বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের এই ৩০তম কেন্দ্রীয় দ্বি-বার্ষিক অধিবেশনে আয়োজিত ৪২তম কেন্দ্রীয় বার্ষিক সাধারণ সভা ও অন্যান্য কার্যক্রমে সমাগত আপনাদের প্রত্যেককে জানাই স্বাগত অভিবাদন, আন্তরিক প্রীতি ও নমস্কার।
সুধী,আজ থেকে ১১১ বছর আগে আসামের অবিভক্ত সুরমা উপত্যকার এই করিমগঞ্জ শহরে (১৩১৯ বঙ্গাব্দ-১৯১২ খ্রিঃ) বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা, তার বিকাশ এবং বাঙালি জাতিসত্তার পরিচয় রক্ষায় ‘দেবীযুদ্ধ’ কাব্যের প্রণেতা, ওই সময়ের সর্বজনশ্রদ্ধেয় কবি শরচ্চন্দ্র চৌধুরীর পৌরোহিত্যে অনুষ্ঠিত ‘সুরমা সাহিত্য সম্মিলনী’ আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেছিল। ওই বৌদ্ধিক উদ্যমের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার নিয়ে এবং একষট্টির রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনের বহমান ধারায় আসামের বাঙালির সার্বিক আত্মপরিচয় এবং অধিকার রক্ষায় ভবিষ্যদদ্রষ্টা চিন্তকদের হাত ধরে ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ, ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে শিলচরের মাটিতে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল ‘কাছাড় বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন’। কালের যাত্রায় এই কেন্দ্রীয় বৌদ্ধিক মঞ্চ ‘বরাত উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন’ নামে পল্লবিত হয়ে আটচল্লিশ বছরে পা দিয়েছে। মাতৃভাষার অধিকারের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং শিক্ষার বিকাশ ও সমৃদ্ধি। কিন্তু এই অধিকার সুকৌশলে খর্ব করতে এ রাজ্যে চলছে বহুমাত্রিক আগ্রাসন। এই উপত্যকায় বাংলা ভাষার অর্জিত অধিকারের সুরক্ষা, আঞ্চলিক ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা এবং বিকাশ, বাংলা ভাষাশিক্ষা প্রদান, সৃষ্টিশীল উদ্যমগুলোকে উৎসাহ দিতে সহযোগিতা, উপেক্ষিত-অবহেলিত এই অঞ্চলের পরিকাঠামো উন্নয়ন, আর্থিক বিকাশ এবং স্বাধিকার, নাগরিকত্বের অধিকার রক্ষায় ধারাবাহিকভাবে নিরলস প্রয়াস চালিয়ে ‘বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন’ আজ শুধু বরাক উপত্যকাই নয়, আসামের রাজ্য পরিসর সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলেও এক সম্মানের জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। এই পথচলায় যে-সব বরেণ্য ব্যক্তিত্ব আমাদের আলোকবর্তিকা, সে-সব মহান ব্যক্তিত্বকে আজ আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।
সুপ্রিয়,ক্ষমতার বাটোয়ারা করতে গিয়ে অখণ্ড ভারতের বুক চিরে দেশটাকে ভাগ করে দেওয়ার অনিবার্য পরিণতিতে এই খণ্ডিত ভূমিতে বাঙালির জাতীয় জীবনে নেমে এসেছিল বিপন্নতা। আসামে জাতিবিদ্বেষ-প্রসূত রাজনীতি সেই বিপন্নতাকে ভয়ঙ্কর দুর্যোগে রূপান্তরিত করে। জাতির আত্মপরিচয় এবং মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে বেঁচেবর্তে থাকার সংবিধানসম্মত আকাঙ্ক্ষাকে দলিত করে শেকড়টা উপড়ে ফেলতে স্বাধীনতার উষালগ্নেই সুবিন্যস্ত ছক সাজিয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তী দশকগুলোতে এটা ক্রমান্বয়ে বীভৎস চেহারা নিয়েছে। জাতিসত্তা, ভাষা-সংস্কৃতি চর্চা ও মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের অধিকার কেড়ে নেবার চেষ্টার সঙ্গে পর্যায়ক্রমে সংযোজিত হয়েছে অর্থনৈতিক, নাগরিকত্ব এবং হালে জমির অধিকার খর্ব করার উদ্যম। আসামে দ্বিতীয় বৃহত্তম গরিষ্ঠ জাতিগোষ্ঠী হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় সংবিধান-বহির্ভূত ‘ভূমিপুত্র’ শব্দবন্ধে অখণ্ড বাঙালি সত্তাকে অধিকারহারা জনমণ্ডলীতে রূপান্তরিত করতে চলছে সর্বগ্রাসী তৎপরতা।
আসলে বাংলার রাষ্ট্রসীমা থেকে সুরমা উপত্যকাকে নির্বাসন দেওয়ার পরই বিপন্নতা হয় আমাদের নিত্যসঙ্গী। ব্রিটিশ সরকার আসামকে একটি আর্থিক স্বনির্ভর রাজ্য হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে অবিভক্ত কাছাড়, সিলেট ও গোয়ালপাড়া জেলাকে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি থেকে সরিয়ে এনে পুনর্গঠিত এই রাজ্যে সংযোজিত করে। সুরমা উপত্যকার সমাজচিন্তকরা ওই সময়েই অনুমান করেছিলেন, ব্রিটিশ সরকারের এই সিদ্ধান্ত আগামী দিনে বাঙালি জাতিসত্তাকে নানাভাবে দুর্ভোগে ঠেলে দিতে পারে, তৈরি হতে পারে নানা ক্ষেত্রে জটিলতা। কিন্তু ব্রিটিশ শাসকরা সব আপত্তি, প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে তাদের সিদ্ধান্ত কার্যকর করে। ওই পর্ব থেকেই সুরমা-কুশিয়ারা আর বরাকের দু'কূলের জনপদে বাস করা বাসিন্দাদের যে বিড়ম্বনার যাত্রা শুরু হয়েছিল, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৬ ও ৭ জুলাই সিলেট গণভোটের কলঙ্কিত অধ্যায় তাকে প্রলম্বিত করার পথকে প্রশস্ত করে দিয়েছিল। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সমঅধিকারের যে কথাগুলো সংবিধানস্বীকৃত, তা থেকে বঞ্চিত করে অখণ্ড ভারতের বাসিন্দা বাঙালির উত্তর প্রজন্মের সামগ্রিক পরিচয়কে আজ সন্দেহের আবর্তে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা এবং রাষ্ট্রবাদী ভাবনার স্বপক্ষে থেকেও স্রেফ জাতি ও ভাষা পরিচয়ের জন্য আজ আসামের বাঙালিকে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বারবার স্বদেশিয়ানার পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। এনআরসি, ডি-ভোটার, বিদেশি নোটিশ, ট্রাইবুনাল, ডিটেনশন ক্যাম্প- এসবকে ভবিতব্য করে তুলে রাজ্যের বাঙালিকে চিরকালীন আতঙ্কের মধ্যে রেখে দিতে চাওয়া হচ্ছে। একইসঙ্গে বিভিন্ন অজুহাত দর্শিয়ে রাজ্যের বাংলামাধ্যমের বিদ্যালয়গুলোর অবলুপ্তি ঘটিয়ে মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের অধিকার খর্ব করা হচ্ছে। নিযুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাভাষী ছেলেমেয়েরা আজ আর কোনওভাবেই যোগ্য বলে বিবেচিত হন না। ফলে স্বাধীনতা-উত্তর প্রজন্মগুলোর সামনে এখন শুধুই আশাভঙ্গের ধূসর প্রান্তর, ক্রমশই তার দিগন্ত বিস্তৃত হচ্ছে। আমাদের প্রতি উপেক্ষা, অবহেলা, হয়রানি, বঞ্চনা-নিঃসৃত মর্মবেদনা কারও কাছেই ন্যায়বিচার পাচ্ছে না। উল্টো ধর্মকেন্দ্রিক ভেদাভেদের আবেশ তাতিয়ে এক অসহনশীল, আত্মঘাতী পরিমণ্ডল তৈরি করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রতিবেশী বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বাঙালির সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নষ্ট করার চেষ্টাও নজরে আসছে।
ভূমিপুত্রের গেরোয় বিপন্নতায় নয়া মাত্রা১৯৮৫-তে যখন ত্রিপাক্ষিক 'আসাম চুক্তি' সম্পাদিত হয়েছিল, তখন তার কোনও অধ্যায়ে 'ভূমিপুত্র' শব্দবন্ধের উল্লেখ ছিল না। এ রাজ্যে অসমিয়া কারা, সেটাও ওই চুক্তি বা সরকারি তরফে আজ পর্যন্ত সংজ্ঞায়িত হয়নি। 'আসাম চুক্তির' তিন দশক পর ২০১৫-য় সালে আসাম বিধানসভার তৎকালীন অধ্যক্ষ প্রণব গগৈ অসমিয়া কারা সংজ্ঞা নির্ধারণের উদ্যোগ নেন। বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন আসামের একমাত্র বাঙালি সংগঠন সেদিন অধ্যক্ষ গগৈর আমন্ত্রণে বিধানসভার সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত শুনানিতে যোগ দিয়ে স্পষ্ট ভাষায় বলেছিল, স্বাধীনতা আন্দোলনে যে বাঙালির আত্মবলিদান ইতিহাসস্বীকৃত, এ রাজ্যের সমৃদ্ধি আনার উদ্যমে যে বাঙালি অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে সমান অংশীদার, বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় ঐক্য ও অখণ্ডতা রক্ষায় যে বাঙালি বরাবর সরকার ও রাষ্ট্রের পাশে থেকেছে, তাকে অধিকারহারা করে অসমিয়া সংজ্ঞা নির্ধারণ করা উচিত হবে না। পরবর্তী সময়ে যখন এনআরসি নবায়ন প্রক্রিয়ায় ভূমিপুত্র, অ-ভূমিপুত্র বিভাজন তৈরির চেষ্টা হয়েছিল, তখন ২০১৬-তে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়ালের, সঙ্গে দেখা করে বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন স্পষ্টভাবে বলেছিল, অখণ্ড ভারতের স্থায়ী বাসিন্দা বাঙালির উত্তর প্রজন্মকে অ-ভূমিপুত্র তালিকাভুক্তির যে কোনও প্রয়াস আসামে বিভাজনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে। সর্বা সরকারের আমলে আসাম চুক্তির ৬ নং দফা রূপায়ণ নিয়ে বিপ্লবকুমার শর্মা নেতৃত্বাধীন সরকারি কমিটি শিলচরে শুনানি গ্রহণে এলে সম্মেলন সেখানে আমন্ত্রিত হয়। তাতে অংশগ্রহণ করে সম্মেলন ভূমিপুত্রের সংজ্ঞা নির্ধারণ না করেই তাদের জন্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও জমির অধিকার প্রদানের যে উদ্যম নেওয়া হয়েছে, তার প্রবল বিরোধিতা করে। বলা হয়েছিল, বাঙালিকে অধিকারহারা করতে চাইলে তা মেনে নেওয়া হবে না।
২০২৩-শে রাজ্যের নির্বাচনকেন্দ্র পুনর্বিন্যাস প্রক্রিয়ায় ফের যখন ভূমিপুত্রদের সুরক্ষার কথা বলা হয়, তখনও বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন গুয়াহাটিতে নির্বাচন কমিশনের শুনানিতে অংশ নিয়ে বলেছে, রাষ্ট্রীয় কাঠামো, জনবিন্যাসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা না করেই ভূমিপুত্রের সুরক্ষার নামে সংবিধান প্রদত্ত অধিকার থেকে বাঙালিকে বঞ্চিত করার চেষ্টা রাষ্ট্রে স্বীকৃত বিধিনিয়ম ও রীতির পরিপন্থী হবে।
রাজ্যে স্থায়ী শান্তি আনার জন্য আলফার সঙ্গে যখন কেন্দ্রের আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু হয়, তখন থেকে সম্মেলন দফায় দফায় কেন্দ্র সরকার ও আলোচনায় মধ্যস্থতাকারীদের চিঠি লিখে বলেছে, বাঙালিকে আলোচনার পরিসরে না রেখে তার ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করে একতরফাভাবে শান্তিচুক্তি সম্পাদন উচিত হবে না। কিন্তু এসব আবেদনে কোনও কর্ণপাত না করে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করা হয়েছে। বিপ্লবকুমার শর্মা কমিটি ৬ নং দফা রূপায়ণ নিয়ে সরকারের কাছে যে সুপারিশ প্রতিবেদন পেশ করেছে কেন্দ্র এখন অবধি সরকারিভাবে তা গ্রহণ না করলেও আলফা চুক্তির মাধ্যমে পরোক্ষভাবে তা রূপায়ণের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যার চেহারা আগামীদিনে স্পষ্ট হবে। নিখাদ জাতিবৈষম্যমূলক মনোভাবের আধারে ভূমিপুত্রের গেরোয় বাঙালির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ভূমির অধিকার খর্ব করার উদ্যমে বিপন্নতা নয়া মাত্রা নিয়েছে।
নির্বাচন কেন্দ্র পুনর্বিন্যাস প্রক্রিয়ায় উপত্যকার অভিমত অগ্রাহ্যআসামে নির্বাচন কেন্দ্র পুনর্বিন্যাসের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা রাজ্যের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রকে যথেষ্ট আলোড়িত করেছে। ভারতীয় সংবিধান যেখানে তার নাগরিকদের সমানাধিকার দিয়েছে, সেখানে এ রাজ্যে শুধু বিশেষ জনগোষ্ঠীর জনপ্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করার প্রয়াস গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে দলিত করেছে। আইনসভাগুলোতে বাঙালি এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার সংকুচিত করে ভবিষ্যতে তাদের অবদমিত করে রাখার উগ্র জাতীয়তাবাদীদের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের ব্যবস্থা হয়েছে। নতুন কাঠামোয় ধর্মভিত্তিক টানাপোড়েন ও বিভাজনমূলক তৎপরতা নিশ্চিতভাবেই বাড়বে, এমন আশঙ্কা রয়েছে। বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন বিষয়টি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, নানা প্ররোচনা সত্ত্বেও শান্তি, সম্প্রীতি ও ঐক্যবোধের যে ভাবনা রাজ্যের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে প্রীতির বন্ধনে রেখেছে, নির্বাচন কমিশনের পদক্ষেপে তা বিঘ্নিত হতে পারে। পাশাপাশি, বরাক উপত্যকার জনসংখ্যা এবং জনবসতির ঘনত্ব রাজ্যের অন্যান্য অঞ্চল থেকে যথেষ্ট বেশি থাকা সত্ত্বেও রাজ্য বিধানসভায় এই উপত্যকার প্রতিনিধিত্বের সুযোগ সীমিত করে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে বিধানসভায় উপত্যকার আসনসংখ্যা যেখানে পনেরো, সেখানে তা কমিয়ে তেরো করে দেওয়ায় শুধু দু'জন প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগই হারাচ্ছে তা নয়, দু'টি কেন্দ্র হ্রাস পাওয়ায় বিভিন্ন সরকারি অনুদান এবং সুযোগ-সুবিধা থেকেও আগামীদিনে এই উপত্যকা বঞ্চিত হবে। জনসংখ্যা বাড়লে আসনসংখ্যা কমে- বরাক উপত্যকায় এই সিদ্ধান্ত কার্যকর বাস্তবিকই বিস্ময়কর। এছাড়া প্রতিটি নির্বাচনকেন্দ্র যেভাবে কাটাছেঁড়া করা হয়েছে তাতে সাধারণ মানুষের মনে যথেষ্ট ক্ষোভ রয়েছে। সম্মেলন এই গোটা বিষয়টি নিয়ে ২০২৩-এর জুলাই মাসে নির্বাচন কমিশনকে স্মারকপত্র দেবার পর এই বয়ানের আদলে অন্যান্য সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গ যাতে কমিশনের দরবারে স্মারকপত্র পাঠান, সে সম্পর্কেও পদক্ষেপ নেয়। এতে উপত্যকাজুড়ে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে। এই ইস্যুতে শিলচর বঙ্গভবনে এবং করিমগঞ্জে বিপিনচন্দ্র পাল স্মৃতিভবনে সম্মেলনের কাছাড় ও করিমগঞ্জ জেলা সমিতির ব্যবস্থাপনায় দু'টি সফল নাগরিকসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। হাইলাকান্দি জেলা সমিতি প্রতিকূল পরিস্থিতির জন্য নাগরিকসভা আয়োজন করতে না পারলেও এক বৈঠকে বসে নাগরিকরা মতবিনিময় করেছেন। এসব তৎপরতার পাশাপাশি গুয়াহাটির শংকরদেব কলাক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন আহূত গণ-শুনানিতে সম্মেলনের তিন প্রতিনিধি কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক গৌতমপ্রসাদ দত্ত, কাছাড় জেলা সমিতির সভাপতি সঞ্জীব দেবলস্কর ও শিলচর আঞ্চলিক সমিতির সম্পাদক উত্তমকুমার সাহা অংশ নিয়ে নির্বাচন কমিশনার অরুণ গোয়েলের কাছে বলিষ্ঠভাবে সম্মেলনের অভিমত তুলে ধরেন। সম্মেলনের এসব তৎপরতা রাজনৈতিক, অ-রাজনৈতিক ও বৌদ্ধিক মহলে প্রশংসিত হয়েছে।
আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসীমা সংকোচনের শঙ্কাআসাম সরকার শিলচরের ঐতিহ্যমণ্ডিত গুরুচরণ কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে উন্নীত করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন তাকে স্বাগত জানিয়েছে। তবে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়কে বরাক উপত্যকার কলেজসমূহ আওতাভুক্ত করার যে ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে সম্মেলন তাতে গভীর উদ্বেগ ব্যক্ত করে বলেছে, এর ফলে দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসর সংক্রান্ত বিধিবদ্ধ ক্ষমতা সংকোচনের আশঙ্কা রয়েছে। এই সরকারি উদ্যম নানাভাবে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। সম্মেলন তাই আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসর সংকোচনের তীব্র বিরোধিতা করে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আর্জি জানিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে গত ১৪ নভেম্বর, ২০২৩ তারিখে কেন্দ্রীয় সভাপতি শ্রী রাধিকারঞ্জন চক্রবর্তীর নেতৃত্বে সম্মেলনের এক প্রতিনিধিদল বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে উপাচার্য শ্রী রাজীব মোহন পন্থের সঙ্গে দেখা করে সম্মেলনের অভিমত লিখিতভাবে তুলে ধরেছে। এই প্রতিনিধিদলে ছিলেন কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক গৌতমপ্রসাদ দত্ত, কাছাড় জেলা সমিতির সভাপতি সঞ্জীব দেবলস্কর ও প্রাক্তন কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সব্যসাচী রায়। উপাচার্য পন্থ সম্মেলনের অভিমত শুনে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে পদক্ষেপ নেবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।
দেশভাগ নিয়ে জাতীয় আলোচনাচক্রবিগত বছর সম্মেলনের তরফে হাতে নেওয়া কর্মসূচিগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল স্বাধীনতার - ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে দেশজুড়ে ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’ উদ্যাপনের অঙ্গ হিসেবে করিমগঞ্জে অনুষ্ঠিত ‘স্বাধীনতা, দেশভাগ এবং উত্তর-পূর্ব ভারত’ শীর্ষক জাতীয় আলোচনাচক্র। সম্মেলনের কেন্দ্রীয় সমিতির অনুমোদন ও সক্রিয় সহযোগিতায় ২৯, ৩০ ও ৩১ জুলাই, ২০২২ তারিখে করিমগঞ্জ মিশন রোডের বিপিনচন্দ্র পাল স্মৃতিভবনে এই সফল জাতীয় আলোচনাচক্রের আয়োজক ছিল সম্মেলনের করিমগঞ্জ জেলা সমিতি। সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছিল কলকাতার মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিট্যুট অব এশিয়ান স্টাডিজ। আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য অধ্যাপক রাজীব মোহন পন্থ এই আলোচনাচক্রের উদ্বোধন করেন। আলোচনার বিষয়বস্তু উপস্থাপন করেন মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিট্যুট অব এশিয়ান স্টাডিজের তৎকালীন প্রধান অধ্যাপক সুজিতকুমার ঘোষ। বিশিষ্ট বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সমীরকুমার দাস, কটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক প্রসূন বর্মন, উত্তর-পূর্ব পার্বত্য বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক বিনায়ক দত্ত, ডায়মন্ডহারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও নিবন্ধকার অনিন্দিতা ঘোষাল, আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জয়তী ভট্টাচার্য সহ এ অঞ্চলের বিদগ্ধরা। ছিল দেশভাগের শিকার হয়ে আসা ব্যক্তিদের অভিযান ও ক্ষোভ নিয়ে কথোপকথন। অংশগ্রহণে ছিলেন নরেন্দ্রচন্দ্র পাল, সুখেন্দুশেখর দত্ত, পদ্মাবতী মজুমদার ও সতু রায়। দেশভাগের পরবর্তী অধ্যায়ে আসাম সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বাঙালির বিপন্নতা নিয়ে গোলটেবিল আলোচনাও ছিল মনোগ্রাহী। এসব কর্মসূচির পাশাপাশি আয়োজিত প্রদর্শনীটি সবার প্রশংসা কুড়িয়েছে।
বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের তরফে দ্বি-বার্ষিক অধিবেশনের বাইরে এত বড় মাপের অনুষ্ঠান আর হয়নি। দেশভাগের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র, অগুনতি ছিন্নমূল মানুষের বিপন্নতা, উদ্বাস্তুদের নিয়ে রাজনৈতিক কূটচক্রান্ত, জাতিবিদ্বেষের মানসিকতা নিয়ে বাঙালির পিঠে বিদেশি তকমা লাগিয়ে সংবিধান প্রদত্ত অধিকারগুলো থেকে তাকে বঞ্চিত করে চরম অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দেওয়ার বিষয়টি তিনদিনের আলোচনাচক্রে অত্যন্ত সুন্দরভাবে আলোচিত হয়েছে। এই সময়ে এধরনের কার্যক্রমের খুব প্রয়োজন ছিল। কেন্দ্রীয় সভাপতি রাধিকারঞ্জন চক্রবর্তী, করিমগঞ্জের জেলা সভাপতি বিনোদলাল চক্রবর্তী ও কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি সুবীর রায়চৌধুরীর নেতৃত্বে পুরো টিম অসাধারণ দক্ষতায় কাজ করেছে। আর এই গোটা কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা প্রণয়ন, বিন্যাস ও রূপায়ণের মধ্যমণি আমাদের প্রাক্তন কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সব্যসাচী রায় মেধা ও শ্রমের মিশেলে আলোচনাচক্রকে অনবদ্য রূপ দিয়েছেন।
প্রতিবেশী ভাষিক গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রয়াসচরিত্রগত দিক থেকে আসাম একটি বহুভাষিক ও বহুধর্মীয় লোকের রাজ্য। এ রাজ্যে সব জনগোষ্ঠীর ভাষা, সাহিত্য ও কৃষ্টি-সংস্কৃতি চর্চা ও বিকাশের সংবিধান স্বীকৃত অধিকার সুরক্ষিত রাখার দাবিতে ‘বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও ও সংস্কৃতি সম্মেলন’ বরাবর সোচ্চার কণ্ঠে কথা বলে আসছে। এই অবস্থানের আধারে প্রতিবেশী জনগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য সম্মেলন আন্তরিক প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। গত বছরের (২০২২) ২২ মার্চ বড়ো সাহিত্য সভার কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি দীননাথ বসুমাতারি শিলচর এলে সম্মেলনের তরফে কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ইমাদ উদ্দিন বুলবুল, সাধারণ সম্পাদক গৌতমপ্রসাদ দত্ত, কাছাড় জেলা সভাপতি সঞ্জীব দেবলস্কর, দূরশিক্ষা কেন্দ্রের সঞ্চালক পরিতোষচন্দ্র দত্ত ও কেন্দ্রীয় সহ-সম্পাদক অনিল পাল তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে মতবিনিময় করেন। তার হাতে সম্মেলন প্রকাশিত স্মরণিকা ও গ্রন্থ তুলে দেওয়া হয়। বড়ো সাহিত্য সভার সহ-সভাপতিকে শিলচর বঙ্গভবনে আসার আমন্ত্রণ জানালে তিনি সানন্দে তা গ্রহণ করে পরদিন ২৩ মার্চ ওখানে আসেন এবং আলোচনায় অংশ নেন। রাজ্যের বাঙালি ও বড়ো জনগোষ্ঠীর মধ্যে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করে তোলার জন্য বড়ো সাহিত্য সভার সহ সভাপতি ও সম্মেলনের কর্মকর্তারা বৈঠকে সহমত ব্যক্ত করে যোগাযোগ রক্ষা করে চলার পক্ষে মত পোষণ করেন।
গত বছরের (২০২২) ৭ ডিসেম্বর শিলচরে নাগা জনগোষ্ঠীর বার্ষিক গাংনাই উৎসবে সম্মেলনের এক শুভেচ্ছা প্রতিনিধিদল উপস্থিত থেকে দুই জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সম্পর্ক নিবিড় করার জন্য মত বিনিময় করেন। সম্মেলনের প্রতিনিধিদলে ছিলেন কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ইমাদ উদ্দিন বুলবুল, কাছাড় জেলা সভাপতি সঞ্জীব দেবলস্কর, কেন্দ্রীয় সহ-সম্পাদক অনিল পাল, শিলচর আঞ্চলিক সমিতির সম্পাদক উত্তমকুমার সাহা ও সদস্য সুপ্রদীপ দত্তরায়।
একইভাবে গত ১৮ ডিসেম্বর কাছাড়ি রাজ্যের শেষ রাজধানী খাসপুরের (ঠালিগ্রাম) ডিমাসা, হিন্দি ও বাংলাভাষীদের নিয়ে স্থানীয় কমিউনিটি হলে এক বৈঠকে মত বিনিময় করেন সম্মেলনের কর্মকর্তারা। উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক গৌতমপ্রসাদ দত্ত, কাছাড় জেলা সভাপতি সঞ্জীব দেবলস্কর ও সম্মেলনের সদস্য সুপ্রদীপ দত্তরায়।
২২ ডিসেম্বর শিলচরের অদূরে দুধপাতিলের সাঁওতাল টিলায় ২০তম সাঁওতালি ভাষা স্বীকৃতি দিবস উপলক্ষে আয়োজিত রাজ্য সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে সম্মেলনের তরফে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক গৌতম প্রসাদ দত্ত, দূরশিক্ষা কেন্দ্রের সঞ্চালক পরিতোষচন্দ্র দত্ত, শিলচর আঞ্চলিক সম্পাদক উত্তমকুমার সাহা ও সুপ্রদীপ দত্তরায়। উপত্যকার চা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত সাঁওতালি ভাষীদের ভাষায় অধিকার রক্ষার আন্দোলনে বঙ্গ সাহিত্য পাশে থাকবে বলে সম্মেলনের সাধারণ সম্পাদক স্পষ্টভাবে জানান। এই বক্তব্যে সাঁওতাল নেতারা সন্তোষ ব্যক্ত করে পারস্পরিক যোগাযোগ রাখা হবে বলে ঘোষণা করেন।
গত ১৫ মার্চ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষা আন্দোলনের শহিদ সুদেষ্ণা সিনহার আত্মবলিদান দিবসে শিলচরে নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি মহাসভা ও মহিলা সমিতি আয়োজিত শহিদ দিবসের অনুষ্ঠানে শ্রদ্ধা জানাতে সম্মেলনের তরফে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক গৌতম প্রসাদ দত্ত, কাছাড় জেলা সভাপতি সঞ্জীব দেবলস্কর, কেন্দ্রীয় সমিতির সদস্য সীমান্ত ভট্টাচার্য, শিলচর আঞ্চলিকের সম্পাদক উত্তম কুমার সাহা ও সদস্য বিনায়ক চৌধুরী। শহিদ দিবসের অনুষ্ঠানে বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনকে পাশে পেয়ে নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি মহাসভার তরফে সন্তোষ ব্যক্ত করা হয়। গত ৩ জানুয়ারি, ২০২৪-এ শিলচর ভুবনেশ্বর সাধুঠাকুর সেবাশ্রম প্রেক্ষাগৃহে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি সাহিত্য সভার উদ্যোগে ভাষাতত্ত্ববিদ ও গবেষক কালীপ্রসন্ন সিংহের ৮৭তম জন্মদিন উপলক্ষে মত বিনিময় অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সম্মেলনের কাছাড় জেলা সমিতির সভাপতি সঞ্জীব দেবলস্কর। ‘ভাষাচার্য কালীপ্রসন্ন সিংহ ও মাতৃভাষা চর্চা’, শীর্ষক বিষয়ে তিনি মনোগ্রাহী বক্তব্য রাখেন যা শ্রোতৃমণ্ডলীর কাছে প্রশংসিত হয়েছে।
বিহার বাঙালি সমিতির সঙ্গে সম্পর্কবরাক উপত্যকা তথা আসামের বাঙালিরা আজ যে বিপন্ন অবস্থায় রয়েছেন তাতে আত্মপরিচয় এবং অধিকার রক্ষার সংগ্রামকে বৃহত্তর পরিসরে তুলে ধরা আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে অন্যান্য রাজ্যের ভাষা সংগ্রামী সংগঠন ও ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ ও সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রসারিত করার প্রয়াস আমরা শুরু করেছি। বিহার বাঙালি সমিতির তরফে এ ব্যাপারে সাড়া পাওয়া গেছে। সমিতির সঙ্গে সম্মেলনের প্রাথমিক যোগাযোগকে আরও প্রসারিত করার বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে আলোচনা ও মতবিনিময় শুরু হয়েছে। এ বছর সম্মেলনের ৪৭ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী কার্যক্রমে শিলচরে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আমাদের আমন্ত্রণে এসেছিলেন বিহার বাঙালি সমিতির কলকাতার সংযোজক তন্ময় বীর। তাঁর এই উপস্থিতি দুই সংগঠনের মধ্যে যোগাযোগের দ্বার উন্মোচিত করেছে। তিনি ইতিমধ্যে সহযোগিতা ও বিনিময় কর্মসূচির প্রস্তাব দিয়েছেন। ওই প্রস্তাব অনুসারে সম্মেলনের অন্যান্য কার্যক্রমে বিহার বাঙালি সমিতির কেন্দ্রীয় কর্মকর্তারা আসবেন, অপরদিকে সমিতির কর্মসূচিতে সম্মেলনের প্রতিনিধিরা বিহার, ঝাড়খণ্ডে যাবেন। এই প্রস্তাব সম্পর্কে আমরা সাংগঠনিক পর্যায়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব। এটা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, বিহার বাঙালি সমিতির সঙ্গে অন্যান্য রাজ্যের বাঙালি সংগঠনগুলোর যোগাযোগ গড়ে উঠেছে।
এই প্রস্তাব মর্মে গত ১০ ডিসেম্বর, ২০২৩ কলকাতার কালীঘাট, অঞ্চলের শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোডের যোগেশ মাইম আকাদেমির সভাগৃহে বিহার বাঙালি সমিতি আহুত 'বর্হিবঙ্গে বাঙালি জীবন ও সংস্কৃতি' বিষয়ে আলোচনা সভায় সম্মেলনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ওখানে সম্মেলনের তরফে কলকাতা অধ্যায়ের সহ-সভাপতি কবি মনোতোষ চক্রবর্তী আসামের বাঙালির সামগ্রিক অবস্থা, বরাক উপত্যকার পরিস্থিতি এবং সম্মেলনের ভূমিকা নিয়ে বক্তব্য রাখেন। এই প্রথমবারের মতো দেশের বিভিন্ন রাজ্যের বাঙালি সংগঠনগুলোর সামনে সম্মেলনের তরফে বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়। অন্যদিকে সম্মেলনের এই ৩০তম দ্বিবার্ষিক অধিবেশনে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকছেন বিহার বাঙালি সমিতি, পাটনার সভাপতি ডা. দিলীপ কুমার সিনহা ও সাধারণ সম্পাদক বিদ্যুৎ পাল।
কলকাতায় সম্প্রসারিত আমাদের কর্মদ্যোগআসামের বাইরে বহির্বরাকবাসী অধ্যুষিত স্থানগুলোতে সম্মেলনের সাংগঠনিক পরিসর সম্প্রসারণের দীর্ঘদিনের প্রয়াস কিছুটা হলেও সফল হয়েছে। বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র কলকাতায় গত ১১ ডিসেম্বর গঠন করা হয়েছে শাখা সংগঠন। কলকাতার লেকটাউনের দক্ষিণদারিতে এ অঞ্চলের সুসন্তান বিশিষ্ট গল্পকার রণবীর পুরকায়স্থের পৌরোহিত্যে অনুষ্ঠিত সভায় 'বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন, কলকাতা অধ্যায়' গঠনের পরই সাংগঠনিক কাজকর্ম শুরু হয়ে গেছে। সূচনাপর্বে সম্মেলনের তরফে কলকাতায় পর্যবেক্ষক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাধারণ সম্পাদক গৌতম প্রসাদ দত্ত। ওই অধ্যায়ের সভাপতি রণবীর পুরকায়স্থ, দুই সহ-সভাপতি কবি মনোতোষ চক্রবর্তী ও লেখক অনুপ সেন, সম্পাদক 'উনিশের পদাবলী' কাব্য সংকলনের সম্পাদক কবি শান্তনু গুপ্ত, যিনি শান্তনু গঙ্গারিডি নামেই সুপরিচিত, আন্তরিকভাবে কাজ করছেন। গত ৮ জানুয়ারি কলকাতা অধ্যায়ের ব্যবস্থাপনায় সল্টলেকের 'অন্য থিয়েটার' নাট্যগোষ্ঠীর সভাঘরে কবি মনোতোষ চক্রবর্তীর পৌরোহিত্যে সম্মেলনের ৪৭ তম প্রতিষ্ঠা দিবস উৎসাহ ও উদ্দীপনায় উদ্যাপন করা হয়েছে। ওই অনুষ্ঠানে বর্তমানে কলকাতা নিবাসী বরাকমূলের কবি, গল্পকার, লেখক এবং সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুরাগীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে উপস্থিত ছিলেন। ওই সময় কলকাতায় অবস্থানরত শিলচরের বিশিষ্ট শল্য চিকিৎসক ডা. কুমার কান্তি (লক্ষণ) দাস অনুষ্ঠানে যোগ দেন। সম্মেলনের প্রবীণ সম্মানিত সদস্য, কাছাড় জেলা সমিতির প্রাক্তন সভাপতি তৈমুর রাজা চৌধুরী ও সংগঠনের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক বিশিষ্ট গল্পকার অরিজিৎ চৌধুরী কার্যক্রমে আলোচনায় অংশ নিয়ে গোটা অনুষ্ঠানকে বিশেষ মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছিলেন।
এই সফল অনুষ্ঠানের পর ১৯ মে, ২০২৩-এ কলকাতার রবীন্দ্র সদন চত্বরের পশ্চিমবঙ্গ চারুকলা পর্ষদ পরিচালিত অবনীন্দ্রনাথ সভাঘরে কলকাতায় প্রথমবারের মতো সম্মেলনের উদ্যোগে কথা-গান-আবৃত্তি-স্বরচিত রচনা পাঠের মধ্যে ভাষা শহিদ দিবস উদ্যাপন করা হয়। একইভাবে ৮ জানুয়ারি, ২০২৪-এ কলকাতা অধ্যায়ের উদ্যোগে ও ব্যবস্থাপনায় পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সভাগৃহে সম্মেলনের ৪৮তম প্রতিষ্ঠা দিবস উদ্যাপন করা হয়। কলকাতা অধ্যায়ের অন্যতম সহ-সভাপতি অনুপ সেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কার্যক্রমে সম্মেলনের কথা ছাড়াও বরাকের বাংলা কবিতা নিয়ে মনোজ্ঞ আলোচনা করেন কবি তীর্থঙ্কর দাশ পুরকায়স্থ। পাশাপাশি ইউরোপের দেশগুলোতে বাঙালি সহ অভিবাসীদের অধিকার নিয়ে আন্দোলনে যুক্ত, ‘পূর্বাশা’ সাময়িক পত্রের সম্পাদক প্রবীণ লেখক, নরওয়ের ওসলো থেকে আগত নির্মল ব্রহ্মচারীর ‘ইউরোপে বাংলা চর্চা’ নিয়ে সমৃদ্ধ আলোচনা, বরাকমূলের কবি, সংগীত শিল্পীদের মনোগ্রাহী উপস্থাপনায় গোটা অনুষ্ঠান শ্রোতৃমণ্ডলীর প্রশংসা কুড়িয়েছে।
কলকাতা পুস্তকমেলায় সম্মেলনবরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন অন্যান্য ক্ষেত্রের সঙ্গে বই প্রকাশের কাজটিও ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। বৃহত্তর বাঙালি পাঠক সমাজ এবং বরাক উপত্যকা তথা আসাম নিয়ে আগ্রহী বোদ্ধাজনের সামনে আমাদের প্রকাশনাগুলো তুলে ধরার তাগিদ দীর্ঘদিন থেকেই অনুভূত হচ্ছে। ইতিপূর্বে কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলার আয়োজক পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ডের সহযোগিতায় সম্মেলন তার নিজস্ব এবং অন্যান্য প্রকাশনা নিয়ে মেলায় স্টল দিয়েছিল। বিভিন্ন কারণে এই প্রয়াস ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। গত বছর আবার আমরা আমাদের প্রকাশনা নিয়ে ওই মেলায় হাজির হতে পেরেছি। এবার সম্মেলনের সঙ্গে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল বিহার বাঙালি সমিতি। ওই সমিতির স্টলে বিহার ও ঝাড়খণ্ড থেকে প্রকাশিত বাংলা ও অন্যান্য বইয়ের সঙ্গে ছিল আমাদের সম্মেলনের নির্বাচিত প্রকাশনাগুলোও। পাশাপাশি মেলার লিটলম্যাগ স্টলের 'উনিশে মে' টেবিলেও উপস্থাপিত হয় আমাদের কিছু প্রকাশনা। ওই দু'টি স্থানেই পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলার বাইরের লেখক, অনুরাগী পাঠক ও ভাষার জন্য সংগ্রামরত ব্যক্তিত্বদের সমাবেশ ঘটেছিল। তাঁরা আমাদের কাজকর্ম সম্পর্কে পরিচিত হয়েছেন। সামগ্রিকভাবে বৃহত্তর বাঙালি পাঠক পরিসরে আমাদের প্রকাশনা সমাদৃত হওয়ার ঘটনা নিঃসন্দেহে গৌরবের। এ ক্ষেত্রে সম্মেলনের কেন্দ্রীয় সহ সম্পাদক অনিল পাল, তার জায়া নন্দিতা অধিকারী পাল, কলকাতা অধ্যায়ের সভাপতি রণবীর পুরকায়স্থ, সম্পাদক শান্তনু গঙ্গারিডি সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। তবে যাঁর ব্যক্তিগত সহযোগিতায় আমরা কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলায় গতবার হাজির হতে পেরেছি, তিনি হলেন বিহার বাঙালি সমিতির কলকাতার সংযোজক ভাষা সংগ্রামী অধ্যাপক তন্ময় বীর। সম্মেলনের তরফে আমরা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
তিন জেলায় সাংস্কৃতিক কর্মশালাবিগত একবছরে সম্মেলন সাংস্কৃতিক কর্মধারায় শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে তিনটি কর্মশালার আয়োজন করেছে। কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহক সমিতির উদ্যোগে এবং কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি জেলা সমিতির ব্যবস্থাপনায় এই কর্মশালাগুলো আয়োজন করা হয়েছে। প্রথম কর্মশালাটি ছিল লোকসঙ্গীতের, ডিসেম্বরের ১০ ও ১১তে, ২০২২ তারিখে। অনুষ্ঠিত হয় করিমগঞ্জের বিপিনচন্দ্র পাল স্মৃতিভবনে। কলকাতার সুরমা-দোহারের অন্যতম সদস্য লোকশিল্পী বাবলু দাসের পরিচালনায় এই কর্মশালায় আশাতীত সাড়া পাওয়া গেছে। দ্বিতীয় কর্মশালাটি ছিল নাটকের। অনুষ্ঠিত হয় হাইলাকান্দি বঙ্গভবনে ২ থেকে ৬ জানুয়ারি, ২০২৩ তারিখ অবধি। এই উপত্যকার বিশিষ্ট নাট্যকার, অভিনেতা ও পরিচালক চিত্রভানু ভৌমিক নবীন নাট্য অনুরাগীদের তালিম দেন। পরে তা মঞ্চস্থ হয়। তৃতীয় কর্মশালাটি ছিল ধামাইলের, অনুষ্ঠিত হয় শিলচর বঙ্গভবনে ২০২৩-শে ফেব্রুয়ারির ৪ ও ৫ তারিখ। প্রবীণ ধামাইল বিশেষজ্ঞ বীণাপাণি নাথ ধামাইলের নানা দিক সম্পর্কে নৃত্যশিল্পীদের প্রশিক্ষণ দেন, সঙ্গে ছিলেন লোক-গবেষক অমলেন্দু ভট্টাচার্য। এই তিনটি কর্মশালা আয়োজনে সূত্রধারের ভূমিকা পালন করেছেন কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি সম্পাদক সব্যসাচী রুদ্রগুপ্ত।
বরাকের অর্থনীতি নিয়ে আকাদেমি পত্রিকার নয়া সংখ্যাসম্মেলনের বৌদ্ধিক তৎপরতার অন্যতম দিক হচ্ছে ভাষা আকাদেমি। বিষয় ভিত্তিক গবেষণা ও প্রকাশনার এই শাখাটির ব্যবস্থাপনায় এবার প্রকাশিত হল অত্যন্ত মূল্যবান লেখায় সমৃদ্ধ 'বরাক উপত্যকার অর্থনৈতিক দৃশ্যপট' শীর্ষক আকাদেমি পত্রিকা। সম্মেলনের ভাষা আকাদেমির আহ্বায়ক পরিতোষচন্দ্র দত্তের সম্পাদনায় এই সংখ্যাটি সম্মেলনের ভাবনার আরেকটি দিক উন্মোচন করল।
ইতিপূর্বে সম্মেলনের ভাষা আকাদেমির (পূর্বতন নাম গবেষণা পর্ষদ) ব্যবস্থায় আরও ৬টি বিষয়ভিত্তিক সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। বরাক উপত্যকার ইতিহাস ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে প্রথম সংখ্যা সম্পাদনা করেছিলেন অপূর্বানন্দ মজুমদার। জন্মজিৎ রায়ের সম্পাদনায় দ্বিতীয় সংখ্যাটি বরাকের অনালোচিত বিভিন্ন দিক নিয়ে লেখায় সমৃদ্ধ ছিল। তৃতীয় সংখ্যা থেকে সুনির্দিষ্ট একটি বিষয়ের নানা দিক নিয়ে লেখায় পরিপূর্ণ আকাদেমি পত্রিকা প্রকাশ শুরু হয়। জন্মজিৎ রায়ের সম্পাদনায় তৃতীয় সংখ্যার বিষয় ছিল ‘বিপিন চন্দ্র পাল’। সঞ্জীব দেবলস্করের সম্পাদনায় চতুর্থ সংখ্যার বিষয় ছিল ‘রবীন্দ্রনাথ’, তুষারকান্তি নাথের সম্পাদনায় পঞ্চম সংখ্যাটির বিষয় ছিল ‘বরাক উপত্যকার লোকসংস্কৃতি’। সঞ্জীব দেবলস্করের সম্পাদনায় যষ্ঠ সংখ্যাটির বিষয় ছিল ‘বরাক উপত্যকার ভাষা সংস্কৃতি’।
সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছে দূরশিক্ষা কেন্দ্রসম্মেলনের বহুমাত্রিক কর্মতৎপরতার আরেকটি দিক হল দূরশিক্ষা কেন্দ্র। সম্মেলন পরিচালিত এই কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনায় আসাম সরকার অনুমোদিত এক বছরের বাংলা ডিপ্লোমা কোর্স ইতিমধ্যেই বাঙালি সহ বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে যথেষ্ট আগ্রহ ও উৎসাহ সৃষ্টি করেছে। দূরশিক্ষা কেন্দ্রের এই কোর্স সাফল্যের সঙ্গে ষষ্ঠ বছর অতিক্রম করে এবার সপ্তম বছরে পা দিয়েছে। শুধু বরাক উপত্যকা নয়, আসামের বিভিন্ন স্থান, এমনকি রাজ্যের বাইরে থেকেও প্রশিক্ষার্থীরা এই কোর্সে পাঠ নিচ্ছে। প্রশিক্ষার্থীদের মধ্যে যেমন বাংলাভাষী রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন অন্যান্য ভাষাভাষীরাও।
২০১৭-১৮ সাল থেকে এই কোর্স শুরু হয়। প্রথম বছর কোর্সে ভর্তি হন ১০৫ জন, উত্তীর্ণ হয়েছেন ৮৮ জন, দ্বিতীয় বছর ২০১৮-১৯-এ ভর্তি হয়েছেন ৭৩ জন, উত্তীর্ণ হয়েছেন ৬৩ জন। তৃতীয় বছর ২০১৯-২০-এ ভর্তি হয়েছেন ৬৪ জন, উত্তীর্ণ হয়েছেন ৫৩ জন। চতুর্থ বছর ২০২০-২১-এ ভর্তি হয়েছেন ২০০ জন, উত্তীর্ণ হয়েছেন ১৭৬ জন। পঞ্চম বছর ২০২১-২২-এ ভর্তি হয়েছেন ৩৬২ জন, উত্তীর্ণ হয়েছেন ২২৯ জন। ষষ্ঠ বছর ২০২২-২৩-এ ভর্তি হয়েছেন ২৯৩ জন, উত্তীর্ণ হয়েছেন ১৭৭ জন। চলতি সপ্তম বছরে ২০২৩-২৪-এ ভর্তি হয়েছেন ২১৭ জন।
গত ২৯ জানুয়ারি, ২০২৩ বাংলা ডিপ্লোমা কোর্সের দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শিক্ষাবর্ষে উত্তীর্ণ প্রশিক্ষার্থীদের শিক্ষা সমাপন অনুষ্ঠান’ শিলচর বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত হয়। এতে ‘আসামের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ প্রণেতা, যোরহাট কলেজের অধ্যক্ষ, বিশিষ্ট অসমিয়া বুদ্ধিজীবী দেবব্রত শর্মা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বীজ ভাষণ প্রদান করেন। তিনি সম্মেলনের দূরশিক্ষা কেন্দ্রের দক্ষতা, নিষ্ঠা ও সুব্যবস্থাপনার ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছেন, কোনও সাহিত্য সংগঠনের এরকম কেন্দ্র বিরল।
সাহিত্যের অনুষ্ঠান ও প্রতিযোগিতাএই কার্যকালে সাহিত্যচর্চায় নানাবিধ কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। ২১ মার্চ, ২০২৩ উপত্যকার তিন জেলায় ‘বিশ্ব কবিতা দিবস’-এর অনুষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন ভাষাভাষী কবিরা তাদের স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন। সেই সঙ্গে কবিতা নিয়েও অনুষ্ঠানে মনোজ্ঞ আলোচনায় অংশ নেন বিশিষ্ট কবিরা। ২১ এপ্রিল, ২০২৩ কাব্য জগতে উপত্যকার অন্যতম মুখ কবি শক্তিপদ ব্রহ্মচারীর ৮৬ তম জন্মদিনটিও কবির কাব্যসাধনার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা, আবৃত্তি ও সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে উদযাপন করা হয়। এ উপলক্ষে শিলচর বঙ্গভবনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাহিত্য অকাদেমির প্রাক্তন পূর্বাঞ্চলীয় সচিব, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্টের প্রাক্তন সঞ্চালক নির্মলকান্তি ভট্টাচার্য।
গত ৩ নভেম্বর, ২০২৩ হাইলাকান্দি বঙ্গভবনে সম্মেলনের কেন্দ্রীয় সমিতির উদ্যোগে ও জেলা সমিতির ব্যবস্থাপনার 'সাহিত্য উৎসব' উদযাপিত হয়েছে। এছাড়া জেলা ও আঞ্চলিক পর্যায়েও সময়ে সময়ে কবিসম্মেলন, সাহিত্য আলোচনার অনুষ্ঠান হয়েছে।
অধিবেশনকে সামনে রেখে ছোটগল্প ও ছড়া রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। সাহিত্য সম্পাদক দীপক সেনগুপ্ত এইসব কর্মকাণ্ডে সংযোজকের ভূমিকা পালন করেন।
প্রতি মাসের নাটকসংস্কৃতি পর্যায়ে এক সমৃদ্ধ শাখা হচ্ছে নাটক। বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন নাট্য আন্দোলনকে বরাবর সহযোগিতা করে আসছে। বিভিন্ন সময়ে আয়োজন করেছে নাট্য কর্মশালা। নাট্যচর্চাকে উৎসাহ দিতে সম্মেলনের কাছাড় জেলা সমিতির ব্যবস্থাপনায় ‘এ মাসের নাটক’ কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছিল। ২০১৮ সাল থেকে শিলচর বঙ্গভবনে এই কর্মসূচি অনুসারে প্রতিমাসে একটি নাটকের দল তাদের প্রযোজনা নিয়ে হাজির হয়েছে। টানা আড়াই বছর প্রতিমাসে নাটক মঞ্চায়নের পর করোনা পরিস্থিতির জন্য তা থমকে দাঁড়ায়। গত ১০ ডিসেম্বর, ২০২৩ থেকে নবপর্যায়ে প্রতি মাসের নাটক কর্মসূচি শুরু হয়েছে। এতে নাট্যামোদী মহলে বেশ উৎসাহের সঞ্চার হওয়ায় বিভিন্ন নাট্যদল এই কর্মসূচির অধীনে নাটক মঞ্চায়নে আগ্রহের কথা জানিয়েছে।
সম্মেলনের ব্যাজ, সম্মেলক সঙ্গীত, উত্তরীয়সম্মেলনের সাংস্কৃতিক উপ-সমিতির উদ্যোগে মেটেলব্যাজ ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে এবং সদস্যদের মধ্যে তা বন্টনের প্রক্রিয়া চলছে। পরম শ্রদ্ধাস্পদ কবি ও প্রাবন্ধিক শ্রী জন্মজিৎ রায়ের লেখা সম্মেলন সঙ্গীতের সুরারোপ করেছেন উপত্যকার বিশিষ্ট সঙ্গীতগুরু শ্রী রণধীর রায়। সম্মেলনের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পর্ষদ এই কথা ও সুর অনুমোদন করেছে। সংগঠনের নিজস্ব উত্তরীয়ও তৈরি হয়েছে। অর্থমূল্য ও অন্যান্য সুবিধার কথা চিন্তা করে এটা কয়েকটি নমুনায় তৈরি করে নিজস্ব অনুষ্ঠানগুলোতে ব্যবহার করা হচ্ছে। আগামীতে এগুলোর আরও বহুল প্রচারের ব্যবস্থা করবে সম্মেলন।
অধিবেশনকে সামনে রেখে ছোটগল্প ও ছড়া রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। সাহিত্য সম্পাদক দীপক সেনগুপ্ত এইসব কর্মকাণ্ডে সংযোজকের ভূমিকা পালন করেন।
পঞ্চাশের পথে সম্মেলনপ্রতি বছর ৮ জানুয়ারি উপত্যকার সর্বত্র আঞ্চলিক ও জেলা সমিতির তরফে সম্মেলনের প্রতিষ্ঠা দিবস উদ্যাপন করা হচ্ছে। এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আমাদের কলকাতা অধ্যায়ও দিনটি পালন করছে। আর দু-বছর পর সম্মেলন তার পথচলার পঞ্চাশ বছরে পা দিতে চলেছে।
সময়ের দাবি মেটাতে সাতচল্লিশ বছর আগে আত্মপ্রকাশ করেছিল 'বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন'। কালের যাত্রায় নানা বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে সম্মেলন যৌথ নেতৃত্বে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। এই ধারা অব্যাহত রাখতে হলে নবীন প্রজন্মের সদস্যদের আরও এগিয়ে আসা উচিত। জাতির আত্মপরিচয় এবং সাংবিধানিক অধিকারের ওপর নানামাত্রায় আরও থাবা বসানোর পূর্বাভাস মিলছে। এই কঠিন সময়ে প্রতিবেশী ভাষিক গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে উদার সুসম্পর্ক রেখে অখণ্ড বাঙালি জাতিসত্তার ঐক্যচেতনাকে আরও মজবুত করে দায়িত্ববোধ নিয়ে সম্মেলনের মশাল জ্বালিয়ে রাখতে হবে।