মাননীয় সভাপতি ও সম্মানিত প্রতিনিধিবৃন্দ,
সকল মাতৃভাষা শহিদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করে এবং আপনাদেরকে আন্তরিক প্রীতি-নমস্কার জানিয়ে প্রতিবেদনের সূচনা করছি।
২০১৭-এর ৩০ জানুয়ারি বর্তমান কার্যনিবাহক সমিতি দায়িত্ব গ্রহণ করে। বিগত দু’বছরে এই কার্যনির্বাহক সমিতি সময়ের দাবি অনুসারে জাতিসত্তার উপর আক্রমণ প্রতিহত করতে, আমাদের স্বকীয় ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির গৌরবময় ধারাকে অবারিত রাখতে এবং শিক্ষাক্ষেত্রে প্রত্যাশা পুরণে যথাসাধ্য প্রয়াস চালিয়ে গেছে।
আমাদের ভাষিক অধিকার রক্ষার বহমান আন্দোলন
মাতৃভাষার বেদিমূলে আত্মাঞ্জলি দেওয়া শহিদের পুণ্যভূমি এই উপত্যকায় আজও প্রতিনিয়ত লঙ্ঘিত হচ্ছে অর্জিত মাতৃভাষার অধিকার। আর এই অধিকার হননের চক্রান্তের বিরুদ্ধে বিগত চার দশক ধরে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকায় রয়েছে বরাক উপত্যকা বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন।
-
গত বছর আসাম মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদ (সেবা) পরিচালিত মুক্ত বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির বিজ্ঞান ও সমাজ অধ্যয়নের সর্বমোট চারটি বই বাংলায় অনুবাদের দায়িত্ব সম্মেলনের উপর অর্পণ করে 'সেবা'। সম্মেলনের ভাষা আকাদেমি ও শিক্ষা অনুসন্ধান উপসমিতির যৌথ উদ্যোগে যথাসময়ে অনূদিত পাণ্ডুলিপি সেবা-কে পাঠানো হয়।
-
আসাম উচ্চতর মাধ্যমিক শিক্ষাপর্ষদ প্রণীত উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের বাংলা পাঠ্যপুস্তক 'বাংলা সাহিত্য চয়নিকার' নতুন সংস্করণ গত শিক্ষাবর্ষের (২০১৭-১৮) মাঝামাঝি হঠাৎ করে চালু করায় ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকমণ্ডলীকে মারাত্মক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। বিষয়টি নিয়ে সম্মেলন জরুরিকালীন তৎপরতায় তদবির করে। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর নিকট এই ব্যাপারে সম্মেলনের পক্ষ থেকে অভিযোগ জানানো হয়। আমাদের অভিযোগ ও তদবিরের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের পুরোনো বাংলা পাঠ্যপুস্তক আরো দু'বছর চালু থাকবে বলে শিক্ষাপর্ষদ নির্দেশনামা জারি করে এবং আমাদেরকেও পত্র মারফত অবহিত করে (পত্র নং- এএইচএসইসি/এসিএ/আরইভি-বিইএন/৩০৪/০৯/২৩০৭তারিখ ২৮/০৮/২০১৭)। 'বাংলা সাহিত্য চয়নিকার' এই নতুন সংস্করণে থাকা ভুল-ভ্রান্তি সংশোধন ও প্রচ্ছদ পরিবর্তনের আর্জি নিয়ে বিগত ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৭ সম্মেলনের প্রতিনিধিদল পর্ষদের সম্পাদকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নতুন পাঠ্যপুস্তকটি সংশোধন ও পুনর্মুদ্রণের আর্জি জানায়। আমাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে পর্ষদের সম্পাদক ভুল-ভ্রান্তির তালিকা পর্ষদকে জানানোর অনুরোধ করেন (পত্র নং- এএইচএসইসি/এসিএ/ইভি-বিইএন/৩০৪/০৯/২৩৩৫১ তারিখ ১৭/০১/২০১৮)। সম্মেলনের ভাষা আকাদেমি ও সাহিত্য উপসমিতির যৌথ উদ্যোগে এই সংশোধনের কাজ সম্পূর্ণ হয় এবং সম্মেলন কর্তৃক প্রস্তুত করা নতুন প্রচ্ছদ সহ সংশোধিত পাণ্ডুলিপি পর্ষদের নিকট পাঠানো হয়।
-
বিগত ৩ জুলাই ২০১৮ তারিখে গৌহাটিতে আসাম মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদের (সেবা) কার্যালয়ে মাধ্যমিক পর্যায়ের (নবম ও দশম মানের) পাঠ্যপুস্তক উন্নীতকরণের লক্ষ্যে 'সেবা' আহূত সভায়, আমাদের সংগঠনের প্রতিনিধি হিসেবে শ্রী অনিল পাল, শ্রী তমোজিৎ সাহা ও শ্রী রঞ্জন ভট্টাচার্য যোগদান করেন। এই ব্যাপারে দীর্ঘ আলোচনায় আমাদের প্রতিনিধিবৃন্দ পাঠ্যপুস্তক সংক্রান্ত মতামত উপস্থাপন করলে এই দুই পাঠ্যপুস্তক সম্পূর্ণ নবীকরণের দায়িত্ব আমাদের উপর অর্পণ করে 'সেবা'। সম্মেলনের ভাষা আকাদেমি, শিক্ষা অনুসন্ধান পর্ষদ ও সাহিত্য উপসমিতির যৌথ উদ্যোগে আমরা এই ন্যস্ত দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করি এবং পাণ্ডুলিপির সফট কপি সেবাকে পাঠিয়ে দিই যা পরবর্তীতে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে প্রণীত হয়েছে।
-
ইউনিফর্ম অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডারের নামে বরাক উপত্যকার স্কুলগুলোতে দুর্গাপূজা-রমজানের ছুটি ও উদ্যাপনের দিনগুলো কর্তনের ব্যাপারটি সম্পর্কে উপত্যকাবাসীর ক্ষোভ সর্বপ্রথম রাজ্য সরকারের নিকট উপস্থাপন করে আমাদের সংগঠন। ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ তারিখে এই ব্যাপারে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী ও মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর নিকট স্মারকপত্র প্রেরণ করা হয়। পরবর্তীতে বিজেপির রাজ্য সভাপতি শ্রী রঞ্জিত দাসের করিমগঞ্জ সফরে (৫ মার্চ, ২০১৭) এবং মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর করিমগঞ্জ সফরে (২ মে, ২০১৭) তাঁদের নিকট এই ব্যাপারে 'স্মারকপত্র প্রদান করা হয় এবং বরাক উপত্যকার জন্য পুরনো রীতিতে অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডার তৈরির আর্জি জানানো হয়। সেই সঙ্গে গত ২৯ মে, ২০১৭ তারিখে রাজ্য মাধ্যমিক শিক্ষার কমিশনার শ্রী আর সি জৈন এবং রাজ্য প্রাথমিক শিক্ষা কমিশনার শ্রী প্রীতম শইকিয়ার সঙ্গে সম্মেলনের প্রতিনিধি দল সাক্ষাৎ করে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে সম্মেলনের পক্ষ থেকে বরাক উপত্যকার স্কুলগুলোতে দুর্গাপূজার ছুটি বাড়ানো ও বাদ পড়া উদ্যাপনের দিনগুলো অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডারে অন্তর্ভুক্তির দাবি জানানো হয়। পরবর্তীতে বরাক উপত্যকায় দুর্গাপূজার জন্য অতিরিক্ত পাঁচ দিনের ছুটি ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার।
২০১৮ শিক্ষাবর্ষের অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডারে রবীন্দ্রজয়ন্তী সহ অন্যান্য মনীষীদের জন্মজয়ন্তী উদ্যাপন দিবস হিসেবে বাদ পড়া এবং 'ভাষা শহিদ দিবস' উনিশে মে-কে 'ভাষা সাহিত্য দিবস' হিসেবে উদ্যাপনের জন্য চিহ্নিত করার বিষয়গুলো নিয়ে সম্মেলন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আমরা আশাবাদী সরকার এই ব্যাপারে সদর্থক পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
-
মহবিদ্যালয়গুলোতে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে টাইপ টেস্টে বাংলাকে বাদ দিয়ে কেবল ইংরেজি ও অসমিয়া ভাষা অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি নিয়ে সম্মেলন সরকারের নিকট জরুরিকালীন তৎপরতায় তদবির করে। আমাদের চাপে সরকার এই নিযুক্তি প্রক্রিয়ায় টাইপ টেস্টে বাংলা অন্তর্ভুক্ত করেছেন। (পত্র নং- ডিএইচই/পিএ/রুলস-গাইডলাইনস/গ্রেড-111/২০১৭/১১৪ তারিখ ১২/০৫/২০১৭)
-
রাজ্য শৈক্ষিক অনুসন্ধান ও প্রশিক্ষণ পরিষদ (এস সি আর টি) প্রণীত পঞ্চম মানের বাংলা পাঠ্যপুস্তক 'অংকুরণে' বাংলা হরফে অসমিয়া কবিতা অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারটি সম্মেলনের পক্ষ থেকে রাজ্য সরকারের নজরে আনা হয়। এই ব্যাপারে বিগত ২৯ মে ২০১৭ তারিখে সংশ্লিষ্ট কমিশনার-সেক্রেটারি শ্রী প্রীতম শইকিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সংগঠনের বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে সদর্থক পদক্ষেপ গ্রহণের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে এই ব্যাপারে।
-
বিগত দিনে বরাক উপত্যকার বিভিন্ন সামাজিক সংস্থার বাংলা ভাষায় লেখা কার্যবিবরণী গৌহাটির পঞ্জিয়কের কার্যালয়ে গ্রহণ না করার খবর আমাদের নজরে এলে সম্মেলনের পক্ষ থেকে বিগত ৩১ অক্টোবর, ২০১৭ তারিখে গৌহাটিতে সামাজিক সংস্থাসমূহের পঞ্জিয়কের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা হয়। বরাক উপত্যকার সরকারি ভাষা যে বাংলা এবং এই উপত্যকার সামাজিক সংস্থাগুলোর সভার কার্যবিবরণী বাংলা ভাষায় লেখার বৈধতা যে প্রশ্নাতীত এই ব্যাপারটি পঞ্জিয়ককে স্পষ্ট ভাষায় বলে দেওয়া হয়। পঞ্জিয়ক তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর কার্যালয়ের আধিকারিকদের বরাক উপত্যকার সংস্থাগুলোর বাংলা ভাষায় লেখা সভার কার্যবিবরণী গ্রাহ্য বলে মান্যতা দেওয়ার নির্দেশ দেন।
-
রাজ্যের জেলা-স্তরের ন্যায়ালয়ে কর্মচারী নিয়োগের জন্য মাননীয় উচ্চ ন্যায়ালয় কর্তৃক জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে (নং 4C, XXXVII-27/2015/2256/R.Cell, তারিখ ৪ মে ২০১৭) বরাক উপত্যকার সরকারি ভাষা বাংলাকে গ্রাহ্য না করায় বরাক উপত্যকার প্রত্যাশীদের যে বঞ্চনার শিকার হতে হচ্ছে এই ব্যাপারটি মাননীয় গৌহাটি উচ্চ ন্যায়ালয়ের নিবন্ধকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সম্মেলন। ফ্যাক্সযোগে অভিযোগপত্র পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোনেও উচ্চ ন্যায়ালয়ের কর্তৃপক্ষের নিকট অভিযোগ জানানো হয়। যদিও, দুর্ভাগ্যজনকভাবে উচ্চ ন্যায়ালয়ের কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কোনো সদর্থক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
-
আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটি তথা উদ্যাপন দিবসের তালিকায় বর্ষবরণ না থাকা এবং বিহু উদ্যাপনের কথা উল্লেখ থাকার বিষয়টি সম্মেলন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নজরে আনে এবং বরাক উপত্যকার বহমান ভাষা আন্দোলনের এবং উপত্যকাবাসীর নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে যে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম এবং এই উপত্যকার সমৃদ্ধ কৃষ্টি ও সংস্কৃতির পতাকাবাহক হিসেবেই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয় গঠন করাটা উপত্যকাবাসী কামনা করে সেকথা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানানো হয় সম্মেলনের পক্ষ থেকে। সেইসঙ্গে বিগতদিনে সপ্তবিংশ অধিবেশনের সিদ্ধান্ত অনুসারে স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজির পাশাপাশি ঐচ্ছিক হিসেবে বাংলা চালু করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্যের নিকট দাবি জানানো হয়েছে, যদিও এই ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি।
-
রাজ্য সরকারের বিভিন্ন প্রচারপত্র, নিদর্শপত্র, অনুজ্ঞা ও বিজ্ঞাপনে এই অঞ্চলের মানুষের ন্যায্য অধিকার ও আবেগকে অমর্যাদা করে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অসমিয়া ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহক সমিতির সিদ্ধান্ত অনুসারে গত ২০১৭-এর জুলাই মাসে সম্মেলনের পক্ষ থেকে জেলা পর্যায়ে উপাযুক্তের নিকট এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে চক্র আধিকারিক ও খণ্ড উন্নয়ন আধিকারিকের নিকট ভাষা আইনের যথাযথ ব্যবহার সুনিশ্চিত করার দাবি সম্বলিত স্মারকপর প্রদান করা হয়েছে।
-
ভাষা আগ্রাসন ও ভাষাবিষ্কৃতি প্রতিরোধে বরাক উপত্যকায় রাজ্য সরকার প্রস্তাবিত মিনি-সচিবালয়ে রাজ্য সরকারের ভাষা আইন জশাষণ বিভাগের পাখা খোলার এবং রাজ্যে একটি স্থায়ী অনুবাদ-সংস্থা গঠন করার দাবি কেন্দ্রীয় সমিতির পক্ষ থেকে রাজ্য সরকারের নিকট উপস্থাপন করা হয়েছে। সেইসঙ্গে রাজ্য সরকারের জনসংযোগ বিভাগ কর্তৃক ইংরেজিতে প্রকাশিত বরাক উপত্যকার সংক্ষিপ্ত পরিচয় বিষয়ক বই বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করার দাবি রাজ্য সরকারের নিকট পেশ করা হয়েছে।
নাগরিকত্ব ও জাতিসত্তার সংকট
উগ্রজাতীয়তাবাদের জয়ধ্বনিতে যখন মুখরিত আসাম, বিদেশি বিতাড়নের নামে বাঙালির বিরুদ্ধে বিষবাষ্প ছড়ানোর অপপ্রয়াস যখন মাথাচাড়া দিয়েছে, বাঙালি-জাতিসত্তাকে প্রত্যাখ্যান করার সুপরিকল্পিত প্রয়াস যখন স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে, সর্বোপরি আসামের বহুভাষিক পরিচয়কে বিনষ্ট করে একজাতি-একভাষী রাজ্য হিসেবে প্রতিপন্ন করার চক্রান্ত কার্যকরী করার ইঙ্গিত যখন স্পষ্ট এই পরিস্থিতিতে সম্মেলন ধারাবাহিকভাবে বরাকের তথা সারা রাজ্যের বাঙালি তথা সকল সংখ্যালঘু ভাষাগোষ্ঠীর প্রতিনিধি-সংগঠন হিসেবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে পিছপা হয়নি।
আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত জাতীয় নাগরিকপঞ্জি নবায়ন, নাগরিকত্ব আইন সংশোধন, ডি-ভোটারের নামে হয়রানি, আলফার সঙ্গে শান্তিচুক্তি, রাজ্য জমি আইন সংশোধন এবং আসাম চুক্তির বিভিন্ন ধারা কার্যকরী করার মতো বিষয়গুলো সামনে রেখে যখন আসামের বাঙালিদের একঘরে করার প্রয়াস জারি রয়েছে, পরিস্থিতি বিবেচনায় সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে কার্যনির্বাহক সমিতি।
নাগরিকপঞ্জি নবায়ন
সম্মেলনের সপ্তবিংশ অধিবেশনে নাগরিকপঞ্জি নবায়ন সম্পর্কে যেসকল আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল পরবর্তীতে বিগত দু'বছরে সেসবই যে অমূলক নয় তা প্রমাণিত হয়েছে। পরিস্থিতির মোকাবিলায় প্রতিটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে দ্রুত ও সুনিশ্চিতভাবে।
- জাতীয় নাগরিকপঞ্জির রাজ্য-সমন্বয়কের নিকট পেশ করা আমাদের আবেদন মাননীয় উচ্চতম ন্যায়ালয়ের নির্দেশে গঠিত গৌহাটি উচ্চ ন্যায়ালয়ের বিচারপতি শ্রী ডি বিশ্বাস ও শ্রী ডি এন চৌধুরীর ডিভিশন বেঞ্চে উপস্থাপিত হয়েছে। মাননীয় বিচারকদ্বয় আমাদের আবেদন পর্যালোচনাক্রমে এক নির্দেশেনামায় "অরিজিন্যাল ইনহ্যাবিটেন্ট (OI)" নির্ধারণ নিয়ে আশঙ্কার ভিত্তি নেই বলে জানিয়েছেন (পত্র নং জাজেজ কমিটি অন এন আর সি/২৩/২০১৭/০৫ তারিখ ২৮/০৬/২০১৭)। যদিও নাগরিকপঞ্জি নবায়ন প্রক্রিয়া সম্পর্কে আশঙ্কা যে অমূলক নয় তা পরবর্তীতে বার বার প্রমাণিত হচ্ছে।
- নাগরিকত্ব সম্পর্কিত মাননীয় উচ্চতম ন্যায়ালয়ে চালু থাকা মামলায় পক্ষভুক্ত বরাক ভ্যালি হিউম্যান রাইটস্ প্রটেকশান সোসাইটি আমাদের সম্মেলনের নিকট এই মামলা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আর্থিক সাহায্যের আর্জি জানায়। কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহক সমিতি এই মামলাটি চালিয়ে নিয়ে যেতে এই সংগঠনকে আর্থিক সহযোগিতার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তিন জেলা সমিতির সহযোগিতায় সর্বমোট এক লক্ষ টাকা বিগত ৯ মে, ২০১৭ তারিখে বরাক ভ্যালি হিউম্যান রাইটস্ ফোরামের হাতে তুলে দেয় সংগঠন। মামলাটি বর্তমানে মাননীয় উচ্চতম ন্যায়ালয়ে বিচারাধীন রয়েছে।
-
বঙ্গভাষী অসংখ্য নাগরিকের নাম নবায়নকৃত নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ পড়ার আশঙ্কা যখন দেখা দিয়েছে, বিশুদ্ধ নাগরিকপঞ্জি তৈরির নামে উচ্চতম ন্যায়ালয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বিষয়টি জটিল করার ইঙ্গিত যখন পাওয়া গেছে একটি জাতিগোষ্ঠীর প্রতি এই বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে সরব হয়েছে বরাক উপত্যকা বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন।
- নাগরিকপঞ্জি নবায়ন সম্পর্কে আর জি আইয়ের আহ্বানে গত ২ নভেম্বরে, ২০১৭ তারিখে গৌহাটিতে অনুষ্ঠিত সভায় আমাদের সম্মেলনের অবস্থান ও দাবি স্পষ্ট করে বলা হয় এবং নাগরিকদের আশঙ্কা ও ক্ষোভের সঙ্গত কারণগুলো উপস্থাপন করা হয়। যদিও উপস্থিত আধিকারিকদের পক্ষ থেকে স্পষ্ট কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি সেই সভায়।
- নাগরিকপঞ্জির প্রথম খসড়া প্রকাশের পর উদ্ভূত পরিস্থিতি পর্যালোচনায় কেন্দ্রীয় সমিতির অনুরোধে জরুরিকালীন তৎপরতায় সম্মেলনের তিন জেলা সমিতি গত ৪, ৫ ও ৬ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে পর্যায়ক্রমে করিমগঞ্জ, শিলচর ও হাইলাকান্দিতে নাগরিকসভা আয়োজন করে। পরবর্তীতে ৭ জানুয়ারি, ২০১৮ তারিখে নির্বাহী পর্ষদের সভায় নাগরিকসভাগুলোর মতামত বিবেচনা করা হয় এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিকপঞ্জির প্রথম খসড়ায় বরাক উপত্যকার নাগরিকদের নাম অন্তর্ভুক্তিতে অসঙ্গতি তথা নাগরিকদের আশঙ্কা, ক্ষোভ ও দাবি সম্বলিত স্মারকপত্র বিগত ১০ জানুয়ারি, ২০১৮ তারিখে তিন জেলা সমিতির উদ্যোগে তিন জেলার উপাযুক্তের মাধ্যমে মাননীয় রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় গৃহমন্ত্রী, মাননীয় রাজ্যপাল, মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী ও আর জি আই-এর নিকট প্রেরণ করা হয়। সেই সঙ্গে তিন জেলার উপাযুক্তের সঙ্গে জেলা সমিতিগুলোর প্রতিনিধিদল স্থানীয় সমস্যা ও অভিযোগগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন এবং সম্মেলনের পক্ষ থেকে বরাক উপত্যকার নাগরিকদের আশঙ্কা ও ক্ষোভ ব্যক্ত করেন।
- পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহক সমিতিতে আলোচনাক্রমে পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও মতবিনিময়ের জন্য সম্মেলনের আঞ্চলিক সমিতি পর্যায়ে নাগরিকসভা আয়োজন, তিন জেলার উকিলসভাগুলোর সঙ্গে মত বিনিময়, জাতীয় নাগরিকপঞ্জি নবায়ন প্রক্রিয়ায় প্রকাশিত অসঙ্গতি, বরাক উপত্যকার নাগরিকদের আশঙ্কা ও দাবি রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট উপস্থাপনের জন্য গৌহাটি ও নয়া দিল্লিতে প্রতিনিধিদল প্রেরণ, বরাক উপত্যকার বঙ্গভাষী তথা অন্যান্য ভাষিকগোষ্ঠীর নাগরিকদের আদি বাসিন্দা হওয়ার ইতিহাস সম্বলিত একটি গ্রন্থ প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
- সিদ্ধান্ত অনুসারে 'আধিপত্যবাদীদের আগ্রাসনে আসামে বাঙালি জাতিসত্তার সংকট' শীর্ষক পুস্তিকা প্রকাশ করে সম্মেলন, যা ৭ জুন ২০১৮ তারিখে শিলচর বঙ্গভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে উম্মোচন করা হয়।
- কেন্দ্রীয় সমিতির সিদ্ধান্ত অনুসারে এবং সময়ের দাবিতে সম্মেলনের চারজনের প্রতিনিধিদল ২০১৮-র জুলাই মাসে দিল্লি সফর করে। সর্বশ্রী বিভাসরঞ্জন চৌধুরী, ইমাদউদ্দিন বুলবুল, সব্যসাচী রায়, সব্যসাচী রুদ্রগুপ্ত ১৯ থেকে ২৩ জুলাই দিল্লি অবস্থান করেন। দিল্লিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের কার্যালয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য নিয়োজিত আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠক করে সম্মেলনের প্রতিনিধিদল। বৈঠকে নাগরিকত্ব ও নাগরিকপঞ্জি, ডি-ভোটার ও ডিটেনশন ক্যাম্প সম্পর্কে চলমান ঘটনাপ্রবাহ ও সম্মেলনের আশঙ্কা ও অভিমত প্রকাশ করে প্রতিনিধিদল। সেইসঙ্গে আলফার সঙ্গে শান্তিচুক্তিতে বরাক উপত্যকাবাসীর মতামত গ্রহণের আর্জিও জানায়। সম্মেলনের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সেই আলোচনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের আধিকারিকদের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তীতে ২৫ জুলাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক থেকে জারি করা নির্দেশনামায় ডি-ভোটার ও ডিটেনশন ক্যাম্প সম্পর্কে কিছুটা স্বস্তির ইঙ্গিত পাওয়া গেছে । দিল্লি অবস্থানকালে সম্মেলনের প্রতিনিধিদল আর জি আই সহ জাতীয় স্তরের বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তি ও জনপ্রতিনিধি, বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থার সঙ্গে নাগরিকত্ব, ডি-ভোটার ও ডিটেনশন ক্যাম্প নিয়ে মত বিনিময় করে এবং ব্যাপারগুলোর প্রেক্ষাপট ও বর্তমান পরিস্থিতি বিজারিত বর্ণনা করে। পাশাপাশি, এই সম্পর্কিত আইনি দিকগুলোও মাননীয় উচ্চতম ন্যায়ালয়ে কর্মরত এবং নাগরিকপঞ্জি সম্পর্কিত মামলায় নিয়োজিত ব্যবহারজীবীদের সঙ্গেও বিস্তারিত আলোচনা করেছে প্রতিনিধিদল। প্রতিনিধিদলের এই দিল্লি সফরকালে সহযোগিতা করার জন্য উত্তর করিমগঞ্জের মাননীয় বিধায়ক শ্রী কমলাক্ষ দে পুরকায়স্থ, করিমগঞ্জের মাননীয় সাংসদ শ্রী রাধেশ্যাম বিশ্বাস, কাছাড়ের মাননীয় সাংসদ শ্রীমতী সুস্মিতা দেবকে আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করি।
- পরিস্থিতি বিবেচনায় সম্মেলনের অধিকাংশ আঞ্চলিক সমিতিগুলোও নাগরিকপঞ্জি নবায়ন নিয়ে সম্মেলনের অবস্থান স্পষ্ট করতে তথা জনমত গঠনে নাগরিক সভা আয়োজন করেছে ২০১৮-এর প্রথমার্ধে।
- নাগরিকপঞ্জির পূর্ণ খসড়া প্রকাশের পর বাদ পড়া চল্লিশ লাখের বেশি আবেদনকারীদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার দিকে চলে যায়। সেইসঙ্গে রাজ্যের ভেতরে উগ্রজাতীয়তাবাদীদের আস্ফালন এবং প্রতিবেশী রাজ্য মেঘালয়-মিজোরাম-মণিপুরে বাঙালিবিদ্বেষ চরমে পৌঁছে। শুরু হয় বাঙালি নির্যাতন। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় অনতিবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সম্মেলনের কেন্দ্রীয় সমিতির উদ্যোগে তিন জেলা সমিতির গত ১৩ আগস্ট ২০১৮ তারিখে তিন জেলার উপাযুক্তের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আধিকারিকের নিকট পরিস্থিতি মোকাবিলায় অনতিবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়ে স্মারকপত্র পাঠায়। একইসঙ্গে চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশের পর সম্পূর্ণ শান্তির বাতাবরণ বিরাজ করার পরও বরাক উপত্যকায় বিনাকারণে দীর্ঘদিন ১৪৪ ধারা বলবত রাখার পদক্ষেপ যে গণতন্ত্রপ্রিয় উপত্যকাবাসীর মৌলিক অধিকার হরণের নামান্তর তা স্পষ্টভাষায় মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর নজরে এনে অনতিবিলম্বে উপত্যকায় ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করার দাবি জানায় সম্মেলন।
- নাগরিকপঞ্জি নবায়ন প্রক্রিয়ায় তালিকাছুট আবেদনকারীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে পরবর্তীতে সংশয় ও অবিশ্বাসের বাতাবরণ সৃষ্টি হলে সম্মেলন তালিকাছুটদের পাশে দাঁড়িয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে তদবির চালিয়ে যায়। খসড়াছুটদের আবেদন-প্রক্রিয়া সম্পর্কিত নিয়মাবলি (SOP) প্রস্তুতির ব্যাপারে সম্মেলন নিজস্ব মতামত বারংবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকে পাঠায়। সেইসঙ্গে এই প্রক্রিয়ায় মাননীয় উচ্চতম ন্যায়ালয়ে চালু থাকা মামলার পক্ষভুক্ত তথা এই ব্যাপারে উচ্চতম ন্যায়ালয় কর্তৃক মতামত আহবান করা সংস্থা আমসু, জমিয়ত, জেক-বিআর, সারা আসাম ভোজপুরি পরিষদ-এর সঙ্গে যোগাযোগ ও মত বিনিময় করে। নিঃশর্ত আপত্তি যে নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫-এর ১৭নং ধারার পরিপন্থী সেই কথাটি এবং সেইসঙ্গে বাদপড়া নামের অন্তর্ভুক্তির দাবির প্রক্রিয়া সরলীকরণ করা, নাগরিকদের নাগরিকত্ব প্রমাণের প্রক্রিয়ায় ভারতীয় সাক্ষ্য আইন, জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের বিধান (নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫-এর ৩নং ধারা) কার্যকরী করা তথা সিটিজেনশিপ আইডেনটিটি কার্ড ও বার্থ সার্টিফিকেটকে বৈধ নথি হিসেবে বিনা দ্বিধায় গ্রহণ করার কথাও আলোচিত হয় সংস্থাগুলোর সঙ্গে। এই বিষয়গুলো নিয়মাবলিতে (SOP) থাকার ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য লিখিতভাবেও সংহাগুলোকে অনুরোধ জানানো হয়। একইসঙ্গে, নিয়মাবলিতে (SOP) পাঁচটিনথি অন্তর্ভুক্তির দাবি জানিয়ে ৬ অক্টোবর ২০১৮ তারিখে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আর জি আই, মুখ্যমন্ত্রীর নিকট স্মারকপত্র প্রদান করা হয়। আমাদের এই নিরবচ্ছিন্ন উদ্যোগ সার্থকতা লাভকরে। দাবি/আপত্তি প্রক্রিয়ায় সিটিজেনশিপ সার্টিফিকেট, রিফিউজি রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট, রেশন কার্ড ইত্যাদি বৈধ নথি হিসেবে মান্যতা দেন মাননীয় উচ্চতম ন্যায়ালয় এবং নাগরিকত্ব আইন অনুসারে শাস্তির বিধানেরও উল্লেখ রাখা হয় এই আপত্তির প্রক্রিয়ায়।
- নাগরিকপঞ্জিতে খসড়াছুটদের নাম অন্তর্ভুক্তির আবেদন প্রক্রিয়ায় সম্মেলনের করিমগঞ্জ ও কাছাড় জেলা সমিতি পুরো ডিসেম্বর মাস জেলা কার্যালয়ে সহায়তা কেন্দ্র চালু রাখে যার মাধ্যমে প্রচুর সংখ্যক খসড়াছুট আবেদনকারীরা উপকৃত হয়েছেন।
- পূর্ণ খসড়া তালিকায় নাম ও অন্যান্য তথ্যে ভুল সংশোধনীর ব্যাপারে এনআরসি-র রাজ্য সমন্বয়ক কর্তৃক ১৪ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে গৌহাটিতে আহূত কর্মশালায় বরাক উপত্যকা থেকে আমন্ত্রিত একমাত্র সংস্থা হিসেবে আমাদের সম্মেলনের ছ'জনের প্রতিনিধিদল অংশগ্রহণ করেন এবং অনলাইন সংশোধন প্রক্রিয়া সম্পর্কে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এই প্রতিনিধিদলে ছিলেন সর্বশ্রী ইমাদউদ্দিন বুলবুল, বিশ্বনাথ মজুমদার, দেবদত্ত চক্রবর্তী, সুদীপ চক্রবর্তী, রাজীব দাশ ও পার্থ সোম। পরবর্তীতে এই সংশোধনী প্রক্রিয়ায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্যরা আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে এই সংশোধন প্রক্রিয়ায় উপত্যকাবাসীর প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।
- অনলাইন সংশোধন প্রক্রিয়ার সময়সীমা ৩১ জানুয়ারি থেকে আরো দু'মাস বাড়ানোর দাবি এনাআরসি-র রাজ্য সমন্বয়কের কাছে জানানো হলে আমাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে সেই সময়সীমা দু'বার বাড়ানো হয়।
নাগরিকত্ব আইন সংশোধন
-
নাগরিকত্ব আইন সংশোধনীর বিলটি এখনও বিচারাধীন। ইতিপূর্বে ২০১৬-এর ২৫ অক্টোবর সম্মেলনের প্রতিনিধিদল দিল্লিতে যৌথ সংসদীয় সমিতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সম্মেলনের নৈতিক সমর্থন সহ প্রয়োজনীয় সংশোধনের দাবি জানিয়েছেন। পাশাপাশি, সম্মেলনের সপ্তবিংশ অধিবেশনের সিদ্ধান্ত অনুসারে, নাগরিকত্ব বিল সংসদে পাশ না হওয়া পর্যন্ত আসামে বিদেশি সন্দেহে কাউকে নোটিশ প্রদান, হেনস্তা, ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানোর সরকারি ও প্রশাসনিক তৎপরতা অবিলম্বে বন্ধ করতে রাজ্য সরকারের নিকট দাবি জানানো হয়েছে। পরবর্তীতে যৌথ সংসদীয় সমিতির বরাক সফরে (৮ ও ৯ মে ২০১৮) সম্মেলনের প্রতিনিধিদল আবারও সমিতির নিকট নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে উপস্থাপন করেন।
- নাগরিকপঞ্জি, নাগরিকত্ব আইন সংশোধনীর বাতাবরণে রাজ্যে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সম্প্রীতি যে খাদের মুখে এবং এর ফলশ্রুতিতে যেকোন সময় যে রাজ্যে বিদ্বেষের দাবানল ছড়িয়ে পড়তে পারে এই ব্যাপারে সতর্ক করে সর্বাবস্থায় রাজ্যে শান্তির বাতাবরণ বজায় রাখতে যথাযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান গত ৩০ অক্টোবর ২০১৮ তারিখে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর নিকট জানায় সম্মেলন। আমাদের আশঙ্কা যে অমূলক নয় তা প্রমাণিত হয় ১ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে তিনসুকিয়ার ধলায় পাঁচজন নিরীহ বাঙালির হত্যাকাণ্ডে। পরবর্তীতে এই ব্যাপারে সম্মেলনের পক্ষ থেকে ৫ নভেম্বর উপত্যকার তিন জেলা সদরে প্রতিবাদী নাগরিক অবস্থান কার্যসূচি আয়োজিত হয় এবং তিন জেলার উপাযুক্তের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক ও মুখ্যমন্ত্রীর নিকট ক্ষোভ-সম্বলিত স্মারকপত্র প্রেরণ করা হয়।
আলফা শান্তিচুক্তি, রাজ্য জমি আইন সংশোধন ও
আসাম চুক্তি রূপায়ণের উদ্যোগ ও আমাদের অবস্থান
- রাজ্য জমি আইন সংশোধনের জন্য রাজ্য সরকার কর্তৃক শ্রী হরিশঙ্কর ব্রহ্মের নেতৃত্বে গঠিত সমিতির বরাক সফরকালে (১৫, ১৬ জুলাই ২০১৭) সংগঠনের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় সমিতির উদ্যোগে করিমগঞ্জ ও কাছাড় জেলা সমিতি করিমগঞ্জে ও শিলচরের উপাযুক্ত কর্তৃক আহুত সভায় 'খিলঞ্জিয়া' সম্পর্কিত সম্মেলনের অবস্থান উপস্থাপন করে জমি আইন সংশোধনের নামে অনসমিয়া বিশেষ করে বাঙালিদের অধিকার খর্ব না করার দাবি জানায়। সম্মেলন স্পষ্টভাষায় সমিতিকে জানায় যে 'খিলজিয়ার' সংজ্ঞা নির্ধারণ করে সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু করার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তাতে বাঙালি তথা অন্যান্য সংখ্যালঘু ভাষিকগোষ্ঠীকে ব্রাত্য রেখে তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। অবিভক্ত আসাম তথা ভারতের যেসব অধিবাসী স্বাধীনতা-উত্তর খণ্ডিত ভারতবর্ষে এসেছেন তারাও নিশ্চিতভাবে এ রাজ্যের ভূমিপুত্র। কিন্তু এই বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে। রাজ্যে ‘খিলঞ্জিয়া’ কারা এই সম্পর্কে সুস্পষ্ট অভিমত গঠন না হওয়া পর্যন্ত যাতে রাজ্যে জমি আইন সংশোধনে সরকার কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করে, এই সমিতির নিকট সম্মেলনের সদস্যরা দ্বার্থহীন ভাষায় মত প্রকাশ করেছেন।
- দীর্ঘদিন থেকে আলফার সঙ্গে শান্তিচুক্তি প্রক্রিয়ায় বরাক উপত্যকায় মতামত গ্রহণের দাবি, সম্মেলন রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট জানিয়ে আসছে। এই ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকার নিয়োজিত মধ্যস্থতাকারী আধিকারিক শ্রী এ. বি. মাথুরের নিকট বারংবার বর্তমান কার্যনির্বাহক সমিতি স্মারকপত্র পাঠিয়েছে এবং শ্রী মাথুরের শিলচর অবস্থানকালে (৩ জুলাই ২০১৮) সম্মেলনের পক্ষ থেকে কাছাড় জেলা সমিতির সভাপতি শ্রী তৈমুর রাজা চৌধুরী তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সম্মেলনের অবস্থান উপস্থাপন করেছেন। সম্মেলনের প্রতিনিধিদলের দিল্লি সফরকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের আধিকারিকদের সঙ্গেও এই ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।
- সম্প্রতি আসাম চুক্তির ৬নং ধারা কার্যকরী করার লক্ষ্যে রাজ্য সরকার কর্তৃক গঠিত সমিতিতে একজনও বাঙালি বিশেষ করে, বরাক উপত্যকার সদস্য না থাকায় সম্মেলন এই ব্যাপারে ক্ষোভ সরকারকে জানিয়েছে। আসাম চুক্তির একটি অংশ যা নাগরিকত্ব আইনে সন্নিবিষ্ট হয়েছে সেটা ব্যতিরেকে আসাম চুক্তির বাকি অংশের যে আইনি বৈধতা নেই এবং সেগুলো একতরফা কার্যকরী করতে গেলে যে রাজ্যে অশান্তির বাতাবরণ সৃষ্টি হবে তা সম্মেলন স্পষ্টভাবে সরকারকে জানিয়েছে।
বাংলা ডিপ্লোমা কোর্স : এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, নতুন পথে পা
এই কার্যকালে কার্যনির্বাহক সমিতির গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হচ্ছে এক বছরের বাংলা ডিপ্লোমা কোর্স 'ডিসিবিএল' চালু করা। বরাক উপত্যকা বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের পথচলায় এটি এক নতুন অধ্যায়।
- এই কার্যকালের শুরুতে মাধ্যমিকে মাতৃভাষা বাংলা না-থাকা উপত্যকার টেট চাকুরিপ্রার্থীদের আবেদনে সাড়া দিয়ে সম্মেলন এক বছরের বাংলা ডিপ্লোমা কোর্স চালু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং অনুমোদনের জন্য রাজ্য সরকারের নিকট আবেদন জানায়। আমাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে এই এক-বছরের বাংলা ডিপ্লোমা কোর্সটিকে টেট উত্তীর্ণ চাকুরিপ্রার্থীদের ন্যূনতম যোগ্যতা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় রাজ্য সরকার (মাননীয় রাজ্যপালের নির্দেশনামা নং এএসই ৩১৩/২০১৩/২০৭ (এ) তারিখ ০১/০৬/২০১৭)। এই কোর্সটি অনুমোদন দেওয়ার জন্য রাজ্য সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। সেইসঙ্গে এই ব্যাপারে সরকারের নিকট তদবির করার জন্য বিধায়ক শ্রী কমলাক্ষ দে পুরকায়স্থ ও প্রাক্তন বিধায়ক শ্রী মিশনরঞ্জন দাসকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। বাংলা ডিপ্লোমা কোর্সটি পরিচালনা করার জন্য বঙ্গ ভবনের কক্ষ তথা অন্যান্য আনুষঙ্গিক সুবিধা ব্যবহারের অনুমতি প্রদানের জন্য কাছাড় জেলা সমিতিকেও ধন্যবাদ জানাই।
- বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনার পর কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহক সমিতি এই কোর্স সম্পর্কিত পাঠক্রম, প্রশাসনিক ও শৈক্ষিক পরিকাঠামো তথা আর্থিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও রূপায়ণের জন্য একটি দূরশিক্ষা কেন্দ্র (Distance Education Centre) গঠন করে এবং এই কেন্দ্রের মাধ্যমে এক-বছরকালীন কোর্স ডি সি বি এল (Diploma Course in Bengali Language) পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
- বিগত ২২ অক্টোবর, ২০১৭ তারিখে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মাধ্যমে এই এক-বছরকালীন কোর্সের সূচনা হয়। এই পাঠক্রমে আশাতীত সাড়া পাওয়া গেছে, প্রথম বছর এই পাঠক্রমে সর্বমোট ১০৫ জন প্রার্থী ভর্তি হয়েছে। দূরশিক্ষা কেন্দ্রের উদ্যোগে এই পাঠক্রমের প্রথম ও দ্বিতীয় ষাণ্মাসিকের দু'টি করে মোট চারটি পাঠ্যপুস্তক ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। প্রথমবর্ষের একবছরের পাঠক্রম শেষ হওয়ার পর ফল প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যে। দ্বিতীয় বর্ষেও এবছর প্রচুর ছাত্র ভর্তি হয়েছে। সঠিক দিকনির্দেশিকায় ও সকলের সহযোগিতায় এই কেন্দ্রটিকে ভবিষ্যতে একটি মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করছি।
আমাদের ওজস্বী ভাষা-সংস্কৃতির পরিচর্যা
- উপত্যকায় গ্রন্থসংস্কৃতির পুনরুজ্জীবনে বিগত একদশক ধরে সম্মেলনের পরিকল্পিত উদ্যোগ সম্মেলনের সাফল্যের আরেক পরিচায়ক। এই কার্যকালে গত দু'বছর আমরা সার্থকভাবে উপত্যকার তিন জেলাসদরে পর্যায়ক্রমে গ্রন্থমেলার আয়োজন করেছি। ২০১৭ সনে কলকাতার পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ডের সহযোগিতায় তিন জেলায় পর্যায়ক্রমে শিলচর (৩-১২ নভেম্বর, ২০১৭), হাইলাকান্দি (১৪-২১ নভেম্বর, ২০১৭) ও করিমগঞ্জে (২৩-৩০ নভেম্বর, ২০১৭) সুষ্ঠুভাবে বইমেলা আয়োজন করেছে সম্মেলন। ২০১৮ সনের গ্রন্থমেলা আয়োজনে সম্মেলনকে কিছুটা প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় যখন কলকাতার পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ড শেষলগ্নে এ-বছর সহযোগিতায় অপারগতার কথা জানায়। তবুও প্রতিকূলতা দূর করতে সম্মেলনের কাছাড় জেলা সমিতি এগিয়ে এসে প্রকাশন সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনার জন্য দু'জন প্রতিনিধি কলকাতায় পাঠায় যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রকাশকরা বইমেলায় ম্যাগদানে রাজি হয় এবং শিলচর (৯-১৮ নভেম্বর), হাইলাকান্দি (২০-২৬ নভেম্বর) এবং করিমগঞ্জে (২৮ নভেম্বর -৫ ডিসেম্বর) পর্যায়ক্রমে আমরা এবারও বইমেলা সুষ্ঠুভাবে আয়োজন করি। উপত্যকার সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা অবারিত রাখতে এই বইমেলা এক উপযুক্ত হাতিয়ার হিসেবে প্রমাণিত হচ্ছে। বইমেলা সার্থকভাবে আয়োজনে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানাই।
- আসাম প্রকাশন পরিষদের আমন্ত্রণে ৩১তম গৌহাটি বুক ফেয়ারে সম্মেলনের প্রতিনিধিদল প্রথমবারের মতো অংশ গ্রহণ করে। ২০১৭-এর ২৮ ডিসেম্বর ৩১তম গৌহাটি বুক ফেয়ারে আয়োজিত বরাক উৎসবে 'বরাক উপত্যকার সমাজ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি' বিষয়ে আলোচনায় সম্মেলনের প্রতিনিধিরা অংশ গ্রহণ করেন। সন্ধ্যায় সংস্কৃতি মঞ্চে দীর্ঘ তিন ঘণ্টা ব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করেন আমাদের শিল্পীবৃন্দ। সাতজন আলোচক ও চব্বিশ জন শিল্পী নিয়ে এই অনুষ্ঠানে যোগদান করে সম্মেলন। আলোচনা অনুষ্ঠানে আসাম প্রকাশন পরিষদের নিকট বরাক উপত্যকার সাহিত্যিকদের প্রণীত বই তথা বরাক উপত্যকার সমাজ ও ইতিহাস বিষয়ক বই প্রকাশের অনুরোধ জানায় সম্মেলন। আসাম প্রকাশন পরিষদের পক্ষ থেকে এই ব্যাপারে সদর্থক ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
- কেন্দ্রীয় সমিতির আর্থিক সহযোগিতায় ও কেন্দ্রীয় সাহিত্য উপসমিতির উদ্যোগে এই কার্যকালে করিমগঞ্জ (২৫-২৬ আগস্ট, ২০১৮) হাইলাকান্দি (২৫-২৬ আগস্ট, ২০১৮) এবং কাছাড় (২৫ ডিসেম্বর, ২০১৮) জেলা সমিতি সার্থকভাবে বাংলা বানান কর্মশালা আয়োজন করে।
- কেন্দ্রীয় সমিতির আর্থিক সহযোগিতায় ও কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি উপসমিতির উদ্যোগে এবছর জেলা সমিতির ব্যবস্থাপনা কাছাড় জেলা সমিতির উদ্যোগে আবৃত্তি কর্মশালা (২৭-৩০ আগস্ট, ২০১৮) করিমগঞ্জ জেলা সমিতির উদ্যোগে ধামাইল কর্মশালা (৭-৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮) এবং হাইলাকান্দি জেলা সমিতি উদ্যোগে নাটকের কর্মশালার (১৮-২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮) আয়োজন করে।
- বহু বছর থেকে অপ্রকাশিত সম্মেলনের মুখপত্র গতবছর সম্মেলনের উধারবন্দ বার্ষিক সাধারণ সভায় বিগত এক বছরের কাজকর্মের খতিয়ানসহ প্রকাশিত হয়েছে।
-
২০১৮-র ৩০ ডিসেম্বর লামডিং-এর ‘বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি মঞ্চের’ আহ্বানে সংস্থার বার্ষিক অধিবেশনে সম্মেলনের প্রতিনিধিদল যোগদান করেন। সেখানে উপস্থিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন বাঙালি-সংগঠনগুলো বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের সম্মেলনের ধারাবাহিক পদক্ষেপগুলোকে সাধুবাদ জানায় এবং আমাদেরকে অগ্রজপ্রতিম সংস্থা হিসেবে এই দায়িত্ব পালনে সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। এই বন্ধুত্ব আগামীতে সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে সহায়ক হবে বলে আশা ব্যক্ত করছি।
সপ্তবিংশ কেন্দ্রীয় অধিবেশনে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো কার্যকরী করতে
কার্যনির্বাহক সমিতি বিগত দিনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
- ব্রডগেজ রেলপথ চালু হলেও উপত্যকার অভ্যন্তরীণ চাহিদা আজও পূরণ হয়নি। পাহাড় লাইন বর্ষায় প্রায়ই মুখ থুবড়ে পড়ছে। পাহাড় লাইনে প্রস্তাবিত দ্বিতীয় লাইন যাতে সব ঋতুতে সচল থাকে তারজন্য সেরকম উপযোগী এলাকা দিয়ে রেলপথ বিছানোর আর্জি রেলমন্ত্রকের কাছে জানিয়েছে কার্যনির্বাহক সমিতি। সেইসঙ্গে, অতীতে প্রস্তাবিত লঙ্কা-চন্দ্রনাথপুর বিকল্প রেলপথ বাস্তবায়নেরও আর্জি জানানো হয়েছে রেলমন্ত্রকের নিকট।
- উপত্যকার অভ্যন্তরীণ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাও সন্তোষজনক নয়। মহাসড়কের প্রকল্পটি এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। বরাক-কুশিয়ারা জাতীয় জলপথ ঘোষিত হলেও তা কার্যকরী হয়নি। এই অবস্থায় উপত্যকায় যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণে সময়বদ্ধ কর্মপ্রণালী হাতে নেবার জন্য রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়েছে।
- স্থানীয় বেকারদের ন্যায্য অধিকার খর্ব করে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ করা হচ্ছে এই উপত্যকায়। এই ব্যবস্থা রদ করে বরাক উপত্যকায় স্থানীয় প্রার্থীদের নিয়োগ করার দাবি কার্যনির্বাহক সমিতির পক্ষ থেকে রাজ্য সরকারের নিকট জানানো হয়েছে।
অনেক কাজ চলছে, অনেক কাজ অসমাপ্ত রয়ে গেছে
- ‘বরাক উপত্যকার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’ ও ‘বরাক উপত্যকা বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের ইতিহাস’ শীর্ষক দুটি গ্রন্থ প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে কার্যনির্বাহক সমিতি এবং এই ব্যাপারে প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে।
- সংস্কৃতি উপসমিতির উদ্যোগে সম্মেলনের স্থায়ী ব্যাজ, উত্তরীয় ও সম্মেলন-সঙ্গীত নির্ধারণের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে।
- বিগত কয়েক বছর ধরে হাইলাকান্দিতে নির্ধারিত বিপিনচন্দ্র পাল স্মারক বক্তৃতা বিভিন্ন কারণে আয়োজন করা সম্ভবপর হয়ে উঠেনি। আগামীতে এই বক্তৃতানুষ্ঠান নিয়মিতভাবে আয়োজিত হবে এই আশা ব্যক্ত করছি। সেই সঙ্গে মুজতবা আলি সাহিত্য সম্মেলন আয়োজনও সম্ভবপর হয়নি এই কার্যকালে।
- ‘বিদ্যাসাগর স্মৃতিরক্ষা সমিতির’ উদ্যোগে দেশব্যাপী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মের দ্বিশতবার্ষিকী উদ্যাপনের সহযোগী সংগঠন হওয়ার প্রস্তাবে কার্যনির্বাহক সমিতি সহমত পোষণ করেছে। এই ব্যাপারে সমিতি আগামীতে বিস্তারিত পরিকল্পনা গ্রহণ করবে বলে আশা প্রকাশ করছি।
-
কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহক সমিতির বিগত এক বছরে সাতটি, নির্বাহী পর্ষদের নয়টি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেইসঙ্গে বিভিন্ন উপসমিতির প্রয়োজনীয় সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছে।
- আর্থিক সংকটের মুখে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহক সমিতি বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে রাজ্য সরকারের বার্ষিক অনুদান থেকে বঞ্চিত সম্মেলন। কেবল সদস্যভুক্তির চাঁদাই মূল আয় যা দিয়ে সংকুলান প্রায় অসম্ভব। আর তাই বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পিছপা হতে হয়েছে সম্মেলনকে। এই ব্যাপারে বারংবার রাজ্য সরকারের নিকট আবেদন জানানো হয়েছে, বারংবার উচ্চ শিক্ষার সঞ্চালকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা হয়েছে। দীর্ঘদিন পর গতবছর সম্মেলন রাজ্য সরকারের বার্ষিক অনুদান হিসেবে তিন লক্ষ টাকা অনুদান পেয়েছে। এতে আর্থিক সংকট কিছুটা নিরসন হয়েছে। যদিও রাজ্য সরকার কর্তৃক রাজ্যের অন্যান্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংস্থাকে দেওয়া বার্ষিক অনুদানের তুলনায় এই পরিমাণ যৎসামান্য। এবছরের অনুদান এখনও মঞ্জুর হয়নি, আমরা আশাবাদী এ-বছর এই রাশি বৃদ্ধি পাবে।
- দূর-শিক্ষা কেন্দ্রের বাংলা ডিপ্লোমা কোর্স পরিচালনার জন্য শিলচরের তারাপুরে সম্মেলনের কেন্দ্রীয় সমিতির জমিতে কেন্দ্রীয় সমিতির নিজস্ব কার্যালয় নির্মাণের প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনা করে সম্মেলনের পক্ষ থেকে রাজ্য সরকারের নিকট অর্থ মঞ্জুরির দাবি জানানো হয়েছে। এই ব্যাপারে মাননীয় মন্ত্রী শ্রী পরিমল শুক্লবৈদ্য ও মাননীয় সাংসদ শ্রীমতী সুস্মিতা দেবের নিকটও আবেদন উপস্থাপন করা হয়েছে।
পরিশেষে-
সম্মেলনের সপ্তবিংশ দ্বিবার্ষিক সাধারণ সভায় আপনারা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমাকে যে দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন আপনাদের সকলের সক্রিয় সহযোগিতায় তা সাধ্য অনুসারে পালনের চেষ্টা করেছি। সহযোগিতার জন্য সম্মেলনের প্রতিটি স্তরের কর্মকর্তা ও সদস্যদের জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। এই সময়কালের সকল ভুল-ত্রুটি নতমস্তকে স্বীকার করছি। বর্তমান কঠিন পরিস্থিতিতে আমাদের অতীত সংগ্রামের গৌরবময় ইতিহাসের কথা স্মরণ করে সম্মেলনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের বিস্তীর্ণ দিগন্তে আমাদের পথচলা হোক সাহসী ও সংঘবদ্ধ, এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করি এবং বরাক উপত্যকা বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের সর্বাঙ্গীণ সাফল্য কামনা করি।