নীড়  দূর-শিক্ষাকেন্দ্র  পাঠ্যপুস্তক  দ্বিতীয় পত্র - অধ্যায়: পাঁচ
বাংলা ভাষা ডিপ্লোমা পাঠক্রম
rotateআপনার মুঠোফোনটিকে ল্যান্ডস্কেপে রাখুন
প্রথম ষান্মাসিক - দ্বিতীয় পত্র
বাংলা ভাষা বিজ্ঞান
দ্বিতীয় পত্র   ❐   অধ্যায় - পাঁচ
বাংলা বানান
 
৫.০   উদ্দেশ্য   

এ পর্বটিতে যা জানতে পারবেন —

  1. বাংলা বানান সমস্যার কারণ
  2. বানান সমস্যা সমাধানের প্রয়োজনীয়তা
  3. বাংলা বানানচিন্তকদের অভিমত
  4. বাংলা বানান বৈচিত্র্যের স্বরূপ এবং সমতাবিধানের গুরুত্ব
  5. বানান সংস্কারের প্রয়াস সমূহ লিখনকর্মে বিরতিচিহ্নের প্রয়োগ
৫.১   ভূমিকা

বানান বিভ্রম, বানান সংকট, বানান বিতর্ক, প্রাচীন এবং প্রমিত বানানের বৈপরিত্য, বিকল্প বানান এ নিয়ে এ বিষয়টি বাঙালি ছাত্রছাত্রী, লেখক, ভাষাবিজ্ঞানী, শিল্পী, সংবাদ মাধ্যম, বৈদুতিন মাধ্যমের কর্মীরা, এবং বিনোদন জগৎ ছাড়াও সাধারণ ভাষা ভাবুকদের মনে অনেক সংশয়। ১৯৩৫ সাল থেকে এপারে, ওপারে ক্রমান্বয়ে অন্তত দুইবার অ্যাকাডেমিকস্, সরকারি, বেসরকারি এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে যে সংস্কারমূলক কার্যসূচি গৃহীত হয়েছে তা'ই এ পর্বে আলোচিত হয়েছে।

৫.২   বাংলা বানান সচেতনতা এবং সংস্কার প্রক্রিয়া

আমরা ইংরেজি বানান ভুল করলে লজ্জায় মরে যাই, কিন্তু বাংলা বানানটা যে শুদ্ধ করে লেখার নিয়ম, এটা যেন মানতেই চাই না। কবে মাইকেল মধুসুদন দত্ত ‘পৃথিবী’ লিখতে ভুল করে ‘প্রথিবী’ লিখেছিলেন এবং তা সত্ত্বেও মহাকবি হয়ে উঠতে তাঁর কিছুই আটকায়নি এরকম কিছু কাহিনীর উপর নির্ভর করে আমরা বেশ আছি। অনেকে বলেন, ‘আজকাল বানানের কোনও নিয়ম নেই। একই শব্দ কত রকম লেখা হয় পত্র পত্রিকায়’ ইত্যাদি। এ কথার মধ্যে সত্য এটাই, বানানকে কখনই কোনও কঠিন নিয়ম শৃঙ্খলার বন্ধনে আবদ্ধ করা যায় না, যায়ও নি। সেই হস্তলিখিত পুথির যুগ থেকে মুদ্রণ যুগের সূচনা, কেরি সাহেব থেকে রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র হয়ে রবীন্দ্র প্রমথ চৌধুরী ,সুনীতিকুমার কিংবা মুজতবা আলী-বুদ্ধদেব-পবিত্র সরকার-শঙ্খ ঘোষ-নীরেন চক্রবর্তী পর্যন্ত বাংলা বানান যে একই ধারায় চলছে তা তো নয়। তবে এ পরিবর্তনের মধ্যেও একটা নিয়ম, একটা যুক্তিগ্রাহ্য বিধির আত্মপ্রকাশও ঘটেছে, যা কিছু লোকের কাছে গ্রহণীয়, কিছু লোকের কাছে গ্রহণীয় নয়, তাও বটে। তবে বাংলা বানানের কোন নিয়ম নেই এটা হাস্যকর উক্তি।

এখানে এ কথাটিও মনে রাখতে হয়- ভাষা তো অচল, অনড়, অটল কিছু নয় যে দশকের পর দশক বা শতাব্দীর পর শতাব্দী একটি নিদিষ্ট ছকে বাঁধা থাকবে। সময়ের রূপান্তরে এক একজন জীবিত ব্যক্তির শারীরিক গড়ন, বাকভঙ্গি, কন্ঠস্বরের যেমন রূপান্তর ঘটবে তেমনি একটি ভাষাও রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে এগোবে। রূপান্তর ঘটবে ভাষার উচ্চারণগত দিকে এবং লিখিত রূপেও। একমাত্র ‘মৃত ভাষা’ (dead language) অর্থাৎ যার স্থান পুথিপত্র, অভিধান আর মহাফেজখানা নামক সমাধিস্থলে- সে ভাষার লিখনশৈলিতে কোনও পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই।

লিপিকর, মুদ্রাকর, পণ্ডিত, ছাত্র এবং সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক ব্যবহারে বাংলা ভাষার লিখনকর্মে পরিবর্তন ঘটবেই। সচেতন ভাষাচিন্তক আর ভাষাবিজ্ঞানীরা এ পরিবর্তনকে বিশ্লেষণ করবেন, পরিবর্তনের ধরন (Pattern) টিকে কোনও যুক্তিগ্রাহ্য নিয়মের মধ্যে সংস্থাপন করবেন - কোন পরিবর্তন ঘটছে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়, কোল্টি অচেতন ভ্রান্তি, কোটি প্রযুক্তির কারণে, আর কোনটি স্বেচ্ছাচারিতা বা ইচ্ছাকৃত অথবা উদ্দেশ্য প্রণোদিত তা নিরূপণ করবেন, এবং এমনি করেই আসে বানানের বিধিবদ্ধতার কথা।

আমাদের অনেক পরিবারেই আছে পূর্বপুরুষের সংরক্ষিত কিছু পুথিপত্র, হস্তলিখিত ‘পদ্মপুরাণ’ (শ্রাবণমাসে সুর করে পাঠের জন্য অন্তত), মুসলিম পরিবারে ‘কেতাব’, রয়েছে কবিরাজি পুথি, পুজাবিধি, মেয়েদের সংরক্ষণে ‘গীত’-এর খাতা (বিয়ের গান, সূর্যব্রতের গান ইত্যাদি)। আমাদের বয়স্করা কী অবলীলাক্রমে এগুলো পাঠ করেন। আমরা নিজেরাও একটু চোখ বুলিয়ে দেখতে পারি কিসন (কৃষ্ণ), পদ্যাবতি (পদ্মাবতী) ইস্বর (ঈশ্বর), ভজইল (ভঞ্জিল),জানিআ (জানিয়া) বানানগুলোকে। ল আর ন-র তফাৎ বোঝাতে একটি বিন্দুর (.) প্রয়োগ ছাড়া আরও অনেক কিছু আবিষ্কার করতে পারি। এরপর, মুদ্রণ প্রযুক্তির আত্মপ্রকাশে ‘ব’ (পেটকাটা)-র এর স্থানে এসেছে ব-এর নিচে বিন্দু (র) দিয়ে ‘র’। মধ্যযুগের সমস্ত বাংলা লিপিতে ওই পেটকাটা ‘ব’-ই পাওয়া যাবে, এতে ভাষাটির বাঙালিত্ব হারাবার ভয় নেই। কাজটি করেছেন অষ্টাদশ শতকের মুদ্রণকর্মী পঞ্চানন কর্মকার, অক্ষরটি যিনি ধাতু ঢালাই দিয়ে ‘র’ তৈরির চেয়ে নিচে একটা ফুটি বসিয়ে (.) সহজে বানাতে পেরেছেন।

ঊনবিংশ শতকে ‘সাহার্য’, ‘যুর্ধ’, ‘ম্যায়া’ (মেয়ে) এসব বানান ছিল। দ্বিত্ব দীর্ঘ-ই কার, মূর্ধন্য-এসবের ব্যবহার ছিল অত্যাধিক। আর বিদেশি শব্দের প্রতিবর্ণীকরণে কত রকমফের ছিল। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ই শেক্সপিয়ার মোক্সমুলার লিখতেন ‘শেক্ষপীয়ার’, ‘মোক্ষমূলার’। ইংরেজ প্রশাসককে কাছাড়ি রাজা সম্বোধন করেছেন ‘মেস্তর’ বলে। আসলে বলতে চেয়েছিলেন ‘মিস্টার’।

আর ‘বাংলা’ শব্দটাই বা কত রূপে কত চেহারা পাল্টে আজকের অবয়ব ধারণ করেছে, এটাই কি আমরা লক্ষ করেছি? চর্যাপদে ছিল ‘বঙ্গালী’, মধ্যযুগে কোরান অনুবাদক লিখেছেন ‘মুসলমানী শাস্ত্রকথা বাঙ্গালি করিলু... (সম্ভবত ১৬৩৯ খ্রিঃ), মনোত্রল লিখেছেন ‘বেঙ্গালা’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বাংলা’ শব্দটি জনপ্রিয় করার পরও ভাষাচার্য সুনীতিকুমার লিখলেন ‘বাঙ্গালা ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা’, সুকুমার সেন লিখলেন ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’। ১৩৩৮ বঙ্গাব্দের ‘গীতিবিতান’ (৩ খন্ডে)-এ ‘বাঙালি’ শব্দটি মান্যতা পাবার পরও ১৩৫৬ বঙ্গাব্দে (১৯৪৯ খ্রিঃ) নীহাররঞ্জন রায় লিখলেন ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’। এই বানান বৈচিত্র্য কোনও দোষের কিছু নয়, তবে মুদ্রণ মাধ্যমের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে এ বিভিন্নতা অনিবার্যভাবেই কিছু সমস্যারও সৃষ্টি করবে, তৈরি হবে বিশৃঙ্খলতারও এবং এর ফলে ব্যাহত হবে ভাষার অগ্রগতি - এ বিবেচনায় বিংশ শতকের গোড়া থেকেই এদিকে সচেতনতা জাগতে শুরু হয়। বিশেষ করে, স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরীর পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা সাহিত্যে চলিত ভাষারীতির প্রাধান্য আসার সঙ্গে সঙ্গে তদ্ভব, দেশি এবং বিদেশি শব্দের প্রয়োগ যেমন বেড়ে গেল তেমনি নতুন অভিজ্ঞতাসঞ্জাত আঞ্চলিক শব্দ, এমনকী স্ল্যাং (Slang) শব্দেরও অনুপ্রবেশ ঘটে গেল যার প্রভাব এল বানান প্রকরণে। এ পরিপ্রেক্ষিতে লিখনকর্মে নিযুক্ত ব্যক্তিরা, তা তিনি যে কোনও পেশাতেই থাকুন না কেন, এরা সংশয় এবং বিভ্রান্তির শিকার হলেন। স্কুল মাস্টার থেকে পাঠ্যপুস্তক প্রণেতারা, সাংবাদিক থেকে সাহিত্যসেবীরাও যথেষ্ট বিড়ম্বনার সম্মুখীন হয়েছেন। প্রথম পর্বে এগিয়ে এসেছেন অভিধান প্রণেতারা, এদের নিজস্ব বানানবিধি নিয়েই। এর সঙ্গে সঙ্গেই আত্মপ্রকাশ ঘটল সচেতন ভাষাভাবুকদের। বঙ্কিমচন্দ্রের নিবন্ধ ‘বাংলা ভাষা’ (১২৮৫ অর্থাৎ ১৮৭৪ খ্রিঃ) এ ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক, এবং বাংলা ভাষাকে বিধিবদ্ধ রূপ দেবার প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত হল ১৮৯২ সালে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ’ প্রতিষ্ঠা হওয়াতে।

বিশ শতকের ত্রিশের দশকে বাংলার বিদ্বজ্জনের সমবেত ইচ্ছার প্রতিফলনই ঘটল কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক বানান সংস্কার সমিতি গঠনে (১৯৩৬)। এর পর আবার ১৯৮ সালে ‘বাংলাদেশ জাতীয় ও শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক বাংলা বানান নিয়ম প্রবর্তন প্রয়াস এবং ১৯৯৭ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি’র বাংলা বানান সংস্কার উদ্যোগ। ‘প্রাকৃত বাংলার’ বানানের শৃঙ্খলার প্রয়োজন প্রথম অনুভব করেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং এ মর্মে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে একটি বিধি প্রণয়নের জন্য আবেদন করেন এবং এতে সাড়া দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় রাজশেখর বসুর সভাপতিত্বে বাংলা বানানের নিয়ম প্রণয়ণের জন্য একটি সমিতি গঠন করেন এবং প্রায় দুই শত বিশিষ্ট লেখক ও অধ্যাপকের অভিমত গ্রহণ করেই ১৯৩৬ সালের ৮ মে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় একটি নিয়মাবলী প্রকাশ করেন। এর পর আরও দুই দফায় সংশোধন সহ এর দ্বিতীয় (২ অক্টোবর, ১৯৩৬) ও তৃতীয় সংস্করণ (২০ মে, ১৯৩৭) প্রকাশিত হয়।

এ সংস্কার প্রস্তাবের পক্ষে বিপক্ষে সেদিন প্রবল তর্ক-বিতর্ক হয়, যার রেশ আজও রয়েছে। এ আলোচনায় যারা যোগ দেন এদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ, যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি, বীরেশ্বর সেন, সুধীর মিত্র, জ্যোতির্ময় ঘোষ, রাধারাণী দেবী, নরেন্দ্র দেব, বিজনবিহারী ভট্টাচার্য, গোবর্ধনদাস শাস্ত্রী, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, রাজশেখর বসু, আশুতোষ ভট্টাচার্য, চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য, বিমলনারায়ণ চৌধুরী, ব্রহ্মানন্দ সেন, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, দেবপ্রসাদ ঘোষ, মঞ্জু ঘোষ, জগন্নাথ চক্রবর্তী, প্রশান্তচন্দ্র মহালনবিশ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

বানানবিধির বিরোধিতা করে প্রকাশিত একটি ইস্তাহারে, (১লা বৈশাখ, ১৩৪৪) স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে ছিলেন দেবপ্রসাদ ঘোষ, অনুরূপা দেবী, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, দীনেন্দ্রকুমার রায়, হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, শৈলেন্দ্রকৃষ্ণ লাহা, সজনীকান্ত দাস, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সুকুমার মিত্র, অশোকনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ।

অবশ্য বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষাক্রম, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, বাংলা একাডেমী (বাংলাদেশ) ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে বানান সরলীকরণ, বানানের সমতা বিধান - এ ধরনের প্রয়াস চলছে, চলছে বানান অভিধান প্রণয়ন, বানান বিধি, ব্যবহারিক শব্দকোষ, প্রয়োগাভিধান প্রকাশ এবং প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক ভাবে বানান কর্মশালা আয়োজন। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে ত্রিপুরা, বিহার, বাংলাদেশ ছাড়াও আসামের বরাক উপত্যকারও বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।

মুদ্রণ প্রযুক্তির বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ইনফরমেশন টেকনোলজির বিস্ফারের সঙ্গে বাংলা লিখনকর্মেও যেমন নতুন সম্ভাবনার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হয়েছে তেমনি বাংলা লিখনকর্মের সামনে এসেছে নতুন প্রত্যাহ্বানও। বানান সংস্কার প্রয়াস ও অভিন্ন বানান বিধি প্রণয়নের স্বপ্ন এখন বাঙালি ভাষাচিন্তক ছাড়া সচেতন পাঠক সমাজেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

একটি চিঠি
(সংক্ষেপিত)
আলমোড়া
প্রতি,
দেবপ্রসাদ ঘোষ
বিনয় সম্ভাষণ পূর্বক নিবেদন

.... বাংলা বানানের নিয়ম বিধিবদ্ধ করার জন্য আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছিলুম।

বাংলা ভাষার উচ্চারণে তৎসম শব্দের মর্যাদা রক্ষা হয় বলে আমি জানিনে। কেবলমাত্র অক্ষর বিন্যাসেই তৎসমতার ভান করা হয় মাত্র, সেটা সহজ কাজ। বাংলা লেখায় অক্ষর বানানের নির্জীব বাহন কিন্তু রসনা নির্জীব নয়- অক্ষর যাই লিখুক, রসনা আপন সংস্কার মতোই উচ্চারণ করে চলে। সেদিকে লক্ষ্য করে দেখলে বলতেই হবে যে, অক্ষরের দোহাই দিয়ে যাদের তৎসম খেতাব দিয়ে থাকি সে সকল শব্দের প্রায় ষোলো আনাই অপভ্রংশ। যদি প্রাচীন ব্যাকরণ কর্তাদের সাহস ও অধিকার আমার থাকত, এই ছদ্মবেশীদের উপাধি লোপ করে দিয়ে সত্য বানানে এদের স্বরূপ প্রকাশ করার চেষ্টা করতে পারতুম।…

এমন কি, যে সকল অবিসম্বাদিত তদ্ভব শব্দ অনেকখানি তৎসম-ঘেঁষা, তাদের প্রতি হস্তক্ষেপ করতে গেলেও পদে পদে গৃহবিচ্ছেদের আশঙ্কা আছে। এরা উচ্চারণে প্রাকৃত কিন্তু লেখনে সংস্কৃত আইনের দাবি করে।

প্রাকৃত বাংলায় তদ্ভব শব্দবিভাগে উচ্চারণের সম্পূর্ণ আনুগত্য যেন চলে এই আমার একান্ত ইচ্ছা ছিল। কিন্তু যদি নিতান্তই সম্পূর্ণ সেই ভিত্তিতে বানানের প্রতিষ্ঠা নাও হয়, তবু এমন একটা অনুশাসনের দরকার যাতে প্রাকৃত বাংলার লিখনে বানানের সাম্য সর্বত্র রক্ষিত হতে পারে।…

রেফের পর ব্যঞ্জনের দ্বিত্ববর্জন সম্বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয় যে নিয়ম নির্ধারণ করে দিয়েছেন তা নিয়ে বেশি তর্ক করার দরকার আছে বলে আমি মনে করিনে। যারা নিয়মে স্বাক্ষর দিয়েছেন তাদের মধ্যে অনেক বড়ো বড়ো পণ্ডিতের নাম দেখেছি। আপনি যদি মনে করেন তাঁরা অন্যায় করেছেন তবুও তাদের পক্ষভুক্ত হওয়াই আমি নিরাপদ মনে করি। অন্তত তৎসম শব্দের ব্যবহারে তাঁদের নেতৃত্ব স্বীকার করতে কোনো ভয় নেই লজ্জাও নেই। শুনেছি ‘সৃজন’ শব্দটা ব্যাকরণের বিধি অতিক্রম করেছে, কিন্তু যখন বিদ্যাসাগরের মতো পণ্ডিত কথাটা চালিয়েছেন তখন দায় তাঁরই, আমার কোনো ভাবনা নেই। অনেক পণ্ডিত ‘ইতিমধ্যে’ কথাটা চালিয়ে এসেছেন, ‘ইতোমধ্যে’ কথাটার ওকালতি উপলক্ষ্যে আইনের বই ঘাঁটবার প্রয়োজন দেখিনে অর্থাৎ এখন ওই ‘ইতিমধ্যে’ শব্দটার ব্যবহার সম্বন্ধে দায়িত্ব বিচারের দিন আমাদের হাত থেকে চলে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় বানান-সমিতিতে তৎসম শব্দ সম্বন্ধে যাঁরা বিধান দেবার দায়িত্ব নিয়েছেন, এ নিয়ে দ্বিধা করবার দায়িত্বভার থেকে তাঁরা আমাদের মুক্তি দিয়েছেন। এখন থেকে ‘কার্তিক’ ‘কর্তা’ প্রভৃতি দুইত-ওয়ালা শব্দ থেকে এক ‘ত’ আমরা নিশ্চিন্ত মনে ছেদন করতে পারি, সেটা সাংঘাতিক হবে না। হাতের লেখার অভ্যাস ছাড়তে পারব বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে পারব না। কিন্তু ছাপার অক্ষরে পারব। এখন থেকে ভট্টাচার্য্য শব্দের থেকে য-ফলা লোপ করতে নির্বিকার চিত্তে নির্মম হতে পারব কারণ নব্য বানান-বিধাতাদের মধ্যে দুজন বড়ো বড়ো ভট্টাচার্যবংশীয় তাঁদের উপাধিকে য-ফলা বঞ্চিত করতে সম্মতি দিয়েছেন। এখন থেকে আর্য্য এবং অনার্য্য উভয়েই অপক্ষপাতে য-ফলা মোচন করতে পারবেন, যেমন আধুনিক মাঞ্চু এবং চীনা উভয়েরই বেণী গেছে কাটা।

... আমি পণ্ডিত নই, অতএব বিধানে যেখানে পাণ্ডিত্য আছে সেখানে নম্রভাবেই অনুসরণের পথ গ্রহণ করব, যে অংশটা পাণ্ডিত্য বর্জিত দেশে পড়ে সে অংশে যতটা শক্তি বাচালতা করব কিন্তু নিশ্চিত জানব, যে একদা ‘অন্যে বাক্য কবে কিন্তু তুমি রবে নিরুত্তর।’   ইতি ১২/৬/৩৭

ভবদীয়,
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৫.৩   বানান সমস্যার স্বরূপ এবং উত্তরণের সূত্রসন্ধান
ইতিমধ্যেই বানান-সচেতনতা প্রসঙ্গটি আলোচনায় এসে গেছে, এবং বানান সংস্কারের পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা হয়েছে। এতগুলো সংশোধনী প্রকল্প সত্ত্বেও একথা নিশ্চিত ভাবে বলা যাচ্ছে না যে বাংলা বানান সম্পর্কে বাঙালির সবকটি ভুবনে একটা ঐক্যমত হয়েছে, বানান প্রকরণে একটা সমতা বিধানের ক্ষেত্রে সহমত তৈরি হয়েছে। বিষয়টি আসলে এত সহজ ব্যাপারও নয়। ভাষা যেহেতু সচল তাই এর বানানপ্রকরণ স্থায়ী কিংবা স্থির হবে এটা আশাই করা যায় না। তদুপরি বাঙালির ভাষা-পৃথিবী যে রাষ্ট্রীয় কিংবা প্রাদেশিক সীমানা অতিক্রম করে বহুদুর বিস্তৃত। এ অবস্থায় বিভিন্ন স্থানীয় প্রভাবে বানানরীতি প্রভাবিত হবে এটা স্বাভাবিক। সে সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অত্যাধুনিক মুদ্রণ প্রযুক্তি এবং প্রচারমাধ্যম ইন্টারনেট অর্থাৎ আন্তর্জাল যার হাত ধরে এসেছে E-Book, E- Magazine, Blog ইত্যাদি যাকে ভিত্তি করে কাগজ-বিহীন এক বিশাল সাহিত্যের সম্ভার উন্মুক্ত হয়েছে। এখন স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ বা ডেক্সটপ নিয়ে যে কোনও কেউ পৃথিবীর যে কোনও স্থান থেকে গুগল গ্লাস, ফেসবুক, ব্লগ, ওয়ার্ডপ্রেস, হোয়াটস অ্যাপের মাধ্যমে লেখালেখি করতে পারেন। এ কাজের সুবিধার জন্য সহজ বাংলা কি-বোর্ড, বাংলা সফট্ওয়ার রয়েছে হাতের কাছে যা বিনামূল্যেই সহজলভ্য। এ অবস্থায় কোনও একটি প্রতিষ্ঠান - বিশ্ববিদ্যালয় বা অ্যাকাডেমিকস্ বা সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠান (পেপার হাউস), কিংবা অভিধান বলে দেবে আর বতা সম্ভব নয়। আমরা দেখেছি ১৯৩৬ সালেই ‘বাংলা বানান-বিধি’র বিরোধিতা সবাই মেনে নেবে তা সতের পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির ‘বানান অভিধান’ নিয়ে তীব্র বিজ্ঞ আর ২০০৪ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি’, ‘রাজ্য শিক্ষা পর্ষদের’ প্রস্তাবিত বানান বিদি এবং লিপি সংস্কার (যুক্তাক্ষর ভেঙে স্বচ্ছ বানান লিখনের প্রয়াস) নিয়েও পত্রপত্রিকায় তীব্র। বাদানুবাদ। ২০০৪ থেকে ২০১৭ এই তেরো বছরে প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতি আমাদের বানান-ভাবনায় দিয়েছে নতুন মাত্রা। তবে এ নিয়ে আলোচনায় যাবার আগে একটু পেছনে যাওয়া প্রয়োজন।

“ . . .'করল' কথাটি 'করিল', 'কোরলো', 'করলো', 'কোরল' কমবেশি পাঁচ রকমই লেখা হয়, 'হৈচৈ' লেখা হয় 'হইচই', 'হই-চই', 'হই চই', 'হৈ-চৈ', 'হৈ চৈ'... এইরকম অজস্র। বলতে কি, বাংলা ভাষার অভিধানগুলি পরস্পর থেকে যথেষ্ট আলাদা। একটি ভাষার আঞ্চলিক রূপ যেমন বহুরকমের হয়, তেমনি প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের বাংলাভাষাও, লিখিত রূপের বিচারে, বহুরকমের হয়ে রয়েছে। প্রাচীন বাংলার (কৃত্তিবাসী রামায়ণ, কাশীদাসী মহাভারত ইত্যাদির) বানান, মধ্যশিক্ষা পর্ষদের বানান, বিশ্বভারতীর বানান, বাংলা অ্যাকাডেমির বানান, আনন্দবাজারের বানান, বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সাহিত্যপ্রতিষ্ঠান সমূহের বানান, প্রতিষ্ঠানে পরিণত কবি-সাহিত্যিকদের যার-যার তার-তার বানান সব আলাদা আলাদা। একই বই বিশ্বভারতী ছাপলে একরকম, কলকাতার বাংলা অ্যাকাডেমি ছাপলে আর এক রকম, বাংলাদেশ ছাপলে আরও অন্য রকম, লিটল ম্যাগওয়ালা ছাপলে তাঁদের মতো। ... ভাবতেও অবাক লাগে যে, যে-ভাষায় একজন কবি নোবেল প্রাইজ পর্যন্ত পেয়ে গেছেন, সেই ভাষাতে এতকাল এই বানান-নৈরাজ্য চলে আসছে!”

‘বাঙ্গলা বানান সমস্যা’ শীর্ষক একটি অভিভাষণে (দেশ ৪ বর্ষ, ৬, মার্চ ১৯৩৭) ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘বাঙ্গালীর লেখায় আর পড়ায় ঠিক নাই। অনেক ‘খুঁটিনাটি ব্যাপারে আমাদের লেখা আর পড়া, বলা আর লেখা এক নয়।’ তিনি বলেন ‘অনেক’ আর ‘এক’ - এতে শব্দদুটোর উচ্চারণ দুইরকম। ‘অতীত কাল’, ‘কালো চোখ’ এ কালতে এ পার্থক্য স্পষ্ট। ‘তোমার মত বন্ধু’ আর ‘তোমার মত কী -’ এখানেও তাই।

তাঁর আরেকটি প্রশ্নের পুরোপুরি মীমাংসা আজও হয়নি: বাংলা কি সংস্কৃতের হুবহ নকল হবে, না ‘উচ্চারণ অনুযায়ী’ হবে ? তিনি বাংলা ভাষায় বিবর্তন ধারাটি এভাবে সাজিয়েছেন –সংস্কৃত → অপভ্রংশ → প্রাকৃত → প্রাচীন প্রাকৃত (পালি)। এবং তাঁর মতে পালি, প্রাকৃত, অপভ্রংশ কোনও লিপিতেই বানান সংস্কৃতের মতো নয় যেমন ভিক্কা, দখিন (পালি), জ্ঞাতি, জ্ঞান, জিবহা, শে (মাগাধি) অথচ বাংলায় লেখা হয় ভিক্ষা, দক্ষিণ, জ্ঞাতি, জ্ঞান, জিহ্বা, সে।

“ এক শব্দের এক অর্থ থাকা ভাষার লোকাল-স্বভাব, আর এক শব্দের বহু অর্থ থাকা ভাষার গ্লোবাল-স্বভাব। আজকের দুনিয়ার প্রায় সব ভাষাই লোকাল-স্বভাবের, আমাদের বাংলা ভাষা সংস্কৃত শব্দের ভাণ্ডার বলে তার লোকাল-স্বভাব ও গ্লোবাল-স্বভাব দুটোই রয়েছে। দুটোকে এতকাল একত্রে মিলিয়ে রাখা হয়েছিল খানিকটা অচেতন ভাবে। এখন সচেতন ভাবে দুটোরই পরিচর্যা করা দরকার। প্রাথমিক স্তরের বাংলায় আমরা লোকালের সাধনা করব, লোকালাইজেশনের সাধনা করব, উচ্চতর স্তরের বাংলায় আমরা গ্লোবালের সাধনা করব, গ্লোবালাইজেশনের সাধনা করব। মাধ্যমিক স্তরের বাংলায় থাকবে প্রথম থেকে তৃতীয়ে উত্তরণের সাধনা। গোলোকায়নের এই যুগে সেটাই আমাদের শুভ ফল এনে দেবে বলে মনে হয়।”

মুহম্মদ শহীদুল্লাহর অভিমত, বানানের উদ্দেশ্য অক্ষরের সাহায্যে শব্দের চিত্ররূপ উপস্থাপন (Phonetic representation) এবং সেটা অবশ্যই উচ্চারণ অনুযায়ী হওয়া উচিত। কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি হয় তখনই যখন উচ্চারণ পাল্টে গেলেও সাবেক বানানরীতি থেকে যায়। আর ‘তখন বানান শব্দের উচ্চারণকে সাচ্চারূপে না চিনাইয়া বরং তার বৃৎপত্তি বা ইতিহাসের সাক্ষী হইয়া দাঁড়ায়।’ ইংরেজিতেও এ সমস্যা রয়েছে এর উদাহরণ স্বরূপ তিনি হাজির করেছে- Know, knee, knave শব্দগুলোকে।

মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন পালি, প্রাকৃতে বানান উচ্চারণ অনুগত ছিল, কিন্তু বাংলাতে এ ধারা রক্ষিত হয়নি। তবে সাধারণ মানুষ তাদের ব্যবহারিক কাজে উচ্চারণ অনুপ বানানই লিখেছেন। তাঁর ভাষায়, ‘যদি বিশ্বাস না হয়, যে কোন পুরাণ পুঁথি বা আদালতের নথি কিংবা ডাকঘরের চিঠির বাকশ সার্চ করিয়া দেখ’।

“... বাংলা ভাষায় ‘বৌ’ বানান পাল্টে দিয়ে যখন ‘বউ’ মুদ্রিত হরফে হেথা-হোথা বেরুচ্ছে, তখন অনাচার দেখে ভাষাচার্য সুনীতিকুমার নাকি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। বলেছিলেন: ‘ছি: ছি: শেষ পর্যন্ত বৌ হল এমন। বৌ, তো বউয়ের মাথায় ঘোমটা কই’।
আপাতদৃষ্টিতে ঘটনাটি যতখানি পরিহাসের, বস্তুত ততখানি নয়। বক্তা সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেই হয়তো বাংলাভাষার লেখ্য রূপের গড়ন নিয়ে অমন অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন সত্য উক্তি তিনি করতে পেরেছিলেন। ভিতরের বাণীটি এই যে, অক্ষর বা বর্ণের পিছনে দৃষ্টিগ্রাহ্য রূপের আভাসও কাজ করে। হঠাৎ-কে ইচ্ছে হলেই কি আমরা ‘হঠাত’ লিখতে পারি? বৌ-এর যেমন ঘোমটা লাগে, তেমনি হাত পিছলে আচমকা পড়ে যাবার জন্য ৎ দরকার যে। অনুস্বারের (২) চেহারাটাই এমন যে স্কুল-বারান্দায় কাঁসরঘন্টা ঝুলছে যেন, অপেক্ষা শুধু পাশে ঝোলানো কাঠিটি তুলে নিয়ে ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজিয়ে দেওয়া। গোল গোল চোখ করে যে তাকিয়ে থাকে, আঃ, উঃ দীর্ঘশ্বাস না ফেলে তার উপায় আছে? এ সবের অর্থ তো এটাই যে, শুধু উচ্চারণ বা অর্থই নয়, বানানে ছবিটাও জরুরি।
‘উজ্জ্বলের সঙ্গে যে জ্বলে ওঠার সম্পর্ক, সম্পর্ক আগুনের, দীপ্তির তা কেমন করে বুঝাব যদি-না এর আড়ালে জ্বলনের ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করতে পারি? জ্বলা আর জলা কি এক? জ্বলনের ব-ফলা তাই উজ্বলে লাগবেই।
... ধরা যাক খুব পরিচিত ও অতিব্যবহৃত তিনটি শব্দ: গীতাঞ্জলী, পুষ্পাঞ্জলী, শ্রদ্ধাঞ্জলী। তিনটিরই বানান ভুল এবং প্রায় সবাই এই ভুল বানানই লেখেন। অথচ ‘অঞ্জলি’ বানান কিন্তু তাঁরাই আবার শুদ্ধ লিখছেন।”

১৯৩৬ সালের পর বাংলা ভাষার বাজারচলতি পায় সব ক'টি অভিধানেই বানান সংস্কারের প্রস্তাবনাটি পরিশিষ্ট অংশে জুড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু স্কুলশিক্ষক, পাঠ্যপুস্তক প্রণেতাদের সচরাচর ওই পৃষ্ঠা পর্যন্ত যাওয়ার অবকাশ ঘটে না। তাই সমস্ত বর্জিত, প্রাচীন, সংস্কৃতঘেঁষা বানানই এতে স্থান পায়। আবার বানানবিধিতে বিকল্প হিসেবে সমস্ত প্রাচীন বনানের সংস্থান রাখায় এগুলোকে ভুল বলার রাস্তাও বন্ধ। তাই ‘পাখি’ এবং ‘পাখী’, ‘হাতী' এবং ‘হাতি’, ‘উনিশ’ এবং ‘উনিশ’, ‘ভঙ্গী’ এবং ‘ভঙ্গি’ সবই এসব বইতে পাশাপাশি বিরাজ করে। তবে সাম্প্রতিক কালে পাঠ্যপুস্তকে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে প্রকাশিত বইগুলোতে প্রমিত বানান ব্যবহারের প্রচলন ঘটেছে, যদিও এতে সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে বলা যায় না; পক্ষান্তরে ২০০৪ সালে এ নিয়ে বিরাট বিতর্ক এবং বিবাদ পশ্চিমবঙ্গ থেকে ত্রিপুরা এবং আসামেও ছড়িয়ে পড়েছিল। (দ্রষ্টব্য পবিত্র সরকার, ‘পক্ষ-বিপক্ষঃ লিপি, বানান, ব্যাকরণ, পরিভাষা বিষয়ে মিথ্যাচার, অপপ্রচার ও আক্রমণের উত্তর’, কলকাতা, ২০০৫)। বাংলাদেশেও এর সামান্য আঁচ লেগেছিল।

ওদিকে যখন এরকম অবস্থা তখন এদিকে, অর্থাৎ আসাম রাজ্যে আশির দশক থেকে বাংলা পাঠ্যপুস্তক ভাষা সংকট এবং বানান সংকটে আক্রান্ত হতে শুরু করে। ভাষা-রাজনীতির কথা বাদ দিলেও নিম্ন অর্থাৎ প্রাক্- প্রাথমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এ রাজ্যে শতাধিক বাংলা পাঠ্যবই তৈরি হয় এ রাজ্যেরই শিক্ষাবিদদের দ্বারা এবং তাদের তত্ত্বাবধানে; আর, এ বইগুলোর সবচেয়ে দুর্বল দিকই হচ্ছে এর বানান। ‘কী’ এবং ‘কি’র ভ্রান্তি এমন পর্যায়ে গেছে যে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরেও, পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও এ ভ্রান্তি এড়াতে পারছে না। স্থাননাম, বিশেষ করে ‘আসাম’ (না অসম), গৌহাটি (গুয়াহাটি), কলিকাতা (কলকাতা) সমস্যা তো রয়েছেই। ব্যক্তিনাম বাদ দিলেও বাক্যপ্রকরণেও বাংলা ভাষার চরিত্রলক্ষণ হারিয়ে যেতে বসেছে। বাংলা বানান সংস্কার প্রকল্পে আসামকে অন্তর্ভুক্ত করার আশু প্রয়োজন।

এ তো একটি দিক, আরেকটি দিক হল বাংলা ভাষার দৈনিক পত্রিকাগুলোরও যে নিজস্ব বানান পদ্ধতি রয়েছে। একটির সঙ্গে আরেকটি পত্রিকার বানানেও বিস্তর গরমিল - এটা পশ্চিমবঙ্গ পেরিয়ে আসামের বরাক উপত্যকায়ও সক্রিয়। প্রতিবেশি রাষ্ট্র বাংলাদেশের কথা না হয় না'ই বলা হয়।

“বানান জিনিসটির প্রয়োজন ভাষাকে লিখিত আকারে ধরে রাখার জন্য। কিন্তু স্থান, কাল ও পাত্রভেদে একই শব্দের ভিন্ন ভিন্ন উচ্চারণ হয়। এ অবস্থায় প্রত্যেকে তাঁর উচ্চারণ মতো বানান লিখতে পারেন না। প্রত্যেক ভাষাতেই বৈয়াকরণ লিপিশাস্ত্রীদের ঠিক করে দিতে হয়, শিক্ষিত মানুষ কোন শব্দের কী বানান লিখবেন। স্বভাবতই প্রতিষ্ঠিত বানান সরালে সমস্যা একদিকে কমে, কিন্তু অন্যদিকে বেড়ে যায়। ইংরেজি ভাষার come, love, give, take, make প্রভৃতি শব্দের পিছনে কোনও ল্যাটিন বা গ্রীক শব্দের ছায়া নেই, তবু ইংরাজীকে ঐসব শব্দের শেষে অনুচ্চারিত ‘ও’ এর বোঝা টেনে যেতে হয় কেন? তার কারণ এই যে, পাঁচ-ছয়শো বছর আগে ঐ ‘e’ গুলো উচ্চারিত হত, এবং সেই হিসাবে তারা বানানের মধ্যে জায়গা পেয়ে গিয়েছিল। আজ যদি এই অনুচ্চারিত ‘e’ কে তুলে দিয়ে বানানের সংস্কার হয়, তবে আগের লিখিত ভাষা ও সাহিত্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে হবে।”

মুদ্রিত মাধ্যমের মধ্যে ‘পঞ্জিকা’ একটি বহুল-ব্যবহৃত, নিত্যপঠিত বই যার প্রভ বাঙালি জীবনে অপরিসীম। এতে প্রধানত বাংলা বানানবিধির সমস্ত বর্জিত বানানই যথাপূত দ্বিত্ব, অপ্রয়োজনীয় য-ফলা, একত্রে দ্বিত্ব ও রেফ এসবের প্রয়োগভারে ন্যুব্জ এ পঞ্জিক ঠাকুর দেবতা, মহাপুরুষ, পূজা পার্বণ এসবের বানানে সেই পুরনো ট্রাডিশন। পঞ্জিকা থেকে বানানগুলো সরাসরি চলে আসে নিমন্ত্রণপত্রে, পূজা কমিটির চাঁদার বইতে, লিফলেটে, কি বাড়ি, পূজামণ্ডপের গেটে, ধর্মীয় পত্রপত্রিকায়, স্মরণিকায় দুর্গা, অঞ্জলী, আরতী, আলে পূর্ব্ব, কার্য্য, সার্ব্বজনীন, কার্ত্তিক ইত্যাদি।

ধর্মীয় গ্রন্থ, বিশেষ করে ইসলামীয় বইগুলোর বানান, খ্রিস্টধর্মীয় প্রচার পুস্তিকা, বইপ ‘সুসমাচারের’ বানানও এক্ষেত্রে লক্ষণীয়। রামকৃষ্ণ মিশন প্রকাশিত বই, পত্র পত্রিকায় এ দিন বিশেষ যত্ন নেওয়া হয় এটা স্বীকার করে নিয়েও বলা প্রয়োজন এখানেও প্রাচীন এবং বলি বানান এখনও মাঝে মাঝে মান্যতা পায়।

সে সঙ্গে সরকারি নথি, প্রচারপত্র, নির্দেশনামা এবং পরিভাষায় বাংলা বানানের প্রতি উদাসীনতা নিতান্তই মর্মান্তিক। আর বাংলা টেলিভিশনের চ্যানেলে যখন বর্জিত এবং ভুল বানান ভেসে ওঠে তা দর্শদের চোখ মনে স্থায়ী ভাবে বসে যায়।

“আজ আমাদের বাংলা ভাষা পঞ্চভুবনে পরিব্যাপ্ত — (এক) পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের জগৎ, (দুই) বাংলাদেশের জগৎ, (তিন) উত্তর-পূর্ব ভারতের বাঙালিদের জগৎ, (চার) ভারতের বাকি অংশের বিভিন্ন শহরে থাকা যথেষ্ট সংখ্যক বাঙালিদের জগৎ, ও (পাঁচ) পৃথিবীর অন্যান্য প্রবাসী বাঙালিদের জগৎ। সব মিলিয়ে ২৪ কোটি বাঙালি বা বাংলাভাষী মানুষের পঞ্চভুবন। লক্ষণীয় যে, তৃতীয় ভুবন উত্তর-পূর্ব ভারত এখন ত্রিপুরা সহ সাতটি রাজ্যে বিভক্ত, এবং অষ্টম রাজ্য হিসেবে সম্প্রতি বিহার থেকে পৃথক হয়ে ভারতের নতুন রাজ্য ঝাড়খন্ড (বাংলা ভাষা যে-রাজ্যের দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে) সেই দলে যোগ দিয়েছে।”

বাংলা বানানপ্রকরণের নানা দিক সূত্রাকারে আলোচনায় এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়েছে যে বাংলা ভাষার একটি সমস্যাপূর্ণ দিকই হল বানান। এর স্থায়ী সমাধান অবশ্য একটি অভাবনীয় প্রস্তাবনাই (কারণ ভাষাটি যে জীবন্ত, সতত পরিবর্তনশীল), তবু এর একটা সমতা বিধানের প্রয়োজন। নইলে এক অঞ্চলের মুদ্রিত বইপত্র অন্য অঞ্চলে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না, আর বাংলা ভাষার আলাদা আলাদা ভৌগোলিক অঞ্চলগুলো ভাষিকসূত্রে এক এবং অভিন্ন পরিচিতি ধরে রাখতে পারবে না।

তাছাড়া সম্প্রতি নতুন প্রযুক্তির আত্মপ্রকাশ অর্থাৎ মুদ্রণ জগতে কমপিউটারের আত্মপ্রকাশে যে দিকটি সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দাবি করছে তা হল বানান। কমপিউটার কোনও আবেগ বোঝে না, বোঝে না কোনও রাজনীতি। কিন্তু একটি শব্দের এক এক রকম বানান, একটি অঞ্চলের এক এক রকম বানান হলে সে তো চুপ করে বসে থাকবে। অথচ সারা বিশ্বের মুদ্রণ জগৎ আজ কম্পিউটারের দখলে। আর, তার আছে ‘Spell check’ ‘Auto correction’ আর হরেক রকম ফন্ট, সাফটওয়ার, ডায়ক্রিটিক সিম্বল ইত্যাদি। এক্ষেত্রে যা প্রয়োজন তা হল একটি মোটামুটি সর্বজনগ্রাহ্য ‘বানান অভিধান’ বা বানানরীতি। তা হলে spell check এবং auto correction এর ব্যবহার হবে সর্বজনীন এবং বাংলা ভাষার অগ্রগতি হবে ত্বরান্বিত। বাংলাদেশ মুদ্রণ প্রযুক্তিতে, বিশেষ করে বাংলা সফ্টওয়ার ডেভোলাপিং-এ অভাবনীয় অগ্রগতি লাভ করেছে, কিন্তু তবু এ কারণেই বিঘ্নিত হচ্ছে এর অগ্রগতি।

আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন :

  • বাংলা ভাষায় বানান সমস্যা একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ দিক।
  • বানান সমস্যা সমাধানকল্পে একাধিকবার বাংলার বিদ্বজ্জন প্রয়াস চালিয়েছেন।
  • বাংলা ভাষার পাঁচটি ভুবনের নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য, সমস্যা এবং সংকটও রয়েছে যার প্রভাব বানান প্রকরণে প্রতীয়মান হয়।
  • বাংলা ভাষার বিভিন্ন স্থানে বিশেষ বিশেষ প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বানান-রীতি রয়েছে।
  • শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যপুস্তকে বানান-বৈচিত্র্য বাংলা ভাষার জন্য সমস্যা সৃষ্টি করে।
  • বাংলা বানানের ‘সমতা-বিধানের’ প্রয়োজন সর্বাধিক।
  • মুদ্রণ জগতে কমপিউটারের প্রচলন হবার পর এর অগ্রগতির ধারাকে সচল রাখতে হলে 'বানান সমতা' সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
৫.৪
   বানান সংস্কারের প্রস্তাব – ১ :
   কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক গৃহীত বাংলা বানানের নিয়ম
   (তৃতীয় সংস্করণ পর্যন্ত)
৫.৪
   বানান সংস্কারের প্রস্তাব – ১ : কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক গৃহীত বাংলা বানানের নিয়ম (তৃতীয় সংস্করণ পর্যন্ত)

সংস্কৃত বা তৎসম শব্দ

১।
রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব
 
  • রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব হইবে না, যথা- ‘অর্চনা, মূর্ছা, অর্জুন, কর্তা, কার্তিক, বার্তা, কর্দম, অর্ধ, বার্ধক্য, কর্ম, সর্ব’।
  • সংস্কৃত ব্যাকরণ-অনুসারে রেফের পর দ্বিত্ব বিকল্পে সিদ্ধ ; না করিলে দোষ হয় না, বরং লেখা ও ছাপা সহজ হয়।
২।
সন্ধিতে ঙ্ স্থানে অনুস্বার
 
  • যদি ক খ গ ঘ পরে থাকে তবে পদের অন্তস্থিত ম্ স্থানে অনুস্বার অথবা বিকল্পে ঙ বিধেয়, যথা- “অহংকার, ভয়ংকর, সংখ্যা, সংগম, হৃদয়ংগম, সংঘটন’ অথবা ‘অহঙ্কার, ভয়ঙ্কর’ ইত্যাদি।
  • সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়ম অনুসারে বর্গীয় বর্ণ পরে থাকিলে পদের অন্তস্থিত ম্ স্থানে অনুস্বার বা পরবর্তী বর্গের পঞ্চম বর্ণ হয়। বাংলায় সর্বত্র এই নিয়ম অনুসারে s দিলে উচ্চারণে বাধিতে পারে, কিন্তু ক-বর্গের পূর্বে অনুস্বার ব্যবহার করিলে বাধিবে না, বরং বানান সহজ হইবে।

অ-সংস্কৃত অর্থাৎ তদ্ভব, দেশজ ও বিদেশী শব্দ

৩।
রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব
 
  • রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব হইবে না, যথা-  ‘কর্জ, শর্ত, পর্দা, সর্দার, চর্বি, ফর্মা, জার্মানি’।
৪।
হস্-চিহ্ন
 
  • শব্দের শেষে সাধারণত হস্-চিহ্ন দেওয়া হইবে না, যথা- “ওস্তাদ, কংগ্রেস, চেক, জজ, টন, টি-পট, ট্রাম, ডিশ, তছনছ, পকেট, মক্তব, হুক, করিলেন, করিস। কিন্তু যদি ভুল উচ্চারণের সম্ভাবনা থাকে তবে হস্-চিহ্ন বিধেয়। হ এবং ও যুক্তব্যঞ্জনের উচ্চারণ সাধারণত স্বরান্ত, যথা— দহ, অহরহ,কান্ড। যদি হসন্ত উচ্চারণ অভিষ্ট হয় তবে হ ও যুক্ত ব্যঞ্জনের পর হস্‌-চিহ্ন আবশ্যক, যথা- ‘শাহ্‌, জেমস্‌ বণ্ড’। কিন্তু সুপ্রচলিত শব্দে না নিলে চলিবে, যথা— ‘আর্ট, কর্ক, গভর্নমেন্ট, স্পঞ্জ’। মধ্য বর্ণে প্রয়োজন হইলে হস্‌-চিহ্ন বিধেয়, যথা— ‘উল্‌কি, সট্‌কা’। যদি উপান্তা স্বর অত্যন্ত হ্রস্ব হয় তবে শেষে হস্‌-চিহ্ন বিধেয়, যথা– ‘কট্‌কট্‌, খপ্‌, সার্‌‘।
  • বাংলায় কতকগুলি শব্দের শেষে অ-কার উচ্চারিত হয়, যথা- ‘গলিত, মন, দৃঢ়, প্রিয়, করিয়াছ, করিত, ছিল, এস’। কিন্তু অধিকাংশ শব্দের শেষের অ-কার গ্রস্ত অর্থাৎ শেষ অক্ষর হসন্তবৎ, যথা– ‘অচল, গভীর, পাঠ করুক, করিস, করিলেন’। এই প্রকার সুপরিচিত শব্দের শেষে অ-ধ্বনি হইবে কি হইবে না তাহা বুঝাইবার জন্য কেহই চিহ্ন প্রযোগ করেন না। অধিকাংশ স্থলে অ-সংস্কৃত শব্দে অন্ত্য হস্‌-চিহ্ন অনাবশ্যক, বাংলাভাষার প্রকৃতি অনুসারেই হসন্ত উচ্চারণ হইবে। অল্প কয়েকটি বিদেশী শব্দের শেষে অ উচ্চারণ হয়, যথা- “বাই-ল”। কিন্তু প্রভেদ রক্ষার জন্য অপর বহু বহু শব্দে হস্র-চিহ্নের ভার চাপান অনাবশ্যক। কেবল ভুল উচ্চারণের সম্ভাবনা থাকিলে হস্‌-চিহ্ন বিধেয়।
৫।
ই ঈ উ ঊ
 
  • যদি মূল সংস্কৃত শব্দে ঈ বা ঊ থাকে তবে তদ্ভব বা তৎসদৃশ শব্দে ঈ বা ঊ অথবা বিকল্পে ই বা উ হইবে, যথা— ‘কুমীর, পাখী, বাড়ী, শীর্ষ, উনিশ, চুন, পূব’ অথবা ‘কুমির, পাখি, বাড়ি, শিব, উনিশ, চুন, পুব’। কিন্তু কতকগুলি শব্দে কেবল ঈ, কেবল ই অথবা কেবল উ হইবে, যথা— ‘নীলা (নীলক), হীরা (হীরক), দিয়াশলাই (দীপশলাকা), পানি (পানীয়), চুল (চূল ), জুয়া (দ্যুত)’।
  • স্ত্রীলিঙ্গ এবং জাতি, ব্যক্তি, ভাষা ও বিশেষণবাচক শব্দের অন্তে ঈ হইবে, যথা— ‘কলুনী, বাঘিনী, কাবুলী, কেরানী, ঢাকী, ফরিয়াদী, ইংরেজী, বিদাতী, দাগী, রেশমী’। কিন্তু কতকগুলো শব্দে ই হইবে, যথা— ‘ঝি, দিদি, বিবি, কচি, মিহি, মাঝারি, চলতি। “পিসী, মাসী’ স্থানে বিকল্পে ‘পিসি, মাসি’ লেখা চলিবে।
  • অন্যত্র মনুষ্যেতর জীব, বস্তু, গুণ, ভাব ও কর্মবাচক শব্দের এবং দ্বিরাবৃত্ত শব্দের অন্তে কেবল ই হইবে, যথা- ‘বেঙাচি, বেজি, কাঠি, সুজি, কেরামতি, চুরি, পাগলামি, বাবুগিরি, তাড়াতাড়ি সরাসরি, সোজাসুজি’।
  • নবাগত বিদেশী শব্দে ঈ ঊ প্রয়োগ সম্বন্ধে পরে দ্রষ্টব্য।
৬।
জ য
 
  • এই সকল শব্দে য না লিখিয়া জ লেখা বিধেয়, যথা— ‘কাজ, জাউ, জাঁতা, জাতি, জুই, জুত, জো, জোড়, জোড়া, জোত, জোয়াল’।
৭।
ণ ন
 
  • অ-সংস্কৃত শব্দে কেবল ন হইবে, যথা— ‘কান, সোনা, বামুন, কোরান, করোনার’। কিন্তু যুক্তাক্ষর ট, ণ্ঠ, চলিবে, যথা— ‘ঘুণ্টি, লুণ্ঠন, ঠাণ্ডা।
  • ‘রাণী’ স্থানে বিকল্পে ‘রানী’ চলিতে পারিবে।
৮।
ও-কার ও ঊর্ধ্ব-কমা প্রভৃতি
 
  • সুপ্রচলিত শব্দের উচ্চারণ, উৎপত্তি বা অর্থের ভেদ বুঝাইবার জন্য অতিরিক্ত ও-কার, ঊর্ধ্ব কমা বা অন্য চিহ্ন যোগ যথাসম্ভব বর্জনীয়। যদি অর্থগ্রহণে বাধা হয় তবে কয়েকটি শব্দে অন্ত্য অক্ষরে ও-কার এবং আদ্য বা মধ্য অক্ষরে ঊর্ধ্ব কমা বিকল্পে নেওয়া যাইতে পারে, যথা- ‘কাল, কালো, ভাল, ভাগো, মত, মতো, পড়ো, প’ড়ো (পড়ুয়া বা পতিত)’।
  • এই সকল বানান বিধেয়- ‘এত, কত যত, তত, বৌ, হয়তো, কাল (সময়, কল্য), চাল (চাউল, ছাত, গতি), ভাল (দাইল, শাখা)’।
৯।
s  ঙ
 
  • ‘বাঙ্গলা, বাঙ্গালা, বাঙ্গালী, ভাঙ্গন’ প্রভৃতি ‘বাংলা, বাংলা, বাঙালী, ভাঙন’ প্রভৃতি উভয় প্রকার বানানই চলিবে।
  • s ঙ-র প্রাচীন উচ্চারণ যাহাই হউক, আধুনিক বাংলা উচ্চারণ সমান, সেজন্য অনুষার স্থানে বিকল্পে ও লিখিলে আপত্তির কারণ নাই। রং-এর অপেক্ষা ‘রঙের’ লেখা সহজ। ‘রঙের’ লিখলে অভীষ্ট উচ্চারণ আসিবে না, কারণ ‘রঙ্গ’ ও ‘রং-এর উচ্চারণ সমান নয়, কিন্তু ‘রং’ ও ‘রঙ’ সমান।
১০।
শ ষ স
 
  • মূল সংস্কৃত শব্দ অনুসারে তন্তর শব্দে শ ব বা স হইবে, যথা— ‘আঁশ (অংশ), আঁষ (আমির), শাস (শস্য), মশা (মশক), পিসী (পিতুঃস্বসা)’ কিন্তু কতকগুলি শব্দে বাতিক্রম হইবে, যথা- ‘মিনসে’ (মনুষ্য), ‘সাধ’ (শ্রদ্ধা)।
  • বিদেশী শব্দে মূল উচ্চারণ-অনুসারেও এ স্থানে স, sh স্থানে শ হইবে। যথা– ‘আসন, ক্লাস, খাস, জিনিস, পুলিস, পেনসিল, মসলা, মাসুল, সবুজ, সাদা সিমেন্ট, খুশি, চশমা, তক্তাপোশ, পশম, পোশাক, পালিশ, পেনশন, শখ, শৌখিন, শয়তান, শরবত, শরম, শহর, শার্ট, শেকস্পিয়র’। কিন্তু কতকগুলি শব্দে বাতিক্রম হইবে, যথা— ‘ইস্তাহার (ইশতিহার), গোমস্তা (গুমাতাহ্), ভিস্তি (বিহিশতী), খ্রীস্ট, খ্রিষ্ট (Christ)’|
  • শ ষ স এই তিন বর্ণের একটি বা দুইটি বর্জন করিলে বাংলা উচ্চারণে বাধা হয় না, বরং বানান সরল হয়। কিন্তু অধিকাংশ তদ্ভব শব্দে মূল-অনুসারে শ ষ স প্রয়োগ বহুপ্রচলিত এবং একই শব্দের বিভিন্ন বানান প্রায় দেখা যায় না। এই রীতির সহসা পরিবর্তন বাঞ্ছনীয় নয়। বহু বিদেশী শব্দের প্রচলিত বাংলা বানানে মূল অনুসারে শত বা স লেখা হয়, কিন্তু কতগুলো শব্দে ব্যতিক্রম বা বিভিন্ন বানান দেখা যায়, যথা- ‘শরবৎ সরবত; শরম সরম; শহর সহর; শয়তান সয়তান; পুলিস পুলিশ। সামঞ্জস্যের জন্য যথাসম্ভব একই নিয়ম গ্রহণীয়।
  • বিদেশী শব্দের S-ধ্বনির জন্যে বাংলায় ছ অক্ষর বর্জনীয়। কিন্তু যেখানে প্রচলিত বাংলা বানানেই আছে এবং উচ্চারণেও ছ হয়, সেখানে প্রচলিত বানানই বজায় থাকিবে, যথা— ‘কেচ্ছা, ছয়লাপ, তছনছ, পছন্দ’।
  • দেশজ বা অজ্ঞাতমূল শব্দের প্রচলিত বানান হইবে, যথা— ‘করিস, ফরসা (ফরশা), সরেস (সরেশ), উসখুস (উসখুশ)’।
১১।
ক্রিয়াপদ
 
  • সাধু ও চলিত প্রয়োগে কৃদন্ত রূপে করান, পাঠান প্রভৃতি অথবা বিকল্প করানো, পাঠানো প্রভৃতি বিধেয়।
  • চলিত ভাষার ক্রিয়াপদের বিহিত বানানের কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হইল। বিকল্পে ঊর্ধ্বকমা বর্জন করা যাইতে পারে এবং নাম বিভক্তি স্থানে লুম বা লেম লেখা যাইতে পারে।
  • হ-ধাতু
  • হয় হন, হও, হস, হই। হচ্ছে। হয়েছে। হ’লাম। হত। হচ্ছিল। হয়েছিল। হব (হবো), হবে। হরো, হ’স হতে, হবে, হলে, হবার, হওয়া।
  • খা-ধাতু
  • খায়, খান, খাও, খাস, খাই। খাচ্ছে। খেয়েছে। খাক, খান, যাও, যা খেলে, খেলাম। খেত। খাচ্ছিল। খেয়েছিল। খাব (খাবো), খাবে। খেয়ো, খাস। খেতে খেয়ে, খেলে, খাবার, খাওয়া।
  • দি-ধাতু
  • দেয়, দেন, দাও, দিস, দিই। দিচ্ছে। দিয়েছে। দিক, দিন, দাও, দে। দিলে, দিলাম। নিত। দিচ্ছিল। দিয়েছিল। দেব (দেবো), দেবে। দিও, দিস। দিতে, দিয়ে, দিলে, দেবার, দেওয়া। ং
  • শু-ধাতু
  • শোয়, শোন, শোও, শুস, শুই। শুচ্ছে। শুয়েছে। শুক, শুন, শোষ, শো। শুন, শুলাম। শুত। শুচ্ছিল। শুয়েছিল। শোব (শোবো)। শুয়ো, শুস। শুতে, শুয়ে, শুলে, শোবার, শোয়া।
  • কর্-ধাতু
  • করে, করেন, কর, করিস, করি। করছে। করেছে। করুক, করুন, কর, কর। করলে, করলাম। করত। করছিল। করেছিল। ক’রব করবো), ক’রবে। কারো, করিস করতে করে, করলে, করবার, করা।
  • কাট্-ধাতু
  • কার্টে, কার্টেন, কার্ট, কাটিস, কাটি। কাটছে। কেটেছে। কাটুক, কার্টুন, কার্ট, কাট। কাটলে, কাটলাম। কাটত। কাটছিল। কেটেছিল। কাটব (কাটবো), কাটবে। কেটো, কাটিস। কাটতে, কেটে, কাটলে, কাটবার, কাটা।
  • লিখ্-ধাতু
  • লেখে, লেখেন, লেখ, লিখিস, লিখি লিখছে লিখেছে। লিখুক, লিখুন, লেখ, লেখ। লিখলে লিখगाম লিখত। লিখছিল। লিখেছিল। লিখব (লিখবো লিখবে। লিখো, লিবিস। লিখতে লিখে লিখলে লেবার লেখা।
  • উঠ্-ধাতু
  • ওঠে ওঠেন, ওঠ, উঠি উঠি। উঠেছে। উঠুক, উঠুন, ওঠ, ওঠ। উঠল উঠলাম। উঠত। উঠছিল। উঠেছিল। উঠব (উঠবো), উঠবে। উঠো উঠিল। উঠতে উঠে উঠলে ওঠবার ওঠা।
  • করা-ধাতু
  • করায়, করান, করাও, করাস করাই। করাচ্ছে। করিয়েছে। করাক করান, করাও, করা। করালে, করালাম। করাত। করাচ্ছিল। করিয়েছিল। করার করাবো। করাবে। করিও, ক্যাস। করাতে, করিয়ে, করণে করবার, করন করানো)।
১২।
কতকগুলি সাধুশব্দের চলিত রূপ
 
  • ‘কুয়া, সুতা, মিছা, উঠান, উনান, পুরান, পিছন, পিতল, ভিতর, উপর’ প্রভৃতি কতকগুলি সাধুশব্দের মৌখিক রূপ কলিকাতা অঞ্চলে অন্যপ্রকার। যে শব্দের মৌখিক বিকৃতি আদা অক্ষরে তাহার সাধুরূপই চলিত ভাষায় গ্রহণীয়, যথা— ‘পিছন, পিতল, ভিতর, উপর”। যাহার বিকৃতি মধ্য বা শেষ অক্ষরে তাহার চলিত রূপ মৌখিক রূপের অনুযায়ী করা বিধেয়, যথা— ‘কুয়ো সুতো, মিছে, উঠন, উনন, পুরনো’।

নবাগত ইংরেজী ও অন্যান্য বিদেশী শব্দ

Cut এর u, cat -এর a, f, v, w, z প্রভৃতির প্রতিবর্ণ বাংলায় নাই। অল্প কয়েকটি নূতন অক্ষর বা চিহ্ন বাংলা লিপিতে প্রবর্তিত করিলে মোটামুটি কাজ চলিতে পারে। বিদেশি শব্দের বাংলা বানান যথাসম্ভব উচ্চারণসূচক হওয়া উচিত, কিন্তু নূতন অক্ষর বা চিহ্নের বাহুল্য বর্জনীয়। এক ভাষার উচ্চারণ অন্য ভাষার লিপিতে যথাযথ প্রকাশ করা অসম্ভব। নবাগত বিদেশি শব্দের শুদ্ধি-রক্ষার জন্য অধিক আয়াসের প্রয়োজন নাই, কাছাকাছি বাংলা রূপ হইলেই লেখার কাজ চলিবে। যে সকল বিদেশি শব্দের বিকৃত উচ্চারণ ও তদনুযায়ী বানান বাংলায় চলিয়া গিয়াছে সে সকল শব্দের প্রচলিত বানানই বজায় থাকিবে, যথা- ‘কলেজ, টেবিল, বাইসিকেল, সেকেন্ড’।

১৩।
বিবৃত অ (cut-এর u)
 
  • মূল শব্দে যদি বিবৃত অ থাকে তবে বাংলা বানানে আদ্য অক্ষরে আ-কার এবং মধ্য অক্ষরে অ-কার বিধেয়, যথা- ‘ক্লাব (club), বাস (bus), বালব (bulb), সার (sir), থার্ড (third), বাজেট (budget), জার্মান (German), কাটলেট (cutlet), সার্কস (circus), ফোকস (focus), রেডিয়ম (radium,), ফরস (phosphorus), হিরোডোটস (Herodotus)’।
১৪।
বক্র আ (বা বিকৃত এ। Cat-এর a)
 
  • মূল শব্দে বক্র আ থাকিলে বাংলায় আদিতে অ্যা এবং মধ্যে্ য্যা বিধেয়, যথা- ‘অ্যাসিড (acid) হ্যাট (hat)’।
  • এইরূপ বানানে ‘য্যা’ কে য-ফলা আ-কার মনে না করিয়া একটি বিশেষ স্বরবর্ণের চিহ্ন জ্ঞান করা যাইতে পারে, যেমন হিন্দীতে এই উদ্দেশ্য ঐ-কার চলিতেছে (hat हैट)। নাগরী লিপিতে যেমন অ-অক্ষরে ও-কার যোগ করিয়া ও (ओ) হয়, সেইরূপ বাংলায় অ্যা হইতে পারে।
১৫।
ঈ উ
 
  • মূল শব্দের উচ্চারণে যদি ঈ উ থাকে তবে বাংলা বানানে ঈ ঊ বিধেয়, যথা- ‘সীল (seal) ঈষ্ট (east) ঊষ্টার (Worcester) স্কুল (spool)’।
১৬।
f v
 
  • F v স্থানে যথাক্রমে ফ ভ বিধেয়, যথা- ‘ফুট (foot) ভোট (vote)। যদি মূল শব্দে v এর উচ্চারণ f-তুল্য হয়, তবে বাংলা বানানে ফ হইবে, যথা (Von) ফন (fon)।
১৭।
w
 
  • w-স্থানে প্রচলিত রীতি অনুসারে উ বা ও বিধেয়, যথা- ‘উইলসন (wilson) উড (wood), ওয়ে (way)’।
১৮।
য়
 
  • নবাগত বিদেশি শব্দে অনর্থক য় প্রয়োগ বর্জনীয়। ‘মেয়র, চেয়র, রেডিয়ম, সোয়েটর’ প্রভৃতি বানান চলিতে পারে, কারণ য় লিখিলেও উচ্চারণ বিকৃত হয় না। কিন্তু উ-কার বা ও-কারের পর অকারণে য়, য়া, য়ো লেখা অনুচিত। ‘এডোয়ার্ড, ওয়ার-বণ্ড’ না লিখিয়া ‘এডওয়ার্ড, ওঅর-বণ্ড’ লেখা উচিত। হার্ডওয়ার (hardware) বানানে দোষ নাই।
১৯।
s sh
 
  • ১০ (দশ) সংখ্যক নিয়ম দ্রষ্টব্য।
২০।
st
 
  • নবাগত বিদেশী শব্দে st স্থানে নূতন সংযুক্ত বর্ণ স্ট বিধেয়, যথা- ‘স্টোভ’ (stove)।
২১।
Z
 
  • z স্থানে জ বা জ বিধেয়।
২২।
হস্-চিহ্ন
 
  • ৪ (চার) সংখ্যক নিয়ম দ্রষ্টব্য।
৫.৫
   বানান সংস্কারের প্রস্তাব – ২ :   পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির ‘বানান বিধি’ (নির্বাচিত অংশ)
৫.৫
   বানান সংস্কারের প্রস্তাব – ২ :
    পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির ‘বানান বিধি’ (নির্বাচিত অংশ)
পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি  কর্তৃক প্রকাশিত আকাদেমি বানান অভিধান

তৎসম শব্দের বানান

(৪) হ্রস্ব-দীর্ঘ স্বরচিহ্ন

৪.১০
তৎসম শব্দের ক্ষেত্রে যেখানে হ্রস্ব ই উ/ই-কার উ-কার এবং দীর্ঘ ঈ উ/ ঈ-কার উ-কার দুটি রূপই প্রচলিত ও গৃহীত, সেখানে হ্রস্ব বিকল্পটিকেই আমরা গ্রহণ করছি। অঙ্গুরি-অঙ্গুরী অন্তরিক্ষ-অন্তরীক্ষ কুটির-কুটীর বা ঊর্ণনাভ-ঊর্ণনাভ ভ্রু-ভ ইত্যাদি উদাহরণ যুগ্মকের প্রথম বিকল্পটি বাংলায় একমাত্ররূপে গৃহীত হোক- এই আমাদের প্রস্তাব। এই রকম একটি তালিকা নীচে দেওয়া হচ্ছে : -
 
অঙ্গুরি
অঙ্গুলি
অবনি
আবলি
আবির
 
উষসী
ঊষা
ঔষধি
কটি
কাশি (নগরী)
 
কুস্তি
কুশারি
কুশি
কেল
কোটি
 
ক্ষৌণি
গাগরি
চিৎকার
চুনি
ত্রুটি
 
দরি
তরণি
দীপাবলি
দ্রোণি
ধমনি
 
ধরণি
ধূলি
নাড়ি
নেমি
পঞ্জি
 
পদবি
পরিপাটি
পর্কটি
পল্লি
পাটি
 
পুত্তলি
পুরন্ধ্রি
পেশি
প্রসুতি
বদরি
 
বলি
বাজি
বারি (হাতি বাঁধবার জায়গা)
 
বেদি
বেলি
ভৃঙ্গি
ভেরি
মহি
 
যুবতি
শরণি
সরণি
সুরভি
 
৪.১১
বলা বাহুল্য, হ্রস্ব বিকল্প না থাকলে তৎসম শব্দের বানানে দীর্ঘ স্বরচিহ্নই লিখতে হবে।
৪.২০
সংস্কৃত ইন-প্রত্যয়ান্ত শব্দগুলি (অধিকারিন অধিবাসিন্ অভিমুখিন্ আততায়িন্ একাকিন্ কৃতিন্ গুণিন্ জ্ঞানিন্ তন্ত্রিন্ দ্বেষিন্ ধনিন্ পক্ষিন বিদ্রোহিন্ মন্ত্রিন রোগিন শশিন্ সহযোগিন্ ইত্যাদি) কর্তৃকারকের একবচনে দীর্ঘ ঈ-কারান্ত হয় এবং এই দীর্ঘ ঈ-কারান্ত রূপেই এগুলি বাংলায় পরিচিত- (অধিকারী অধিবাসী অভিমুখী আততায়ী একাকী কৃতী গুণী জ্ঞানী তন্ত্রী দ্বেষী ধনী পক্ষী বিদ্রোহী মন্ত্রী রোগী শশী সহযোগী ইত্যাদি) সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়মে সমাসবদ্ধ কিংবা প্রত্যয়যুক্ত হলে এইসব শব্দের দীর্ঘ ঈ-কার আবার হ্রস্ব ই-কারে ফিরে যায়। যেমন গুণিজন পক্ষিকুল মন্ত্রিসভা শশিভূষণ বা একাকিত্ব, কৃতিত্ব সহযোগিতা ইত্যাদি। কিন্তু বাংলা বানান-ব্যবহারে এই নিয়মের প্রচুর ব্যতিক্রম দেখা যায়। যেমন আগামীকাল পরবর্তীকাল প্রাণীবিদ্যা হস্তীদল। এর ফলে অনেক সময় যে বানান বিভ্রাট ঘটে তার নিরসনকল্পে প্রশ্ন উঠেছিলঃ সমাসবদ্ধ শব্দের ক্ষেত্রে ইন-প্রত্যয়ান্ত পূর্বপদের বানানে কোনো হেরফের করা সম্ভব কি না। আলোচনার পর প্রস্তাব নেওয়া হয় যে : -
৪.২১
সমাসবদ্ধ শব্দের ক্ষেত্রে সংস্কৃত মূল শব্দটিকে দীর্ঘ ঈ-কারান্ত 'বাংলা' শব্দ ধরে নিয়ে সমাস হলেও তার দীর্ঘ ঈ-কারের ব্যত্যয় ঘটানো চলবে না। তাই আগামীকাল মন্ত্রীগণ মন্ত্রীসভা শশীভূষণ রূপই গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে।
৪.২২
কিন্তু তৎসম ত্ব ও তা প্রত্যয় যোগ করা হলে এইসব শব্দের হ্রস্ব ই-কারান্ত (অর্থাৎ ইন-এর ন্ লোপের পর যা থাকে) মূল প্রাতিপদিক রূপেই লেখা হবে। যেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রতিযোগিতা মন্ত্রিত্ব স্থায়িত্ব ইত্যাদি।
অবশ্য অতৎসম প্রত্যয় যুক্ত হলে ৪.২১ বিধি প্রযোজ্য হবে। যেমন, মন্ত্রীগিরি।

(৫) বিসর্গ(t) চিহ্নের রক্ষা/বর্জন

৫.১০
তৎসম শব্দে বিসর্গ সর্বত্র রক্ষিত হবে কি না এ বিষয়ে আলোচনার পর প্রস্তাব হল : -
৫.১১
যেখানে-তস বা-শস্ প্রত্যয়ান্ত শব্দগুলিতে অন্ত্যবিসর্গের প্রয়োগ প্রচলিত ছিল (কিন্তু কালক্রমে বর্জিত হতে দেখা যাচ্ছে), সেগুলিতে এখন আর বিসর্গ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান-সংস্কার সমিতি তাঁদের নিয়মে বিকল্পের বিধান রেখেছিলেন, সেখানে আমরা বিসর্গহীন একটিমাত্র রূপেরই পক্ষপাতী। ফলে অন্ততঃ প্রথমতঃ ফলতঃ বস্তুতঃ ক্রমশঃ প্রায়শঃ নয়, লেখা হোক অন্তত প্রথমত ফলত বস্তুত ক্রমশ প্রায়শ।
৫.১২
বিসর্গসন্ধিযুক্ত পদেও অন্ত্যঃবিসর্গ বর্জিত হোক।যেমন এইসব ক্ষেত্রে : -
ইতঃ + তত  ইতস্তত (ইতস্ততঃ নয়)
অহঃ + অহঃ  অহরহ
মুহুঃ + মুহুঃ  মূহূর্মুহু
কিন্তু সন্ধিতে যেখানে পদমধ্যে বিসর্গ রক্ষিত থাকে সেখানে পদমধ্যস্থ বিসর্গ লিখতে হবে। যেমন : -
অতঃ + পরঃ  অতঃপর
অন্তঃ + করণ  অন্তঃকরণ
মনঃ + পূত  মনঃপূত
৫.১৩
বিসর্গসন্ধিজাত ও-কারের প্রচলিত ও দীর্ঘকাল গৃহীত রূপগুলি রক্ষণীয়। যেমন অকুতোভয় ততোধিক বয়োজ্যেষ্ঠ মনোযোগ মনোরঞ্জন মনোরম। ‘মনমোহন’ কোনো কোনো নামে, বিশেষত অবাঙালি নামে, দেখা গেলেও তৎসম মনোমোহন-ই গ্রহণীয়।
৫.১৪
‘ছন্দ’ শব্দটির ক্ষেত্রে এটিকে বাংলা অর্ধতৎসম শব্দ ধরে নিয়ে বিসর্গসন্ধি-জাত ও কারকে বর্জন করা যেতে পারে। যেমন ছন্দগুরু ছন্দবিজ্ঞান ছন্দমুক্তি ছন্দলিপি।
৫.১৫
দুঃস্থ নিঃস্তব্ধ নিঃস্পৃহ বয়ঃস্থ মনাস্থ ইত্যাদি শব্দের ব্যাকরণসম্মত বিকল্প রূপ প্রচলিত আছেঃ দুস্থ নিস্তব্ধ নিস্পৃহ বয়স্থ মনস্থ। বিসর্গহীন এই বিকল্প রূপগুলিই আমরা ব্যবহার করতে চাই। এখানে অবশ্য স্মরণীয় যে, অন্তঃস্থ আর অস্তস্থ দুটি ভিন্নার্থক শব্দ, একটির অর্থ 'ভিতরকার' (অন্তঃ+স্থ) এবং অন্যটির ‘শেষের’ (অন্ত+স্থ)। তাই ‘অন্তঃস্থ’ শব্দটির বিসর্গ রক্ষিত হবে।

(৬) হস্ চিহ্নের সমস্যা

পদান্তের হস্ চিহ্নকে পরস্বরহীন অর্থাৎ ব্যঞ্জনান্ত উচ্চারণ বোঝানোর চিহ্ন বা ধ্বনিদাগ (diacritical mark) হিসেবে গণ্য করা হয়। বাংলায় কয়েকটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্র ছাড়া অ-কারান্ত শব্দ প্রায় সর্বত্র ব্যঞ্জনান্ত উচ্চারিত হয়। এই রীতি অনুসারে পদের শেষে হচিহ্নের ব্যবহার বাহুল্যসূচক (redundent) এজন্য নিম্নলিখিত ক্ষেত্রগুলিতে পদান্ত হস্ বর্জনের প্রস্তাব নেওয়া হল : -
৬.১০
আশিস দিক ধিক পরিষদ বণিক বিপদ বিরাট ভিষক সভাসদ সম্রাট ইত্যাদি শব্দগুলি হস্ চিহ্ন ছাড়াই ব্যবহৃত হোক।
৬.১১
তদ্ধিত মতুপ্ প্রত্যয়ের হসন্ত মান্ আর কৃৎ শান চ্। প্রত্যয়ের হচিহ্নহীন মান নিয়ে বিভ্রমের অবকাশ থাকলেও উভয় ক্ষেত্রেই হস্স্নিহীন মান ব্যবহারের প্রস্তাব করি। যেমন রুচিমান শক্তিমান শ্রীমান সংস্কৃতিমান এবং ঘটমান ধাবমান বর্তমান ম্রিয়মাণ ইত্যাদি।
অনুরূপভাবে, বতুপ্ প্রত্যয়জাত বান্‌ও বান-রূপে লেখা হোক : জ্ঞানবান ধনবান ভগবান।
৬.২০
তবে সংস্কৃত সন্ধিজাত শব্দে পূর্বপদের শেষে হস্ চিহ্ন থাকবে। যেমন দিগ্‌ভ্রান্ত পৃথক্‌করণ বাক্‌সিদ্ধ বাগ্‌ধারা।
৬.২১
ষড়যন্ত্র শব্দটি ষড়যন্ত্র হিসাবেই প্রচলিত; এই প্রচলন মান্য করা যেতে পারে।

(৭) রেফের নীচে ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব

৭.০০ 
রেফের নীচে ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব সর্বত্রই বর্জিত হওয়া সংগত। র্য-এর ক্ষেত্রে র্য্য। রূপে এটি সবচেয়ে বেশি রক্ষিত হতে দেখা যায়, কিন্তু আমরা র্য-এরই পক্ষপাতী। দ্বিত্বহীন এই রেফযুক্ত শব্দগুলির বানান লক্ষণীয়- অর্চনা অর্জন আর্য উর্ধ্ব কর্ম চর্চা তুর্য পূর্ব বর্জন মূর্ছনা হার্দিক ইত্যাদি তো বটেই, এমনকী কৃত্তিকা থেকে উৎপন্ন কার্তিক বা বৃদ্ধ-এর সঙ্গে সম্পর্কিত বার্ধক্য-তেও ত ও ধ-এর দ্বিত্ব অপ্রয়োজনীয়।

(৮) ঙ আর s

৮.০০
ঙ আর s  দুটোই যে-বানানে (সংস্কৃত ব্যাকরণমতে) শুদ্ধ, সেখানে  s  ব্যবহারের প্রস্তাব গৃহীত হল। কিন্তু যেখানে  s  প্রয়োগ ওই ব্যাকরণে অস্বীকৃত সেখানে নিছক সমতারক্ষার জন্য s ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। কয়েকটি সংগত  s-এর দৃষ্টান্ত : -
অলম্ + কার  অলংকার
অহম + কার  অহংকার
ভয়ম্ + কর  ভয়ংকর
শম্ + কর  শংকর
সম্ + গত  সংগত
সম্ + গীত  সংগীত
৮.১০
কিন্তু যেসব শব্দে s ম্-এর সন্ধি-পরিণাম হিসেবে আসেনি, সেখানে s ব্যবহার অবৈধ। তাই অংক নয়, অঙ্ক (অক্+অল্); বংগ নয়, বঙ্গ; শংকা নয় শঙ্কা; সংগে নয়, সঙ্গে। এই রকম : -
অঙ্কুশ (অন্‌ক্ বা অক্ + উশ)
আতঙ্ক (আ-তক্ বা তঙক+ ঘঞ)
কঙ্কাল (কনক্‌ বা কঙক্ + কালন)
পঙ্ক (পনক্‌ বা পঙক্‌ + ঘঞ)
বঙ্কিম (বঙক্ + ইম) ইত্যাদি।
৮.২০
সম+গীত সংগীত হলেও সম্+বোধন কিন্তু সংবোধন নয়। ম্-এর পরে বর্গীয় ব থাকলে তা ম্-ই থাকবে, s হবে না; ম্-এর পরে অন্তঃস্থ ব থাকলে তবেই সেটা s হবে। তাই কিংবা প্রিয়ংবদা সংবর্ধনা, কিন্তু সম্বন্ধ সম্বুদ্ধ সম্বোধি।

(৯) শ-ষ-স

৯.০০
যেসব তৎসম শব্দে শ-ষ বা শ-স দুটোই সংস্কৃত অভিধানে স্বীকৃত সেগুলির ক্ষেত্রে শুধু শ ব্যবহার করার প্রস্তাব গৃহীত হল। এইসব বিকল্পের প্রথমটিই আমরা নেব: উশীর-উষীর, কিশলয়-কিসল, শরণি-সরণ, শায়ক-সায়ক ইত্যাদি।
কোশ-কোষ নিয়ে প্রথমে একটু অসুবিধে হতে পারে কিন্তু এ দুটি যেহেতু একই শব্দের বিকল্প বানান, সুতরাং ‘কোশ’-ই হোক।

অ–তৎসম শব্দ বিষয়ে

(১০) হ্রস্ব ই-কার দীর্ঘ ঈ-কারের সমস্যা

অ-তৎসম শব্দে ঈ-কারকে যথাসম্ভব বর্জন করাই সংগত বলে আমাদের মনে হয়েছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান-সংস্কার সমিতি বহুকাল আগেই এই বিধান দিয়েছিলেন, কিন্তু তখন বিকল্প রূপটি বর্জিত হয়নি। অর্থাৎ, সমিতির বানান-সুত্র অনুযায়ী কুমির-কুমীর পাখি-পাখী ইত্যাদির দুইটি ব্যবহারযোগ্য ছিল। আমাদের প্রস্তাব, দীর্ঘ ঈ-কারযুক্ত বিকল্প রূপটিকে বর্জন করা হোক। এই প্রস্তাব অনুসারে : -
১০.১০
কুমির চাঁদনি ছেনি দিঘল দিঘি দিয়াশলাই নিচু নিলা পশমি পাখি পাথুরি পারানি পিরিতি বাড়ি বাঁশি বাঁশরি রাখি সুপারি সেঁউতি হাতি হিরা হিরে ইত্যাদি শব্দে সবসময়েই হ্রস্ব ই-কার ব্যবহৃত হবে।
১০.১১
কিন্তু কয়েকটি ক্ষেত্রে, প্রচলনগত কারণে ঈ-কারের ব্যবহার মেনে নিয়েও- যেমন কাহিনী চীনা চীনে ইত্যাদির ক্ষেত্রে, বিকল্পে কাহিনি চিনা চিনে আমরা স্বীকার করতে পারি।
১০.২০
অতৎসম শব্দে হ্রস্ব ই-কার আর দীর্ঘ ঈ-কার দিয়ে বিশেষ্য বিশেষণ রূপের স্বাতন্ত্র্য দেখানোর দরকার নেই। অর্থাৎ
 
আমার খুশি
আমি খুশী
তৈরি করা
তৈরী বাড়ি
 
এরকম কোনো প্রভেদ করা নিষ্প্রয়োজন। এসব ক্ষেত্রে সর্বত্রই হ্রস্ব ই-কারের প্রয়োগ চলুক।
১০.৩০
সংস্কৃত স্ত্রীবাচক প্রত্যয়ের নীতি অনুসারে অতৎসম শব্দেও দীর্ঘ ঈ-কার দিয়ে স্ত্রীলিঙ্গ বোঝানোর রীতি এখনও কমবেশি চলছে। আমাদের প্রস্তাব: এ ক্ষেত্রেও হ্রস্ব ই-কারের ব্যবহার হোক। তাই আমরা লিখব কাকি (-মা) কামারনি খান্ডারনি খুকি খুড়ি খেঁদি গয়লানি চাকরানি চাচি ছাগলি ছুঁড়ি ছুকরি জেঠি (-মা) ঝি ঠাকুরানি দিদি ধাঙড়নি নেকি পাগলি পিসি পেঁচি বাঘিনি বামনি বেটি ভেড়ি মামি (-মা) মাসি মুদিনি মেথরানি রানি সাপিনি সোহাগি স্যাঙাতনি ইত্যাদি।
১০.৪০
জীবিকা ভাষা গোষ্ঠী সম্প্রদায় জাতি বোঝানোর জন্য যে ই-কারান্ত প্রত্যয় ব্যবহার করা হয় তা দীর্ঘ ঈ-কার হবে না, সবসময় হ্রস্ব ই-কার হবে এইভাবে আমাদের প্রস্তাব : -
উজিরি ওকালতি জজিয়তি জমিদারি ডাক্তারি তবলচি পণ্ডিতি ফকিরি বরকন্দাজি মশালচি মাস্টারি মোক্তারি হাকিমি;
আরবি ইংরেজি কাশ্মীরি গুজরাতি জাপানি তুরকি পাঞ্জাবি ফরাসি ফারসি ভিয়েতনামি মারাঠি মালয়ালি মৈথিলি সিন্ধি হিন্দি; আকালি কংগ্রেসি জনসঙ্ঘি ঝাড়খণ্ডি।
ইরাকি ইরানি ওড়িশি কাবুলি জাপানি পাকিস্তানি বর্মি বাঙালি লাডাকি হানাফি
১০.৫০
কয়েকটি তদ্ভব অর্ধতৎসম মিশ্র ও বিদেশি বিশেষণ শব্দে যে ই-প্রত্যয় যুক্ত হয় তাও হ্রস্ব ই-কার দিয়েই লিখতে হবে- তা এ প্রসঙ্গে আলাদা করে বলা হচ্ছে : -
আন্দাজি আসামি কারবারি খানদানি খুনি গায়েবি জাহাজি ঠগি তুফানি তেজারতি দরদি দেশি ধানি (-রঙ) নজরবন্দি নাকি (-সুর) পন্থি পশ্চিমি ফরিয়াদি বিদেশি মজলিশি মরমি মরশুমি মুলতুবি মৌসুমি রাজি শরবতি হজমি।
১০.৫১
কিছু দেশি-বিদেশি সাধারণ বিশেষ্য শব্দেও হ্রস্ব ই-কার বাঞ্ছনীয় : -
কবুলতি কাঁসারি কেরামতি ক্যারদানি খবরদারি গোলামি চালাকি চালিয়াতি জালিয়াতি টিটকিরি ঠুংরি ডুগডুগি ঢাকি (যারা ঢাক বাজায়) থানকুনি দেহলি পড়শি ফরসি মালি (যারা বাগানে কাজ করে) শালিশি সরফরাজি হালালি হম্বিতম্বি হুজ্জতি।
১০.৬০
তবে সংস্কৃত ঈয় প্রত্যয় যদি অতৎসম শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয় সে ক্ষেত্রে দীর্ঘ ঈ-কার বজায় রাখতে হবে : -
অস্ট্রেলীয় আর্টেজীয় আলজিরীয় ইউরোপীয় ইতালীয় এশীয় কানাডী ক্যারিবীয় ক্যালাডোনীয় জর্জীয় পেলোপোনেশীয় লাইবিরীয় সাইবেরীয়।
১০.৭০
কী আর কি- এই দুই শব্দের মধ্যেও একটা প্রভেদ রাখা বাঞ্ছনীয়। ‘কী’ হল কখনও কর্মবাচক প্রশ্নমূলক সর্বনাম, কখনও বিশেষণের বিশেষণ: তুমি কী দেখেছ বলবে তো। বা কী চমৎকার। কীবা তার শোভা। বিকল্পাত্মক বিশেষণ হিসেবেও কী ব্যবহৃত হবে: কী রাম কী শ্যাম- দুটোই সমান পাজি। এইসঙ্গে কীসে এবং কীসের দীর্ঘ ঈ-কার দিয়ে লেখা উচিত বলে মনে করি।
১০.৭১
কিন্তু যে-প্রশ্নের উত্তর হয় ‘হ্যাঁ’ হবে না হয় ‘না’ হবে- সে ক্ষেত্রেই শুধু হ্রস্ব ই-কারযুক্ত কি ব্যবহৃত হবে : -
তুমি কি দেখেছ বইটা?- এর উত্তর হবে হ্যাঁ বা না।
তুমি কী দেখেছ?- এর উত্তর হবে শ্রোতা যা দেখেছে তার নাম বা বর্ণনা।

(১১) হ্রস্ব উ-কার দীর্ঘ উ-কার নিয়ে

১১.০০
হ্রস্ব ই-কার দীর্ঘ ঈ-কারের মতো একই সমস্যা আছে হ্রস্ব উ-কার দীর্ঘ উ-কার নিয়ে। এক্ষেত্রেও অতৎসম শব্দে আমরা বিকল্পহীনভাবে হ্রস্ব উ-কার ব্যবহারের পক্ষপাতী। তাই ধূলো পূজো পুরো না লিখে আমরা লিখতে চাই ধুলো পুজো পুরো। এরকমভাবেই উনিশ চুন চুনি চুল জুয়া পুব ইত্যাদি।
১১.১০
দীর্ঘ উ-কারযুক্ত তৎসম শব্দ বা উপসর্গের সঙ্গে বাংলা প্রত্যয় বা শব্দ যুক্ত হলেও ব্যুৎপত্তি স্মারকতার সূত্রে দ্রুত অর্থবোধের সহায়ক বলে মূলে দীর্ঘ উ/ঊ-কার পালটানো ঠিক হবে না। তাই ঊনত্রিশ ধূর্তামি মূর্খামি ভূতুড়ে পূজারি।
১১.২০
কিন্তু শব্দগুলি অর্ধতৎসম রূপ গ্রহণ করলে দীর্ঘ উ-কারের বদলে হ্রস্ব উ-কারই গৃহীত হবে : উনপাজুরে মুখুমি ধুরতুমি পুজুরি ইত্যাদি।
অর্থাৎ তদ্ভব ও অর্ধতৎসম কথ্য রূপে যে শব্দগুলি পাই সেসবের বানানে আমরা ব্যুৎপত্তি থেকে উচ্চারণের দিকে কিছুটা সরে আসতে চাই।

(১২) শব্দান্তে ও-কার

১২.০০
ও-ধ্বনির উচ্চারণ বোঝানোর জন্য কোনো কোনো শব্দের বানানে ও-কার যোগ করা সংগত কি না, এই সমস্যার নিরসনে আমাদের প্রস্তাব, এইসব শব্দে ও-কারান্ত রূপ থাকুক : -
 
কালো খাটো ছোটো-বড়ো ভালো মতো
এগারো বারো তেরো-চোদ্দো পনেরো ষোলো সতেরো আঠারো।
১২.০১
কিন্তু, এত কত তত যত ইত্যাদি শব্দে ও-কার অপ্রয়োজন।
১২.০২
কোন-কোনো-কোনোও- এই বানানগুলির মধ্যে দুটি ভিন্ন অর্থে ‘কোন’ (প্রশ্নবাচক সর্বনাম, আর ‘কোনো’ ‘কোনও’ (অনিশ্চাসূচক সর্বনাম, which) ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। অনেকগুলির মধ্যে কয়েকটি বোঝানোর জন্য লেখা হোক ‘কোনো কোনো’/ ‘কোনও কোনও’।
তেমনিভাবে কখনো কখনও, কারো/ কারও, আরো/ আরও, আরোই/ আরওই।
১২.১০
Too অর্থে ‘ও’ যোগ করলে সেটা স্বতন্ত্র বর্ণ হিসেবেই লেখা উচিত। তাই আজো এখনো তোমারো নয়, লেখা হবে আজও তোমারও রামেরও ইত্যাদি। কবিতায় ছন্দের কারণে ও-কারের বানান থাকতে পারে।
১২.২০
আদি অক্ষরে (syllable-এ) স্বরধ্বনি অ-যুক্ত মূল শব্দের সঙ্গে-উয়া প্রত্যয় জুড়ে যে-রূপ হয় (জল উয়া জলুয়া), তার আধুনিক স্বরসংগতি প্রসূত রূপে দুটো ও-কার দেওয়াই সংগত হবে। তাই জলুয়া থেকে জোলো, পড়ুয়া থেকে পোড়ো, পটুয়া থেকে পোটো।
১২.৩০
কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষণের ‘লো’ প্রত্যয় ও-কার ছাড়া লেখার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে যেমন ঘোরাল, ছুঁচোল, জোরাল, ধারাল, টিকোল প্যাঁচাল। আমরা এই প্রবণতা অযৌক্তিক মনে করি, তাই আমরা প্রত্যয়ের উচ্চারণ বজায় রেখে লিখতে চাই : -
ঘোরালো, ছুঁলো, জোরালো, ধারালো, টিকোলো, প্যাঁচালো।
১২.৪০
‘তো’ এবং সেই সূত্রে ‘হয়তো’ ও-কারযুক্ত হোক।
১২.৫০
ক্রিয়াপদের বিভিন্নরূপে নিম্নবর্ণিত পার্থক্যগুলি বজায় রাখা হোক : -
নিত্যবর্তমানকালে অ-কারান্ত : তুমি কোন্ কাগজ পড়?
বর্তমান অনুজ্ঞায় ও কারান্ত : এটা পড়ো তো দেখি।
তুচ্ছার্থক বর্তমান অনুজ্ঞায় হলন্ত : তুই পড়।
ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞায় একাধিক ও-কার : এ বইটা অবশ্যই পোড়ো
বস্ ধাতুর ক্ষেত্রে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞায় রূপ হবে বোসো।
আরও দ্রষ্টব্য - ১২.৮০, ১২.৮১।
১২.৫১
তবে ক্রিয়াপদের অতীত ও ভবিষ্যৎ রূপে শেষ বর্ণে ও-কার হবে না। অর্থাৎ বলল বলত বলব লেখা হবে, বললো বলবো ইত্যাদি নয়। হল (হইল), হত (হইত) আমরা ও-কার ছাড়াই লিখতে চাই।
১২.৫২
সাধিত ধাতু থেকে নিষ্পন্ন ক্রিয়াবাচক বিশেষ্যের রূপ হবে নো-অন্তক। যেমন করানো (করান নয়)। এইভাবে দেখানো শোনানো বলানো চালানো লাগানো পাঠানো খাওয়ানো ইত্যাদি।
১২.৬০
কোথাও কোথাও দ্বি-অক্ষরযুক্ত ধাতুর দ্বিতীয় ব্যঞ্জনে ও-কার বর্জনের প্রথা গৃহীত হয়েছে, যেমন জুড়ল ফুরল, লুকবে। আমরা এই নীতিও যুক্তিহীন মনে করি। আমরা লিখতে চাই : -
জুড়োল, পিছোবে, ফুরোল, ভিড়োবে লুকোবে।
এ বিষয়ে আমাদের দু রকম যুক্তি আছে। এক, ধ্বনিতত্ত্বের যুক্তি: লুকা, জুতা-ফুরা- থেকে ধ্বনি পরিবর্তনের লুকো, জুতো, ফুরো হয়েছে, যে নিয়মে মূলা থেকে মুলো, সুতো হয় সেই একই নিয়মে। সুতরাং লুকো- ইত্যাদির সঙ্গেই বিভক্তি যোগ হবে। দুই, সমরূপতার সম্ভাবনা এড়ানোর যুক্তি: ভিড়বে আর ভিড়োবে-র প্রথমটি প্রযোজক নয়। দ্বিতীয়টি প্রযোজক ক্রিয়া। এই রকমভাবে তফাত রাখা দরকার জুড়ল (ছেঁড়া পাতা জুড়ল) জুড়োল (ঠাণ্ডায় শরীর জুড়োল) ইত্যাদির মধ্যে।
১২.৭০
অসমাপিকা ক্রিয়ার কোনো রূপেই স্বরসংগতিতে ও-কার বা উর্ধ্বকমার প্রয়োজন নেই।
তাই বোলে বা ব'লে নয়, আমরা লিখতে চাই বলে কয়ে হয়ে সয়ে পড়ে চলে। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে অর্থবোধে সংশয় দেখা দিলে উর্ধ্বকমার প্রয়োগ চলতে পারে।
১২.৮০
এই কয়েকটি ক্রিয়াপদের অনুজ্ঞা-রূপে ও উচ্চারণ বোঝানোর জন্য ও-কার প্রয়োগ সংগতঃ বোস্ হোন হোক।
১২.৮১
সাধিত প্রযোজক ধাতুর ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞায় ইও-র বদলে ইয়ো লেখারই প্রস্তাব হল। অর্থাৎ আমরা লিখতে চাইঃ করিয়ো দেখিয়ো শুনিয়ো।
সিদ্ধ আ-অন্তক ধাতুর মধ্যম পুরুষের অনুজ্ঞার ক্ষেত্রেও ওইভাবে য়ো হবে খেয়ো দিয়ো ঘেরো।

(১৩) ঐ-কার বা ঔ-কার

১৩.০০
ঐ-কার বা ঔ-কারের অই বা অউ ব্যবহার প্রয়োজনমতো করা যেতে পারে, কিন্তু সর্বত্র সম্ভব বলে মনে হয়নি।
১৩.১০
তবে কই দই বই (বৈ কী) হইচই পইতে রইরই পইপই চইচই (হাঁসকে ডাকার শব্দ) ইত্যাদি শব্দ ঐ-কার ছাড়া লেখা হোক।
১৩.২০
তেমনই বউ মউ ছউ ফউজ ঔ-কার ছাড়া লেখা যেতে পারে।

(১৪) ঙ বনাম ঙ্গ

১৪.০০
কিছু কিছু শব্দে ঙ এবং ঙ্গ দুই বানানই প্রচলিত। যেমন ভাঙা-ভাঙ্গা বাঙালি- বাঙ্গালি। এসব ক্ষেত্রে মান্য উচ্চারণের ভিত্তিতে আমরা ঙ-বানানেরই পক্ষপাতী। তাই : -
কাঙাল গোঙানি টাঙানো ডাঙশ ডাঙা ডিঙি ডোঙা ঢ্যাঙা ধাঙড় নোঙর ভাঙা ভেঙে রঙিন রাঙা লাঙল।
১৪.১০
যেখানে সাধারণত ঙ্গ উচ্চারণ হয়, সেখানে গ-যুক্ত ঙ্গ-ই লিখতে হবে, যেমন জঙ্গল জঙ্গি দাঙ্গা ভঙ্গি লুঙ্গি হাঙ্গামা।

(১৫) জ এবং য

১৫.০০
অ-তৎসম শব্দে ব্যুৎপত্তি স্মারকতার সূত্রে দ্রুত অর্থবোধের সহায়ক বলে য-এর বদলে জ ব্যবহার করবার প্রস্তাবে এই ব্যতিক্রম রাখা যেতে পারে -
যখ যখন যত যন্তন্না যবে যাওয়া যিনি যে ইত্যাদি।
১৫.১০
প্রচলিত কয়েকটি ক্ষেত্রে য-এর বদলে জ হবে। যেমন কাজ জাতা জাউ জুঁই জো জোগাড় জোড় জোড়া জোত জোয়াল।

(১৬) ণ এবং ন

১৬.০০
সংস্কৃত ণত্ব বিধান কেবল তৎসম শব্দের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
১৬.১০
এইসব শব্দে দন্ত্য-ন হবে : -
অঘ্রান কান কোনাকুনি ঘরানা চিরুনি চুন ঝরনা ঠাকরুন দরুন ধরনা নরুন পুরোনো রানি সোনা ইত্যাদি।
১৬.২০
অ-তৎসম শব্দে মুর্ধন্য বর্ণের সঙ্গে যুক্ত ন দন্ত্য ন-ই হবে। তাই : -
আন্ডা কান্ডা ঠান্ডা পিন্ডি মুন্ডা মুন্ডারি মুন্ডি মুন্ডু লন্ডভন্ড ষন্ডা ইত্যাদি।

(১৭) য-ফলা

১৭.০০
অ-তৎসম শব্দে য-ফলা সবক্ষেত্রে বর্জন করা সম্ভব নয়; বিশেষত অর্ধতৎসম শব্দে য-ফলা রাখতে হবে। তাই কাব্বি জন্নে ভুজ্জি মান্নিগন্নি ইত্যাদি না লিখে কাব্যি জন্যে ভুজ্যি মান্যিগন্যি সাধ্যি সুজ্যি হিসেবে লেখাই সংগত হবে।
১৭.১০
হিস্যা লেখা হোক হিস্সা।
১৮.০০
মফঃস্বল নয়, লেখা হোক মফস্সল বা মফস্বল।

(১৯) শ ষ স

১৯.০০
অ-তৎসম শব্দে প্রচলন অনুযায়ী শ-য-স তিনটিরই ব্যবহার হবে। যেমন ষাঁড় মোষ মাসি পিসি।

(২০) ক্ষ এবং খ

২০.০০
ক্ষুদ ক্ষেত ক্ষ্যাপা ইত্যাদি শব্দে ক্ষ-এর বদলে খ ব্যবহারই সংগত বলে প্রস্তাব নেওয়া হল। লিখতে হবে খুদ খেত খ্যাপা।

(২১) বিদেশি শব্দ বিষয়ে, একটু পৃথক-ভাবে

২১.০০
বাংলা শব্দভাণ্ডারে গৃহীত বিদেশি দীর্ঘ স্বরচিহ্ন না দিয়ে হ্রস্ব স্বরচিহ্ন ব্যবহার করাই সংগত হবে। নিচে সেসব শব্দের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা দেওয়া হল :-
 
ইডেন
ইদ
ইঞ্জিনিয়ার
ইভ
ইস্ট
 
ইস্টার
কমিটি
কাজি
কিডনি
ক্রিজ
 
ক্রিম
ক্লিন
খ্রিষ্টান
গির্জা
চিপ
 
জানুয়ারি
টিন
টিম
ডিগ্রি
থ্রি
 
নবিশ
নেভি
প্লিডার
ফি
ফিরিঙ্গি
 
ফ্রি
বিচ
বিন
বিম
ব্রিজ
 
ব্রিফ
মিটিং
মিলিটারি
মুভি
রিডার
 
রিম
রিল
রেফারি
লিগ
লিড
 
লিডার
লেডি
সিজার
সুফি
সেক্রেটারি
 
স্টিম
স্ট্রিট
হাজি
হিজরি।
 
 
ইডেন
ইদ
ইঞ্জিনিয়ার
ইভ
ইস্ট
 
ইস্টার
কমিটি
কাজি
কিডনি
ক্রিজ
 
ক্রিম
ক্লিন
খ্রিষ্টান
গির্জা
চিপ
 
জানুয়ারি
টিন
টিম
ডিগ্রি
থ্রি
 
নবিশ
নেভি
প্লিডার
ফি
ফিরিঙ্গি
 
ফ্রি
বিচ (beach)
বিন (bean)
বিম (beam)
ব্রিজ
 
ব্রিফ
মিটিং
মিলিটারি
মুভি
রিডার
 
রিম
রিল
রেফারি
লিগ
লিড
 
লিডার
লেডি
সিজার
সুফি
সেক্রেটারি
 
স্টিম
স্ট্রিট
হাজি
হিজরি।
 
২২.০০
বিদেশি শব্দের ক্ষেত্রে মুর্ধন্য ণ প্রযোজ্য হবে না, সর্বত্রই দন্ত্য ন ব্যবহার করতে হবে। এখানে উচ্চারণের কোনো ইঙ্গিত রাখা হচ্ছে না। উদাহরণ: টার্মিনাল ট্রেন পরগনা ফার্ন ব্যারন বায়রন রোমান কন্ট্রাকটর কন্ট্রোলার লণ্ঠন লন্ডন।
২৩.০০
বর্ণগুচ্ছ বিশিষ্ট ইংরেজি শব্দে ব্যবহার করতে হবে। তাই আমরা লিখতে চাই: ইস্ট পোস্ট পোস্টার মাস্টার স্টেশন স্টোর স্ট্রিট।
২৩.০১
স্বাঙ্গীকৃত বিদেশি শব্দের উচ্চারণে যেখানে স উচ্চারণে হচ্ছে না সেখানে ষ্ট হয় তাই খিষ্ট খ্রিষ্টান খ্রিষ্টাব্দ এই বানানে লেখা হোক।

(২৪) বিদেশি শব্দে শ-স

২৪.০১
এই সব আরবি-ফারসি শব্দে স ব্যবহারই চলবে : -
ইসলাম তসবির ফারসি মুসলিম মুসলমান সাদা সিতারা সুলতান সোফিয়া ইত্যাদি।
২৪.১০
আমাদের চালু অভ্যাসের মধ্যে এসে গেছে বলে এই শব্দগুলি তালব্য শ দিয়ে লেখা হোক : -
আপসোশ আয়েশ আশরফি উশুল ওয়াশিল কোশিশ চাপরাসি তপশিল তহশিল পোশাক বকশিস বাদশাহি বালিশ শিশমহল হুঁশিয়ার ইত্যাদি।
২৪.২০
এই ইংরেজি শব্দগুলিতে উচ্চারণ ঘনিষ্ঠতার কারণে তালব্য শ হবে : -
অ্যাশট্রে কার্নিশ নোটিশ বার্নিশ পালিশ পুলিশ মেশিন রাবিশ শুটিং (shooting) শ্যালো হাশিশ।
২৪.২১
ইংরেজি s-এর উচ্চারণ বাংলা শব্দে বজায় থাকলে তা দন্ত্য স দিয়েই লেখা উচিত হবে : -
কেস ক্রস (juice) নার্স নার্সারি পাস মেস মিস সুইট (suite) সুটকেস ইত্যাদি।
২৪.৩০
বাংলা মান্য উচ্চারণ অনুসারে স এর (s উচ্চারণযুক্ত) শব্দকে ছ দিয়ে লেখা ঠিক হবে না। তাই এছলাম মুছলমান ছালাম নয়, আমরা লিখতে চাই : -
ইসলাম মুসলমান সালাম সুলতান সোলেমান।
২৫.০০
ভারতীয় বাংলায় য দিয়ে z উচ্চারণ বোঝানোর রীতি মান্যতা পায়নি। তাই এই রীতি গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। এজন্য অযু বা ওযু নয়, অজু বা ওজু। নামায নয়, নামাজ। হযরত নয়, হজরত।

(২৬) র-ফলা

২৬.০০
বিদেশি শব্দের ক্ষেত্রে ঋ-কার ব্যবহার না করে র-ফলা ই-কার ব্যবহার করাই উচিত হবে। যেমন : -
খৃষ্ট নয়, খ্রিষ্ট, বৃটিশ নয়, ব্রিটিশ।

(২৭) ব্যঞ্জনপূর্ব র্‌-রেফ

২৭.০০
হলন্ত র-এর পর ব্যঞ্জন থাকলে র্‌-এর জায়গায় সাধারণত র থাকবে। তবে উচ্চারণ ভুলের সম্ভাবনা থাকলে রেফ ব্যবহৃত হবে। যেমন : -
তুরকি, বরমি, আবার দর্দীয়, নর্ডীয়।

লিখনরীতি বিষয়ক প্রস্তাব

বাংলা বানান নিয়ে আলোচনার সময়ে সমাসবদ্ধ তথা যৌগিক শব্দ সাজানোর গীতের পদ্ধতি নিয়েও প্রশ্ন ওঠে, কাজেই এ সম্বন্ধেও সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কোন্ শব্দগুচ্ছ একসঙ্গে লিখব, কোনগুলিকে পৃথক রাখব বা হাইফেন দিয়ে যুক্ত করব, সে সম্বন্ধে কতকগুলি সাধারণ সুপারিশ : -
২৮.০০
যেসব ক্রিয়াজাত বিশেষ্য বা বিশেষণ পদ একাধিক অংশে বিভক্ত এবং সাধারণভাবে অসমাপিকার যোগফলে তৈরি, সেগুলিতে হাইফেন ব্যবহার করা হোক । যেমন : -
খসে-পড়া (‘মালা হতে খসে-পড়া ফুলের একটি দল’)
ভুলে-যাওয়া (‘ভুলে-যাওয়ার বোঝাই ভরি’)
চোখে-চাওয়া (‘চোখে-চাওয়ার সকল বাঁধন’)
চলে-যাওয়া (‘শুধু ব্যথা পাওয়া, শুধু চলে-যাওয়া’)।
২৮.১০
দুই বা দুইয়ের বেশি শব্দ নিয়ে তৈরি সমাসবদ্ধ শব্দের ক্ষেত্রেও হাইফেন বাঞ্ছনীয়। যেমন : -
নাম-না-জানা, সদ্য-ভর্তি-হওয়া, না-বলা, না-দেখা, কত-না।
২৮.২০
সন্ধি করা যায়, কিন্তু করা হয়নি- এমন সমাসবদ্ধ পদেও হাইফেন দিতে হবে।যেমন : -
ঘন-আড়ম্বর, প্রয়োজন-উদ্ভূত, বিদ্যুৎ-আলোক।
২৮.৩০
তৎসম বিধানে প্রাতিপদিকের সঙ্গে সন্ধি না করে কর্তৃকারকের একবচনের রূপের সঙ্গে অন্য শব্দের সমাস করলে বিকল্পে হাইফেন দেওয়া ভালো। যেমন : -
প্রাণী-বিদ্যা পক্ষী-নিবাস যশ-ইচ্ছা ছন্দ-প্রকরণ (‘ছন্দস্’-এর কর্তৃকারক এক-বচনের রূপ ‘ছন্দঃ’ হলেও আধুনিক প্রয়োগে সমাসের পূর্বপদ হিসেবে ‘ছন্দ’ লেখা যেতে পারে)।
২৮.৩১
কতগুলি অতি-প্রচলিত প্রয়োগে হাইফেন না দিয়ে শব্দগুলিকে জুড়ে লিখলেও আপত্তি নেই। যেমন : -
আগামীকাল পরবর্তীকাল।
২৮.৪০
দুয়ের বেশি শব্দের দ্বন্দ্ব সমাসের ক্ষেত্রে সংযোগ চিহ্ন আবশ্যিক হবে। যেমন : -
তেল নুন-লকড়ি রূপ-রস-শব্দ-গন্ধ-স্পর্শ বাপ-মা-ভাই-বোন হাত-পা- নাক-কান।
২৮.৫০
সমার্থক দুটি শব্দের সমাস হলে তা জুড়ে লেখাই উচিত। যেমন : -
ভেবেচিন্তে বেঁচেবর্তে বিদেশবিভূই কাগজপত্তর বন্ধুবান্ধব রাজাবাদশা ঘরবাড়ি টাকাপয়সা।
২৮.৫১
এ ক্ষেত্রে পরবর্তী শব্দটির গোড়ায় স্বরবর্ণ থাকলে হাইফেন দেওয়া বাঞ্ছনীয়। যেমন : -
রাজা-উজির আমির-ওমরা বিষয়-আশয় জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় ভাদ্র-আশ্বিন।
২৯.০০
নিষেধাত্মক ‘না’ ক্রিয়াপদে ব্যবহৃত হলে 'না'-কে পৃথক লিখতে হবে। যেমন : -
দেব না, বলি না, কোরো না, শুনল না, যেত না।
২৯.১০
কিন্তু নিষেধাত্মক ও অতীতবাচক 'নি' যদি ক্রিয়াপদে যুক্ত হয় তা ক্রিয়ারূপের সঙ্গে জুড়ে লেখাই সংগত; কারণ পূর্বপদের ধ্বনি প্রবাহের ধারাবাহিকতার সঙ্গে পরবর্তী নি যুক্ত- হয়নি করিনি দেখিনি শুনিনি ধরেনি ভাবেনি
২৯.১১
‘ন’' ও ক্রিয়ারূপের সঙ্গে যুক্তভাবে লেখা হোক: যেমন : -
করিনে, যাইনে, ভাবিনে (দ্র৽ ২৯.১০)
২৯.২০
‘না’ যখন অনুজ্ঞায় নির্বন্ধের চিহ্ন, তখন তা ক্রিয়ার সঙ্গে জুড়ে অথবা হাইফেন বসিয়ে লিখতে হবে। যেমন : -
যাওনা যাও-না বলোনা বলো-না দেখোনা-দেখোনা। কারণ এই ‘না’ পূর্ব ক্রিয়াপদকে নাকচ না করে তারই একটা ধরন (aspect) বোঝাচ্ছে, সেদিক থেকে এই ‘না’ সংশ্লিষ্ট ক্রিয়ার অঙ্গ।
৩০.০০
এই প্রসঙ্গে একসঙ্গে ‘এমনকী’ (‘এমনকী আমিও কথাটা বলে ফেলেছি’) এবং পৃথক ‘এমন কী’ (‘এমন কী ভালো খেলল অস্ট্রেলিয়া’)- এ দুয়ের তফাত খেয়াল করা দরকার।
৩০.১০
এইভাবেই প্রভেদ করতে হবে ‘সে কী’ (বিস্ময়বাচক উচ্ছ্বাস) আর ‘সে কি’ (সাধারণ হ্যাঁ না প্রশ্নের কি) এর মধ্যে :
ও এর মধ্যেই চলে গেছে? সে কী?
সে কি কাজটা শেষ করেছে?
৩০.২০
বাংলায় দুরকম ‘কিনা’ প্রচলিত। যেমন, তুমি যাবে কি না? (তুমি যাবে কি যাবে না?)। এখানে কি ও না পৃথক থাকবে। কিন্তু, তুমি যাবে কিনা তাই উশখুশ করছ- এখানে কিনা একসঙ্গে।
৫.৬   বিরতি চিহ্ন ইত্যাদি
আমাদের জীবনে গতি যেমন আছে তেমনি রয়েছে বিরতিরও সংস্থান। কোথাও অতি সংক্ষিপ্ত বিরতি কোথায় একটু দীর্ঘ, কোথাও সাময়িক এবং একসময় পূর্ণ বিরতি। বিরতি আছে বলেই গতির কার্যকারিতা। ব্যাপারটা একটা রেলগাড়ির মতো। গাড়িটি যদি সূচনা-স্টেশন থেকে অভীষ্ট লক্ষ্যের মধ্যিখানে না থেমে কেবলই চলত, তবে তো হাজার হাজার যাত্রীর কোন কাজেই লাগত না। ছোট স্টেশন, বড় স্টেশন, ক্রসিং, জংশন এগুলো আছে বলেই রেল পরিষেবা মানুষের উপকারে লাগে। তেমনি আমরা যদি কেবল বলেই যাই, বিরামবিহীন, বিরতিবিহীন তবে কথা হয়ে উঠত অর্থহীন। লিখনকর্মে রয়েছে বিরতি, কমা, সেমি-কোলন, কোলন, হাইফেন, ড্যাশ এবং দাঁড়ি। তাছাড়াও রয়েছে ঊর্ধ্ব কমা, উদ্ধৃতিচিহ্ন ইত্যাদি। কথা বলার সময় যদিও এগুলো দৃশ্যমান হয় না, তবু আমাদের বলার ভঙ্গি, কণ্ঠস্বরের মডিউলেশন, উচ্চারণের ঝোঁক এ চিহ্নগুলোকে মনশ্চক্ষে দৃশ্যমান করে তোলে বই কি।
লিখনকর্ম শুধু অক্ষরের পাশে অক্ষর বসানোই নয়, অক্ষরগুলোর সাইজ, অক্ষরের উপর মাত্রা দেওয়া বা মাত্রাশূন্য রাখার ব্যাপারটিও আছে। আর আছে সমাসবদ্ধ শব্দকে হাইফেন দিয়ে যুক্ত করা, কিংবা হাইফেন বিহীন একাধিক শব্দকে পাশাপাশি রেখে অসংলগ্ন সমাস গড়ে তোলা, তাছাড়াও কোন্ একপদী শব্দের সঙ্গে আরেকটি শব্দ যুক্ত হবে বা শব্দদুটোর মধ্যিখানে ব্যবধান থাকবে তা নিরূপণ করা। বানান-প্রকরণের সঙ্গে এ সবই নিবিড় ভাবে, সম্পৃক্ত। ‘আমগাছ’, ‘জামগাছ’, ‘তালগাছ’ যুক্ত হলেও ‘নারকেল গাছ’, ‘জামরুল গাছ’ যে আলাদা হয়ে যাবে লিখনকর্মে, ‘কখনো’ আর ‘কখনও’, ‘কোন’ আর ‘কোনও’ যে বিশেষ অর্থবহ এটাও বিবেচনায় রাখতে হবে, বিবেচনায় রাখতে হবে কোথায় বিসর্গ বসবে বা বসবে না।
প্রশ্নবোধক চিহ্ন, আশ্চর্যবোধক চিহ্ন, ত্রিবিন্দু, উদ্ধৃতিচিহ্ন এগুলোর কিন্তু বিধিবদ্ধতা আছে, আর আছে কিছু প্রথাও, যা মুদ্রিত বই দেখেও শিখে নেওয়া সম্ভব যদি এদিকে নজর আকৃষ্ট হয়। আমরা অনেকেই বই পড়ি কিন্তু বই ‘দেখি’ না, অর্থাৎ মুদ্রিত পৃষ্ঠায় চিহ্নগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখা হয় না এদিকে সচেতনতার অভাবে।
বিরাম বা বিরতি চিহ্নের জগতে প্রবেশ করলে দেখব এ জগৎ কম বিস্তৃত নয়, এবং এখানেও যথেষ্ট অনুশীলনের মাধ্যমে শিখে নেবারও অনেক কিছু রয়েছে। উদ্ধৃতিচিহ্ন, বন্ধনী, বক্রাক্ষর, ঊর্ধ্বকমার সমস্যা যেমন আছে, তেমনি রয়েছে কমা ব্যবহারেও বৈশিষ্ট্যও, আমরা এখানে কেবলমাত্র কমা আর প্রশ্নবোধক চিহ্নতেই আলোচনাটি সীমাবদ্ধ রাখব।
কমা : বাংলা কেন, আমাদের জানা পৃথিবীর বোধ হয় সব ক'টি ভাষাতেই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত বিরামচিহ্ন হল কমা। এই কমার প্রয়োগ খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়। সচেতনতার অভাবে অনেকে এ চিহ্নটির ব্যবহার করেন প্রায় ইচ্ছাকৃত ভাবে। যত্রতত্র যেমন-তেমন ভাবেই। এতে বাক্যের বক্তব্যটি পাঠকের কাছে যথাযথ ভাবে পৌঁছতে না পেরে বিপথগামীও হয়। কমার সুচিন্তিত ব্যবহার বাক্যের গতিকে যেমন ত্বরান্বিত করতে পারে, তেমনি অসাবধানী প্রয়োগ বাক্যের গতি ব্যাহতও করে। লক্ষ রাখতে হবে কমা কখনও কখনও অপ্রয়োজনীয়, আবার কখনও অত্যাবশ্যক। এটাও লক্ষণীয় –‘এবং’, ‘আর’ এসবের পূর্বে কমার প্রয়োগ নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়। আবার কতকগুলো অব্যয়ের পর কমা না দিলে বাক্যটা একেবারে খাপছাড়া হয়ে যায়। যেমন, ‘আচ্ছা, তুমি যা চাইছ তাই হবে’, ‘বেশ, বিকেলের আগেই আমরা পৌঁছে যাব’।
এখানে কমা, বন্ধনী আর আশ্চর্যবোধক চিহ্নের প্রয়োগ লক্ষ্য করুন : -
‘দাঁড়াও পথিক-বর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধিস্থলে
(জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি
বিরাম) মহীর পদে মহানিদ্রাবৃত
দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রী মধুসূদন।
যশোরে সাগরদাঁড়ী কবতক্ষ-তীরে
জন্মভূমি, জন্মদাতা দত্ত মহামতি
রাজনারায়ণ নামে, জননী জাহ্নবী।’
সমাধি-লিপি || মাইকেল মধুসূদন দত্ত
‘যে’ দিয়ে সংযোজক বাক্য গঠন করা হলে ‘যে’-র পর কমা আবশ্যক। যেমন : -
‘তিনি, বললেন যে, যারা গতকাল আসতে পারেনি এরা আগামীকাল আসুক।’ প্রত্যক্ষ উক্তিতে (Direct Speach) কমা না দিলে তো বিষয়টি বোঝানোই যাবে না। যেমন : -
তিনি বললেন, ‘আমার দ্বারা ও কাজ হবে না।’
সে বলল, ‘কার এত দুঃসাহস?’
প্রশ্নবোধক চিহ্ন : অনেক সময় বাক্যটি প্রশ্নের মতো, কিন্তু আসলে অনুজ্ঞা। তখন প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিলেই সব মাটি। যেমন : -
‘তোমরা বসছ না কেন গিয়ে’
‘তুমি নিজেই এক গ্লাস জল ভরে খাও না কেন’- এরকম বাক্যে প্রশ্নবোধক চিহ্ন বসবে না, বসবে দাঁড়ি।
ইংরেজিতে যেমন : -
‘Why don't you come this evening’.
‘Why don't you sit down for a while’.
এ বাক্যগুলো তো কিছু জিজ্ঞেস করছে না। নির্দেশ দিচ্ছে।
আবার আরেক ধরনের বাক্য আছে যেখানে প্রশ্নবোধক চিহ্ন দেবার প্রবণতা থাকে অসাবধানী লেখকদের। যেমন-‘তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি এখন কী করবেন’, ‘আমি জানি না কে তাকে এরকম পরামর্শ দিচ্ছে’।
এ প্রসঙ্গটি নিয়ে আরও দীর্ঘ আলোচনা করা সম্ভব এবং প্রাসঙ্গিকও, তবে পাঠ্যক্রমে বিষয়টির অন্তর্ভুক্তির সূচনাতে এর বেশি টেনে নিয়ে যাওয়ার অবকাশ নেই। পাঠকরা মুদ্রিত বই দেখে নিজেরাও এখন অনেক কিছু বের করতে পারবেন যা এতদিন তাঁদের চোখ এড়িয়ে গেছে হয়তো।
অনুশীলনী
(ক)
  • বানান বলতে কী বোঝায়?
  • বানান কি অপরিবর্তনীয় কিছু, না পরিবর্তন সাপেক্ষ?
  • কোন্ ভাষার বানান প্রকরণে আর কোনও পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই?
  • প্রাক্-মুদ্রণ যুগের বাংলা বানান কী রকম ছিল?
  • বাংলায় ‘ব’ (পেটকাটা র) কেন, কবে, কার হাতে ‘র’ (নিচে বিন্দু দিয়ে)-তে রূপান্তরিত হল?
  • ‘বাঙালি’ শব্দটি কত রকম লেখা হত? এখন কী ভাবে লেখা সঙ্গত আপনি মনে করেন?
  • বাংলা বানান সংস্কারের জন্য কবে, কারা অগ্রণীর ভূমিকা নিয়েছিলেন?
  • রবীন্দ্রনাথ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানাননীতি কি মেনে নিয়েছেন? তিনি কি লিখন অভ্যাসকে পাল্টে নিতে রাজি ছিলেন?
  • মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, 'বাঙ্গালীর লেখায় আর পড়ায় ঠিক নাই'। এর স্বপক্ষে কী উদাহরণ দিয়েছিলেন তিনি?
  • বাংলা ভাষায় বানানের সমতা আনার প্রয়োজন কেন?
  • কোন্ কোন্ বিশেষ প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বানান-রীতি রয়েছে যা অন্যের সঙ্গে মাঝে মাঝে মেলে না?
  • আসামে বাংলা পাঠ্যপুস্তক, পত্রপত্রিকায় কী কী বানান বিভ্রম সচরাচর চোখে পড়ে?
  • বাংলা বানানবিভ্রমের জন্য কা’কে মূলত দায়ি করা যায়?
  • কমপিউটার প্রযুক্তি বাংলা লিখন-জগতের কাছে কী দাবি করছে?
  • ‘বানান অভিধান’ বলতে কী বোঝায়?
(খ)
  • কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান বিধিতে ‘তৎসম’ শব্দের বানান সম্বন্ধে কী বলা হয়েছে?
  • আরবি ফরাসি শব্দের বানানে ন/ণ, স/ষ, w / x -এর প্রয়োগ সম্পর্কে ওই বানানবিধিতে কী বলা হয়েছে?
  • খ্রিষ্টাব্দ/খ্রিস্টাব্দ/খৃষ্টাব্দ/খ্রীস্টাব্দ/খ্রীষ্টাব্দ/খৃস্টাব্দ এই ৬ ধরনের বানানের মধ্যে কোন বানানটি প্রমিত বানান হিসেবে গ্রাহ্য?
  • এতদিন পাখি, হাতি, বাড়ি, গাড়ি কোন যুক্তিতে এতে হ্রস্ব-ই দেওয়া হয়? বানানগুলো দীর্ঘ-ই কার দিয়ে লেখা হত।
  • ভট্টাচার্য, কার্তিক বানান সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ কী বলেছেন? নিজস্ব লিখনকর্মে কবিগুরু কি সংশোধিত (প্রমিত) বানান লেখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন?

দ্বিতীয় পত্র
অধ্যায় - 
বানান