবে আমরা পারলাম এত বড় কাজটা করতে? পেরেছি আমাদের সবার সম্মিলিত প্রয়াস, নিষ্ঠা ও ভালবাসার জোরে। আজ খুব বেশি করে মনে পড়ছে একটা কথা, দেশের প্রথমসারির শিল্প সমালোচক তথা বরাকের সু-সন্তান শোভন সোম একদিন বলেছিলেন, ‘স্বপ্নকে কখনও ছোট করো না। স্বপ্ন ছোট হলে সামনের রাস্তাটাও ছোট হয়ে যায়।’ সত্যি, আমরা আমাদের সাধ্যের তুলনায় একটু বড়ই স্বপ্ন দেখেছিলাম। কিন্তু দেখেছিলাম বলেই পূর্ণাঙ্গ বঙ্গভবন মাথা তুলতে পারল। নাহলে কী হত জানি না। এ সমস্ত কিছুর জন্য মন্ত্রী গৌতম রায় সহ যারাই সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন তাদের আবারও অশেষ ধন্যবাদ। তবে এটাও ঠিক, একটা স্বপ্ন ভূমিষ্ঠ হল বাস্তবের রং মেখে। এখন সেটাকে বাঁচিয়ে রাখা, যথাযথ লালন-পালন করা এবং বিকাশের পথে হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটা হবে আরও কঠিন কাজ। আমাদের সবাইকেই সে কাজে ব্রতী হতে হবে। কারণ বরাক উপত্যকা বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের দায়িত্ব যে অনেক। চিরঅভাগী বরাকের সর্বভাষা, সর্বসংস্কৃতির মহামূল্য রতনমণি এই বঙ্গভবন। এতদিনের অবহেলা, বঞ্চনা, আগ্রাসনের নিকষ কালোকে বিদীর্ণ করে আলোর পথ দেখাতে হবে তাকেই। চল্লিশ লক্ষ বরাকবাসীর অভিভাবক হতে হবে তাকে। আর আমরাও এভাবে স্বপ্নের জাল বুনে যাব। সম্প্রসারিত বঙ্গভবনের স্বপ্ন সাফল্য আমাদের জুগিয়ে যাবে নতুন স্বপ্ন দেখার সাহস। নিরন্তর, নিশিদিন।