এ পর্বটিতে যা জানতে পারবেন —
বানান বিভ্রম, বানান সংকট, বানান বিতর্ক, প্রাচীন এবং প্রমিত বানানের বৈপরিত্য, বিকল্প বানান এ নিয়ে এ বিষয়টি বাঙালি ছাত্রছাত্রী, লেখক, ভাষাবিজ্ঞানী, শিল্পী, সংবাদ মাধ্যম, বৈদুতিন মাধ্যমের কর্মীরা, এবং বিনোদন জগৎ ছাড়াও সাধারণ ভাষা ভাবুকদের মনে অনেক সংশয়। ১৯৩৫ সাল থেকে এপারে, ওপারে ক্রমান্বয়ে অন্তত দুইবার অ্যাকাডেমিকস্, সরকারি, বেসরকারি এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে যে সংস্কারমূলক কার্যসূচি গৃহীত হয়েছে তা'ই এ পর্বে আলোচিত হয়েছে।
আমরা ইংরেজি বানান ভুল করলে লজ্জায় মরে যাই, কিন্তু বাংলা বানানটা যে শুদ্ধ করে লেখার নিয়ম, এটা যেন মানতেই চাই না। কবে মাইকেল মধুসুদন দত্ত ‘পৃথিবী’ লিখতে ভুল করে ‘প্রথিবী’ লিখেছিলেন এবং তা সত্ত্বেও মহাকবি হয়ে উঠতে তাঁর কিছুই আটকায়নি এরকম কিছু কাহিনীর উপর নির্ভর করে আমরা বেশ আছি। অনেকে বলেন, ‘আজকাল বানানের কোনও নিয়ম নেই। একই শব্দ কত রকম লেখা হয় পত্র পত্রিকায়’ ইত্যাদি। এ কথার মধ্যে সত্য এটাই, বানানকে কখনই কোনও কঠিন নিয়ম শৃঙ্খলার বন্ধনে আবদ্ধ করা যায় না, যায়ও নি। সেই হস্তলিখিত পুথির যুগ থেকে মুদ্রণ যুগের সূচনা, কেরি সাহেব থেকে রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র হয়ে রবীন্দ্র প্রমথ চৌধুরী ,সুনীতিকুমার কিংবা মুজতবা আলী-বুদ্ধদেব-পবিত্র সরকার-শঙ্খ ঘোষ-নীরেন চক্রবর্তী পর্যন্ত বাংলা বানান যে একই ধারায় চলছে তা তো নয়। তবে এ পরিবর্তনের মধ্যেও একটা নিয়ম, একটা যুক্তিগ্রাহ্য বিধির আত্মপ্রকাশও ঘটেছে, যা কিছু লোকের কাছে গ্রহণীয়, কিছু লোকের কাছে গ্রহণীয় নয়, তাও বটে। তবে বাংলা বানানের কোন নিয়ম নেই এটা হাস্যকর উক্তি।
এখানে এ কথাটিও মনে রাখতে হয়- ভাষা তো অচল, অনড়, অটল কিছু নয় যে দশকের পর দশক বা শতাব্দীর পর শতাব্দী একটি নিদিষ্ট ছকে বাঁধা থাকবে। সময়ের রূপান্তরে এক একজন জীবিত ব্যক্তির শারীরিক গড়ন, বাকভঙ্গি, কন্ঠস্বরের যেমন রূপান্তর ঘটবে তেমনি একটি ভাষাও রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে এগোবে। রূপান্তর ঘটবে ভাষার উচ্চারণগত দিকে এবং লিখিত রূপেও। একমাত্র ‘মৃত ভাষা’ (dead language) অর্থাৎ যার স্থান পুথিপত্র, অভিধান আর মহাফেজখানা নামক সমাধিস্থলে- সে ভাষার লিখনশৈলিতে কোনও পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই।
লিপিকর, মুদ্রাকর, পণ্ডিত, ছাত্র এবং সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক ব্যবহারে বাংলা ভাষার লিখনকর্মে পরিবর্তন ঘটবেই। সচেতন ভাষাচিন্তক আর ভাষাবিজ্ঞানীরা এ পরিবর্তনকে বিশ্লেষণ করবেন, পরিবর্তনের ধরন (Pattern) টিকে কোনও যুক্তিগ্রাহ্য নিয়মের মধ্যে সংস্থাপন করবেন - কোন পরিবর্তন ঘটছে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়, কোল্টি অচেতন ভ্রান্তি, কোটি প্রযুক্তির কারণে, আর কোনটি স্বেচ্ছাচারিতা বা ইচ্ছাকৃত অথবা উদ্দেশ্য প্রণোদিত তা নিরূপণ করবেন, এবং এমনি করেই আসে বানানের বিধিবদ্ধতার কথা।
আমাদের অনেক পরিবারেই আছে পূর্বপুরুষের সংরক্ষিত কিছু পুথিপত্র, হস্তলিখিত ‘পদ্মপুরাণ’ (শ্রাবণমাসে সুর করে পাঠের জন্য অন্তত), মুসলিম পরিবারে ‘কেতাব’, রয়েছে কবিরাজি পুথি, পুজাবিধি, মেয়েদের সংরক্ষণে ‘গীত’-এর খাতা (বিয়ের গান, সূর্যব্রতের গান ইত্যাদি)। আমাদের বয়স্করা কী অবলীলাক্রমে এগুলো পাঠ করেন। আমরা নিজেরাও একটু চোখ বুলিয়ে দেখতে পারি কিসন (কৃষ্ণ), পদ্যাবতি (পদ্মাবতী) ইস্বর (ঈশ্বর), ভজইল (ভঞ্জিল),জানিআ (জানিয়া) বানানগুলোকে। ল আর ন-র তফাৎ বোঝাতে একটি বিন্দুর (.) প্রয়োগ ছাড়া আরও অনেক কিছু আবিষ্কার করতে পারি। এরপর, মুদ্রণ প্রযুক্তির আত্মপ্রকাশে ‘ব’ (পেটকাটা)-র এর স্থানে এসেছে ব-এর নিচে বিন্দু (র) দিয়ে ‘র’। মধ্যযুগের সমস্ত বাংলা লিপিতে ওই পেটকাটা ‘ব’-ই পাওয়া যাবে, এতে ভাষাটির বাঙালিত্ব হারাবার ভয় নেই। কাজটি করেছেন অষ্টাদশ শতকের মুদ্রণকর্মী পঞ্চানন কর্মকার, অক্ষরটি যিনি ধাতু ঢালাই দিয়ে ‘র’ তৈরির চেয়ে নিচে একটা ফুটি বসিয়ে (.) সহজে বানাতে পেরেছেন।
ঊনবিংশ শতকে ‘সাহার্য’, ‘যুর্ধ’, ‘ম্যায়া’ (মেয়ে) এসব বানান ছিল। দ্বিত্ব দীর্ঘ-ই কার, মূর্ধন্য-এসবের ব্যবহার ছিল অত্যাধিক। আর বিদেশি শব্দের প্রতিবর্ণীকরণে কত রকমফের ছিল। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ই শেক্সপিয়ার মোক্সমুলার লিখতেন ‘শেক্ষপীয়ার’, ‘মোক্ষমূলার’। ইংরেজ প্রশাসককে কাছাড়ি রাজা সম্বোধন করেছেন ‘মেস্তর’ বলে। আসলে বলতে চেয়েছিলেন ‘মিস্টার’।
আর ‘বাংলা’ শব্দটাই বা কত রূপে কত চেহারা পাল্টে আজকের অবয়ব ধারণ করেছে, এটাই কি আমরা লক্ষ করেছি? চর্যাপদে ছিল ‘বঙ্গালী’, মধ্যযুগে কোরান অনুবাদক লিখেছেন ‘মুসলমানী শাস্ত্রকথা বাঙ্গালি করিলু... (সম্ভবত ১৬৩৯ খ্রিঃ), মনোত্রল লিখেছেন ‘বেঙ্গালা’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বাংলা’ শব্দটি জনপ্রিয় করার পরও ভাষাচার্য সুনীতিকুমার লিখলেন ‘বাঙ্গালা ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা’, সুকুমার সেন লিখলেন ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’। ১৩৩৮ বঙ্গাব্দের ‘গীতিবিতান’ (৩ খন্ডে)-এ ‘বাঙালি’ শব্দটি মান্যতা পাবার পরও ১৩৫৬ বঙ্গাব্দে (১৯৪৯ খ্রিঃ) নীহাররঞ্জন রায় লিখলেন ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’। এই বানান বৈচিত্র্য কোনও দোষের কিছু নয়, তবে মুদ্রণ মাধ্যমের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে এ বিভিন্নতা অনিবার্যভাবেই কিছু সমস্যারও সৃষ্টি করবে, তৈরি হবে বিশৃঙ্খলতারও এবং এর ফলে ব্যাহত হবে ভাষার অগ্রগতি - এ বিবেচনায় বিংশ শতকের গোড়া থেকেই এদিকে সচেতনতা জাগতে শুরু হয়। বিশেষ করে, স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরীর পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা সাহিত্যে চলিত ভাষারীতির প্রাধান্য আসার সঙ্গে সঙ্গে তদ্ভব, দেশি এবং বিদেশি শব্দের প্রয়োগ যেমন বেড়ে গেল তেমনি নতুন অভিজ্ঞতাসঞ্জাত আঞ্চলিক শব্দ, এমনকী স্ল্যাং (Slang) শব্দেরও অনুপ্রবেশ ঘটে গেল যার প্রভাব এল বানান প্রকরণে। এ পরিপ্রেক্ষিতে লিখনকর্মে নিযুক্ত ব্যক্তিরা, তা তিনি যে কোনও পেশাতেই থাকুন না কেন, এরা সংশয় এবং বিভ্রান্তির শিকার হলেন। স্কুল মাস্টার থেকে পাঠ্যপুস্তক প্রণেতারা, সাংবাদিক থেকে সাহিত্যসেবীরাও যথেষ্ট বিড়ম্বনার সম্মুখীন হয়েছেন। প্রথম পর্বে এগিয়ে এসেছেন অভিধান প্রণেতারা, এদের নিজস্ব বানানবিধি নিয়েই। এর সঙ্গে সঙ্গেই আত্মপ্রকাশ ঘটল সচেতন ভাষাভাবুকদের। বঙ্কিমচন্দ্রের নিবন্ধ ‘বাংলা ভাষা’ (১২৮৫ অর্থাৎ ১৮৭৪ খ্রিঃ) এ ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক, এবং বাংলা ভাষাকে বিধিবদ্ধ রূপ দেবার প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত হল ১৮৯২ সালে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ’ প্রতিষ্ঠা হওয়াতে।
বিশ শতকের ত্রিশের দশকে বাংলার বিদ্বজ্জনের সমবেত ইচ্ছার প্রতিফলনই ঘটল কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক বানান সংস্কার সমিতি গঠনে (১৯৩৬)। এর পর আবার ১৯৮ সালে ‘বাংলাদেশ জাতীয় ও শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক বাংলা বানান নিয়ম প্রবর্তন প্রয়াস এবং ১৯৯৭ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি’র বাংলা বানান সংস্কার উদ্যোগ। ‘প্রাকৃত বাংলার’ বানানের শৃঙ্খলার প্রয়োজন প্রথম অনুভব করেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং এ মর্মে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে একটি বিধি প্রণয়নের জন্য আবেদন করেন এবং এতে সাড়া দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় রাজশেখর বসুর সভাপতিত্বে বাংলা বানানের নিয়ম প্রণয়ণের জন্য একটি সমিতি গঠন করেন এবং প্রায় দুই শত বিশিষ্ট লেখক ও অধ্যাপকের অভিমত গ্রহণ করেই ১৯৩৬ সালের ৮ মে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় একটি নিয়মাবলী প্রকাশ করেন। এর পর আরও দুই দফায় সংশোধন সহ এর দ্বিতীয় (২ অক্টোবর, ১৯৩৬) ও তৃতীয় সংস্করণ (২০ মে, ১৯৩৭) প্রকাশিত হয়।
এ সংস্কার প্রস্তাবের পক্ষে বিপক্ষে সেদিন প্রবল তর্ক-বিতর্ক হয়, যার রেশ আজও রয়েছে। এ আলোচনায় যারা যোগ দেন এদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ, যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি, বীরেশ্বর সেন, সুধীর মিত্র, জ্যোতির্ময় ঘোষ, রাধারাণী দেবী, নরেন্দ্র দেব, বিজনবিহারী ভট্টাচার্য, গোবর্ধনদাস শাস্ত্রী, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, রাজশেখর বসু, আশুতোষ ভট্টাচার্য, চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য, বিমলনারায়ণ চৌধুরী, ব্রহ্মানন্দ সেন, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, দেবপ্রসাদ ঘোষ, মঞ্জু ঘোষ, জগন্নাথ চক্রবর্তী, প্রশান্তচন্দ্র মহালনবিশ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
বানানবিধির বিরোধিতা করে প্রকাশিত একটি ইস্তাহারে, (১লা বৈশাখ, ১৩৪৪) স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে ছিলেন দেবপ্রসাদ ঘোষ, অনুরূপা দেবী, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, দীনেন্দ্রকুমার রায়, হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, শৈলেন্দ্রকৃষ্ণ লাহা, সজনীকান্ত দাস, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সুকুমার মিত্র, অশোকনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ।
অবশ্য বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষাক্রম, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, বাংলা একাডেমী (বাংলাদেশ) ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে বানান সরলীকরণ, বানানের সমতা বিধান - এ ধরনের প্রয়াস চলছে, চলছে বানান অভিধান প্রণয়ন, বানান বিধি, ব্যবহারিক শব্দকোষ, প্রয়োগাভিধান প্রকাশ এবং প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক ভাবে বানান কর্মশালা আয়োজন। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে ত্রিপুরা, বিহার, বাংলাদেশ ছাড়াও আসামের বরাক উপত্যকারও বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
মুদ্রণ প্রযুক্তির বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ইনফরমেশন টেকনোলজির বিস্ফারের সঙ্গে বাংলা লিখনকর্মেও যেমন নতুন সম্ভাবনার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হয়েছে তেমনি বাংলা লিখনকর্মের সামনে এসেছে নতুন প্রত্যাহ্বানও। বানান সংস্কার প্রয়াস ও অভিন্ন বানান বিধি প্রণয়নের স্বপ্ন এখন বাঙালি ভাষাচিন্তক ছাড়া সচেতন পাঠক সমাজেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
.... বাংলা বানানের নিয়ম বিধিবদ্ধ করার জন্য আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছিলুম।
বাংলা ভাষার উচ্চারণে তৎসম শব্দের মর্যাদা রক্ষা হয় বলে আমি জানিনে। কেবলমাত্র অক্ষর বিন্যাসেই তৎসমতার ভান করা হয় মাত্র, সেটা সহজ কাজ। বাংলা লেখায় অক্ষর বানানের নির্জীব বাহন কিন্তু রসনা নির্জীব নয়- অক্ষর যাই লিখুক, রসনা আপন সংস্কার মতোই উচ্চারণ করে চলে। সেদিকে লক্ষ্য করে দেখলে বলতেই হবে যে, অক্ষরের দোহাই দিয়ে যাদের তৎসম খেতাব দিয়ে থাকি সে সকল শব্দের প্রায় ষোলো আনাই অপভ্রংশ। যদি প্রাচীন ব্যাকরণ কর্তাদের সাহস ও অধিকার আমার থাকত, এই ছদ্মবেশীদের উপাধি লোপ করে দিয়ে সত্য বানানে এদের স্বরূপ প্রকাশ করার চেষ্টা করতে পারতুম।…
এমন কি, যে সকল অবিসম্বাদিত তদ্ভব শব্দ অনেকখানি তৎসম-ঘেঁষা, তাদের প্রতি হস্তক্ষেপ করতে গেলেও পদে পদে গৃহবিচ্ছেদের আশঙ্কা আছে। এরা উচ্চারণে প্রাকৃত কিন্তু লেখনে সংস্কৃত আইনের দাবি করে।
প্রাকৃত বাংলায় তদ্ভব শব্দবিভাগে উচ্চারণের সম্পূর্ণ আনুগত্য যেন চলে এই আমার একান্ত ইচ্ছা ছিল। কিন্তু যদি নিতান্তই সম্পূর্ণ সেই ভিত্তিতে বানানের প্রতিষ্ঠা নাও হয়, তবু এমন একটা অনুশাসনের দরকার যাতে প্রাকৃত বাংলার লিখনে বানানের সাম্য সর্বত্র রক্ষিত হতে পারে।…
রেফের পর ব্যঞ্জনের দ্বিত্ববর্জন সম্বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয় যে নিয়ম নির্ধারণ করে দিয়েছেন তা নিয়ে বেশি তর্ক করার দরকার আছে বলে আমি মনে করিনে। যারা নিয়মে স্বাক্ষর দিয়েছেন তাদের মধ্যে অনেক বড়ো বড়ো পণ্ডিতের নাম দেখেছি। আপনি যদি মনে করেন তাঁরা অন্যায় করেছেন তবুও তাদের পক্ষভুক্ত হওয়াই আমি নিরাপদ মনে করি। অন্তত তৎসম শব্দের ব্যবহারে তাঁদের নেতৃত্ব স্বীকার করতে কোনো ভয় নেই লজ্জাও নেই। শুনেছি ‘সৃজন’ শব্দটা ব্যাকরণের বিধি অতিক্রম করেছে, কিন্তু যখন বিদ্যাসাগরের মতো পণ্ডিত কথাটা চালিয়েছেন তখন দায় তাঁরই, আমার কোনো ভাবনা নেই। অনেক পণ্ডিত ‘ইতিমধ্যে’ কথাটা চালিয়ে এসেছেন, ‘ইতোমধ্যে’ কথাটার ওকালতি উপলক্ষ্যে আইনের বই ঘাঁটবার প্রয়োজন দেখিনে অর্থাৎ এখন ওই ‘ইতিমধ্যে’ শব্দটার ব্যবহার সম্বন্ধে দায়িত্ব বিচারের দিন আমাদের হাত থেকে চলে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় বানান-সমিতিতে তৎসম শব্দ সম্বন্ধে যাঁরা বিধান দেবার দায়িত্ব নিয়েছেন, এ নিয়ে দ্বিধা করবার দায়িত্বভার থেকে তাঁরা আমাদের মুক্তি দিয়েছেন। এখন থেকে ‘কার্তিক’ ‘কর্তা’ প্রভৃতি দুইত-ওয়ালা শব্দ থেকে এক ‘ত’ আমরা নিশ্চিন্ত মনে ছেদন করতে পারি, সেটা সাংঘাতিক হবে না। হাতের লেখার অভ্যাস ছাড়তে পারব বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে পারব না। কিন্তু ছাপার অক্ষরে পারব। এখন থেকে ভট্টাচার্য্য শব্দের থেকে য-ফলা লোপ করতে নির্বিকার চিত্তে নির্মম হতে পারব কারণ নব্য বানান-বিধাতাদের মধ্যে দুজন বড়ো বড়ো ভট্টাচার্যবংশীয় তাঁদের উপাধিকে য-ফলা বঞ্চিত করতে সম্মতি দিয়েছেন। এখন থেকে আর্য্য এবং অনার্য্য উভয়েই অপক্ষপাতে য-ফলা মোচন করতে পারবেন, যেমন আধুনিক মাঞ্চু এবং চীনা উভয়েরই বেণী গেছে কাটা।
... আমি পণ্ডিত নই, অতএব বিধানে যেখানে পাণ্ডিত্য আছে সেখানে নম্রভাবেই অনুসরণের পথ গ্রহণ করব, যে অংশটা পাণ্ডিত্য বর্জিত দেশে পড়ে সে অংশে যতটা শক্তি বাচালতা করব কিন্তু নিশ্চিত জানব, যে একদা ‘অন্যে বাক্য কবে কিন্তু তুমি রবে নিরুত্তর।’ ইতি ১২/৬/৩৭
“ . . .'করল' কথাটি 'করিল', 'কোরলো', 'করলো', 'কোরল' কমবেশি পাঁচ রকমই লেখা হয়, 'হৈচৈ' লেখা হয় 'হইচই', 'হই-চই', 'হই চই', 'হৈ-চৈ', 'হৈ চৈ'... এইরকম অজস্র। বলতে কি, বাংলা ভাষার অভিধানগুলি পরস্পর থেকে যথেষ্ট আলাদা। একটি ভাষার আঞ্চলিক রূপ যেমন বহুরকমের হয়, তেমনি প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের বাংলাভাষাও, লিখিত রূপের বিচারে, বহুরকমের হয়ে রয়েছে। প্রাচীন বাংলার (কৃত্তিবাসী রামায়ণ, কাশীদাসী মহাভারত ইত্যাদির) বানান, মধ্যশিক্ষা পর্ষদের বানান, বিশ্বভারতীর বানান, বাংলা অ্যাকাডেমির বানান, আনন্দবাজারের বানান, বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সাহিত্যপ্রতিষ্ঠান সমূহের বানান, প্রতিষ্ঠানে পরিণত কবি-সাহিত্যিকদের যার-যার তার-তার বানান সব আলাদা আলাদা। একই বই বিশ্বভারতী ছাপলে একরকম, কলকাতার বাংলা অ্যাকাডেমি ছাপলে আর এক রকম, বাংলাদেশ ছাপলে আরও অন্য রকম, লিটল ম্যাগওয়ালা ছাপলে তাঁদের মতো। ... ভাবতেও অবাক লাগে যে, যে-ভাষায় একজন কবি নোবেল প্রাইজ পর্যন্ত পেয়ে গেছেন, সেই ভাষাতে এতকাল এই বানান-নৈরাজ্য চলে আসছে!”
‘বাঙ্গলা বানান সমস্যা’ শীর্ষক একটি অভিভাষণে (দেশ ৪ বর্ষ, ৬, মার্চ ১৯৩৭) ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘বাঙ্গালীর লেখায় আর পড়ায় ঠিক নাই। অনেক ‘খুঁটিনাটি ব্যাপারে আমাদের লেখা আর পড়া, বলা আর লেখা এক নয়।’ তিনি বলেন ‘অনেক’ আর ‘এক’ - এতে শব্দদুটোর উচ্চারণ দুইরকম। ‘অতীত কাল’, ‘কালো চোখ’ এ কালতে এ পার্থক্য স্পষ্ট। ‘তোমার মত বন্ধু’ আর ‘তোমার মত কী -’ এখানেও তাই।
তাঁর আরেকটি প্রশ্নের পুরোপুরি মীমাংসা আজও হয়নি: বাংলা কি সংস্কৃতের হুবহ নকল হবে, না ‘উচ্চারণ অনুযায়ী’ হবে ? তিনি বাংলা ভাষায় বিবর্তন ধারাটি এভাবে সাজিয়েছেন –সংস্কৃত → অপভ্রংশ → প্রাকৃত → প্রাচীন প্রাকৃত (পালি)। এবং তাঁর মতে পালি, প্রাকৃত, অপভ্রংশ কোনও লিপিতেই বানান সংস্কৃতের মতো নয় যেমন ভিক্কা, দখিন (পালি), জ্ঞাতি, জ্ঞান, জিবহা, শে (মাগাধি) অথচ বাংলায় লেখা হয় ভিক্ষা, দক্ষিণ, জ্ঞাতি, জ্ঞান, জিহ্বা, সে।
“ এক শব্দের এক অর্থ থাকা ভাষার লোকাল-স্বভাব, আর এক শব্দের বহু অর্থ থাকা ভাষার গ্লোবাল-স্বভাব। আজকের দুনিয়ার প্রায় সব ভাষাই লোকাল-স্বভাবের, আমাদের বাংলা ভাষা সংস্কৃত শব্দের ভাণ্ডার বলে তার লোকাল-স্বভাব ও গ্লোবাল-স্বভাব দুটোই রয়েছে। দুটোকে এতকাল একত্রে মিলিয়ে রাখা হয়েছিল খানিকটা অচেতন ভাবে। এখন সচেতন ভাবে দুটোরই পরিচর্যা করা দরকার। প্রাথমিক স্তরের বাংলায় আমরা লোকালের সাধনা করব, লোকালাইজেশনের সাধনা করব, উচ্চতর স্তরের বাংলায় আমরা গ্লোবালের সাধনা করব, গ্লোবালাইজেশনের সাধনা করব। মাধ্যমিক স্তরের বাংলায় থাকবে প্রথম থেকে তৃতীয়ে উত্তরণের সাধনা। গোলোকায়নের এই যুগে সেটাই আমাদের শুভ ফল এনে দেবে বলে মনে হয়।”
মুহম্মদ শহীদুল্লাহর অভিমত, বানানের উদ্দেশ্য অক্ষরের সাহায্যে শব্দের চিত্ররূপ উপস্থাপন (Phonetic representation) এবং সেটা অবশ্যই উচ্চারণ অনুযায়ী হওয়া উচিত। কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি হয় তখনই যখন উচ্চারণ পাল্টে গেলেও সাবেক বানানরীতি থেকে যায়। আর ‘তখন বানান শব্দের উচ্চারণকে সাচ্চারূপে না চিনাইয়া বরং তার বৃৎপত্তি বা ইতিহাসের সাক্ষী হইয়া দাঁড়ায়।’ ইংরেজিতেও এ সমস্যা রয়েছে এর উদাহরণ স্বরূপ তিনি হাজির করেছে- Know, knee, knave শব্দগুলোকে।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন পালি, প্রাকৃতে বানান উচ্চারণ অনুগত ছিল, কিন্তু বাংলাতে এ ধারা রক্ষিত হয়নি। তবে সাধারণ মানুষ তাদের ব্যবহারিক কাজে উচ্চারণ অনুপ বানানই লিখেছেন। তাঁর ভাষায়, ‘যদি বিশ্বাস না হয়, যে কোন পুরাণ পুঁথি বা আদালতের নথি কিংবা ডাকঘরের চিঠির বাকশ সার্চ করিয়া দেখ’।
“... বাংলা ভাষায় ‘বৌ’ বানান পাল্টে দিয়ে যখন ‘বউ’ মুদ্রিত হরফে হেথা-হোথা বেরুচ্ছে, তখন অনাচার দেখে ভাষাচার্য সুনীতিকুমার নাকি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। বলেছিলেন: ‘ছি: ছি: শেষ পর্যন্ত বৌ হল এমন। বৌ, তো বউয়ের মাথায় ঘোমটা কই’।আপাতদৃষ্টিতে ঘটনাটি যতখানি পরিহাসের, বস্তুত ততখানি নয়। বক্তা সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেই হয়তো বাংলাভাষার লেখ্য রূপের গড়ন নিয়ে অমন অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন সত্য উক্তি তিনি করতে পেরেছিলেন। ভিতরের বাণীটি এই যে, অক্ষর বা বর্ণের পিছনে দৃষ্টিগ্রাহ্য রূপের আভাসও কাজ করে। হঠাৎ-কে ইচ্ছে হলেই কি আমরা ‘হঠাত’ লিখতে পারি? বৌ-এর যেমন ঘোমটা লাগে, তেমনি হাত পিছলে আচমকা পড়ে যাবার জন্য ৎ দরকার যে। অনুস্বারের (২) চেহারাটাই এমন যে স্কুল-বারান্দায় কাঁসরঘন্টা ঝুলছে যেন, অপেক্ষা শুধু পাশে ঝোলানো কাঠিটি তুলে নিয়ে ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজিয়ে দেওয়া। গোল গোল চোখ করে যে তাকিয়ে থাকে, আঃ, উঃ দীর্ঘশ্বাস না ফেলে তার উপায় আছে? এ সবের অর্থ তো এটাই যে, শুধু উচ্চারণ বা অর্থই নয়, বানানে ছবিটাও জরুরি।‘উজ্জ্বলের সঙ্গে যে জ্বলে ওঠার সম্পর্ক, সম্পর্ক আগুনের, দীপ্তির তা কেমন করে বুঝাব যদি-না এর আড়ালে জ্বলনের ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করতে পারি? জ্বলা আর জলা কি এক? জ্বলনের ব-ফলা তাই উজ্বলে লাগবেই।... ধরা যাক খুব পরিচিত ও অতিব্যবহৃত তিনটি শব্দ: গীতাঞ্জলী, পুষ্পাঞ্জলী, শ্রদ্ধাঞ্জলী। তিনটিরই বানান ভুল এবং প্রায় সবাই এই ভুল বানানই লেখেন। অথচ ‘অঞ্জলি’ বানান কিন্তু তাঁরাই আবার শুদ্ধ লিখছেন।”
১৯৩৬ সালের পর বাংলা ভাষার বাজারচলতি পায় সব ক'টি অভিধানেই বানান সংস্কারের প্রস্তাবনাটি পরিশিষ্ট অংশে জুড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু স্কুলশিক্ষক, পাঠ্যপুস্তক প্রণেতাদের সচরাচর ওই পৃষ্ঠা পর্যন্ত যাওয়ার অবকাশ ঘটে না। তাই সমস্ত বর্জিত, প্রাচীন, সংস্কৃতঘেঁষা বানানই এতে স্থান পায়। আবার বানানবিধিতে বিকল্প হিসেবে সমস্ত প্রাচীন বনানের সংস্থান রাখায় এগুলোকে ভুল বলার রাস্তাও বন্ধ। তাই ‘পাখি’ এবং ‘পাখী’, ‘হাতী' এবং ‘হাতি’, ‘উনিশ’ এবং ‘উনিশ’, ‘ভঙ্গী’ এবং ‘ভঙ্গি’ সবই এসব বইতে পাশাপাশি বিরাজ করে। তবে সাম্প্রতিক কালে পাঠ্যপুস্তকে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে প্রকাশিত বইগুলোতে প্রমিত বানান ব্যবহারের প্রচলন ঘটেছে, যদিও এতে সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে বলা যায় না; পক্ষান্তরে ২০০৪ সালে এ নিয়ে বিরাট বিতর্ক এবং বিবাদ পশ্চিমবঙ্গ থেকে ত্রিপুরা এবং আসামেও ছড়িয়ে পড়েছিল। (দ্রষ্টব্য পবিত্র সরকার, ‘পক্ষ-বিপক্ষঃ লিপি, বানান, ব্যাকরণ, পরিভাষা বিষয়ে মিথ্যাচার, অপপ্রচার ও আক্রমণের উত্তর’, কলকাতা, ২০০৫)। বাংলাদেশেও এর সামান্য আঁচ লেগেছিল।
ওদিকে যখন এরকম অবস্থা তখন এদিকে, অর্থাৎ আসাম রাজ্যে আশির দশক থেকে বাংলা পাঠ্যপুস্তক ভাষা সংকট এবং বানান সংকটে আক্রান্ত হতে শুরু করে। ভাষা-রাজনীতির কথা বাদ দিলেও নিম্ন অর্থাৎ প্রাক্- প্রাথমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এ রাজ্যে শতাধিক বাংলা পাঠ্যবই তৈরি হয় এ রাজ্যেরই শিক্ষাবিদদের দ্বারা এবং তাদের তত্ত্বাবধানে; আর, এ বইগুলোর সবচেয়ে দুর্বল দিকই হচ্ছে এর বানান। ‘কী’ এবং ‘কি’র ভ্রান্তি এমন পর্যায়ে গেছে যে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরেও, পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও এ ভ্রান্তি এড়াতে পারছে না। স্থাননাম, বিশেষ করে ‘আসাম’ (না অসম), গৌহাটি (গুয়াহাটি), কলিকাতা (কলকাতা) সমস্যা তো রয়েছেই। ব্যক্তিনাম বাদ দিলেও বাক্যপ্রকরণেও বাংলা ভাষার চরিত্রলক্ষণ হারিয়ে যেতে বসেছে। বাংলা বানান সংস্কার প্রকল্পে আসামকে অন্তর্ভুক্ত করার আশু প্রয়োজন।
এ তো একটি দিক, আরেকটি দিক হল বাংলা ভাষার দৈনিক পত্রিকাগুলোরও যে নিজস্ব বানান পদ্ধতি রয়েছে। একটির সঙ্গে আরেকটি পত্রিকার বানানেও বিস্তর গরমিল - এটা পশ্চিমবঙ্গ পেরিয়ে আসামের বরাক উপত্যকায়ও সক্রিয়। প্রতিবেশি রাষ্ট্র বাংলাদেশের কথা না হয় না'ই বলা হয়।
“বানান জিনিসটির প্রয়োজন ভাষাকে লিখিত আকারে ধরে রাখার জন্য। কিন্তু স্থান, কাল ও পাত্রভেদে একই শব্দের ভিন্ন ভিন্ন উচ্চারণ হয়। এ অবস্থায় প্রত্যেকে তাঁর উচ্চারণ মতো বানান লিখতে পারেন না। প্রত্যেক ভাষাতেই বৈয়াকরণ লিপিশাস্ত্রীদের ঠিক করে দিতে হয়, শিক্ষিত মানুষ কোন শব্দের কী বানান লিখবেন। স্বভাবতই প্রতিষ্ঠিত বানান সরালে সমস্যা একদিকে কমে, কিন্তু অন্যদিকে বেড়ে যায়। ইংরেজি ভাষার come, love, give, take, make প্রভৃতি শব্দের পিছনে কোনও ল্যাটিন বা গ্রীক শব্দের ছায়া নেই, তবু ইংরাজীকে ঐসব শব্দের শেষে অনুচ্চারিত ‘ও’ এর বোঝা টেনে যেতে হয় কেন? তার কারণ এই যে, পাঁচ-ছয়শো বছর আগে ঐ ‘e’ গুলো উচ্চারিত হত, এবং সেই হিসাবে তারা বানানের মধ্যে জায়গা পেয়ে গিয়েছিল। আজ যদি এই অনুচ্চারিত ‘e’ কে তুলে দিয়ে বানানের সংস্কার হয়, তবে আগের লিখিত ভাষা ও সাহিত্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে হবে।”
মুদ্রিত মাধ্যমের মধ্যে ‘পঞ্জিকা’ একটি বহুল-ব্যবহৃত, নিত্যপঠিত বই যার প্রভ বাঙালি জীবনে অপরিসীম। এতে প্রধানত বাংলা বানানবিধির সমস্ত বর্জিত বানানই যথাপূত দ্বিত্ব, অপ্রয়োজনীয় য-ফলা, একত্রে দ্বিত্ব ও রেফ এসবের প্রয়োগভারে ন্যুব্জ এ পঞ্জিক ঠাকুর দেবতা, মহাপুরুষ, পূজা পার্বণ এসবের বানানে সেই পুরনো ট্রাডিশন। পঞ্জিকা থেকে বানানগুলো সরাসরি চলে আসে নিমন্ত্রণপত্রে, পূজা কমিটির চাঁদার বইতে, লিফলেটে, কি বাড়ি, পূজামণ্ডপের গেটে, ধর্মীয় পত্রপত্রিকায়, স্মরণিকায় দুর্গা, অঞ্জলী, আরতী, আলে পূর্ব্ব, কার্য্য, সার্ব্বজনীন, কার্ত্তিক ইত্যাদি।
ধর্মীয় গ্রন্থ, বিশেষ করে ইসলামীয় বইগুলোর বানান, খ্রিস্টধর্মীয় প্রচার পুস্তিকা, বইপ ‘সুসমাচারের’ বানানও এক্ষেত্রে লক্ষণীয়। রামকৃষ্ণ মিশন প্রকাশিত বই, পত্র পত্রিকায় এ দিন বিশেষ যত্ন নেওয়া হয় এটা স্বীকার করে নিয়েও বলা প্রয়োজন এখানেও প্রাচীন এবং বলি বানান এখনও মাঝে মাঝে মান্যতা পায়।
সে সঙ্গে সরকারি নথি, প্রচারপত্র, নির্দেশনামা এবং পরিভাষায় বাংলা বানানের প্রতি উদাসীনতা নিতান্তই মর্মান্তিক। আর বাংলা টেলিভিশনের চ্যানেলে যখন বর্জিত এবং ভুল বানান ভেসে ওঠে তা দর্শদের চোখ মনে স্থায়ী ভাবে বসে যায়।
“আজ আমাদের বাংলা ভাষা পঞ্চভুবনে পরিব্যাপ্ত — (এক) পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের জগৎ, (দুই) বাংলাদেশের জগৎ, (তিন) উত্তর-পূর্ব ভারতের বাঙালিদের জগৎ, (চার) ভারতের বাকি অংশের বিভিন্ন শহরে থাকা যথেষ্ট সংখ্যক বাঙালিদের জগৎ, ও (পাঁচ) পৃথিবীর অন্যান্য প্রবাসী বাঙালিদের জগৎ। সব মিলিয়ে ২৪ কোটি বাঙালি বা বাংলাভাষী মানুষের পঞ্চভুবন। লক্ষণীয় যে, তৃতীয় ভুবন উত্তর-পূর্ব ভারত এখন ত্রিপুরা সহ সাতটি রাজ্যে বিভক্ত, এবং অষ্টম রাজ্য হিসেবে সম্প্রতি বিহার থেকে পৃথক হয়ে ভারতের নতুন রাজ্য ঝাড়খন্ড (বাংলা ভাষা যে-রাজ্যের দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে) সেই দলে যোগ দিয়েছে।”
বাংলা বানানপ্রকরণের নানা দিক সূত্রাকারে আলোচনায় এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়েছে যে বাংলা ভাষার একটি সমস্যাপূর্ণ দিকই হল বানান। এর স্থায়ী সমাধান অবশ্য একটি অভাবনীয় প্রস্তাবনাই (কারণ ভাষাটি যে জীবন্ত, সতত পরিবর্তনশীল), তবু এর একটা সমতা বিধানের প্রয়োজন। নইলে এক অঞ্চলের মুদ্রিত বইপত্র অন্য অঞ্চলে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না, আর বাংলা ভাষার আলাদা আলাদা ভৌগোলিক অঞ্চলগুলো ভাষিকসূত্রে এক এবং অভিন্ন পরিচিতি ধরে রাখতে পারবে না।
তাছাড়া সম্প্রতি নতুন প্রযুক্তির আত্মপ্রকাশ অর্থাৎ মুদ্রণ জগতে কমপিউটারের আত্মপ্রকাশে যে দিকটি সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দাবি করছে তা হল বানান। কমপিউটার কোনও আবেগ বোঝে না, বোঝে না কোনও রাজনীতি। কিন্তু একটি শব্দের এক এক রকম বানান, একটি অঞ্চলের এক এক রকম বানান হলে সে তো চুপ করে বসে থাকবে। অথচ সারা বিশ্বের মুদ্রণ জগৎ আজ কম্পিউটারের দখলে। আর, তার আছে ‘Spell check’ ‘Auto correction’ আর হরেক রকম ফন্ট, সাফটওয়ার, ডায়ক্রিটিক সিম্বল ইত্যাদি। এক্ষেত্রে যা প্রয়োজন তা হল একটি মোটামুটি সর্বজনগ্রাহ্য ‘বানান অভিধান’ বা বানানরীতি। তা হলে spell check এবং auto correction এর ব্যবহার হবে সর্বজনীন এবং বাংলা ভাষার অগ্রগতি হবে ত্বরান্বিত। বাংলাদেশ মুদ্রণ প্রযুক্তিতে, বিশেষ করে বাংলা সফ্টওয়ার ডেভোলাপিং-এ অভাবনীয় অগ্রগতি লাভ করেছে, কিন্তু তবু এ কারণেই বিঘ্নিত হচ্ছে এর অগ্রগতি।
আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন :
সংস্কৃত বা তৎসম শব্দ
অ-সংস্কৃত অর্থাৎ তদ্ভব, দেশজ ও বিদেশী শব্দ
নবাগত ইংরেজী ও অন্যান্য বিদেশী শব্দ
Cut এর u, cat -এর a, f, v, w, z প্রভৃতির প্রতিবর্ণ বাংলায় নাই। অল্প কয়েকটি নূতন অক্ষর বা চিহ্ন বাংলা লিপিতে প্রবর্তিত করিলে মোটামুটি কাজ চলিতে পারে। বিদেশি শব্দের বাংলা বানান যথাসম্ভব উচ্চারণসূচক হওয়া উচিত, কিন্তু নূতন অক্ষর বা চিহ্নের বাহুল্য বর্জনীয়। এক ভাষার উচ্চারণ অন্য ভাষার লিপিতে যথাযথ প্রকাশ করা অসম্ভব। নবাগত বিদেশি শব্দের শুদ্ধি-রক্ষার জন্য অধিক আয়াসের প্রয়োজন নাই, কাছাকাছি বাংলা রূপ হইলেই লেখার কাজ চলিবে। যে সকল বিদেশি শব্দের বিকৃত উচ্চারণ ও তদনুযায়ী বানান বাংলায় চলিয়া গিয়াছে সে সকল শব্দের প্রচলিত বানানই বজায় থাকিবে, যথা- ‘কলেজ, টেবিল, বাইসিকেল, সেকেন্ড’।
তৎসম শব্দের বানান
(৪) হ্রস্ব-দীর্ঘ স্বরচিহ্ন
(৫) বিসর্গ(t) চিহ্নের রক্ষা/বর্জন
(৬) হস্ চিহ্নের সমস্যা
(৭) রেফের নীচে ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব
(৮) ঙ আর s
(৯) শ-ষ-স
অ–তৎসম শব্দ বিষয়ে
(১০) হ্রস্ব ই-কার দীর্ঘ ঈ-কারের সমস্যা
(১১) হ্রস্ব উ-কার দীর্ঘ উ-কার নিয়ে
(১২) শব্দান্তে ও-কার
(১৩) ঐ-কার বা ঔ-কার
(১৪) ঙ বনাম ঙ্গ
(১৫) জ এবং য
(১৬) ণ এবং ন
(১৭) য-ফলা
(১৯) শ ষ স
(২০) ক্ষ এবং খ
(২১) বিদেশি শব্দ বিষয়ে, একটু পৃথক-ভাবে
(২৪) বিদেশি শব্দে শ-স
(২৬) র-ফলা
(২৭) ব্যঞ্জনপূর্ব র্-রেফ
লিখনরীতি বিষয়ক প্রস্তাব