এ পর্বটিতে যা জানতে পারবেন —
মহাগ্রন্থে উচ্চারিত হয়েছে ‘And let there be word, and there was word’। এই যে দৈব অনুজ্ঞা ‘শব্দ সৃষ্টি হোক্’ এবং এরপর শব্দ হয়ে- ওঠা —এর মধ্যিখানে রয়েছে দুস্তর ব্যবধান। ধ্বনিময় এ পৃথিবীতে ধ্বনি থেকে উৎপন্ন হয়েছে শব্দ, উৎসারিত হয়েছে বাক্য, স্ফুরণ ঘটেছে সৃজনশীলতার— সে অনেক অনেক শতাব্দীর ভাষাহারা বিজনবেদনার এবং নীরব সাধনার ফলশ্রুতি।
আসা যাক্ ব্যাকরণের পরিভাষার। শব্দ কা’কে বলা হবে? সোজা বাংলায়, যে ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টি একটি অর্থকে প্রকাশ করে তা’ই শব্দ। অর্থাৎ অর্থ-প্রকাশক ধ্বনি এবং লেখার ক্ষেত্রে বর্ণকেই শব্দ বলা হবে।
শব্দকে নাম বা প্রতিপাদিক হিসেবেও অভিহিত করা হয়।
[‘প্রতিপদ’ শব্দটির সঙ্গে বাঙালির মোটামুটি পরিচয় আছে। অমাবস্যার পর আসে প্রতিপদ, এরপর দ্বিতীয়া, তৃতীয়া তিথি। এ প্রতিপদ মানে আরম্ভ, beginning । সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায় “প্রতিপদ শব্দের অর্থ 'আরম্ভ', ইহা হইতেই বিভক্তিযুক্ত পদের আরম্ভ বা সূত্রপাত, এই জন্য ইহাকে প্রতিপাদিক বলে।” (ভাষা প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ, পৃঃ ১২৪)]
তাহলে আমরা বলতে পারি অর্থপূর্ণ ক্ষুদ্রতম ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টিই শব্দ, যেমন মা, পা, শ এবং মামা, বাবা, শত, শতক ইত্যাদি। আর এই শব্দ যখন বাক্যে ব্যবহৃত হয় তখন তার নাম হয় পদ। শব্দ আর পদ যদিও খুব কাছাকাছি তবুও এক নয়। শব্দের স্থান অভিধানে, ভাষার ভাণ্ডারে, কিন্তু পদের স্থান মানুষের মুখে। শব্দকে যখন বাক্যে ব্যবহার করা হয় (এ কাজে কিছু টানা হ্যাঁচড়াও করতে হয়) তখনই তা হয় পদ। ‘পদ’ শব্দটিকেই একটু বিশ্লেষণ করা যাক্। পদ হল পা, যা মানুষকে সচল (Workable) করে। এই যেমন ‘সূর্য’ শব্দটি। সূর্য শক্তির উৎস, সূর্য পূর্বদিকে উদয় হয় ইত্যাদি বাক্য আমরা করছি, কিন্তু এর তো আরও ব্যবহার করার প্রয়োজন, যেমন, ‘সূর্যের আলো’, ‘সূর্যের রশ্মি’, ‘সূর্যের উপগ্রহ’ ইত্যাদি। এখানে সূর্য-শব্দের সঙ্গে বিভক্তি যোগ করায় শব্দটি সচল হল, কিন্তু ‘সূর্যের’ শব্দটি তো অভিধানে খুঁজে পাবেন না। অতএব আমরা বলতে পারি পদ হল বিভক্তিযুক্ত শব্দ। অর্থাৎ বিভক্তির যোগেই শব্দ পদে পরিণত হয়।
শব্দকে দুই প্রকারে ভাগ করা যেতে পারে :
(ক) মৌলিক : অর্থাৎ যা'কে ভাঙা যায় না। যেমন : - জন, কান, নাক।
(খ) সাধিত : প্রত্যয়ের সাহায্যে কিংবা সমাসের ফলে যা গঠিত হয়— যেমন, লাঠি + আল = লাঠিয়াল › লেঠেল। বৃষ + তি = বৃষ্টি। পিত + অম্বর = পিতাম্বর। রাজ + পুত্র = রাজপুত্র
'সাধিত শব্দ' শব্দকে আবার প্রধানত দুইটি উপ-বিভাগে ভাগ করা যায় :
(ক) যৌগিক : শব্দটির মূলে রয়েছে ‘যোগ’। যে শব্দ একাধিক মৌলিক শব্দের মিশ্রণে অথবা প্রত্যয়যুক্ত হয়ে মূল শব্দের প্রকৃত অর্থকে প্রকাশ করে তা’ই যৌগিক শব্দ, যেমন অণ্ডজ। অশু থেকে যার উৎপত্তি, অণ্ড শব্দের ‘ড’ এর সঙ্গে প্রত্যয় যুক্ত হয়ে গঠিত শব্দে প্রার্থিত অর্থই প্রকাশিত হল। তেমনি দাতা, গোলাপী, রাজপুত্র।
(ক) যোগরূঢ় শব্দ : ‘রূঢ়’ মানে প্রসিদ্ধ। একাধিক শব্দযোগে বা প্রকৃতি-প্রত্যয় যোগে গঠিত শব্দ এবং সমাসবদ্ধ শব্দ যখন অন্য একটি বিশেষ অর্থপ্রকাশের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়, তখন তাকে বলে যোগাররূঢ় শব্দ। যেমন সুহৃৎ। শব্দটির মূল অর্থ সুন্দর হৃদয় যার; কিন্তু আমরা ‘সুহৃৎ’ বলতে বিশেষ অর্থে ‘বন্ধু’ বুঝি। তেমনি ‘পঙ্কজ’-এর অর্থে পঙ্কে যা জাত; কিন্তু আমাদের কাছে এর অর্থ ‘পদ্মফুল’।
আমাদের ভাষার অন্যতম প্রধান উপাদানই হল শব্দ। এই শব্দের পাশে শব্দ বসিয়ে আমাদের কথা বলা (সঙ্গে কিছু ধ্বনিও থাকে অবশ্য), কথা লেখা, সংগীত, কবিতা, গল্প-প্রবন্ধ-পত্র রচনা করা। এ শব্দের উৎস সন্ধান এবং এর উদ্ভবের ধারা অনুযায়ী এর শ্রেণীবিন্যাস আমাদের ভাষা-অন্বেষার একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং চিত্তাকর্ষক কর্মও বটে। প্রাত্যহির কথোপকথনে আমরা এমন সব শব্দ অবলীলাক্রমে উচ্চারণ করি, একটু স্থির মস্তিষ্কে চিন্ত করতে বসলে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয় দেখে যে- কোথাকার শব্দ কোথা থেকে কোথায় কী রূপ ধারণ করে এসে কী অর্থ বহন করছে। এই যেমন সিলেট-কাছাড় অঞ্চলে অতিথি আপ্যায়নে আমরা এগিয়ে দিই বাটাভরা ‘পান’। এক বিশেষ জনগোষ্ঠীর জীবিকার প্রধান স্থল ‘পুঞ্জি’তে উৎপন্ন এ পান, এক ‘পাই’, দু ‘পাই’ করে বাজারে বিক্রয় হয়। ওই জনগোষ্ঠী হলেন অস্ট্রিক, (খাসি) পানই যাদের সম্পদ, (আমরা বলি না পুঁজি?) অর্থাৎ treasure । এরই আরেকটি রকমফের হল ‘বুরঞ্জি’, যেমন ‘কাছাড়ি বুরঞ্জি’, ‘আহোম বুরঞ্জি’, বুরঞ্জি শব্দের অর্থও সম্পদ (তবে এখানে পার্থিব সম্পদ নয়, তথ্য অর্থাৎ জ্ঞান। অতীত সমাজ-রাজনীতি সম্পর্কিত জ্ঞান।) বাংলা ভাষায় এই ‘পান’, ‘পাই’ শব্দ আমাদের প্রাক্-পুরাতন আত্মীয়দের সূত্রে প্রাপ্ত, এটা দেশীয় না বিদেশি ঋণশব্দ সে বিচার পরে হবে। ইদানীং, সেও প্রায় সার্ধশতকের প্রথা, অতিথিকে পান দেবার আগে একটু গলা ভিজিয়ে নেবার জন্য এগিয়ে দেওয়া হয় এক কাপ ‘চা’ । আমরা কি ভেবেছি এ শব্দটি দুর্ভেদ্য প্রাচীর পেরিয়ে চিনদেশ থেকে এসেছে এ মুলুকে। ভাষাবিজ্ঞানে এ শব্দটিকে একটি বিশেষ শ্রেণীতে রাখা হয়েছে, আমরা যথাসময়ে দেখব।
আমাদের ভাষা আসলে একটি বহমান নদী। ঝরনা, ছড়া, হিমবাহ- নানা উৎস থেকে জল এসে যেমন মূল খাতটিকে পুষ্ট করে এবং সচল রাখে, তেমনি পূর্বপুরুষের সঞ্চিত শব্দ ভাণ্ডার, সমসাময়িক জীবন থেকে উঠে আসা নতুন শব্দ, নিকট-প্রতিবেশি, দূর-প্রতিবেশি, এবং অন্য ভাষিকগোষ্ঠীর শব্দ এসে যোগ হয়, যোগ হয় ভিন্ন প্রদেশ, ভিন্ন দেশের শব্দ। ভিন্ন জীবিকা বা সংস্কৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শব্দ তো আছেই।
একটি জীবিত ভাষার (Living language) চরিত্রলক্ষণই এটা, এতে প্রতিনিয়ত নতুন শব্দ- নানা উপায়ে- সংযোজিত হবে। সময়ের চাহিদা অনুযায়ী যে ভাষা এ চরিত্রলক্ষণটি হারাবে তা হয়ে যাবে মৃতভাষা (Dead language), যার সর্বশেষ অবলম্বন হবে পুথিপত্র, অভিধান - মানুষের মৌখিক বাচনে নয়।
বাংলা ভাষার শব্দসম্ভারকে প্রধানত দুইটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়- প্রথমটি হ’ল বাংলা ভাষার নিজস্ব উত্তরাধিকার বা মৌলিক শব্দ। দ্বিতীয়টি হল আগন্তুক বা ঋণ শব্দ।
প্রথমোক্ত, অর্থাৎ বাংলার নিজস্ব উত্তরাধিকারের মধ্যে আসছে সেই শব্দগুলো যারা সংস্কৃত থেকে সরাসরি, এবং প্রাকৃত অপভ্রংশের মধ্য দিয়ে রূপান্তরিত হয়ে বাংলায় এসেছে। এদের এক একটি নামও দেওয়া হয়েছে- তৎসম এবং তদ্ভব। ‘তৎসম’ অর্থাৎ ‘যেরকম ছিল তেমনি’; তদ্ভব হচ্ছে, ‘যা হয়েছে তা’। এদেরও আবার কিছু রকমফের আছে, যথাসময়ে আসা হবে এতে।
তাছাড়া, এই উত্তরাধিকার শব্দসম্ভারেই রয়েছে দেশি শব্দ যা মূলত আমাদের প্রাক্ পুরাতন অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, কোল, মঙ্গোলীয় পূর্বপুরুষদের সূত্রে প্রাপ্ত, এ সঙ্গে কিছু অনির্ণীত, অজ্ঞাতমূল দেশি শব্দও রয়েছে।
আর, আরেকটি শ্রেণী যাকে আমরা ঋণ শব্দ হিসেবে চিহ্নিত করছি এতে রয়েছে নানা প্রাদেশিক, এবং বিদেশি শব্দ। এই ভাষাপৃথিবী ভারতীয় মানচিত্র অতিক্রম করে মধ্যপ্রাচ্য তো বটেই, একেবারে সাগর পেরিয়ে ইউরোপ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, চিনা, জাপান, মায়াম্মার, অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয় দেশ পর্যন্ত বিস্তৃত।
এবার আমরা আরও নিবিড় ভাবে এ শব্দসম্ভার পর্যবেক্ষণ করব।
“ বাঙলা দেশকে যখনই বাইরের কোনো শক্তি শাসন করতে চেষ্টা করেছে তখন বাঙালি বিদ্রোহ করেছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আপন স্বাধীনতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে।...
...অন্যান্য আর্যদের তুলনায় বাঙালি কিছুমাত্র কম সংস্কৃত চর্চা করেনি, কিন্তু সে-চর্চা যে করেছে আপন বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে। আদিশূর থেকে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সকলের বহু চেষ্টাতেও বাঙালি উত্তরভারতের সঙ্গে স্ট্রীম-লাইনড্ হয়ে সংস্কৃত পদ্ধতিতে সংস্কৃত বর্ণমালার উচ্চারণ করেনি এবং বাঙলাতে সংস্কৃত শব্দ উচ্চারণ করার সময় তো কথাই নেই। ”
উত্তরাধিকার পর্যায়ের শব্দের মধ্যে প্রথমেই আসছে সংস্কৃত বা তৎসম শব্দ।
তৎসম শব্দ :
বাংলা ভাষার উন্মেষ পর্ব থেকে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত যেসব সংস্কৃত শব্দ অবিকৃত অবস্থায় ব্যবহৃত হচ্ছে তা'ই তৎসম শব্দ। এ ব্যাপারটি ইংরেজিতেও আছে। যেমন লাতিন শব্দ Parliament- লাতিন বানানের অনুরূপই লেখা হয়, যদিও ইংরেজিতে উচ্চারিত হয় ভিন্ন রূপে অর্থাৎ ‘পার্লামেন্ট’ (এদেশে শিক্ষিতজনেরাও ‘পার্লিয়ামেন্ট’ বলে থাকেন অবশ্য। বাংলায় তৎসম শব্দের সংস্কৃত ররূপ প্রাকৃতের ধ্বনি পরিবর্তনের ধারাতে ক্ষুণ্ণ হয়নি। তাছাড়াও অনেক ভাষাবিদ মনে করেন এ তৎসম শব্দগুলো ‘মাগধী প্রাকৃতের থেকে বাংলায় আসেনি। বাংলা ভাষা গড়ে ওঠার পর সংস্কৃত শব্দভাণ্ডার থেকে এইসব শব্দ নিয়ে এসে বাংলায় ব্যবহার করা হয়েছে।’ (সুভাষ ভট্টাচার্য, বাঙালির ভাষা, পৃ৽ ১৭০)
তৎসম শব্দগুলোর বানান সংস্কৃতের মতো, কিন্তু উচ্চারণ বাঙালিদের উচ্চারণের মতো। এ থেকে বিস্তর বানান বিভ্রমও ঘটে, তা আমরা প্রতিদিনই দেখি। বাঙালিরা সংস্কৃতের মতো, ‘পদ্ম’, ‘লক্ষ্মী’, ‘অক্ষর’ লিখেছে বটে, কিন্তু মুখে বলেছে ‘পদদো’, ‘লকখি’, ‘অকখরই’।
একটি পরিসংখ্যান মতে জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের অভিধানে সংকলিত শব্দের মধ্যে ৪৪ শতাংশই তৎসম।
অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতকে, বিশেষ করে ‘সাধু’ গদ্যে তৎসম শব্দের ব্যবহার ছিল অনেক বেশি। তবে চলতি গদ্যে এর ব্যবহার নিশ্চিতই কম, আর প্রাত্যহিক মুখের ভাষায়, উপভাষায় তো আরও কম।
তৎসম শব্দের কয়েকটি উদাহরণ নিম্নরূপ (বানান হুবহু সংস্কৃতের মতো, উচ্চারণ অনেক সময় ভিন্ন) : -
অঙ্গ, অক্ষি, অগ্নি, আকাশ, ইষ্ট, ঈশ্বর, উত্তর, ঐক্য, ওষধি, ঔজ্জ্বল্য, কবি, কান্তি, কুটুম্ব, কৃষি, ক্রোধ, ক্ষতি, গগন, গীত, ঘর্ম, চরণ, ছবি, ছিন্ন, জীবন, ঝঞ্ঝা, তন্ত্র, তৃণ, দস্ত, দান, ধান্য, ধূম, নক্ষত্র, নর, নিশা, পত্র, পাণীয়, ফল, বংশ, বায়ু, বিদ্যা, বীণা, ভক্তি, মান্য, যুবা, রাত্রি, রিক্ত, লজ্জা, লোহিত, শক্তি, শান্তি, শ্রম, যশু, সাগর, সূর্য, সিংহ, হেতু, হোম।
আরো একটি বিশেষ লক্ষণীয় বিষয় হল, সংস্কৃত ভাষায় নেই অথচ সংস্কৃতের নিয়মেই শব্দগুলো সৃষ্টি হয়ে তৎসম শব্দের দল ভারি করেছে। যেমন,
অতিষ্ঠ, আবাহন, খড়্গহস্ত, কাণ্ডজ্ঞান, অগ্নিদূত, গণ্ডমূর্খ। সংস্কৃত অভিধানে এ শব্দের স্থানও নেই। এখানে বাঙালির শব্দসৃষ্টির চমৎকার নিদর্শন।
বাঙালির চমৎকারিত্বের আরও উদাহরণ রয়েছে : -
অলাবু, কার্পাস, কম্বল, ঘণ্টা, ঘোটক, পুষ্প, পূজা, মঙ্গল, মর্কট, ময়ূর, মীন, অট্ট, অম্বা, কেকা, গঙ্গা, গণ্ডার, কোকিল, মুকুট, ডিম্ব, চুম্বন, পণ্ডিত, দুন্দুভি।
এ শব্দগুলো মূলত সংস্কৃত নয়, আর্যেতর। এদের সংস্কৃত করে নেওয়া হয়েছে এবং তৎসম শব্দের মর্যাদায় আসীন এরা। (জ্যোতিভূষণ চাকী, বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, পৃ৽ ২৭)
তাছাড়াও রয়েছে কিছু বিকৃত, ভাঙা তৎসম শব্দের নমুনা, যাকে বলা হয় অর্ধ-তৎসম। যেমন কেষ্ট (কৃষ্ণ), খিদে (ক্ষুধা) গেরাম (গ্রাম), ছিরি (শ্রী), তরাস (ত্রাস), থান (স্থান), দরশন (দর্শন), মন্তর (মন্ত্র) ইত্যাদি।
তদ্ভব শব্দ :
শব্দটির মধ্যেই অর্থ লুকিয়ে আছে। তদ্ভব মানে, তা থেকে উদ্ভব হয়েছে। ‘তৎ’ অবশ্যই সংস্কৃত নির্দেশক। ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ‘মুখ্যত এই শব্দগুলিকে লইয়াই আমাদের ভাষা’। (বাঙ্গালা ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা, ১৯১১, পৃ৽ ৪১)
অর্ধ-তৎসম শব্দের সঙ্গে এর পার্থক্য হল, এ শব্দগুলোকে চট করে সংস্কৃত শব্দজাত বলে সনাক্ত করা যায় না, বিবর্তন প্রক্রিয়ায় শব্দগুলো সংস্কৃত থেকে অনেকটাই সরে গেছে। সংস্কৃত নয়, প্রাকৃতের সঙ্গেই তদ্ভব শব্দের ধ্বনিগত সাদৃশ্য বেশি।
তদ্ভব শব্দের কয়েকটি উদাহরণ নিম্নরূপ : -
চলতি এবং মুখের ভাষায় তদ্ভব শব্দের বহুল প্রচলন। কবিতা এবং গানেও চমৎকার ভাবে এ শব্দগুলো স্থান পেয়েছে। রবীন্দ্রসংগীতে আছে ‘আকাশে উড়িছে বকপাঁতি’, ‘সে নাম খানি নেমে এল ছুঁয়ে, কখন আমার ললাট দিল ছুঁয়ে।’
দেশি শব্দ :
দেশি মানে দেশজ, স্থানীয় শব্দ। আর্যেতর, দ্রাবিড়, অস্ট্রিক, তাল, ভিল, কোল, মুন্ডা প্রভৃতি যে সমস্ত আদি বাসিন্দারা বাংলা মুলুকে বাস করতেন, আর্যভাষী জনগোষ্ঠী এসে এদের মুখের ভাষা থেকে অনেক শব্দ গ্রহণ করেছেন। এ সূত্রে প্রাপ্ত শব্দগুলোর ব্যুৎপত্তি জানা যায় না (সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়ম দিয়ে বিশ্লেষণ করা যায় না)। কুলো, খড়, চিংড়ি, ঝিঙা, টুকরি, ডিঙি, ঢেঁকি-এ সবই বঙ্গভূমির অনাবাদি, আংশিক আবাদি ভূমির উপর বিচরণশীল জনগোষ্ঠীর মুখ নিঃসৃত শব্দ।
দেশি শব্দগুলোর সংক্ষিপ্ত তালিকাটি নিম্নরূপ :
এছাড়াও অনুমান করা হচ্ছে কবাট, কেঁদো, চিলে, নরুন, পোড়া, মাঠ, মাকুন্দ এ শব্দগুলোও দ্রাবিড় সূত্রে প্রাপ্ত।
বিদেশি শব্দ :
বাংলা ভাষায় বিদেশি শব্দের উৎস সন্ধানে আমরা ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়িয়ে কতদূর যেতে পারি তা'র সীমারেখা নেই। এ অন্বেষায় আমাদের স্থানের গণ্ডি যেমন অতিক্রম করতে হয় তেমনি কালের গণ্ডিও। অতি প্রাচীন কাল থেকেই বিদেশি শব্দের অনুপ্রবেশ বাংলা ভাষায়। মধ্যপ্রাচ্যের বণিকরা এনেছে পারসি শব্দ খ্রিস্টীয় শতাব্দীর পূর্বেই। ৩২৭ অব্দে আলেকজান্ডারের আগমন এবং অতঃপর উত্তর-পশ্চিমভারতে গ্রিক উপনিবেশ স্থাপনের সূত্রে এল গ্রিক শব্দ। আরবি শব্দ এল সিন্ধু বিজয়ের পর। তুর্ক-আফগান শাসনে এল তুর্কি শব্দ, আর মুঘল আমলে ফারসি এবং আরবি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটল দেশের বিভিন্ন প্রদেশে, বাংলা এর অন্যতম অবশ্যই। পঞ্চাদশ শতাব্দী থেকে পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ফরাসি, ডেনিশ এবং ইংরেজ জাতি ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের সঙ্গে বঙ্গভূমিতেও অবস্থান করেছিল। স্বভাবতই ওই সূত্র থেকেও শব্দ এসেছে বাংলা ভাষায়।
কালানুক্রমিক ভাবে বিদেশি শব্দের সংক্ষিপ্ত তালিকা :
গ্রিক শব্দ :
বাংলায় বহুল ব্যবহৃত শব্দ ‘দাম’। এর উৎসে রয়েছে গ্রিক ‘দ্রামে’। ‘কেন্দ্র’ শব্দটি সংস্কৃতে এসেছে গ্রিক শব্দ ‘কেনত্রিন’ থেকে। শব্দটি তৎসম শব্দ হিসেবে বাংলায় স্থান পেয়েছে। তাছাড়াও রয়েছে ‘যবন’ প্রভৃতি শব্দ।
আর বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, মুদ্রাব্যবস্থা, শিল্পকলা প্রভৃতি ক্ষেত্রেও কিছু গ্রিক শব্দ ভারতীয় ভাষায় পরিবর্তিত এবং অপরিবর্তিত রূপে ঢুকেছে। অম্লজান, যবক্ষারজান শব্দগুলো গ্রিক শব্দের বঙ্গীকরণ। কিছু গ্রিক শব্দ আরবি, ফরাসির মাধ্যমেও বাংলায় এসেছে। ইদানীং হিন্দি, বাংলা সহ প্রায় সবক'টি প্রাদেশিক ভাষায় ‘আকাদেমি’ শব্দটি জনপ্রিয়। ‘সাহিত্য অকাদেমি’ কর্তৃক গৃহীত এ শব্দটির মূলে রয়েছে গ্রিক ব্যক্তিনাম ‘অ্যাকাদেমাস’। যার বাড়িতে প্লেটো তাঁর শিষ্যদের সঙ্গে দর্শনচর্চা করতেন। বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র হিসেবে ওই বাড়িটির অর্থসম্প্রসারণ ঘটল পশ্চিমে গেল Academi হয়ে, আর আরব মুলুক হয়ে ভারতে এল ‘অকাদেমি’ বা ‘আকাদেমি’ (Akademi) হয়ে। আমাদের ‘সাহিত্য অকাদেমি’ নামটি গ্রহণ করার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর একটি ভূমিকা ছিল। তাঁর অভিমত, যখন একটি বিদেশি শব্দকেই গ্রহণ করা হবে, তখন তা ইংরেজি কেন, আমাদের নিকট প্রতিবেশী আরবীয়রা শব্দটি যেভাবে উচ্চারণ করেন সেভাবেই গ্রহণ করতে পারি।
পর্তুগিজ শব্দ :
বাংলায় ‘পাউরুটি’ শব্দটির মূলে পর্তুগিজ ‘পঁও’, মানে রুটি (এ পঁও মানে leg নয়, পাউরুটি কখনওই ‘হাত’ রুটির প্রতিশব্দ নয়)। আর এসেছে আলমারি, আলকাতরা, আলপিন, আনারস, আয়া, আতা, ইস্পাত, এনতার, বাজু, কাফরি, গরাদ, গির্জা, চাবি, পাদরি, পিস্তল, পিরিচ, নিলাম, ফিতা, ফরাসি, বয়াম, বেহালা, বোমা, বোম্বেটে, বোম্বাই, মেজ, মাস্তুল, সাগু, সাবান প্রভৃতি শব্দ।
একথা মনে রাখা প্রয়োজন পর্তুগিজ অভিযাত্রী ভাসকো-ডা-গামা বর্তমান কেরলের কালিকটে এসেছিলেন ১৪৯৮ খ্রিঃ, আর ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে পর এদের যাওয়া আসা শুরু হয় বাংলায়। এদের সূত্রে বাংলায় প্রায় শ’খানেক শব্দের আমদানি হয়েছে।
ফরাসি শব্দ :
ফরাসি উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় এদেশে ইংরেজির প্রভাবটাই সর্বাধিক। বাংলা ভাষায় আবার যেসব ফরাসি শব্দ এসেছে এগুলোর উচ্চারণও হয়ে গেছে ইংরেজি উচ্চারণের মতো। যেমন ‘গ্যারেজ’, ‘ক্রচেট’, ‘এলিট’। তা-ছাড়া অবশ্য ফরাসি উচ্চারণ-অনুগ বেশ কিছু ফরাসি শব্দও বাংলায় চালু। যেমন, ‘আঁতাঁত’, ‘বুর্জোয়া’, ‘কাঁফে’, ‘কার্তুজ’, ‘মাদাম’, ‘ব্যালে’, ‘রেস্তোরাঁ’। আরও ক'টি নিত্য ব্যবহৃত ফরাসি শব্দ বাঙালির মুখে একটু রূপান্তরিত হয়ে উচ্চারিত হয়: ‘কুপন’, ‘ম্যাটিনি’, ‘প্ল্যানচেট’।
ওলন্দাজ শব্দ :
ওলন্দাজ বা ডাচ জাতিরা ১৬০৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ভারতে আসতে থাকে এবং কালিকট, সুরাট, মসলিপত্তম, কোচিন থেকে পর্তুগিজদের উৎখাত করে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। এরপর এরা বাংলার চুঁচুড়া ও কাশিমবাজারে আধিপত্য বিস্তার করে, তবে ইংরেজদের কাছে পরাজিত আবার হয়ে পিছু হটে। স্বল্পকালীন অবস্থিতিতেও কিছু শব্দ বাংলায় দিয়ে যার এরা, যেমন রুইতন, হরতন, ইশকাপন, তুরূপ, ইস্কুপ ইত্যাদি। বলা বাহুল্য শেষেরটি ছাড়া অন্য শব্দগুলো তাস খেলার সঙ্গে সম্পর্কিত।
আরবি-ফরাসি শব্দ :
বাংলায় ব্যবহৃত বিদেশি ঋণ-শব্দের আরবি-ফারসি সূত্রে। প্রাচীন কালে এসেছিল কিছু মধ্যে তিন হাজারেরও অধিক শব্দ এসেছে ফারসি শব্দ- যেমন মুচি, কাহন, মিহির (মেহের), স্যাকরা (সিক্কা)।
“ ..... এইসব আরবি-ফারসি-তুরকি শব্দ দীর্ঘদিন ব্যবহার করার ফলে বাংলার নিজস্ব সম্পদ হয়ে গিয়েছে।
কাজি নজরুল ইসলাম কবিতায় বহু আরবি ফারসি শব্দ ব্যবহার করেছেন: ‘আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ’, ‘ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মত’, ‘বাঙালির খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর’- এসব পঙক্তিতে কুর্নিশ, হিম্মত, খুন, খঞ্জর এগুলোকে বাংলা শব্দ বলতে বাধে না...”
আর দ্বাদশ শতকের পর তুর্ক-আফগান এবং ষোড়শ শতকে মুঘল শাসনের সূত্রে আরবি ফারসি শব্দের অনুপ্রবেশ-উত্তর ভারত হয়ে একেবারে বঙ্গভাষা-অঞ্চল অবধি। তুর্কি ভাষা অবশ্য ভারতে খুব বেশি বিস্তারলাভ না করে ফারসি ভাষাকেই পথ ছেড়ে দিয়েছিল। মুঘল শাসকরা তুর্কির বদলে ফার্সিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন তাও ওই ফারসির হাত ঘুরে। শব্দগুলোর মধ্যে । এমনকী এ দেশে যে আরবি শব্দ এসেছে ধ্বনিগত পরিবর্তনও ঘটেছে।
ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে বাংলায় চল্লিশটির মতো তুর্কি শব্দ রয়েছে। কয়েকটি নমুনা- আলখাল্লা, উজবুক, কলকা, কাঁচি, কাবু, কুলি, কোরমা, কোঁতকা, খান, খাঁ, খাতুন, চক্সকি, চিক, তবক, তকমা, তোড়া, বাবুর্চি, বোঁচকা, মুচলেকা, লাস, সাওগাত ইত্যাদি।
বাংলায় আরবি শব্দের কয়েকটি নমুনা :
অকু, আক্কেল, আসবাব, ইজ্জত, উকিল, ওজন, কদর, কাগজ, কায়দা, খাতির, জ্বালাতন, তুলকালাম, দাবি, নকল, ফকির, বদন, মেজাজ, রদ, লোকসান, শহিদ, শুরু, সই, সাহেব, হাকিম, হাল, হিসাব।
“ ... কোনও কোনও শব্দ (বাংলায়) মূল আরবি থেকে অনেকটাই সরে এসেছে। যেমন : - মেরামত এসেছে মূল মরম্মৎ থেকে, ফইজত এসেছে ফদীহৎ থেকে, মুহুরি এসেছে মূল মুহরবির থেকে, কাগজ এসেছে কায়গদ থেকে এবং ওজর এসেছে উদর থেকে। ”
বাংলা শব্দসম্ভারে ফারসি ঋণ-শব্দের সংখ্যা আরবির চেয়ে অনেক বেশি। এ শব্দগুলোর নানা শ্রেণীও আছে প্রশাসন বিষয়ক, ইসলাম ধর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, রাজস্ব, শিল্প, সংগীত ইত্যাদি বিষয়ক। কিছু শব্দের নমুনা অন্দর, আওয়াজ, আতশ, আদমশুমার, আন্দাজ, আবাদ, আমদানি, আমেজ, আশমান, আস্তে, ইয়ার, কারবার, কামাই, কোতোয়াল, কোমর, খরিদ, খাকি, খুব, খরগোশ, খুশি, খোদা, খোজা, খুসবু, খানসামা, খামোখা, গোমস্তা, গোলাপ;
চশমা, চোস্ত, চাপরাশি, চালাক, চাকর, চাদর, চৌবাচ্চা, চরকা, চেহারা, জখম, জঙ্গি, জমি, জমাদার, জমিদার, জিনিস, জাদুকর, জানোয়ার, টাকা, তরমুজ, তাজা, তন্দুর;
দারগা, দরবার, দরদ, দম, দরুন, দলিল, দস্তাবেজ, দরজি, দামামা, দাগ, দালান, দরাজ, দায়ের, দরখাস্ত, দুশমন, দিল, দিলদার, দেওয়ান, দস্তক, দরবেশ, দস্তানা, দস্তুর, দোকান, দোয়াব, দস্তা, দপ্তর, দুরস্ত, নরম, নমুনা, নাচার, নাস্তানাবুদ, নগদ, নালিশ, নিশান, নজরানা, পরোয়া, পাইকার, পেঁয়াজ, পেয়াদা, পোলাও, পরদা, পরগনা, পায়মাল, পছন্দ, পরকলা, পোক্ত, পোস্ত, পেয়ালা, পায়জামা, পেশা, পুল;
ফরমাশ, ফরমান, ফরিয়াদ, বন্দর, বরফ, বাগিচা, বাদাম, বেলোয়ারি, বন্দোবস্ত, বাজার, বাজিকর, বুলবুল, বকশিস, বাগান, বিমা, ভিস্তি, ময়দা, মলম, মালাই, মজুর, মহরত, মালিশ, মহিলা, মিহি, মোরগ, রওয়ানা, রপ্তানি, রাস্তা, রুমাল, রেহাই, রেশম, রেকাব, শিশি, শরিক, শানাই, শের, সরকার, সরদার, সওয়ার, সাজা, সিকদার, হরকরা, সাদা, হামানদিস্তা, হাজার, হেস্তনেস্ত।
ইংরেজি ঋণ-শব্দ :
দু’শো বছরের ইংরেজ শাসনে বাংলা ভাষায় বিপুল পরিমাণে ইংরেজি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। স্বাধীনতার সাতটি দশক পরও এ ট্র্যাডিশন সামনে চলছে। শাসন সংক্রান্ত শব্দ, ব্যবসা বাণিজ্যের শব্দ, নতুন অভিজ্ঞতাসঞ্জাত শব্দ, শিক্ষা, জ্ঞান বিজ্ঞান, ধর্ম-দর্শন, রাজনীতি, সাহিত্য-সংগীত, বিনোদন জগৎ-বিজ্ঞাপন জগৎ-ফ্যাশন জগৎ, শিল্প-প্রযুক্তি এবং যুদ্ধ বিগ্রহের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শব্দ প্রতিনিয়ত বাংলা ভাষায় সংযোজিত হচ্ছে। এটা একটা পূর্ণাঙ্গ অভিধানই দাবি করতে পারে।
এ শব্দগুলোর মধ্যে কিছু শব্দ আছে যা প্রায় অবিকৃত ভাবে বাংলায় এসেছে। যেমন- অফিস, অর্ডার, অ্যাসিড, অ্যালার্ম, আর্ট, অ্যাশট্রে, অ্যাটর্নি, কেয়ার, কমেডি, কাট, ক্লাস, কফ, কর্ক, গ্যালারি, চেয়ার, চপ, টাইম, টয়লেট, টট্র্যাজেডি, টিকিট, টেলিফোন, টেলিগ্রাম, ট্র্যাকস্, ট্র্যাক্সি, ড্রাইবার, ড্রাম, থিয়েটার, থিয়োরি, নোট, নেট, পেনসিল, পকেট, পাউডার, ফাউল, ফ্যাশন, ফুটবল, বল, ম্যানেজার, স্ট্রিট, সোয়েটার, স্ট্রাইক।
আবার আরেক শ্রেণীর ইংরেজি শব্দ আছে যাদের উচ্চারণ বদলে গেছে। যেমন- আপিল, আস্তাবল, ইঞ্জিন, ইঞ্চি, ইস্টিমার, ইস্টিশন, ইশকুল, কোম্পানি, কেতলি, ক্যানেস্তারা, কলম, গেলাশ, টেবিল, ডজন, ডাক্তার, প্লাস, পলেস্তারা, ফিস্টি, বুরুশ, বান্ডিল, ল্যামফো, লিস্টি, লাগেজ, সাস্ত্রি, সুভেনির, হ্যান্ডেল।
দুটো শব্দের বঙ্গীকরণ বিশেষ লক্ষণীয়: লজেন্স, (Lozenges) বাংলায় হয়েছে ‘লজেন্ডুস’। একেবারে রসনাটুকু পর্যন্ত, ধ্বনি ও বর্ণের মধ্যে প্রতিফলিত। আরেকটি হল হসপিটল (Hospital)। বাংলায় একেবারে ‘হাসপাতাল’। এখানে এলে কী হতে পারে না পারে, তারও একটা ইঙ্গিত বোধহয় খুব কষ্টকল্পনা নয়।
অন্যান্য বিদেশি শব্দ :
মধ্যপ্রাচ্য এবং বিভিন্ন ইউরোপীয় ভাষা থেকেও বাংলা ভাষায় আরও কিছু বিদেশি ভাষা শব্দেরও অনুপ্রবেশ ঘটেছে যা অদ্যাবধি প্রচলিত রয়েছে। এ হল দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ভাষা।
অস্ট্রেলিয়ার ‘ক্যাঙারু’, ‘বুমেরাং’, জাপানি ভাষার ‘রিকশা’, ‘হারাকিরি’, ‘জুজুৎসু’, তিব্বতি ভাষার ‘লামা’, চিনা ভাষায় ‘চিনি’, ‘চা’, ‘লিচু’, মায়ান্মারের ‘লুঙ্গি’, ‘প্যাগোডা’ ইত্যাদি।
বাঙালি বাচ্চারা পড়েছে ‘কাকাতুয়ার মাথায় ঝুঁটি, খেঁকশিয়ালী পালায় ছুটি’, আর গেয়েছে ‘লালঝুটি কাকাতুয়া ধরেছে যে বায়না/চাই তার লাল ফিতে, চিরুনি আর আয়না’। এই ‘কাকাতুয়া’ পাখিটি নিশ্চিতই মালয়সাগর পেরিয়ে এসেছে এই বাংলায়, শব্দটি যে মালয়ী।
বাংলার শব্দকে পাঁচটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয় : -
বিশেষ্য, বিশেষণ, সর্বনাম, ক্রিয়া, অব্যয়।
এখন এক একটি করে ওই শব্দ বা নামপদের সংজ্ঞা এবং স্বরূপ বিশ্লেষণ করা যাক্ :
বিশেষ্য :
বিশেষ্যের আরেকটি নাম হল নামপদ। যা-কিছুতে নাম বোঝায় তা-ই বিশেষ্য। ইংরেজি করে বললে বলা যায়— a naming word। একবার চোখ বন্ধ করে আবার চোখ মেলে দেখুন, যা দেখবেন সবই বিশেষ্য - আকাশ, মাটি, মেঘ, গাছ, পাখি, মানুষ, বাড়ি, ঘর।
শাক্ত পদাবলির আগমনী পর্যায়ের একটি গানের কল—
উমা আমার কী ধন আছে
তোমায় দিতে পারি,
নয়ন মেলে ব্রহ্মাণ্ডময়
সকলই তোমারই॥
এই ‘নয়ন মেলে ব্রহ্মাণ্ডময়’ সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, নক্ষত্র, পৃথিবী, সাগর, পর্বত, মানুষ, পশু পক্ষী, কীট-পতঙ্গ, অণুপরমাণু সমস্ত কিছুর অধিশ্বর এই 'বিশেষ্য', বাংলা ব্যাকরণের শব্দশ্রেণীর অন্যতম।
বিষয়টিকে আরও একটু বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। নিম্নলিখিত বাক্যগুলো দেখুন- সৌরভ আসছে, রেলগাড়ি চলছে। বৃষ্টি পড়ে, আলস্য ভাল না, বেশি ঘুমানো খারাপ, সে বিএ ক্লাসে পড়ে এখানে ‘সৌরভ’, ‘রেলগাড়ি’, ‘বৃষ্টি’, ‘আলস্য’, ‘ঘুমানো’, ‘ক্লাসে’ শব্দগুলোর মধ্যে ‘সৌরভ’ একটি ব্যক্তির নাম, ‘রেলগাড়ি’, এক ধরনের যান-এর নাম, ‘বৃষ্টি’ একটি জিনিসের নাম, ‘আলস্য একটি গুণের (দোষেরও, Quality) নাম, ‘ঘুমানো’ একটি ক্রিয়ার নাম এবং ‘ক্লাস’ ছাত্রের সমষ্টির নাম। এরা প্রত্যেকেই এক একটি পদ, তাই এরা বিশেষ্য পদ। এর সংজ্ঞা হ’ল- যে-পদ ব্যক্তি, জাতি, জিনিস, গুণ, ক্রিয়া এবং সমষ্টির নাম বুঝায় তাকে বিশেষ্য বলে (ইংরাজিতে Noun)।
বিশেষণ :
আমরা অনেক সময় অত্যধিক প্রশংসাসূচক বাক্যের উত্তরে বলি- ‘এত বিশেষণ লাগিয়ে বলো না, আমি মোটেই বিশিষ্ট কেউ নই।’ ওই যে নামের আগে বিশেষ সংযোজন, তা'ই বিশেষণ ।
নিম্নলিখিত বাক্যগুলো লক্ষ করুন-
ভাল জামাটি নাও,
বাচ্চা ছেলেটি কোথায়?
দুটো ছাত্র এসেছে-
‘ভাল’, শব্দটি জামার গুণ বোঝাচ্ছে, ‘বাচ্চা’ শব্দটি ছেলের অবস্থা, আর ‘দুটো’ শব্দে ছাত্রের সংখ্যা। এই শব্দগুলো হ'ল বিশেষণ।
অতএব, সংজ্ঞাটি হতে পারে এরকম- যে-পদ বিশেষ্যের দোষ, গুণ, অবস্থা বা সংখ্যা বিশেষভাবে বুঝায় (Qualify করে) তা'ই বিশেষণ (ইংরেজিতে Adjective এবং Adverb)।
সর্বনাম :
নাম পদ বা বিশেষ্যের (Noun) পরিবর্তে যে-পদ ব্যবহৃত হয় তা'ই সর্বনাম (ইংরেজি Pronoun)। তবে এখানে এ কথাটিও মনে রাখা চাই, আমি, তুমি, যে, তারা- এ ব্যক্তিবাচক সর্বনাম ছাড়াও আরও বেশ কিছু সর্বনাম রয়েছে। ‘কে’, ‘কবে’, ‘কোথায়’, ‘কোন’, ‘কি’, ‘কী’ ইত্যাদি প্রশ্নেবোধক শব্দও সর্বনাম। তাছাড়াও ‘ওই’, ‘ও’, ‘ওটা’, ‘এটা’ ইত্যাদি নির্দেশাত্মক এবং ‘কোনও’, ‘কারও’ ইত্যাদি অনির্দেশাত্মক শব্দ ছাড়াও সাকল্যবাচক, আত্মবাচক, যুগ্মসাপেক্ষ এবং ব্যতিহারমূলক শব্দও সর্বনাম পদবাচ্য হয়। যেমন : -
সাকল্যবাচক : সবাই, উভয়ে, সকলে, সব;
আত্মবাচক : স্বয়ং, নিজে, আপনি;
যুগ্মসাপেক্ষ : যত-তত, যে-সে;
ব্যতিহারমূলক : একে, অন্যে, পরস্পর।
এছাড়াও সর্বনামের তালিকায় কিছু সর্বনামীয় (Pronominals) শব্দ আসবে যেগুলো প্রায়ই বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেমন : - ‘এত’, ‘তত’, ‘এমন’, ‘তেমন’, ‘অমন’।
তাছাড়াও, বাংলায় বহুল ব্যবহৃত শব্দ, ‘অমুক’, ‘তমুক’ ‘প্রভৃতি’, ইত্যাদি- এগুলোও সর্বনাম পর্যায়ে, কারণ এ শব্দ তো ব্যক্তি বা বস্তুর পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে (মানে Substitute করছে)। আর বিশেষ মুদ্রাদোষ বলে অভিহিত ‘ইয়ে’ অব্যয়টিও মাঝে মাঝে বা প্রায়শই সর্বনাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়- যেমন, ‘ছেলেটা বেশ ইয়ে হয়েছে’, মানে পাকা, চালাক। বিশেষ্য পদবাচ্য আর ক’টি শব্দ হল ‘আর’, ‘কিন্তু’, ‘আরকি’।
ক্রিয়া :
যে-পদে কোনও কিছু করা, হওয়া, থাকা ইত্যাদি বোঝায় তা'ই ক্রিয়া (ইংরেজিতে Verb অর্থাৎ doing word)। যেমন- সূর্য ওঠে, জল পড়ে, ফুল ফোটে, ঘোড়া ছোটে। ক্রিয়াপদের প্রাচীন পরিভাষা হল, ‘আখ্যাত’, অর্থাৎ যার দ্বারা কর্তার কিছু করা বা হওয়া বোঝানো হয়, তা'ই ক্রিয়া। তাই ‘আখ্যাত’ শব্দ ধাতুকেও বোঝায়। ক্রিয়ার সঙ্গে ধাতু শব্দটিও সম্পর্কিত। আসলে ধাতুই ক্রিয়ার মূল এবং ক্রিয়ার বাচক।
এই ‘ধাতু’ শব্দটিকে একটু বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হ’ল ‘ধারক’, অর্থাৎ ক্রিয়ার্থের ধারক। ক্রিয়াপদ থেকে বিভক্তি বাদ দিলে যা থাকে তা’ই ‘ধাতু’। করে, করিল, করিবে, ক্রিয়াপদ থেকে এ, ইল, ইবে বিভক্তিগুলো বাদ দিলে ‘কর’ হ'ল ধাতু বা ক্রিয়ামূল।
বাক্যে ক্রিয়ার গুরুত্ব সবচাইতে বেশি। একটি বাক্যে বিশেষ্য, বিশেষণ, সর্বনাম বা অব্যয় না থাকলেও বাক্যটি দাঁড়াতে পারে, কিন্তু ক্রিয়া না থাকলে বাক্যটি দাঁড়াতেই পারবে না। অনেক সময় বাক্যে ক্রিয়া থাকে, কিন্তু তা দৃশ্যমান নয়। যেমন, শ্যামল তাঁর বড় ছেলে-এ বাক্যে ক্রিয়া আছে তবে দৃশ্যমান নয়, ক্রিয়া উহ্য।
বাক্যের ‘ক্রিয়া’ পদেই ‘কাল’ বোঝায়। অর্থাৎ বর্তমান, অতীতও ভবিষ্যৎ কাল নিরূপণের জন্য ক্রিয়াপদের উপরই নির্ভর করতে হয়। যেমন সে আসিতেছে, সে আসিয়াছিল, সে এসেছে বাক্যগুলোর মধ্যেই রয়েছে ভবিষ্যৎ, অতীত এবং বর্তমান কালের স্বাক্ষর।
অব্যয় :
আমরা কথা বলতে বা লিখতে কতগুলো শব্দ ব্যবহার না করে থাকতে পারি না, অথচ এগুলোর শ্রেণী কী তা নিয়ে খুব একটা মাথাও ঘামাই না। যেমন- এবং, বরং, আর, হঠাৎ, বা, বৈ, বরঞ্চ, নতুবা, যদ্যপি, তথাচ, তথাপি, হয়তো, বা, যদি, যদিবা, কেন-না, আর-কি।
এই অব্যয় শব্দগুলোর মূল রূপটি সব সময়ই অপরিবর্তিত থাকে। এগুলোর সঙ্গে বিভক্তি বা প্রত্যয়ের যোগও হয় না। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বাংলা অব্যয়কে সংযোজকবাচক বা সম্বন্ধবাচক (Conjunction) এবং আবেগবাচক বা মনোভাব বাচক (Interjection) হিসেবে ভাগ করেছেন। সংযোগবাচক অব্যয় হল- ‘ও’, ‘এবং’, ‘আর’, ‘যদি’, ‘তবু’, ‘বা’, ‘অথবা’, ‘নাকি’, ‘নইলে’, ‘তথাপি’, আর আবেগবাচক হল, ‘হায়’, ‘বেশ’, ‘ঠিক’, ‘বাঃ’।
সুভাষ ভট্টাচার্য আবার সমস্ত অব্যয়কে এ ভাবেও ভাগ করার প্রয়াস পেয়েছেন :
এক শ্রেণীর পদকে অন্য শ্রেণীর পদে পরিবর্তিত করার নামই পদান্তর। পদান্তর মানে শব্দের পরিবর্তন। পদ-পরিবর্তনের অর্থ হ'ল- বিশেষ্য পদকে বিশেষণে এবং বিশেষণকে বিশেষ্যে রূপান্তরিত করা।
বিশেষ্য পদের সঙ্গে তব্য, অনীয়,--ত, য, -ই, ঈ, -এ, ও, -টে প্রত্যয় যোগ করে বিশেষণপদে পরিবর্তিত করা যায়।
বিশেষণ পদকে বিশেষ্যে পরিণত করতে হলে এর সঙ্গে-অ, আ, -তি প্রভৃতি প্রত্যয় যুক্ত করতে হয়।
বিশেষ্য থেকে বিশেষণ :
বিশেষণকে বিশেষ্যে পরিবর্তন :
বিশেষ্য / বিশেষণ, ক্রিয়াপদের বিশিষ্ট প্রয়োগ :
একই পদকে নানা স্থানে নানা অর্থে প্রয়োগ করলে বক্তব্য চিত্তাকর্ষক হয়, অর্থবহ হয়। বিশেষ্য, বিশেষণ আর ক্রিয়াপদের বিশিষ্ট প্রয়োগ বাংলা ভাষায় অজস্র। এখানে কিছু নমুনা দেওয়া হল : -
বিশেষ্য পদের বিশিষ্ট প্রয়োগ–
চোখ — চোখ রাখা, চোখে চোখে কথা, চোখ বোজা, চোখে পড়া, চোখ রাঙানো।
কান — কান পাতলা, কান ভারি, কান কাটা, কানে ওঠা, কানে লাগা।
গা — গা লাগানো, গা ঝাড়া, গা ঢাকা, গায়ে হাত, গায়ে কাঁটা।
বিশেষণ পদের বিশিষ্ট প্রয়োগ–
কাঁচা কান — (অনিপুণ)
কাঁচা লেখা — (অপরিচ্ছন্ন)
কাঁচা পয়সা — (নগদ পয়সা)
পাকা মাথা — (অভিজ্ঞ)
পাকা কথা — (চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত)
ক্রিয়াপদের বিশিষ্ট প্রয়োগ–
গলা কাটা — (বেশি দাম)
তাল কাটা — (তালভঙ্গ/ছন্দবিহীন)
জিব কাটা — (লজ্জা পাওয়া)
ভুল ধরা — (ত্রুটি নির্দেশ করা)
বাংলা ভাষায় বহুপদকে একপদে পরিণত করে একটি চমৎকার প্রকাশ সৃষ্টি হয়েছে। একে বাক্য সংকোচনও বলা হয়। এ রূপান্তর করা যায় কৃৎপ্রত্যয়, তদ্ধিত প্রত্যয় যোগ করে, এবং সমাসের দ্বারাও।
পান করিবার ইচ্ছা— এটাকে একপদে রূপান্তর করলে হয় → পিপাসা (কৃৎপ্রত্যয়)
তেমনি, তর্কশাস্ত্র জানে যে → তার্কিক (তদ্ধিত প্রত্যয় যোগে)
নদী মাতা যাহার → নদীমাতৃক (সমাস)
এখানে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হল :
সমোচ্চারিত ভিন্নার্থক শব্দ : এ শব্দগুলোর উচ্চারণ প্রায় সমান, কিন্তু বানান এবং অর্থে পার্থক্য স্পষ্ট। যেমন : -
বিপরীতার্থক শব্দ : বাংলায় অনেক শব্দ আছে যার যথাযথ বিপরীত শব্দেরও প্রচলন রয়েছে। বিশাল শব্দভাণ্ডারে এ বিপরীতার্থক শব্দ খুঁজে বেড়ানো ভাষা অন্বেষার এক অন্যতম কর্ম। কয়েকটি নমুনা দেওয়া হল—
নানার্থক শব্দ : এ শব্দ বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিভিন্ন প্রেক্ষিতে বিভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে। কয়েকটি নমুনা এখানে দেওয়া হল—
অর্থ — ধন, তাৎপর্য, প্রয়োজন, উদ্দেশ্য।
অঙ্ক — গণিত, কোল, সংখ্যা, চিহ্ন, নাটকের অংশ।
উত্তর — দিক্ বিশেষ, পরবর্তী, জবাব।
কর — কিরণ, হস্ত, খাজনা।
পত্র — গাছের পাতা, চিঠি, ফলক।
বাস — বস্ত্র, গন্ধ, বাসস্থান।
মতি — মনোযোগ, বুদ্ধি, রত্নবিশেষ।
সমার্থক শব্দ : বাংলায় একই অর্থ বোঝাতে একাধিক শব্দ (Synonym) রয়েছে (অবশ্য অন্যভাষাতেও তা'ই)। এ শব্দের যথাযুক্ত প্রয়োগ ভাষার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। কয়েকটি নমুনা দেওয়া হল—
অগ্নি — আগুন, অনল, কৃশানু, পাবক, বহ্নি, বায়ুসখা, বৈশ্বানর, বিভাবসু, পাবক, হুতাশন।
অন্ধকার — আঁধার, তিমির, তমিস্রা, তমঃ।
আকাশ — অন্তরীক্ষ, অভ্র, খ, গগন, নভঃ, দ্যুলোক, বিমান, শূন্য।
কেশ — অলক, কুন্তল, চিকুর, চুল।
গৃহ — আগার, আবাস, আলয়, গেহ, ঘর, বাড়ি, নিলয়, শালা, সদন।
রজনী — ক্ষাণদা, ক্ষপা, ত্রিযামা, নিশা, নিশীথিনী, যামিনী, বিভাবরী, রাত্রি, শর্বরী।
সমাস বলতে আমরা কী বুঝি?
সহজ ভাবে বললে একাধিক শব্দ বা পদ এক সঙ্গে যুক্ত হয়ে একটি বড় শব্দ তৈরি হ’লে তা’কে বলে সমাস। সমাস শব্দটির অর্থ হ’ল ‘সংক্ষেপ’। দুই, তিন, চার কিংবা আরও বেশি শব্দ মিলে যখন ‘একটি’ শব্দ তৈরি হয়, তখনই আমরা বলি সমাস। আমাদের জাতীয় সংগীতে অনেকগুলো অঞ্চলের নাম মিলে এক ‘একটি’ শব্দ (সমাস) হয়েছে-
‘পাঞ্জাব-সিন্ধু-গুজরাট-মারাঠা-দ্রাবিড়-উৎকল-বঙ্গ’।
তেমনি অনেকগুলো শব্দ মিলে হয়েছে-
‘জনগণমনঅধিনায়ক’।
বন্দেমাতরম গানে আছে- ‘শুভ্রজ্যোৎস্নাপুলকিতযামিনী’।
তাছাড়া ছোট ছোট সমাসের উদাহরণ-
সিংহ + আসন = সিংহাসন
ত্রি + জগৎ = ত্রিজগৎ
বীণা + পাণি = বীণাপাণি — ইত্যাদি।
সমাস প্রধানত ছয় প্রকারের :
এবারে খুব সংক্ষেপে সমাসগুলোকে নিয়ে আলাদাভাবে আলোচনা করা যাক্ :
(১)দ্বন্দ্ব সমাসদ্বন্দ্ব মানে যুগ্ম বা জোড়া। এটা একটা সম্পর্ক (relation)। এ সম্পর্ক বিবাদের হতে পারে বন্ধুত্বের হতে পারে। [‘দ্বন্দ্ব’ শব্দটি ছাত্রদের মনে সংশয়ের সৃষ্টি করে তাই এ কথাটি মনে রাখা]।
যেখানে ‘ও’, ‘এবং’ ইত্যাদি সংযোগমূলক অব্যয়ের দ্বারা জোড়া লাগানো দুই বা ততোধিক বিশেষ্যপদ মিলে সমাস হয় তা’কে বলে দ্বন্দ্ব সমাস। এখানে দুটি বিশেষ্যপদের প্রাধান্যই অক্ষুণ্ণ থাকে। উদাহরণ- ‘রাতদিন’, ‘পূজাপার্বন’, ‘আসা যাওয়া’, ‘সাদা কালো’।
দ্বন্দ্ব সমাসেরও নিম্নলিখিত প্রকারভেদ আছে :
অলুক দ্বন্দ্ব — এখানে দু'টি পদের বিভক্তি চিহ্ন [-এ -কার, ।-আকার] অক্ষুণ্ণ থাকে।] যেমন : - হাটে ও মাঠে = হাটেমাঠে; আগে ও পিছে = আগেপিছে।
সাধারণ দ্বন্দ্ব — এ সমাস সম-জাতীয় কিংবা বিপরীত অথবা বিকল্প (Substitute) পদ মিলে তৈরি হয়। যেমন : - লোক ও লস্কর = লোকলস্কর (সমজাতীয়); সুখ ও দুঃখ = সুখদুঃখ; দিবস ও বিভাবরী = দিবসবিভাবরী (বিপরীত); ভাল ও মন্দ = ভালমন্দ (বিকল্পার্থক); রাজা ও বাদশা = রাজাবাদশা (সমার্থক);
(২)তৎপুরুষ সমাসযে-সমাসে উত্তরপদের (Second word) অর্থটাই প্রধান এবং পূর্ব-পদের সঙ্গে তার কারক-সম্পর্ক থাকে, তাই তৎপুরুষ সমাস। যেমন : -
মাছ ধরা = মাছধরা; এখানে ‘মাছ’ নয় ‘ধরা’ পদটিই গুরুত্ব পেয়েছে।
তেমনি, ‘সাহায্য প্রাপ্ত’, ‘কষ্টার্জিত’ শব্দে ‘প্রাপ্তি’ আর ‘অর্জনে’রই প্রাধান্য।
তৎপুরুষ সমাসের ও অনেক শ্রেণী-বিভাজন :
এই সমাসে প্রথম পদটি দ্বিতীয় পদের বিশেষণ রূপে অবস্থান করে এবং দ্বিতীয়টির অর্থ বলবৎ থাকে। যেমন : - নীল যে আকাশ নীলাকাশ। এখানে ‘নীল’ শব্দ বা পদটি ‘আকাশ’-এর বিশেষণ। কিন্তু সমাস হয়ে গেলে ‘আকাশ’-এর প্রাধান্যই বলবৎ হয়। ‘অম্লমধুর’ শব্দে মধুর (মাধুর্যের) প্রাধান্যই বেশি, অম্ল বা টক আছে, তবে স্বল্প।
রবীন্দ্রগানের কয়েকটি শব্দ বিশেষ লক্ষণীয় —
‘মন্দমধুর’, ‘অতিথি অজানা’, ‘সজলঘন’।
কর্মধারয়ের আবার শ্রেণী-বিভাজন আছে :
এই সমাসে প্রথম পদটি সংখ্যাবাচক (numerical figure), উত্তরপদটি (second word) নামবাচক (বিশেষ্য/noun), এবং সমস্ত পদটি সমষ্টিবোধক (collective)। যেমন : -
পঞ্চ (five, numerical) বটের (noun) সমাহার (collective) → পঞ্চবটী, তেমনি ত্রি ভুবনের সমাহার → ত্রিভুবন, সপ্ত অহর (দিন) সমাহার → সপ্তাহ।
এখানে পূর্বপদে (1st word) অব্যয় (যা বদলায় না) থাকে, এবং অব্যয়ের অর্থই প্রাধান্য লাভ করে। যেমন : -
জন্ম হইতে → আজন্ম,
সমুদ্র হইতে → আসমুদ্র, ভিক্ষার অভাব → দুর্ভিক্ষ।
সমাসের আরও শ্রেণী রয়েছে। যেমন : -
নিত্যসমাস — দেশান্তর, মনান্তর, কৃষ্ণসর্প, শেঁয়ালবাঁটা।
মিশ্রসমাস — শুভ্রজ্যোৎস্নাপুলকিতযামিনী, উচ্ছলজলধিতরঙ্গ।
অসংলগ্ন সমাস — ‘বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন’। এখানে সমস্যমান পদগুলোকে সংলগ্ন করেই লেখা হয়। অনেক সময় এ ধরনের শব্দে হাইফেন ব্যবহৃত হয় – তবে সব শব্দ মিলে এতে ‘একটি’ নামপদ’–ই বোঝায়।