বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের এই উনত্রিশতম দ্বিবার্ষিক কেন্দ্রীয় অধিবেশনে আয়োজিত চল্লিশতম কেন্দ্রীয় বার্ষিক সাধারণ সভায় সমাগত আপনাদের প্রত্যেককে জানাই স্বাগত অভিবাদন, আন্তরিক প্রীতি ও নমস্কার।
ভাষা আন্দোলনের বহমান ধারা আত্মপরিচয় ও অধিকার রক্ষায় একদল ভবিষ্যৎদর্শী বোদ্ধাজনের হাত ধরে সাড়ে চার দশকের বেশি সময় আগে এই শিলচরের মাটিতে যে কাছাড় বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন আত্মপ্রকাশ করেছিল তা আজ গোটা উপত্যকার বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন নামে পল্লবিত। বহুমাত্রিক আগ্রাসনের থাবা থেকে এই উপত্যকার বাংলা ভাষার অর্জিত অধিকারের সুরক্ষা, আঞ্চলিক ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চা ও বিকাশ, বাংলা ভাষাশিক্ষা প্রদান, সৃজনশীল উদ্যমের পর্যায়ে উৎসাহ দিতে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে, উপেক্ষিত-অবহেলিত এই অঞ্চলের পরিকাঠামো উন্নয়ন, আর্থিক বিকাশ ও স্বাধিকারের জন্য ধারাবাহিকভাবে নিরলস প্রয়াস চালিয়ে সম্মেলন আজ শুধু বরাক উপত্যকা নয়, গোটা রাজ্যেই এক সম্মানের জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, এই পথচলার বিগত দিনে যেসব বরণ্য ব্যাক্তিরা ছিলেন আমাদের আলোকবর্তিকা আজ সেইসব মহান ব্যক্তিত্বদের আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।
অবিভক্ত সুরমা উপত্যকার সমাজচিন্তকদের আপত্তি অগ্রাহ্য করে ব্রিটিশ সরকার তার প্রশাসনিক কাজকর্মে সুবিধার জন্য ১৮৭৪ সালে এই অঞ্চলকে বাংলার রাষ্ট্রসীমা থেকে নির্বাসিত করার পর সুরমা-কুশিয়ারা আর বরাকের দু'কূলের জনপদের অধিবাসীদের যে বিড়ম্বনা-যাত্রা শুরু হয়েছিল, ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ জুলাই সিলেট গণভোটের কলঙ্কিত অধ্যায় তাকে প্রলম্বিত করার পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিল। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সমঅধিকারের যে বিধানগুলো সংবিধান স্বীকৃত তা থেকে বঞ্চিত করে শুধু ভাষা ও জাতি পরিচয়ের জন্য এক বিশাল জনমণ্ডলীর প্রতি চরম বৈরী মনোভাব নিয়ে তাদের রাষ্ট্রহীন নাগরিকে রূপান্তরের ভয়ঙ্কর খেলা শুরু হয়েছে। ভাষিক, সাংস্কৃতিক, জীবন-জীবিকা, আর্থিক বিকাশ এবং নাগরিকত্বের প্রশ্নে আজ আমরা একেবারে কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছি। আমাদের প্রজন্ম তো বটেই, নবীন প্রজন্মের সামনেও এখন আশাহীনতার ধূসর প্রাস্তর ক্রম সম্প্রসারণশীল। আমাদের প্রতি উপেক্ষা, অবহেলা নিঃসৃত মর্মবেদনা রাজ দরবারের ন্যায়বিচার পাচ্ছে না। ভাষা ও ধর্মকেন্দ্রিক ভেদাভেদের আবেশ তাতিয়ে এমন এক অসহনশীল আবহ তৈরি করা হয়েছে যেখানে স্বাধীনতা সংগ্রামে উল্লেখযোগ্যভাবে আত্মবলিদান করা বাঙালির উত্তর প্রজন্ম অভূতপূর্ব অসহায়ত্বের পরিসরে দিনযাপন করছে। এই কঠিন সময়ে পারস্পরিক বোঝাপড়া, সহমর্মিতাকে আরও প্রসারিত করা দরকার। আমাদের সুচিন্তিত ঐক্যচেতনার উপরই নির্ভর করছে আমাদের ভবিষ্যৎ।
অর্জিত অধিকার রক্ষার সংগ্রাম
করোনা পরিস্থিতির জন্য সম্মেলনের অধিবেশন যেমন নির্ধারিত সময়ে করা যায়নি, তেমনি বিগত তিনটি বছর, একই অবস্থার জন্য সংগঠনের তৎপরতাও সীমায়িত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তার সিংহভাগ জুড়ে ছিল ভাষা ও জাতির আত্মপরিচয় এবং অধিকার রক্ষার জন্য সংগ্রাম। আসাম ভাষা আইন অনুসারে বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক সরকারি ভাষা বাংলা। প্রশাসনিক স্তরে এবং সমস্ত সরকারি কাজে এই ভাষা ব্যবহারের যে আইনি সংস্থান রয়েছে তাকে নানা কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া এবং ভাষা চাপানোর ধারাবাহিক কৌশল এখন ভিন্ন মাত্রায় চলছে। আয়ের সার্টিফিকেট, প্রবীণ নাগরিকদের সার্টিফিকেট ইত্যাদির ক্ষেত্রে রাজস্ব বিভাগ বরাক উপত্যকায় বাংলা বর্জন শুরু করেছিল। গত ২১ জুন, ২০১৯ এ সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে পাঠানো চিঠিতে ভাষা আইন লঙ্ঘনের কথা তুলে ধরা হয়। সেচ বিভাগে নিযুক্তির পরীক্ষায় বরাকের প্রার্থীদের জন্য বাংলা ব্রাত্য ছিল, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ এ সম্পর্কে বিহিত ব্যবস্থা নেবার জন্য মুখ্যমন্ত্রী ও সেচমন্ত্রীর কাছে আর্জি রেখে চিঠি দেওয়া হয়। আবার কোভিড টিকাকরণের সার্টিফিকেটে বাংলা বর্জন করায় ১৫ জানুয়ারি ২০২১ মুখ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। গৌহাটি হাইকোর্টের পরিচালনায় জেলা পর্যায়ের আদালতে নিযুক্তিতে বরাকেও অসমিয়া ভাষাজ্ঞান বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। বিষয়টি যে ভাষা আইন লঙ্ঘন করেছে সে সম্পর্কে ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ও রেজিস্ট্রারকে পৃথক চিঠিতে সবিস্তারে সব লিখে বরাকের আদালতে নিযুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাকে মান্যতা দেবার দাবি পেশ করা হয়। আসাম সরকারের সংস্কৃতি বিভাগ শিলচরে বরাক উৎসব আয়োজন করে তার নিমন্ত্রণপত্রে বাংলাকে ব্রাত্য রেখেছিল। সম্মেলনের তরফে এ নিয়ে ৩১ জানুয়ারি ২০২০ কাছাড়ের জেলাশাসকের মাধ্যমে ভাষা আইন মান্যতা দেবার দাবি জানালে তা মেনে নেওয়া হয়।
এভাবে আরও বহু ক্ষেত্রে সরকার তা সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও কর্তৃপক্ষের কাছে ভাষা আইন লঙ্ঘনের প্রতিবাদ জানিয়ে চিঠিপত্র, বিবৃতি প্রদান ও মৌখিকভাবে আলোচনা করা হয়েছে। ২০ আগস্ট ২০২১ বরাক উপত্যকা ও পাবর্ত্য বিভাগের আয়ুক্ত নীরা গগৈ সানোয়ালের সঙ্গে শিলচরের অস্থায়ী মিনি সচিবালয়ে সম্মেলনের এক প্রতিনিধিদল দেখা করে প্রশাসনিক স্তরে ভাষা আইন লঙ্ঘনের নানা ঘটনার কথা উল্লেখ করে বিহিত ব্যবস্থার দাবি জানান। এরপরই আয়ুক্ত অন্যান্য বিভাগের সঙ্গে রাজ্যের তথ্য ও জনসংযোগ বিভাগকেও বরাকে ভাষা আইন যথাযথভাবে মেনে চলার নির্দেশ দেন। এসব কাজকর্মের পাশাপাশি এই বিষয় এবং নিযুক্তির ক্ষেত্রে ভাষা চাপানোর প্রতিবাদে ১৮ জানুয়ারি ২০২১ সম্মেলনের তরফে উপত্যকা জুড়ে প্রতিবাদী অবস্থান, ধর্না, প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে জেলাশাসকদের কাছে স্মারকপত্র দেওয়া হয়। একইভাবে বাঁকাপথে উপত্যকায় ভাষা চাপানোর নয়া উদ্যমের প্রতিবাদ জানিয়ে ৯ ডিসেম্বর ২০২১ আবার উপত্যকা জুড়ে জেলাশাসকদের কাছে প্রতিনিধিদল প্রেরণ করে স্মারকপত্র প্রদানের কর্মসূচিও গ্রহণ করা হয়, এই সবগুলো কর্মসূচি রূপায়ণে সম্মেলনের তিন জেলা সমিতি এবং প্রায় সবগুলো আঞ্চলিক সমিতি আন্তরিকভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। পাশাপাশি ভাষা আইন সম্পর্কে জনচেতনা জাগরণের জন্য সংশ্লিষ্ট তথ্য সম্বলিত ফ্ল্যাক্স তিন জেলা সদরে লাগানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
উদ্বেগজনক ঘটনাক্রম
এইসব তৎপরতার মধ্যে দু'টি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাক্রম যথেষ্ট উদ্বেগ সঞ্চার করেছে। প্রথম ভাষা আইনের অপব্যাখ্যা এবং দ্বিতীয়ত হোর্ডিং বিতর্ককে সামনে রেখে জাতিবিদ্বেষ ছড়ানোর চেষ্টা। বরাক উপত্যকায় আঞ্চলিক সরকারি ভাষা বাংলা এবং কীভাবে তার প্রয়োগ হবে সে সম্পর্কে ভাষা আইন, সংশ্লিষ্ট বিধি ও সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। রাজ্য সরকারও বরাকে সবক্ষেত্রে বাংলাই ব্যবহার করা হবে বলে একাধিকবার ঘোষণা করেছেন। তা সত্ত্বেও নতুনভাবে বলা হচ্ছে বরাকের আঞ্চলিক ভাষা বাংলা হলেও অসমিয়া ভাষা ব্যবহারে কোনও আইনি বাধা নেই। জলজীবন মিশনের হোর্ডিংকাণ্ডে এ নিয়ে বিস্তর জলঘোলা করা হয়েছে যা আগামী দিনের জন্য এক অশনি সংকেত যদিও জলজীবন মিশন থেকে শুরু করে অন্যান্য বিভাগ হোর্ডিং, সাইনবোর্ডে বাংলা ব্যবহার করছে বা দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ভুলগুলো সংশোধনও করে নেওয়া হচ্ছে।
কিন্তু এই পরিস্থিতিকে সামনে রেখে একদিকে ভাষা আইন প্রয়োগের দাবি উত্থাপনকারীদের দেশ বিরোধী' আখ্যা দেওয়ার ঘটনা যেমন দেখা গেছে তেমনি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার কিছু সংগঠন প্রচণ্ডভাবে বাঙালি বিদ্বেষী উত্তেজনা ছড়ানোর চেষ্টা করেছে। সম্মেলন এ সম্পর্কে বিবৃতি দিয়ে তার অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেছে, অসমিয়া হোর্ডিঙে কালিলেপন কিংবা হুমকি দিয়ে তা সরানোর দাবির মতো চমকসৃষ্টিকারী তৎপরতায় কোনও ভাবেই সম্মেলনের সায় নেই। এটা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কোনও পন্থা হতে পারে না। তবে এ ক্ষেত্রে আইনের রক্ষকদের পক্ষপাতদুষ্ট ও অমানবিক আচরণও কাম্য নয়। বাকস্বাধীনতার কণ্ঠরোধ গণতান্ত্রিক রীতিনীতি বিরুদ্ধ। কিন্তু যখন উজান আসাম, ওয়াহাটিতে বাংলা ও হিন্দি হোর্ডিং, সাইনবোর্ডে কালি লেপন, হুমকি প্রদান করা হয় তখন প্রশাসনিক নীরবতা অবশ্যই বিস্ময়কর। এই দ্বিচারিতা বাস্তবিকই বেদনাদায়ক।
শিক্ষায় আগ্রাসন
নিযুক্তি ক্ষেত্রে ভাষা চাপিয়ে বঞ্চনার ক্রমাগত চেষ্টার পাশাপাশি শিক্ষায় ফের আগ্রাসনের প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে। আসাম মধ্যশিক্ষা পর্ষদ গত বছর বরাক উপত্যকার বিদ্যালয় সমূহে নবম ও দশম শ্রেণিতে অসমিয়া ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করে নির্দেশনামা জারি করেছিল। এ ব্যাপারে সম্মেলন মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সচিবকে চিঠি এবং টেলিফোনে প্রতিবাদ জানানোর পর তাতে সংশোধনী আনা হয়। তবে পরবর্তী সময়ে জাতীয়তাবাদী চাপে তা প্রত্যাহার করে পূর্বের স্থিতি বহাল রাখা হয়েছে। অবশ্য এ নিয়ে প্রতিবাদের প্রেক্ষিতে বরাক উপত্যকায় নির্দেশ রূপায়ণে তেমন চাপ দিতে দেখা যাচ্ছে না।
একইভাবে গত বছর ১৯ মে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার সূচিতে থাকায় সম্মেলন তার প্রতিবাদ ওয়াহাটি পর্যন্ত নিয়ে গেছে। পরবর্তী সময়ে অন্যান্য সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে সম্মেলন আরও ব্যাপক প্রতিবাদ জানায়। এতে চাপে পড়ে ১৯ মে পরীক্ষা রাখার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়।
এন আর সি থেকে নাগরিকত্ব - যন্ত্রণার সাতকাহন
ভাষার সঙ্গে নাগরিকত্বের প্রশ্নটিও বারবার আসছে। ২০১৫ সালের ৭ সেপ্টেম্বর এ দেশে আগত শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক যে জোড়া বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিলেন তা আজও এ রাজ্যে কার্যকর হয়নি। অনেক টালবাহানার পর ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন (কা) সংসদে অনুমোদিত হয়ে রাষ্ট্রপতির সম্মতি পেলেও সেটা কার্যকর করার ক্ষেত্রে আবশ্যক বিধি প্রণয়ন দু'বছর ধরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এই দু'টি ক্ষেত্রেই সুরক্ষা প্রদানের কোনও ব্যবস্থা না হওয়ায় আসামের বাঙালি ও অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বহু সংখ্যক লোক বিদেশি সন্দেহে নানাভাবে ক্রমাগত হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
অন্যদিকে ষোলশো কোটি টাকা ব্যয় করে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এন আর সি) নবায়ন প্রক্রিয়ায় যে চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে তা এখনও রেজিস্ট্রার জেনারেল অব ইন্ডিয়ার অনুমোদন পায়নি। ফলে এই তালিকার যে কোনও বৈধতা নেই সেটাই সরকারি তরফে ঘুরপথে বারবার বলা হচ্ছে। তাই দেওয়া হচ্ছে না রিজেকশন শ্লিপ। আর এটা না দেওয়ায় তালিকায় ব্রাত্য উনিশ লক্ষাধিক লোক ট্রাইব্যুনালে গিয়ে নিজের ভারতীয়ত্বের প্রমাণ দিতেও পারছেন না। এই তালিকা নবায়নের সময় দাবি ও আপত্তি পর্বে যে আট লক্ষ লোক নিজেদের নথি বায়োমেট্রিক পরীক্ষার জন্য দিয়েছিলেন তা 'লক' করে রাখা হয়েছে। ফলে উনিশ আর আট লক্ষ মিলে সাতাশ লক্ষ লোক আধার সহ বিভিন্ন সরকারি সুবিধা গ্রহণ করতে পারছে না। এখন আধারের সঙ্গে ভোটার কার্ড লিঙ্ক করে দেওয়ার কথা ঘোষণা করার পর এই সাতাশ লক্ষের ভোটাধিকারও চলে যেতে বসেছে। ফলে এই বিপুল সংখ্যক লোক কার্যত অধিকারহারা শ্রেণিতে রূপান্তরিত হয়ে এক দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। এইসব পরিবারের ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার দরজাও বন্ধ হয়ে যেতে বসেছে। এতবড় একটি অমানবিক কাণ্ড গণতান্ত্রিক দেশে নীরবে ঘটে যাচ্ছে। সম্মেলন এ নিয়ে জনপ্রতিনিধি ও সরকারের কাছে বিভিন্ন সময় চিঠি, স্মারকপত্র দিয়ে হস্তক্ষেপ চাইলেও কোনও সাড়া মিলছে না। গত ১৮ সেপ্টেম্বর আসামের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি পাঠিয়ে নিরপরাধ জনের দুর্দশা মুক্তির আর্জি রেখেছে সম্মেলন।
আর্থ-সামাজিক অধিকারও খর্ব করার আয়োজন চলছে
আসাম চুক্তির ছয় নং দফা রূপায়নের জন্য কেন্দ্র সরকার গঠিত বিপ্লবকুমার শর্মা নেতৃত্বাধীন কমিটিতে একজন বাঙালি প্রতিনিধি রাখার জন্য কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে চিঠি লিখে আর্জি জানানো হয়েছিল। কিন্তু তা গ্রহণ করা হয়নি। রাজ্যের নব্বই লক্ষ বাঙালির একজন প্রতিনিধি না রেখে গঠিত সরকারি কমিটি 'খিলপ্পিয়া' স্বার্থরক্ষার নামে নিযুক্তি, জমি কেনা-বেচা সহ সামাজিক ও আর্থিক অধিকার থেকে বাঙালিকে বঞ্চিত করার উদ্যোগ নিতেই ২০১৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সম্মেলনের তরফে কমিটির কাছে চার পৃষ্ঠার প্রতিবেদন পেশ করে বাঙালি ও অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীও যে আসামে ভূমিপুত্র তার সপক্ষে ঐতিহাসিক তথ্য তুলে ধরা হয়। ওই বছরের ১৫ নভেম্বর শর্মা কমিটি শিলচরে শুনানি গ্রহণে এলে সম্মেলনকেও তার বক্তব্য পেশ করতে লিখিতভাবে আমন্ত্রণ আসে। ওই শুনানিতে হাজির থেকে সম্মেলনের পক্ষে নীতিশ ভট্টাচার্য, তৈমুর রাজা চৌধুরী, সঞ্জীব দেবলস্কর ও বর্তমান সাধারণ সম্পাদক বিভিন্ন তথ্য দিয়ে ফের বলেন, বাঙালিরাও এই উপত্যকায়, রাজ্যে ভূমিপুত্র। কিন্তু কমিটি যে প্রতিবেদন পরে সরকারের কাছে পেশ করে তাতে বাঙালির প্রায় সব মৌলিক অধিকার খর্ব করতে চাওয়া হয়েছে। চাকরি, জমি কেনা-বেচার ক্ষেত্রে সংরক্ষণ ও বিধিনিষেধ প্রয়োগের সুপারিশ করেছে। ভারতীয় সংবিধানে প্রদত্ত ব্যবস্থার পরিপন্থী ওই সুপারিশগুলি সরকারের পক্ষে গ্রহণ সম্ভব নয় বলেই তা এখন পর্যন্ত সরাসরি আদৃত না হলেও বিভিন্ন আইনি পদক্ষেপ ও নির্দেশে তা কার্যকর করার প্রয়াস শুরু হয়ে গেছে। ভূমিপুত্রদের জন্য জমির অধিকার নিশ্চিত করতে রাজ্য সরকারের তরফে যে আইন আনার কথা ঘোষণা করা হয়েছে তাতেও রাজ্যে মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ডের মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। নিযুক্তির প্রক্রিয়ায় ইতিমধ্যে 'বাঙালি হঠাও' অভিযান শুরু হয়ে গেছে। বরাক উপত্যকার সরকারি দপ্তর ও আদালতে গত দু'বছরের নিযুক্তির চেহারায় এটা পরিস্কার হয়ে গেছে। নাগরিকত্ব সমস্যায় জেরবার রাজ্যের বাঙালির জীবনে আরও ভয়ঙ্কর দুর্যোগ আসছে এটা প্রতীয়মান হওয়ায় রাজনৈতিক ও সামাজিক স্তরে প্রবল জনমত গঠন জরুরি। সম্মেলন এই প্রক্রিয়া শুরু করে শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি ও লক্ষীপুরে চারটি বড় মাপের নাগরিক সভা করলেও করোনা পরিস্থিতির জন্য সে প্রয়াস থমকে গেছে। তবে এতবড় দুর্যোগ মোকাবিলায় অন্যান্য সংগঠন, জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দলগুলোকেও এগিয়ে আসা উচিত মনে হচ্ছে।
আর্থিক বিকাশে চাই পরিকল্পিত পদক্ষেপ
ভৌগোলিক অবস্থান ও স্থানীয় সম্পদ কাজে লাগিয়ে বরাক উপত্যকার আর্থিক বিকাশে সুনির্দিষ্ট রূপরেখা তৈরির জন্য সম্মেলন বারবার দাবি তুলেছে। উপত্যকার আর্থিক স্বাধিকারের জন্য স্বশাসিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন পর্ষদ গঠন হলে এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে বলে সম্মেলন ২০০৫ সাল থেকে রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্বকে বলে আসছে। 'বরাক উপত্যকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন' নিয়ে রাজ্য বিধানসভার তৎকালীন অধ্যক্ষ ২০১৯ সালের ২৫ জুলাই দিসপুরে বিধানসভার সভাস্থলে যে সভা আহ্বান করেছিলেন তাতে আমন্ত্রিত হয়ে সম্মেলন লিখিত এবং মৌখিকভাবে আর দেরি না করে উপত্যকার পরিকাঠামো উন্নয়ন এবং চাহিদা ভিত্তিক প্রকল্প স্থাপনের আর্জি রেখেছে। পাঁচগ্রাম কাগজ কল নতুন ব্যবস্থায় ফের চালু করার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখে বলা হয়েছে, ওটা না হলে উপত্যকায় শিল্প সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যাবে। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে জলপথে কলকাতা-করিমগঞ্জ-শিলচর যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করার যে কথা ইতিমধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে তার বাস্তবায়ন চেয়ে কেন্দ্র সরকারকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। মহিশাসনকে টার্মিনাল করে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে রেলের ট্রানজিট রুটের জন্য সম্মেলন দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছে। এক্ষেত্রে সরকারের নতুন উদ্যোগকে সম্মেলন স্বাগত জানায়। তবে সময়ভিত্তিক স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করে কাজ শুরু করতে না পারলে বরাকের আর্থিক স্থিতির উন্নতি হবে না। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে সময়ে সময়ে এই অভিমত পেশ করে উদ্যোগী হবার আহ্বান জানানো হলেও আশাপ্রদ কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কেন্দ্র সরকারের 'অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি'তে বরাক কতটুকু সুবিধা পাবে তাও আজ পর্যন্ত নির্ণিত না হওয়ায় আর্থিক বিকাশের সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার শঙ্কা প্রবল হয়ে উঠছে বলে সম্মেলন মনে করে।
কর্পাস ফান্ড
রাজ্যের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং বৌদ্ধিক কাজকর্মকে উৎসাহিত করতে সরকার কর্পাস ফান্ড থেকে অর্থ মঞ্জুর করেছেন। এক্ষেত্রে ২২টি জনগোষ্ঠীকে সহায়তা প্রদান করা হলেও ব্রাত্য বাঙালি ও হিন্দিভাষী জনগণ। সম্মেলনের তরফে গত বছর ৬ ফেব্রুয়ারি গুয়াহাটিতে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়ালের সঙ্গে দেখা করে এ ব্যাপারে আর্জি রাখা হলে তিনি সদর্থক সাড়া দেন। পরবর্তীতে রাজ্য বিধানসভায় প্রশ্নটি উত্থাপিত হলে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মাও ইতিবাচক আশ্বাস প্রদান করেন। কিন্তু কিছুই হয়নি। বর্তমান রাজ্য সরকারের কাছেও ফের ওই দাবি পেশ করা হয়েছে লিখিতভাবে। কিন্তু বাঙালি ও বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের দাবিতে সাড়া মেলেনি। এমনকি সম্মেলনকে বার্ষিক অনুদান ইতিপূর্বে যেখানে চার লক্ষ টাকা করে দেওয়া হত, সেখানে গত বছর দেওয়া হয়েছে মাত্র দেড় লক্ষ টাকা।
আরও কাজ করার ছিল
সম্মেলনের ইচ্ছে থাকলেও কোভিড পরিস্থিতির জন্য ২০১৯ সালের পর আর বইমেলা আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। প্রকাশনার ক্ষেত্রটিতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তাকে আরও পরিকল্পিত রূপ দেওয়া দরকার। ভাষা আকাদেমির গবেষণা পত্রিকার নতুন সংখ্যা সময়মত লেখা না পাওয়ায় প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। অধিবেশনের এ সম্পর্কে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শিলচর তারাপুরে কেন্দ্রীয় সমিতির জমির পুরকর নিয়মিত দেওয়া হলেও মাটি ভরাট করার কাজ নানা প্রতিকূলতার জন্য সম্ভব হয়নি। আগামী মাসেই তাতে হাত দেওয়া হবে। তবে সামাজিক মাধ্যমে প্রচারের জন্য সম্মেলনের ফেসবুক পেজ খুলে নানা বিষয়ে মনোজ্ঞ আলোচনা সভা হয়েছে, নিয়মিতভাবে তাতে নানা বিষয় সন্নিবিষ্ট হচ্ছে। খোলা হয়েছে টুইটার অ্যাকাউন্টও। ইতিমধ্যে তাতে সাড়া মিললেও সম্মানিত সদস্যদের আরও সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূলতার জন্য অনেক কাজ করা সম্ভব না হলেও সম্মেলন যে সার্বিকভাবে সদর্থক ভূমিকা নিয়ে চলছে সেটা দাবি করা যেতে পারে।