এ পর্বটিতে যা জানতে পারবেন —
উপস্থাপনমূলক ঘটনা বা কাহিনিভিত্তিক শিল্পই নাটক। এ উপস্থাপন হয় কোন মঞ্চে- সেটা মুক্ত হতে পারে, আবার গৃহাভ্যন্তরও হতে পারে। এতে আর কী চাই? না, এতে দর্শক চাই। এ দর্শকদের (শ্রোতাও) ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। এরপর আসছে কতিপয় জীবন্ত চরিত্র, যাদের বলা হয় কুশীলব। এরা কোনও ঘটনা বা কাহিনির দৃশ্য এবং শ্রাব্যরূপ উপস্থাপন করবেন, অর্থাৎ অভিনয় করবেন জীবন্তভাবে। এতে একটা সুসংহত কাহিনী বা ঘটনার বিন্যাস চাই, যাকে বলা হয় স্ক্রিপ্ট (script) যার একটা সূচনা-মধ্যমা- সমাপ্তিও থাকবে, (ইংরেজিতে beginning-middle-end)। সমাপ্তিটি হল নাটকের চরম পূর্ণতা অর্থাৎ climax। এ উপস্থাপনা যদি শিল্পসম্মত না হয়, যদি দর্শকদের শুরু থেকে শেষ অবধি ধরে না রাখতে পারে, যদি নানা ঘটনার টানাপোড়েনে কোনও বিশেষ ভাবনার মধ্যে আবর্তিত এক বা একাধিক ঘটনা বিভিন্ন চরিত্রের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একটি নাট্যমুহূর্তে নিয়ে যেতে না পারে তবে তা নাটক পদবাচ্য হতে পারে না। নাটকে আঙ্গিক, অভিনয়, মঞ্চক্রিয়া, গতি, আবহ এবং সে সঙ্গে বাক্য, শব্দ, ধ্বনি অর্থাৎ সব কিছুই গুরুত্বপূর্ণ। এটা কোনও একক নয়, সার্বিক উপস্থাপনা। তবে বর্তমান প্রসঙ্গে এদিকে যাবার প্রয়োজন নেই। বর্তমান পর্বে বাংলা নাট্যশিল্পের বিবর্তনের একটি প্রাথমিক রূপরেখার ধারণাই নেওয়া হবে।
বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশে এখন যাকে মঞ্চনাটক বা স্টেজ-থিয়েটার বা ড্রামা বলা হয় - এটা যদিও ইউরোপীয় নাটক-কারদের হাত ধরেই এসেছে তবুও আমাদের দেশীয় শিল্পজগতে (উপস্থাপনমূলক আঙ্গিকে) তা একেবারে পরম্পরাবিহীন কিছু নয়। সংস্কৃত নাট্যশাস্ত্র, নাটক ইত্যাদি ঐতিহ্যের কথা নাই বা বলা হল, বাংলার লৌকিক কীর্তন, ভাসান, পাঁচালি গীত, কথকতা, পালাগান- এসবের মধ্যেও নাটকের উপাদান ছিল এবং এ থেকেই মধ্যযুগে বা প্রাগাধুনিক যুগে উদ্ভব হয়েছে ঢপযাত্রা, যেখানে কোনও উচ্চ মঞ্চের প্রয়োজন নেই, চারদিকে শ্রোতার আসনের মাঝখানে সামান্য একটুখানি জায়গায় অতি সামান্য উপাচার, একটি তালযন্ত্র, বাঁশি, তারযন্ত্র বা হারমোনিয়াম আর উপস্থাপকের কণ্ঠসম্পদকে নির্ভর করেই কোনও পৌরাণিক কাহিনির উপর তৈরি এ ঢপযাত্রার কথা আর সুর শ্রোতাদের আবিষ্ট করে রাখত।
যুগের বিবর্তনে এ ভাসমান শিল্পীরা গড়ে তুললেন যাত্রার দল। এখানেও সেই মুক্তমঞ্চ, তবে এখানে গানের আধিক্যের স্থলে এল কথার প্রাধান্য। একজন বা দুজন উপস্থাপকের স্থলে এলেন একাধিক কুশীলব। পালাটিকে গ্রন্থনা করতে এলেন পালাকার (রাইটার) এবং আত্মপ্রকাশ করলেন অধিকারী (আজকের ভাষায় ডিরেক্টর-ম্যানেজার)। জমিদার বা ধনাঢ্য ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতায় এ শিল্পের বিকাশ ঘটল, যা নগরায়নের সঙ্গে বিস্তার লাভ করল নানা ভাবে। বাংলার সাংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতার হয়ে ওঠা, গড়ে ওঠা, বিশেষ করে ইংরেজ ঔপনিবেশিক রাজধানী হিসেবে কলকাতার গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে নানা ধরনের বিনোদনমূলক শিল্পের সঙ্গে জড়িত মানুষজনের এখানে এসে জড়ো হওয়া এবং লোকায়ত আঙ্গিকে পালাগান, যাত্রা বা এর পূর্বাবস্থায় আখড়াই হাফ-আখড়াই, কবিগান ইত্যাদির মাধ্যমে উপস্থাপনমূলক শিল্পকে একটি বিশেষ স্থানে পৌঁছোতে সহায়তা করল। কলকাতা ভিত্তিক রঙ্গমঞ্চ এবং মঞ্চনাটকের প্রাক্-পর্বে গ্রামবাংলায় যাত্রাপালার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে জমিদার, বা খুদে মহারাজদের পৃষ্ঠপোষকতায়। এর প্রভাব আসাম এবং ত্রিপুরায়ও পরিলক্ষিত হয়।
তবে আধুনিক নাট্যশিল্পের পূর্ববর্তী স্তরের ওই ইতিহাস পুনরুদ্ধার আজও সম্ভব হয়নি। লোকসংস্কৃতি গবেষকেরা এ নিয়ে কাজ করলেও গ্রামবাংলার নেহাত মামুলি যাত্রার আসরে মুখে রঙ মেখে, পরচুলা পরে এক রাতের রাজা মহারাজাদের ইতিহাস সে রকম ভাবে লিপিবদ্ধ হয়নি। অবশ্য খোদ কলকাতায় উনবিংশ শতাব্দীর গৌরবময় রঙ্গমঞ্চের ইতিহাস পুনরুদ্ধার করতে কত সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন পন্ডিতেরা। সেই গিরিশ ঘোষ-নটি বিনোদিনী কিংবা দানীবাবু-শিশির ভাদুড়ি, ক্ষিরোদপ্রসাদ, অমরেন্দ্র দত্ত, অমৃতলাল বসু এরাও সঠিক সংরক্ষিত। তথ্যের অভাবে সত্য মিথ্যার মিশ্রণে কিংবদন্তি হয়ে রয়েছেন আমাদের সমাজে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে কলকাতা মহানগরীকে কেন্দ্র করে আখড়াই, হাফ আখড়াই, তরজা ছেড়ে থিয়েটারের আত্মপ্রকাশ ঘটতে শুরু হয়। এই পথটা প্রথম দেখিয়েছে ইংরেজরাই। এদের প্রয়াসে প্রথমে লালবাজারে প্লে হাউস, এবং পরে 'ক্যালকাটা থিয়েটার' স্থাপিত হয় যা ছিল ইংরেজ নিয়ন্ত্রিত। এতে ইংরেজরাই ইংরেজি নাটক মঞ্চায়ন করতেন। যা উল্লেখ্য তা হল মঞ্চে প্রথম বাংলা নাটক অভিনয়ের কৃতিত্ব একজন বিদেশীর। তিনি রুশ দেশীয় হেরাশিম লেবেডফ। কলকাতার ডোমতলায় মঞ্চ বেঁধে ই.এম.জডরেলের 'দি ডিসগাইজ' এর বঙ্গানুবাদ 'কাল্পনিক সংবদল' (১৭৯৫) অভিনয় করান তিনি, এবং স্ত্রীভূমিকায় মেয়েদের দিয়েই অভিনয় করান। (নলিনীরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, 'শ্রীরামকৃষ্ণ-সমসাময়িক কলকাতার থিয়েটার, উদ্বোধন, শতাব্দী জয়ন্তী নির্বাচিত সঙ্কলন, কলিকাতা, ১৯৯৯, পৃ. ৩১০)। কলকাতার সম্ভ্রান্ত এবং বাবুশ্রেণীর প্রয়াসে প্রথম কিছু ইংরেজি ও সংস্কৃত নাটকের অনুবাদ অভিনীত হয়। ক্রমে বিদ্যোৎসাহিনী রঙ্গমঞ্চ, বেলগাছিয়া নাট্যশালা, মেট্রোপলিটান থিয়েটার এবং জোড়াসাঁকো নাট্যশালার উদ্ভব হয়।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত পাশ্চাত্য রীতিতে মৌলিক বাংলা নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’ (১৮৫৯), ‘পদ্মাবতী’ (১৮৬০), ‘কৃষ্ণকুমারী’ (১৮৬১) ছাড়াও কয়েকটি প্রহসন লিখে বাংলা নাট্যসাহিত্যে নবযুগের সূচনা করেন। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে দীনবন্ধু মিত্র লিখলেন ‘নীলদর্পণ’ যা সৃষ্টি করল নতুন ইতিহাস। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় সাধারণ রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠা নাটকের চর্চাকে তথা নাট্যআন্দোলনকে এগিয়ে দিল। গিরিশ ঘোষের নাট্যজগতে আত্মপ্রকাশ এবং শ্রীরামকৃষ্ণ কর্তৃক নাটককে লোকশিক্ষার মাধ্যমে হিসেবে স্বীকৃতি দান ঊনবিংশ শতাব্দীতে থিয়েটারের স্বর্ণযুগের সূচনা করল। গিরিশ ঘোষ উপহার দিলেন মৌলিক নাটক ‘আগমনী’ (১৮৭৭)। ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ‘চৈতন্যলীলা’ দেখতে আসেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস এবং এ আগমন তৎকালীন থিয়েটার জগৎকে বিশেষ অনুপ্রাণিত করে।
দক্ষযজ্ঞ, জনা (১৮৯৪), বিল্বমঙ্গল (১৮৮৮), প্রফুল্ল (১৮৮৯), সিরাজদ্দৌল্লা (১৯০৬), মীরকাশিম (১৯০৬), কালাপাহাড়, আবু হোসেন (১৮৯৬) গিরিশ ঘোষের মঞ্চসফল নাটক। পৌরাণিক, ঐতিহাসিক, সামাজিক নাটক ছাড়াও তিনি শেক্সপিয়ারের ‘ম্যাকবেথ’ নাটকের সার্থক বাংলা অনুবাদও করেন। নাট্যকার, অভিনেতা এবং পরিচালক হিসেবে তিনি জীবিতাবস্থায়ই কিংবদন্তিতে রূপান্তরিত হন। তাঁর নাটকের অমিত্রাক্ষর ছন্দের বৈশিষ্ট্যের জন্য একে ‘গৈরিশ ছন্দ’ ও বলা হত। নাটকের জন্য তিনি অপূর্ব সব শাক্তপদ এবং বৈষ্ণবীয় পদও রচনা করে গেছেন। ওই সময়ের আরেক প্রতিভাশালী নাট্যকার ক্ষিরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ (১৮৬৩-১৯২৭) উপহার দেন আলিবাবা, রঘুবীর, বঙ্গের প্রতাপাদিত্য, আলমগীর, নন্দকুমার প্রভৃতি মঞ্চসফল নাটক।
বিংশ শতাব্দীতে বাংলা নাটকের ধারাকে টেনে নিয়ে যান যাঁরা এদের মধ্যে রয়েছেন ক্লাসিক থিয়েটারের অমরেন্দ্রনাথ দত্ত, যোগেশচন্দ্র চৌধুরী, মন্মথ রায়, শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। আর, এদের মধ্যে যুগান্তকারী নাট্যকার হিসেবে যাঁর নাম করতে হয় তিনি হলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩) যাঁর দেশাত্মবোধক গান বাঙালি জীবনে যেমন পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে অদ্যাবধি, তেমনি ঐতিহাসিক নাটক আজও জনপ্রিয়তা হারায়নি। তাঁর নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে সীতা (১৯০৮), ভীষ্ম (১৯১৪), প্রতাপাদিত্য (১৯০৫), দুর্গাদাস (১৯০৫), নুরজাহান (১৯০৮), মেবার পতন (১৯০৮), শাজাহান (১৯০৯) এবং চন্দ্রগুপ্ত (১৯১১)। ইংলন্ডের এলিজাবেথীয় নাট্যধারায়, বিশেষ করে শেক্সপিয়রের নাটকের আঙ্গিকে তাঁর নাটক বাংলা নাট্যজগৎকে যে সমৃদ্ধির শিখরে নিয়ে গেছে তা অভূতপূর্ব।
সূত্রাকারে বাংলা নাটকের উদ্ভব এবং বিবর্তনের ধারায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় অবশ্য কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরে এসে যে-পূর্ণতা লাভ করেছে এর উল্লেখমাত্রই এখানে করা হবে। কবিগুরু প্রথানুগ নাটক যেমন লিখেছেন তেমনি লিখেছেন আধুনিক আঙ্গিকেও, যা বাংলা নাটককে একেবারে আধুনিক বিশ্বের নাটকের সমকক্ষ করে দিতে সক্ষম হয়েছে।
রাজা ও রানী (১৮৮৯), বিসর্জন (১৮৯০), মালিনী (১৮৯৬), মুকুট (১৯০৮), প্রায়শ্চিত্ত (১৯০৯), রাজা (১৯১০), অচলায়তন (১৯১২), ডাকঘর (১৯১২), ফাল্গুনী (১৯১৬), রক্তকরবী (১৯১৬), মুক্তধারা (১৯২৫) এর মধ্যে বাংলা নাট্যসাহিত্যের উত্তরণের স্বাক্ষর বিদ্যমান। এ সঙ্গে কবির গীতি-নৃত্যনাট্য তাসের দেশ (১৯৩৩), চিত্রাঙ্গদা (১৯৩৬), চন্ডালিকা (১৯৩৭), শ্যামা (১৯৩৯) এবং বাল্মীকি প্রতিভা'য় কাব্য-সংগীত-নৃত্য এবং ভাবসম্পদ এ সৃষ্টিকে অনন্য মহিমায় মহিমান্বিত করেছে।
বিশ্বযুদ্ধকালীন পরিস্থিতি যে এ দেশের শিল্প-সংস্কৃতি ভাবনায় বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছে তার প্রতিফলন স্বাভাবিকভাবেই বাংলা নাটকে দেখা গেছে। নাটক যে বিনোদনের জগৎ থেকে নেমে এসেছে মানুষের প্রতিবাদী মিছিলে, হয়ে উঠেছে সংগ্রামী হাতিয়ার এ হচ্ছে বাংলা নাটকের ইতিহাসে আরেকটি অধ্যায়। সাম্যবাদী চেতনার উৎসারণ, প্রগতিশীল চিন্তার বিস্তার যে নাট্যজগতে প্রতিফলিত হয়েছে এর স্বাক্ষর রয়েছে বিজন ভট্টাচার্যের 'নবান্ন' (১৯৪৪) নাটকে যা সময়-সমাজ-রাজনীতি-প্রতিবাদ-প্রতিরোধের নাটকের ক্ষেত্রে একটি মাইলস্টোন। প্রাগাধুনিক কালে যে বিশাল বঙ্গভূমির গ্রামেগঞ্জে সাধারণ জনতার আগ্রহ সম্বল করে মঞ্চবিহীন, নাট্য উপাচার বিহীন, আড়ম্বরবিহীন লোক, লোকায়ত নাট্যের ধারা সৃষ্টি হয়েছিল, দুই মহাযুগের অন্তবর্তীকালীন সময়ে বাংলার সচেতন নাট্যকর্মীদের প্রয়াসে, মূলত ভারতীয় গণনাট্য এবং সম মনোভাবাপন্ন সংস্থার উদ্যোগে নতুন ভাষায় নতুন আঙ্গিকে, নতুন উদ্দীপনায় নাটক পৌঁছে গেল নাগরিক মঞ্চ থেকে একেবারে সাধারণ মানুষের কাছেই, যার অভিঘাত কলকাতা, ঢাকা এবং তৎকালীন প্রধান শহর ছাড়িয়ে সিলেট, কাছাড়, মেঘালয় হয়ে আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়ল, রচিত হল নতুন নাটক, নতুন নাট্য ইতিহাস।