2022
report-2025-header
শ্রদ্ধাস্পদ সভাপতি সম্মানিত অতিথি ও প্রতিনিধিবৃন্দ,

বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের এই ৪৩তম কেন্দ্রীয় বার্ষিক সাধারণ সভায় সমাগত আপনাদের প্রত্যেককে জানাচ্ছি স্বাগত অভিবাদন, আন্তরিক প্রীতি ও নমস্কার।

সুধী,

বরাক উপত্যকার উত্তরাঞ্চলের ঐতিহ্যমন্ডিত এলাকা বড়খলায় এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সম্মেলনের ৪৩তম কেন্দ্রীয় বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই উপত্যকার ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, বৌদ্ধিক এবং সমাজ উত্তরণের প্রক্রিয়ায় বড়খলা এক বন্দিত নাম। ইংরেজ শাসনের পূর্বে ডিমাসা রাজত্বকালে মাইবং ও খাসপুরের রাজধানীর ছত্রছায়ায় বড়খলা অঞ্চলের বিকাশ পর্ব ছন্দময় হয়ে উঠেছিল। ১৭৩৬ খ্রিস্টাব্দে, ১৬৫৮ শকাব্দের সনদপত্রে বড়খলার কথা আমরা পেয়েছি। পদ্মনাথ বিদ্যাবিনোদ সম্পাদিত ‘হেড়ম্ব রাজ্যের দন্ডবিধি’ গ্রন্থেও এই জনপদের অস্তিত্বের উল্লেখ রয়েছে। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে উপেন্দ্রনাথ গুহ তাঁর ‘কাছাড়ের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থেও বড়খলার কথা লিখেছেন। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও সমাজ গবেষক জয়ন্ত ভূষণ ভট্টাচার্য, সুজিৎ চৌধুরী, নলিলেন্দ্র বর্মন, সঞ্জীব দেবলস্করের বিভিন্ন গ্রন্থ প্রবন্ধ ও পুস্তিকায় বড়খলার উল্লেখ রয়েছে । প্রাক ব্রিটিশ শাসন পর্বে ডিমাসা রাজসভার যুগে বাংলা ভাষাই এই উপত্যকার সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃত ছিল। মাইবঙের রাজধানী থেকে মহারাজ কীর্তিচন্দ্র প্রদত্ত সমতল কাছাড়র উজির নিয়োগ পত্র তার অন্যতম সাক্ষ্য বহন করছে। শতাব্দী প্রাচীন বিভিন্ন দেবালয় এবং মহারাজ গোবিন্দ চন্দ্রের নামে উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় বড়খলার গৌরবের স্মারক হয়ে রয়েছে। বিভিন্ন ভাষা ও ধর্মের সমন্বিত চিন্তার অন্যতম কেন্দ্রভূমি এই বড়খলা। জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের দিনগুলোতে এ অঞ্চলের অংশগ্রহণ স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। প্রণম্য স্বাধীনতা সংগ্রামী যতীন্দ্রমোহন দেবলস্কর, ইরফান মিঞা বড়ভূঁইয়া, রমেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য, নলিনী কুমার শর্মা, চৈতন্যচরণ নাথ, সূর্যমণি রায়, অবন্তী কুমার শর্মা, শরৎচন্দ্র মজুমদার, হুরমত আলি বড়লস্কর, মনিন্দ্র চন্দ্র বর্মন, সুরেশ চন্দ্র বর্মন, মজিদ আলী মজুমদার, গৌড় নিতাই সিং, ব্রহ্মময়ী রাহা, মজিবুর রহমান বড়ভূঁইয়া, তারাচরণ চক্রবর্তী, মুন্সি ওয়াজিদ আলী প্রমুখ ব্যক্তিত্বদের নাম আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়। ৬১ এবং তার পরবর্তী সময়ে উপত্যকার আত্মপরিচয় রক্ষায় ভাষা আন্দোলনে এ অঞ্চলের বিভিন্ন স্তরের জনগণ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের প্রভাবে এ অঞ্চল থেকে সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব লেখক, শিল্পী, শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মীর আত্মপ্রকাশ আমরা দেখতে পাই, যাঁরা বিভিন্ন সময়ে উল্লেখযোগ্যভাবে কাজ করে আসছেন।

সুপ্রিয়,

দেশের মুক্তি সংগ্রামীরা যে স্বাধীন অখন্ড ভারতের স্বপ্ন দেখে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন, দিয়েছিলেন আত্মাহুতি তাদের প্রত্যাশাকে দলিত করে ক্ষমতার বাটোয়ারা করতে গিয়ে দেশটার বুক চিড়ে ভাগ করে দেওয়ার অনিবার্য পরিণতিতে এই খন্ডিত ভূমির বাঙালির জীবনে নেমে এসেছিল বিপর্যয়। স্বাধীনতার ঊষালগ্ন থেকেই আসামে বিদ্বেষ প্রসূত ধারাবাহিক রাজনীতি জাতির জীবনে নিয়ে আসে ভয়ংকর দুর্যোগের ঘনঘটা। ভারতীয় সংবিধান যেখানে দেশের প্রতিটি ভাষা, জাতি ও ধর্মের মানুষকে গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে বেঁচে বর্তে থাকার সংস্থান করে দিয়েছিল সেখানে তাকে উপেক্ষা করে এ রাজ্যে বাঙালির জাতিগত আত্মপরিচয়, ভাষা সংস্কৃতি চর্চা ও মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের অধিকার কেড়ে নেবার চেষ্টার সঙ্গে পর্যায়ক্রমে সংযোজিত হয়েছে অর্থনৈতিক, নাগরিকত্ব এবং হালে আসাম চুক্তির ৬ নং দফা রূপায়ণের নামে জমির অধিকার খর্ব করার উদ্যম। সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে আসামে দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতি গোষ্ঠী হওয়া সত্ত্বেও ভূমিপুত্র শব্দবন্ধকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে অখন্ড বাঙালি সত্তাকে অধিকারহারা, পরিচয়হীন জনমণ্ডলীতে রূপান্তরিত করতে বহুমাত্রায় চলমান তৎপরতা এখন সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। এই সংকটে সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব, মোহগ্রস্ত আবেশ ঝেড়ে প্রত্যয়ী মনোভাব নিয়ে অধিকার আদায়ে যুতবদ্ধ হওয়া সময়ের আহবান হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সংশয়ের আবর্তে ভবিষ্যৎ

আসাম কোনকালেই এক ভাষা সংস্কৃতির রাজ্য ছিল না। বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর অংশীদারিত্বে এ রাজ্য পল্লবিত হয়েছে ।১৮৭৪ সালে ব্রিটিশ সরকার আসামকে অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বনির্ভরশীল করে তোলার জন্য অবিভক্ত সুরমা উপত্যকার সিলেট ও কাছাড় এবং গোয়ালপাড়া জেলাকে স্থানীয় বাসিন্দা বাঙালিদের তীব্র আপত্তি অগ্রাহ্য করে এ রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করেছিল। পরে বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে এ অঞ্চলের বিকাশে এই সংযোজিত ভূমির বাঙালি এবং ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় আগে থেকেই বসবাস করা এই জনগোষ্ঠীর মানুষ সদর্থক ভূমিকা নিয়েছিল । তবে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বাঙালিকে অবদমিত করে রাখার মানসিকতার স্ফুরণ ঘটেছিল মুক্তি সংগ্রামের দিনগুলোতেই। যার পরিণতিতে ৪৭ সালের ৬ ও ৭ জুলাই গণভোটের নামে কুটিল রাজনৈতিক চক্রান্তে সিলেটকে পাকিস্তানে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। এরপরই স্বাধীন ভারতে এ রাজ্যের প্রথম রাজ্যপাল স্যার আলি আকবর হাইদরি সরকারি মনোভাবের জানান দিয়ে বলেছিলেন, আসামের কর্তৃত্ব থাকবে কেবল অসমীয়দের হাতেই। সরকারি ভাষা, শিক্ষার মাধ্যম, পঠন-পাঠনের বিষয় ইত্যাদি প্রশ্নে সরকারি মনোভাবের প্রতিফলন ঘটতে শুরু করেছিল। কালক্রমে তা অর্থনৈতিক অধিকার সংকুচিত করার পর্যায়ে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু এতেও যখন আকাঙ্ক্ষার পরিতৃপ্তি হয়নি তখন এ রাজ্যের ভারতীয় বাঙালিদের পিঠে বিদেশি তকমা সেটে নাগরিকত্বের অধিকার কেড়ে নেবার জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে প্রকারান্তরে বার্তা দেওয়া হয় রাজ্যের বৃহত্তর পরিসরে বাঙালি অনাকাঙ্ক্ষিত। ১৬শ কোটি টাকা ব্যয় করে দেশের শীর্ষ আদালতের তত্বাবধানে ১৯৫১ সালের জাতীয় নাগরিক পঞ্জি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চকে ভিত্তি ধরে নবায়িত করা হলেও তা সরকারিভাবে গ্রহণ করা হয়নি। এখন এন আর সির চূড়ান্ত খসড়া তালিকা পুনঃপরীক্ষার ফরমান জারি করা হয়েছে। পাশাপাশি গোটা দেশের মধ্যে শুধু এই রাজ্যেই সরকারি কোষাগারের বিপুল অর্থ ব্যয় করে গোয়ালপাড়ার মাটিয়াতে গড়ে তোলা হয়েছে বৃহৎ আকারের স্থায়ী ডিটেনশন ক্যাম্প। রাষ্ট্রগঠন, বিকাশ এবং রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে এ রাজ্যের বাঙালিদের অবস্থান স্পষ্ট হওয়া সত্বেও তাদের ভাষা, কৃষ্টি -সংস্কৃতির সুরক্ষা, মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিসরে কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশা পূরণের পরিবর্তে কার্যত এই জাতি গোষ্ঠীকে প্রান্তিকায়িত অবস্থায় ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। অসমীয়া সহ অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গে শ্রদ্ধা ও মর্যাদার সম্পর্ক রাখা হলেও এ রাজ্যের বাঙালির বর্তমান ও উত্তর প্রজন্মের ভবিষ্যৎ সংশয়ের আবর্তে চলে গেছে। বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন এই ৪৩ তম কেন্দ্রীয় বার্ষিক সাধারণ সভা সমাগত প্রতিনিধি এবং স্ব-জনগোষ্ঠীর লোকদের এই প্রেক্ষাপটে আত্মবিশ্লেষণে এগিয়ে আসা জরুরী মনে করছে।

বছরজুড়ে নানা কার্যক্রম

২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে শ্রীভূমিতে অনুষ্ঠিত ৩০তম কেন্দ্রীয় অধিবেশন এবং ৪২তম বার্ষিক সাধারণ সভার পর বিগত এক বছরের বেশি সময়কালে সম্মেলন কেন্দ্র থেকে জেলা ও আঞ্চলিক স্তরে নানা কার্যক্রম নিয়ে কর্মতৎপর ছিল। গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি ঘটনা প্রবাহে কেন্দ্রীয় সমিতি তার সুচিন্তিত বক্তব্য সরকার ও জনসাধারণের সামনে উত্থাপন করে দায়িত্বশীল সামাজিক সংগঠনের পরিচয় তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। বিগত বছরগুলোর নানা কর্মকাণ্ডে এই সম্মেলন, যা সাধারণভাবে বরাকবঙ্গ নামেই পরিচিতি লাভ করেছে, আজ জনমানসে গভীর আস্থার জায়গায় রয়েছে।

মুজতবা আলি সাহিত্য উৎসব

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য বরাক উপত্যকার সুসন্তান বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলিকে সম্মেলন দীর্ঘদিন থেকেই স্মরণ করে অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করে আসছে। গত ১৩ ও ১৪ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় সাহিত্য উপ-সমিতির আহবানে এবং শ্রীভূমি জেলা সমিতির ব্যবস্থাপনায় শ্রীভূমির বিপিনচন্দ্র পাল স্মৃতি মিলনায়তনে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে মুজতবা আলি সাহিত্য উৎসব উদযাপিত হয়। উদ্বোধনী পর্বে করিমগঞ্জ কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বিশিষ্ট আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে মুজতবার জীবন ও সাহিত্যের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে মুজতবার আত্মজা শামিমুর রাজা চৌধুরীও উপস্থিত থেকে তার অনুভব ব্যক্ত করেন। উৎসবের সমাপ্তিপর্বে ‘সৈয়দ মুজতবা আলির অখণ্ড বাঙালি চেতনা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য তপোধীর ভট্টাচার্য। তিনি তার দীর্ঘ সুচিন্তিত কথনে বলেন, মুজতবা ধর্মের পরিচয় বাঙালি জাতিসত্তার বিভাজন চান নি। অথচ আজকে ধর্মের আধারে বাঙালিকে বিভাজিত করে রাখার আত্মঘাতী প্রয়াস চলছে। আর এই পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে বাঙালির শিকড় উৎপাটনের জন্য নানা ছলায় ছড়ানো হচ্ছে বিভ্রান্তি।

সঞ্জীব দেবলাস্করের সঞ্চালনায় এই আলোচনায় অংশ নেন বিশিষ্ট ইতিহাস গবেষক বিবেকানন্দ মোহন্ত। ওই দিনের দ্বিতীয় পর্বে মুজতবা আলির রচনা এবং স্বরচিত কবিতা পাঠের এক মনোগ্রাহী আসর বসেছিল। শ্রীভূমি জেলা সমিতির সভাপতি অরবিন্দ পালের পৌরোহিত্যে ওই কার্যক্রমে উপত্যকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কবি লেখক ও সাহিত্য অনুরাগীরা উপস্থিত ছিলেন।

শারদ সাহিত্য, পত্রিকা নিয়ে লেখক সমাবেশ

এই উপত্যকার সাহিত্যচর্চায় বিভিন্ন লিটিল ম্যাগাজিনের শারদ সংখ্যা এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। ওই পত্রিকা প্রকাশকে কেন্দ্র করে কবি, লেখক এবং সাহিত্য অনুরাগীদের মধ্যে প্রবল উৎসাহ দেখা যায় । এই গোটা বিষয়টিকে একটি মঞ্চে তুলে এনে পারস্পারিক পরিচয়, অনুভব প্রকাশ এবং পর্যালোচনার এক সুন্দর আসর বসেছিল গত সাত অক্টোবর। সম্মেলনের কেন্দ্রীয় সমিতির প্রস্তাবে এবং কাছাড় জেলা সমিতির ব্যবস্থাপনায় শিলচর বঙ্গভবনের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপত্যকার তিন জেলার শারদ পত্রিকাগুলোর সম্পাদক, ব্যবস্থাপক এবং কবি গল্পকার ও প্রাবন্ধিকরা জমায়েত হয়েছিলেন। এদের সবাইকে উত্তরীয় দিয়ে বরণ করে তাদের নিরলস সাহিত্য সাধনার প্রতি সম্মান জানানো হয়। প্রথমবারের মতো আয়োজিত শারদ সাহিত্য নিয়ে এই অনুষ্ঠান উপত্যকার লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক ও লেখকদের মধ্যে যথেষ্ট উৎসাহ সৃষ্টি করে।

ভাষিক গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ে ভাষা গৌরব অনুষ্ঠান

গত বছর কেন্দ্রীয় সরকার বাংলা এবং অসমীয়া ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি দিয়েছেন। এই সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানাতে গত নভেম্বরে আসাম সরকার রাজ্যে ভাষা গৌরব সপ্তাহ উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেন। রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী রণোজ পেগু সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অন্যান্য সাহিত্য সংগঠনের সঙ্গে বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনকেও একদিনের কার্যক্রম হাতে নেওয়ার জন্য চিঠি পাঠান। এতে সাড়া দিয়ে সম্মেলন গত ৮ নভেম্বর শিলচর বঙ্গভবনে কেন্দ্রীয়ভাবে বিভিন্ন ভাষা গোষ্ঠীর সাহিত্য সংগঠনগুলোর কর্মকর্তাদের আমন্ত্রণ করে এনে পারস্পরিক মতবিনিময়, আলোচনা এবং সাহিত্য পাঠের আয়োজন করে। এতে অসম সাহিত্য সভা, মনিপুরী সাহিত্য পরিষদ, বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী সাহিত্য পরিষদ, ডিমাসা সাহিত্য সভা ও বরাক উপত্যকা হিন্দি সাহিত্য সমিতির কর্মকর্তা ও লেখকরা উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনের প্রবীণ ব্যক্তিত্বদের উপস্থিতিতে এই অনুষ্ঠান বিভিন্ন ভাষিকগুলোর সঙ্গে সম্মেলনের পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

বিজিতকুমার ভট্টাচার্য স্মরণে ভাষা আলোচনা ও বানান কর্মশালা

বাংলা ভাষা চর্চার অধিকার সংরক্ষণের প্রশ্নে ভাষা দূষণ এবং বানান বিধি নিয়ে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা আবশ্যক। এই বিষয়টি মাথায় রেখে সম্মেলনের কেন্দ্রীয় সমিতির সহযোগিতায় কাছাড় জেলা সমিতি গত ১৪-১৫ ডিসেম্বর ২০২৪এ শিলচর বঙ্গভবনে আয়োজন করেছিল ঈশান বাংলার সাহিত্য ও ভাষা চর্চার অন্যতম বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব প্রয়াত বিজিত কুমার ভট্টাচার্য স্মরণে বক্তৃতা এবং বানান বিধি নিয়ে কর্মশালা। ১৪ ডিসেম্বর বঙ্গভবনের ভাষা শহীদ স্মৃতিমঞ্চে ‘ভাষা দূষণ এবং মাতৃভাষার বিপন্নতা’ শীর্ষক আলোচনা কার্যক্রমে মুখ্য বক্তা রূপে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট ভাষা তাত্বিক ও লেখক, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য পবিত্র সরকার। মাতৃভাষা চর্চার বর্তমান স্থিতি এবং তার ভবিষ্যৎ নিয়ে সারগর্ভ বক্তব্য বক্তব্য রাখেন পবিত্র সরকার। পরদিন বানান বিধি নিয়ে কর্মশালায়ও মুখ্য নির্দেশক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পবিত্রবাবুই। এই আলোচনা চক্র এবং বানান কর্মশালায় নবীন প্রবীণ সবার স্বতস্ফূর্ত উপস্থিতি অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রাসঙ্গিকতাকে মূর্ত করে তুলেছে।

উইকিমিডিয়াতে বরাকের সাহিত্য তুলে ধরতে উদ্যোগ

বরাক উপত্যকার ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতির মূল্যবান গ্রন্থ দলিল দস্তাবেজ সারা বিশ্বের পাঠক সমাজের কাছে তুলে ধরতে উইকিমিডিয়ার সঙ্গে সহযোগিতার এক উদ্যোগ নিয়েছে সম্মেলন। এক্ষেত্রে উইকিমিডিয়া ইউজার্স গ্রুপের পশ্চিমবঙ্গ অধ্যায়ের অন্যতম ব্যবস্থাপক তন্ময় বীরের সঙ্গে সম্মেলনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদকের মতবিনিময়ের পর গ্রন্থগুলো ডিজিটাইজেশন বা আন্তর্জালিকরণের প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এরই অঙ্গ হিসেবে গত ২১ ও ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ শিলচরে কাছাড় জেলা সমিতি ও শ্রীভূমিতে শ্রীভূমি জেলা সমিতির ব্যবস্থাপনায় দুটি আলোচনা চক্র আয়োজন করা হয়। এতে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ। দুটি স্থানে উইকিমিডিয়ার কাজকর্ম, গ্রন্থ আন্তর্জালিকরণ এবং আনুষাঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করেন উইকিমিডিয়ার পশ্চিমবঙ্গ ইউজারস গ্রুপের তন্ময় বীর ও বোধিসত্ত্ব মন্ডল। এই আলোচনা চক্রে সম্মেলনের পক্ষে শিলচরে বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় সমিতির সাধারণ সম্পাদক গৌতম প্রসাদ দত্ত ও কাছাড় জেলা সমিতির সভাপতি সঞ্জীব দেব লস্কর এবং করিমগঞ্জের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক সব্যসাচী রায়। দুটি স্থানে আলোচনার সঞ্চালনায় ছিলেন মিলন উদ্দিন লস্কর ও সৌমিত্র পাল । আগামী দিনে এই আন্তর্জাতিকরণ প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা হাতে নেওয়া আবশ্যক।

এ রাজ্যে বাঙালিরাও ভূমিপুত্র, করালো দাবি সম্মেলনের

আসাম চুক্তির ৬ নং দফা রুপায়নের জন্য বিপ্লব শর্মা কমিটির সুপারিশ কার্যকর করতে গিয়ে ভূমিপুত্রদের সুরক্ষার নামে এ রাজ্যে বসবাসকারী দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী বাঙালির সংবিধান প্রদত্ত অধিকারগুলো ঘুরপথে খর্ব করার যে প্রণালী চেষ্টা চলছে তার বিরুদ্ধে বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন জড়ালো প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। গত ২১ নভেম্বর ২০২৪, দিসপুর জনতা ভবনে রাজ্যের শিক্ষা মন্ত্রী রনোজ পেগু আহুত বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বৈঠকে আমন্ত্রিত সম্মেলনের সাধারণ সম্পাদকের পক্ষে সব্যসাচী রুদ্রগুপ্ত জোরালোভাবে বরাকবঙ্গের অবস্থান তুলে ধরেন। শিক্ষামন্ত্রী এবং সরকারের উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা সাধারণ সম্পাদক স্বাক্ষরিত সম্মেলনের দাবিপত্র গ্রহণ করে এ সম্পর্কে সব্যসাচী রুদ্রগুপ্তের বক্তব্য শুনলেও কোনও প্রতিশ্রুতি দেননি। এরপরই ২৬ নভেম্বর শিলচরে সম্মেলনের তরফে এক সাংবাদিক সম্মেলন আহ্বান করে সাধারণ সম্পাদক গৌতম প্রসাদ দত্ত বলেন,২০১৯ সালে আসাম চুক্তির ৬ নং দফা বাস্তবায়নের জন্য গঠিত বিপ্লব শর্মা কমিটির কাছে পাঠানো লিখিত অভিমত এবং শিলচরে এ সংক্রান্ত শুনানি কালে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, যে অখন্ড ভারতের বাসিন্দা বাঙালিরা ১৮৭৪ থেকে এ রাজ্যে স্থায়ীভাবে বাস করছেন। স্বাধীনতার আন্দোলনের দিনগুলোতে এবং পরবর্তী সময়ে এ রাজ্যের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে বাঙালিরাও সমানভাবে অংশীদার। এই ঐতিহাসিক সত্য উপেক্ষা করে সরকারি -বেসরকারি নিযুক্তি, অনুদান বন্টন এবং জমির অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করার নানা কুটকৌশল চলছে। নিযুক্তির ক্ষেত্রে বাঙালির দরজা প্রায় রুদ্ধ হয়ে গেছে। এর ফলে যে জনসন্তুোষ দেখা দিয়েছে সে ব্যাপারে বাঙালি রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বিশেষ করে বরাকের নেতারা প্রত্যাশিত মাত্রায় সোচ্চার নন। এই পরিবেশ দীর্ঘদিন অব্যাহত থাকলে বিভিন্নভাবে তার প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে বলে সম্মেলন আশঙ্কা করছে। তাই নিযুক্তি, আর্থিক সহায়তা এবং জমির অধিকারের ক্ষেত্রে অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বাঙালিকেও সংরক্ষণের আওতায় আনার ব্যবস্থা করা উচিত। এ ব্যাপারে সহানুভূতিশীল মনোভাব নিয়ে সরকার এগিয়ে আসবে বলে সম্মেলন প্রত্যাশা রাখছে। এই সাংবাদিক সম্মেলনে সংগঠনের তরফে দুই কেন্দ্রীয় সহ- সভাপতি সুবীর রায় চৌধুরী ও মানিক চক্রবর্তী কাছাড় জেলা সভাপতি সঞ্জীব দেবলস্কর, গুয়াহাটিতে সাধারণ সম্পাদকের প্রতিনিধি সব্যসাচী রুদ্রগুপ্ত, সম্মেলনের দূর -শিক্ষা কেন্দ্রের সঞ্চালক পরিতোষ চন্দ্র দত্ত, কেন্দ্রীয় কোষাধ্যক্ষ আশিস চৌধুরী, সহ-সম্পাদক মিলন উদ্দিন লস্কর, সাহিত্য সম্পাদক দীপক সেনগুপ্ত, সাংগঠনিক উপ-সমিতির আব্বায়ক অনিল পাল, কাছাড় জেলা সম্পাদক উত্তম কুমার সাহা সহ সংগঠনের অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

বরাকের আর্থিক বিকাশে আকাদেমি পত্রিকা

সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষাক্ষেত্রে চর্চা ও আত্মপরিচয়ের অধিকার রক্ষায় তৎপর বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন অর্থনৈতিক বিষয়ে নিজস্ব ভাবনার কথা সময়ে সময়ে ব্যক্ত করে আসছে। তারই সূত্র ধরে আমাদের সাম্প্রতিক আকাদেমি পত্রিকার সংখ্যা অর্থনৈতিক বিষয়ে নিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে। ২০২৪ সালে করিমগঞ্জ অনুষ্ঠিত সম্মেলনের ৩০ তম কেন্দ্রীয় অধিবেশনে আনন্দবাজার পত্রিকার বিশিষ্ট সাংবাদিক সেমন্তী ঘোষের হাত ধরে পত্রিকাটির উন্মোচন হয়েছিল। গত ১৯ মার্চ শিলচর বঙ্গভবনে পত্রিকাটির আনুষ্ঠানিক উন্মোচন করেন বরাক উপত্যকা উন্নয়ন দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী কৌশিক রায়। তিনি বরাকের উন্নয়নে সম্মেলনের ভাবনা-চিন্তার এই তৎপরতাকে প্রশংসা করে বলেন, সরকার এই উপত্যকার সার্বিক বিকাশের জন্য আন্তরিক প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। পরিকাঠামগত উন্নয়নের সঙ্গে শিল্প স্থাপনের জন্য লগ্নি আনোয়নে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরীর জন্য ক্রমাগত সচেষ্ট। এ অঞ্চলের আর্থিক চিত্রের আমল পরিবর্তনে তিনি বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন সহ গোটা সুশীল সমাজের সহযোগিতা কামনা করেন।

মনিপুরী সাহিত্য পরিষদের আসাম রাজ্য সম্মেলনে আমন্ত্রিত সম্মেলন

বরাক উপত্যকায় বসবাসকারী বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করে পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের যে প্রয়াস সম্মেলন দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে আসছে অন্যান্য জনগোষ্ঠী তাকে অভিনন্দন জানিয়েছে। এই সুসম্পর্কের অঙ্গ হিসেবে ৪, ৫ ও ৬ এপ্রিল ২০২৫ এ কাছাড় জেলার বিন্নাকান্দিতে মনিপুরী সাহিত্য পরিষদ, আসামের ৬২তম বার্ষিক সম্মেলনে বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন আমন্ত্রিত হয়েছিল। সাহিত্য পরিষদের সম্মেলন উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকায় কেন্দ্রীয় সভাপতি রাধিকারঞ্জন চক্রবর্তী শুভেচ্ছা বাণী প্রকাশিত হয়েছে। অন্যদিকে প্রকাশ্য অধিবেশনে সম্মেলনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক গৌতম প্রসাদ দত্ত অন্যতম নির্দিষ্ট বক্তা হিসাবে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। বাঙালি এবং মনিপুরী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরিতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে সুদীর্ঘকাল ধরে দুটি প্রতিবেশী জনগোষ্ঠীর সুসম্পর্কের ধারাগুলো সাধারণ সম্পাদক তার বক্তব্যে তুলে ধরেন। আগামী দিনেও এই দুই জনগোষ্ঠী পারস্পারিক শ্রদ্ধা ও সমমর্যাদার ভিত্তিতে কাজ করে যাবে বলে সাধারণ সম্পাদক আশা ব্যক্ত করেন। আসাম সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত মনিপুরী লেখক ও বোদ্ধাজন প্রকাশ্য অধিবেশনে তাঁদের বক্তব্যে বরাকবঙ্গের এই অবস্থানের সপ্রশংস উল্লেখ করেছেন।

কলকাতা অধ্যায় নিয়মিতভাবে কাজ করে যাচ্ছে

২০২২ সালে সম্মেলনের কলকাতা অধ্যায় যাত্রা শুরু করেছিল। তারপর থেকেই রণবীর পুরকায়স্থ ও শান্তনু গঙ্গারিডির নেতৃত্বে অধ্যায় কাজ করে চলেছে। প্রতিবছর কলকাতা মহানগরে সম্মেলনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও ১৯ মে নানা অনুষ্ঠানে উদযাপন করে চলেছে। পাশাপাশি গত ২৫ নভেম্বর ২০২৪ পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমি পরিচালিত জীবনানন্দ সভাঘরে আয়োজন করেছিল এক মনোজ্ঞ কবিতা সন্ধ্যা। এতে বরাকমূলের যেসব কবি ও সাহিত্যুরাগী বর্তমানে কলকাতা ও শহরতলীতে বসবাস করছেন তাদের অনেকে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। পাশাপাশি বরাক উপত্যকার প্রতি আগ্রহী অন্যান্য ব্যক্তিরাও অনুষ্ঠানে হাজির থেকেছেন।

বিনীত



৭ আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২২ জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
বড়খলা, কাছাড়, আসাম।
signature
(গৌতম প্রসাদ দত্ত)
সাধারণ সম্পাদক
কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহক সমিতি
বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন



৭ আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২২ জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
বড়খলা, কাছাড়, আসাম।
signature
(গৌতম প্রসাদ দত্ত)
সাধারণ সম্পাদক
কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহক সমিতি
বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন